2 of 2

৫৬. কেশব ব্ৰাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পর

দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রর একদা সহপাঠী কেশব ব্ৰাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পর থেকেই ব্ৰাহ্মদের মধ্যে যেন আবার নতুন রক্ত সঞ্চারিত হলো।

কিছুদিন ধরে ব্ৰাহ্মদের মধ্যে নিজীবি ভাব এসে গিয়েছিল, ভিতরে ভিতরে নানা রকম মনোমালিন্য ও মতভেদ। কেউ কেউ বুদ্ধি ও জ্ঞানচর্চায় যতটা আগ্রহী ততটা ঈশ্বর বা ধর্মচৰ্চায় নয়। তত্ত্ববোধিনী সভার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর, কিন্তু তাঁর মুখে ঈশ্বরের কথা কখনো শোনা যায় না। অক্ষয়কুমার দত্তও যেন দিন দিন সংশয়বাদী হয়ে পড়ছেন। দেবেন্দ্রনাথ মনে মনে এদের প্রতি বিরক্ত। রাগ করে তিনি পাহাড়ে চলে গিয়েছিলেন, ফিরে এসেও ব্রাহ্মদলের ঠিক মতন হাল ধরতে পারছিলেন না।

দেবেন্দ্রনাথ এখন প্রৌঢ়। এক কালের তরুণ বিপ্লবী এখন রক্ষণশীল। কিছু ব্ৰাহ্ম সভ্যদের চাপে পড়ে তিনি স্বীকার করেছেন যে বেদ কোনো অভ্রান্ত, পবিত্র গ্ৰন্থ নয়। কিন্তু ব্ৰহ্মসভার বেদীতে কোনো ব্ৰাহ্মণের বদলে অব্ৰাহ্মণ বসে শাস্ত্ৰ পাঠ করে শোনাবে, এতটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। পৈতা-বিসর্জন, জাতিভেদ প্রথার অবসান কিংবা বিধবা বিবাহ-এর কোনোটারই ঠিক বিরোধী না হলেও দ্রুত কোনো পরিবর্তনের তিনি পক্ষপাতী নন। তিনি ব্ৰাহ্ম হলেও তাঁর বাড়িতে দুৰ্গাপূজা হয়, তিনি বাধা দেন না, আবার পূজার সময় নিজে উপস্থিতও থাকেন না।

কেশবচন্দ্রের মধ্যে তিনি দেখলেন নব যৌবনের এক মূর্ত প্ৰতীককে। এ ছেলেটি যেমন তেজস্বী তেমনই এর মধ্যে ধর্মের প্রতি উন্মাদনা রয়েছে। প্রবল পাপ বোধ আছে বলে সে পুণ্যের অভিলাষী। বেহালা বাজানোয় বেশী আসক্তি হয়ে যাচ্ছিল বলে নিজের হাতেই সেই বেহালা ভেঙে ফেলেছে। কেশব।

বিখ্যাত রামকমল সেনের পৌত্র কেশবকে দেবেন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকেই দেখছেন। প্রায়ই সে এ বাড়িতে তাঁর ছেলেদের কাছে আসে। বৈষ্ণব বংশের সন্তানকে এক সময় কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নিতে হয়, কিন্তু কেশব সেই দীক্ষা নেয়নি, পরিবারের সকলের মতের বিরুদ্ধে গিয়েই সে ব্ৰাহ্ম হয়েছে। এতেই বোঝা যায় তার সাহস।

কৈশোর ছাড়বার পর থেকেই কেশব আদর্শ ও নীতিচচাঁ নিয়ে মেতে আছে। তার একটা বড় গুণ, সে কোনো কাজই একা করে না, অনেককে একসঙ্গে নেয়। নেতৃত্বের সহজাত গুণ আছে তার মধ্যে, যুবকের দল বিনা দ্বিধায় তাকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়। ইয়ং বেঙ্গল, দিস ইজ ফর ইউ! নামে সে একটা ইংরেজী পুস্তিকা লিখেছে, তাতে যেন আগুন ঝরছে একেবারে।

ছেলেদের নিয়ে দেবেন্দ্ৰনাথ একবার বোটে করে বেড়াতে গেলেন রাজমহলে, সঙ্গে আছেন রাজনারায়ণ বসু, আর এসেছে পুত্রবন্ধু কেশব। বোটের এক কোণে বসে উপনিষদ পড়েন দেবেন্দ্রনাথ, অন্য কোণে বসে কেশব পড়ে বাইবেল। আবার হঠাৎ হঠাৎ কেশব আর সত্যেন্দ্ৰ এক সঙ্গে গান করে। বৈষ্ণব বাড়ির ছেলে কেশব, বাল্যকাল থেকেই গানের চাচা আছে তার। কেশবের অনুপ্রেরণায় সত্যেন্দ্ৰও গান লিখতে ও গাইতে শুরু করেছে। দুজনের গান শুনে প্ৰাণ জুড়িয়ে যায় দেবেন্দ্রনাথের। শুধু শুষ্ক তত্ত্ব নয়, ভক্তিরসের সঞ্চার করে এই দুই যুবক।

ব্ৰাহ্মধর্ম প্রচারের ব্যাপারে কেশবের খুব উৎসাহ। প্রায়ই সে বলে, মাত্র এক হাজার দুহাজার লোক ব্ৰাহ্ম হলে কী হবে? এই নব ধর্ম ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে, এমন কি সারা পৃথিবীতে! যেমন তেমন করে হোক আমরা সকলকেই এই ধর্মে দীক্ষা দেবো! আমাদের ধর্মেতে পাগল হতে হবে। উন্মত্ত না হলে কোনো কাজ হবে না।

ব্ৰাহ্মধর্মের মূল কথাটাও বড় সরল করে বলে কেশব। সে বলে, আমাদের এই ব্ৰাহ্মধর্মের ঈশ্বর তর্কলব্ধ বর্ণিত ঈশ্বর নন। এই ঈশ্বর জীবন্ত ঈশ্বর। বিশ্ব এই ধর্মের মন্দির, প্রকৃতি এর পুরোহিত। সকল অবস্থায় মানুষ ঈশ্বরের নিকটবর্তী হয়ে পূজা করবার অধিকারী।

তরুণ কেশবের মুখে এসব কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান দেবেন্দ্রনাথ। যত শোনেন আরও শুনতে ইচ্ছে হয়। বিষয়-সম্পত্তি কিংবা পারিবারিক সুখ সম্ভোগের জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই এর, কেশব চায় তার সর্ব সময় ব্ৰাহ্মধর্মের জন্য দেবে, সে সারা দেশে প্রচারে বেরিয়ে পড়বে।

যেন এই রকম একজনের জন্যই এতদিন অপেক্ষা করছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। শুধু একটা বিষয়ে তাঁর খাটুকা লাগে। কেশব যেমন তেমন বলে কেন? সে যেমন তেমন ভাবে সকলকে ব্ৰাহ্মধর্মে দীক্ষা দিতে চায়, তা হলে কি সে কোনো কৌশল বা চাতুর্যের আশ্রয় নেবে? কেশব জাতিতে বৈদ্য, লোকে বলে বৈদ্যরা ফিচেল হয়, কিন্তু পবিত্র ধর্মের প্রচারের মধ্যে তো ফিচলেমি থাকলে চলে না। রাজনারায়ণ বসুকে দেবেন্দ্রনাথ চুপি চুপি জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, তুমি কি জানো, বৈদ্যজাতি ফিচেল বলে অপবাদ আছে কিনা?

রাজনারায়ণ হাসতে হাসতে উত্তর দেন, হ্যাঁ, তা আছে!

দেবেন্দ্ৰনাথের এ সংশয়ও এক সময় কেটে যায়। তাঁর মনে হয় কেশব ছেলেটি একেবারে খাঁটি সোনা। সে ভাবাবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, পৃথিবীর সকল জাতি সমস্বরে এই গান করুক, ঈশ্বর আমাদের পিতা, সকল মানুষ ভাই-ভাই! তা শুনে দেবেন্দ্রনাথের মনে হয়, ব্ৰাহ্মধর্ম প্রচারের জন্য এই তো আদর্শ বাণী।

পরের বছর দেবেন্দ্ৰনাথ সদলবলে গেলেন সিংহলে। জাহাজে চড়ে কালাপানি পার। এবারও সঙ্গী হলেন কেশব এবং কালীকমল গাঙ্গুলী নামে দুই যুবক। বাড়ির লোকের ঘোর অমতে কেশব চুপি চুপি জাহাজে উঠে এক কুঠুরির মধ্যে লুকিয়ে রইলো। জানলা দিয়ে বাইরে কোনো বাঙ্গালীকে দেখা মাত্র চমকে চমকে ওঠে, এই বুঝি তার কোনো আত্মীয় তাকে ধরে নিতে এসেছে। সিংহল যাতায়াতের দীর্ঘ সময়ে দেবেন্দ্ৰনাথ তাকে আরও ভালো করে চিনলেন।

কেশব যে কতখানি উৎসাহী প্রচারক তার প্রমাণ পাওয়া গেল সিংহল থেকে ফেরার পরের বৎসর। শারীরিক অসুস্থতার জন্য কেশব বায়ু পরিবর্তনের জন্য কিছু দিনের জন্য গোল কৃষ্ণনগর। কলকাতার চেয়েও কৃষ্ণনগর প্রাচীন এবং বহু শিক্ষিত লোকের বাস সেখানে। পাদ্রীরা সেখানে খ্ৰীষ্টধর্ম প্রচার করার জন্য বড় ঘাঁটি বানিয়েছে। কেশব সেখানে সভা ডেকে ব্ৰাহ্মধর্ম প্রচার করতে গিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে দিল পাদ্রীদের সঙ্গে। পাস্ত্রী ডাইসন কেশবকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করলে কেশব সিংহগর্জনে মুখের মতন জবাব দিলো তাঁর। বহু লোক ভিড় করে এলো কেশবকে দেখতে ও তার মুখের কথা শুনতে। একটার পর একটা সভা, স্থানীয় ছাত্র, শিক্ষকের দল, এমন কি রক্ষণশীল হিন্দুরাও এলো কেশবকে সমর্থন জানাতে। এতদিন পর একজন এসে পাদ্রীদের রোধ করবার জন্য নিখুঁত যুক্তিজাল দিয়ে পাদ্রীদের চুপ করিয়ে দিয়েছে। কেশব খ্ৰীষ্টধর্মের নিন্দা করে না, সে বাইবেল থেকেই অজস্র উক্তির উদ্ধৃতি দেয়, দেশের অবস্থা এবং সমাজের অবস্থাও আলোচনা করে সে বুঝিয়ে দেয় যে ধর্ম সমাজ-ছাড়া নয়, আবার সমাজও ধর্ম-ছাড়া নয়।

কেশবের এই বিজয়-অভিযানের বিবরণ শুনে চমৎকৃত হন দেবেন্দ্রনাথ।

 

ক্রমে অবস্থা এমন হলো যে কেশবকে না দেখে তিনি থাকতেই পারেন না। পুত্রসম এই যুবকটি হয়ে উঠলো। তাঁর পুত্রদের চেয়েও প্রিয়তরা। কেশব বাড়িতে এলে তিনি শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ান। কেশব অন্য আর পাঁচজনের সঙ্গে বসতে গেলে তিনি তাকে জোর করে টেনে এনে বসিয়ে দেন নিজের কৌচের এক পাশে। তাঁর জন্য মিছরি বা অন্যান্য কোনো খাদ্য এলে তিনি এক চামচ কেশবের মুখে তুলে দিয়ে তারপর নিজে এক চামচ খেয়ে বলেন, একবার তুমি খাও, একবার আমি খাই!–তোমাকে দেখলেই আমার আত্মার আরাম হয়, তুমি যে ব্ৰহ্মানন্দ!

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেশবের সঙ্গে আলাপচারি করে কাটান দেবেন্দ্রনাথ। কেশব বেঙ্গল ব্যাঙ্কে কেরানিগিরি করে, আপিস ছুটি হলেই সে চলে আসে। সঙ্গে আসে তার বন্ধু ও সমর্থকরা। হলঘরে লম্বা মাদুর পেতে তার ওপরে বসে সকলে। ছেড়া ও ময়লা পোশাক পরা যুবক কেরানির দল ধর্ম আলোচনায় গলা ফাটায়, কখনো গেয়ে ওঠে। গান। ঘন ঘন চা আসে। অধিক রাত্রি হয়ে গেলে কেউ কেউ ওঠবার জন্য ঘড়ি দেখলে দেবেন্দ্ৰনাথ তার হাত চেপে ধরে বলেন, রাখো তোমার ঘড়ি, ঘড়ি কি ঠিক সময় রাখে?

কেশবের প্রভাবে দেবেন্দ্রনাথের মধ্যেও কিছু কিছু পরিবর্তন হলো। কেশব তার যুবক বন্ধুদের সঙ্গে এই সংকল্প নিয়েছে যে তাদের মধ্যে যারা ব্ৰাহ্মণ তারা আর কেউ উপবীত ধারণ করবে না। এই কথা শুনে দেবেন্দ্ৰনাথ নিজের পৈতের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে আর এটা রাখা কেন? এতদিন পর তিনিও পৈতে ত্যাগ করলেন।

দেবেন্দ্রনাথ জানতেন, পিরালী সংসর্গ থাকায় তাঁদের কেউ খাঁটি ব্ৰাহ্মণ মনে করে না। ব্ৰাহ্ম সমাজের উপাসনার সময় উপাচার্য হিসেবে খাঁটি ব্ৰাহ্মণরাই বেদীতে বসে শাস্ত্ৰ পাঠ করে। দেবেন্দ্রনাথ উপদেশ দেবার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, সেই বেদীতে কখনো বসেননি। কেশব একদিন তাঁকে বললো, আপনি আমাদের চক্ষে সকল ব্ৰাহ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, আপনি মহর্ষি, আপনি কেন বেদীতে বসবেন না? ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা এই ধর্মের সার কি বোঝে? এই অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না দেবেন্দ্রনাথ, দু-একদিন দ্বিধা করার পর বেদীতে বসলেন। ব্ৰাহ্ম সমাজের এতদিনকার এক প্রথার পরিবর্তন হলো।

এর পর একটু বেশী সাহসের কাজ করে ফেললেন দেবেন্দ্রনাথ।

 

কেশব নারীদের স্বাধীনতার পক্ষপাতী, তার বন্ধু সত্যেন্দ্ৰ অল্প বয়েসেই স্ত্রী স্বাধীনতা নামে একটি বই লিখেছে। দুই বন্ধু স্ত্রীলোকদের শিক্ষা দান এবং বাড়ির ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি দান বিষয়ে আলোচনা করে। এসব দেবেন্দ্রনাথের কানে আসে, তিনি আপত্তি করেন না। তিনি বুঝতে পারেন, যুগের পরিবর্তন হচ্ছে।

কেশব কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার দুমাস পরে দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া কন্যা সুকুমারীর বিবাহ। কেশব এবং অন্যান্য যুবকরা খুব একটা উচ্চ কণ্ঠে দাবি না তুললেও গুনগুনিয়ে বলাবলি করতে লাগলো, ব্ৰাহ্ম সমাজের প্রধান পুরুষ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ের বিয়ে কেন হিন্দু মতে হবে। সেই নারায়ণ শিলা আর অগ্নিসাক্ষী? ব্রাহ্মরা এই সব পৌত্তলিকতা মানে না, অথচ সামাজিক অনুষ্ঠানে এগুলো মেনে চলতে হবে?

দেবেন্দ্রনাথ রাজি হয়ে গেলেন যুবকদের কথায়। তিনি ঘোষণা করলেন, ব্ৰাহ্মমতেই কন্যার বিবাহ দেবেন। একেবারে সব কিছু অস্বীকার না করে একটা মাঝামাঝি ব্যবস্থা নিলেন তিনি। হিন্দু রীতি প্ৰায় সব কিছুই রইলো, শাঁখ বাজিলো, উলুধ্বনি হলো, বিয়ের আসরে সাজানো রইলো দান সজ্জা। অর্ঘ্য, অঙ্গুরীয়, মধুপর্ক ও বস্ত্ৰাদি নিয়ে বরকে বরণ করলেন দেবেন্দ্রনাথ, স্ত্রী-আচারও হলো, শুভদৃষ্টি, মালা বদল, গ্ৰন্থি বন্ধন এসব কিছুই বাদ গেল না। শুধু রইলো না কোনো পুরোহিত আর নারায়ণ শিলা, আগুনের সামনে যজ্ঞও হলো না। তার বদলে বর ও বধূকে নিয়ে হলো ব্ৰহ্ম-উপাসনা আর পুরোহিতের বদলে প্ৰবীণ ব্ৰাহ্মরা দিলেন উপদেশ।

উগ্ৰ ব্ৰাহ্মরা এতখানি হিন্দুয়ানী মেনে চলায় পুরোপুরি খুশী না হলেও এটাই হলো প্ৰথম ব্ৰাহ্মমতে বিবাহ। হিন্দু সমাজের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি। এ কাহিনী ছড়িয়ে পড়লো নানা দিকে। ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স সম্পাদিত বিলাতি সংবাদপত্র অল দা ইয়ার রাউণ্ড-এ এই বিবাহের বর্ণনা ছাপা হলো ফলাও ভাবে।

আর এরই ফলে বিরাট কোলাহল পড়ে গেল হিন্দু সমাজে। নতুন ভাবে দ্বন্দ্ব শুরু হলো। ব্ৰাহ্ম ধর্ম প্রচলনের পর প্রথমে প্রবল আলোড়ন হলেও আস্তে আস্তে তা স্তিমিত হয়ে এসেছিল। দেশের মানুষ ধরে নিয়েছিল যে এটা কিছু আলাভোলা বড় মানুষ আর কিছু কলেজীয় ছোঁকরাদের ব্যাপার। হিন্দু ধর্মের অসংখ্য শাখা আছে, ব্ৰাহ্মরাও না হয় আর একটা শাখা হয়ে ঝুলে থাকবে।

কিন্তু ব্ৰাহ্মরা বেদকে অস্বীকার করায় হিন্দুরা আবার নড়ে চড়ে ওঠে। খ্ৰীষ্টানদের আছে বাইবেল, মুসলমানদের কোরাণ, আর হিন্দুদের বেদ থাকবে না? এই সব দৈব গ্রন্থের কেউ ভুল ধরতে পারে? আর ব্ৰাহ্মরা বলে কিনা বেদ অভ্রান্ত নয়। এমন কি কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে, বেদ একখানি কাব্যগ্রন্থ মাত্র। এমন কথা যারা বলে, তারা হিন্দু ধর্মের শত্ৰু।

এর পর ঠাকুরবাড়িতে শালগ্রাম শিলা বাদ দিয়ে বিবাহের কথা প্রচারিত হওয়ায় ক্রোধের ফুলকি ছড়াতে লাগলো। ঈশ্বর ও অগ্নিসাক্ষী না রেখে বিবাহ হয়? সে তো ব্যভিচার। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত হতে লাগলো সারা দেশের ঘৃণা। শুধু উপহাস ও বিদ্যুপ নয়। ব্ৰাহ্মদের ওপর যখন তখন আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিল। ব্ৰাহ্মরাও যুদ্ধের জন্য কোমর বাঁধলে নবোদ্যমে।

এই সময় ব্ৰাহ্মদের একজন সেনাপতি দরকার। আর কে হবে সেই সেনাপতি, কেশব ছাড়া?

শহরে দেবেন্দ্রনাথের মন টেকে না। সুকুমারীর বিবাহের সময় আত্মীয় পরিজনদের কাছ থেকেও অনেক লাঞ্ছনা ও কটুক্তি সইতে হয়েছে তাঁকে। দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছা শহর থেকে বেশ দূরে কোনো নিরালা জায়গায় একটা আশ্রম তৈরি করবেন। সেই উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে, স্থান নির্বাচনের জন্য ঘুরতে ঘুরতে বর্ধমানের গুসকরায় এক আম্রকুঞ্জে তাঁবু খাঁটিয়ে রয়েছেন তিনি, হঠাৎ যেন এক রাত্রে প্ৰত্যাদেশ পেলেন। যেন স্বয়ং ঈশ্বর তাঁকে ডেকে বলছেন, কেশবচন্দ্ৰকে সমাজের আচাৰ্য করো, তাতেই সমাজের কল্যাণ হবে।

কলকাতায় ফিরে গিয়েই তিনি ঘোষণা করলেন যে কেশবচন্দ্রকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আচার্যের পদে বরণ করবেন। তাঁর বয়েস হয়েছে। সব কাজের ভার তিনি একার হাতে আর রাখতে পারেন না, তা ছাড়া এখন তিনি বেশীর ভাগ সময়েই বাইরে বাইরে থাকবেন। তিনি নামে মাত্র প্রধান আচাৰ্য থাকলেও সব কাজের দায়িত্ব এখন থেকে নেবে কেশবচন্দ্ৰই।

কেশবচন্দ্রের বয়েস সবে মাত্র তেইশ বৎসর পার হয়েছে, তাকে বসিয়ে দেওয়া হবে সমস্ত প্ৰবীণ ব্ৰাহ্মদের মাথার ওপরে! এবং অব্ৰাহ্মণ হয়েও সে আচার্য হবে! এ কি সকলে মেনে নিতে পারে? কয়েকজন বয়স্ক শুভানুধ্যায়ী দেবেন্দ্রনাথকে আড়ালে বললেন, এখনই এতটা বাড়াবাড়ি করা কি ঠিক হচ্চে আপনার? আর কিছুদিন অপেক্ষা করলে হয় না? ঐ মাথা-গরম ছোঁকরাকে আপনি এতখানি সম্মান ও দায়িত্ব দিয়ে একেবারে সমাজের আচাৰ্য করে দিচ্ছেন? ঐ বোধ হয়। আর চেষ্টা করিব-কে দিয়ে কতটা কাজ হবে।

বোধহয় আর চেষ্টা করিব নিয়ে কেশবচন্দ্রের আড়ালে অনেকেই কৌতুক করে। কেশবচন্দ্রের সত্যানুরাগ এখন এমনই স্তরে গেছে যে যাতে ভুল করেও একটা মিথ্যে বলে ফেলতে না হয়, সেই জন্য কেশবচন্দ্ৰ সব কথার মধ্যে বোধ হয় বা চেষ্টা করিব জুড়ে দেয়। ব্যাঙ্কে অঙ্কের হিসাব মেলাবার পর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলে সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন, হিসেব মিলেছে? কেশবচন্দ্ৰ উত্তর দিয়েছিল, বোধহয় মিলেছে! সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, হিসেব মিলেছে কিংবা মেলেনি, এর মধ্যে আবার বোধহয় কী? কেউ কেউ রসিকতা বানিয়েছে যে, কেশবচন্দ্ৰ ভাত খেতে বসে বলে, এবার আমি ভাত খাইবার চেষ্টা করিব। খাওয়ার পর হাত ধুয়ে এসে বলে, এবার বোধহয় আমি আচাইয়াছি!

প্রবীণদের আপত্তিতে কান দিলেন না দেবেন্দ্রনাথ। কেশবের মতো এমন সত্যনিষ্ঠ, কমিষ্ঠ আর কে আছে? সবচেয়ে বড় কথা, তার অন্তরে জ্বলছে আগুন। আগামী ১লা বৈশাখে মহা ধুমধামের সঙ্গে তাকে বরণ করা হবে আচাৰ্য পদে।

বেঙ্গল ব্যাঙ্কে কেরানির চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কেশব। প্রায় সর্বক্ষণই সে ঠাকুরবাড়িতে থাকে। উৎসবের দুদিন আগে সত্যেন্দ্র তার বন্ধুকে বললেন, ভাই, এত বড় একটা ব্যাপার হবে সেদিনতোমার স্ত্রীকে আনবে না? তিনি দেখবেন না?

কেশব বললো, এ তো অতি উত্তম কথা। অবশ্যই বোধহয় তাঁকে আনা উচিত।

এবারে কিন্তু কেশবের পরিবারের সকলে একেবারে বেঁকে বসলেন। বাড়ির বউ যাবে ঐ ঠাকুরদের মতন স্নেচ্ছ ও পতিতদের বাড়িতে? তা একেবারেই অসম্ভব। কেশব যদি তার স্ত্রীকে নিয়ে যায় তা হলে একেবারেই চলে যেতে হবে, এ বাড়িতে আর তার ফিরে আসা চলবে না। এমন কি সম্পত্তির অংশ থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হবে।

কেশবচন্দ্র তাতেও নিরস্ত হলো না। সম্পত্তির চিন্তা না হয়। পরে করা যাবে, এখন যেমন ভাবেই হোক সে তার স্ত্রীকে নিয়ে যাবে। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কেশব তার স্ত্রীকে কোথাও খুঁজে পেল না। এর মধ্যেই তাকে কোথাও লুকিয়ে ফেলা হয়েছে।

সেই রাত্রেই একটা শিবিকা সঙ্গে নিয়ে কেশব চলে এলো বালীতে। এখানে তার শ্বশুরালয়। ভৃত্যদের কাছে প্রথমে সন্ধান নিল তার পত্নী জগন্মোহিনী সেখানে আছেন কি না। আছেন জেনেও কেশবচন্দ্র বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো না, এক ভৃত্যকে দিয়ে সংবাদ পাঠালো যে সে বাইরে অপেক্ষা করছে, জগন্মোহিনী ইচ্ছে হলে এসে সাক্ষাৎ করতে পারে। .

জগন্মোহিনী তৎক্ষণাৎ নেমে আসতেই কেশবচন্দ্ৰ তাকে সমস্ত ঘটনাটি প্ৰথমে বোঝালো। তারপর বললো, শোনো, তুমি খুব ভালো করে ভেবে দ্যাখো। তুমি যদি আমার সঙ্গে আসে, তবে তোমাকে জাত, ধর্ম, টাকা-পয়সা, সোনা-গহনা সব ত্যাগ করতে হবে। তোমার পিতা-মাতা ও অন্যান্যরা যাঁদের সঙ্গে তুমি স্নেহভালোবাসার বন্ধনে বদ্ধ, তাঁদের সঙ্গে নষ্ট হবে তোমার সম্পর্ক। ক্ষুধার অন্ন কখন কী জুটবে ঠিক নেই। আমাকে ছাড়া আর সব কিছুই হারাবে তুমি। এতখানি ত্যাগের বিনিময়ে শুধু আমি কি তোমার যোগ্য?

কোনো উত্তর না দিয়ে কেশবের দিকে এগিয়ে এলো জগন্মোহিনী।

ভোরবেলা সস্ত্রীক কেশব এসে পৌঁছলো জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দেউড়ির সামনে। দেবেন্দ্রনাথ অপেক্ষা করছিলেন তার জন্য। কেশবকে আলিঙ্গন করার জন্য দু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তিনি বললেন, এসো ব্ৰহ্মানন্দ, আমার এ গৃহ, তোমার গৃহ। তুমি সুখে এখানে বাস করো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *