৫৬
এক-একটা দিন আসে সকাল থেকে রাত অবধি যেন ভাল জিনিসে ঠাসা। সেদিন যেন সুখ একেবারে উপচে পড়তে থাকে। সকালে সূর্যটা যেন অন্য রকম করে ওঠে, পাখি যেন অন্য রকম করে ডাকে, সেদিন মা সকালের জলখাবারে দুটোর বদলে তিনখানা রুটি দিয়ে ফেলে, এক চিমটির বদলে এক ডেলা গুড়, সেদিন ইস্কুলে মাস্টারমশাইরা একবারও বেত মারেন না, সেদিন গোপাল সারাক্ষণ আনন্দের নানা রকম শব্দ করে, বাবা সেদিন একটুও মাতাল হয় না, ন’পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে সেদিন হঠাৎ ভাবসাব হয়ে যায়, সন্ধের পর আধখানা চাঁদ ঠিক যেন সোনার নৌকোর মতো আকাশে ভেসে ভেসে বেড়ায়, বারান্দায় বসে দাদুর কাছে সেদিন ভারি চমৎকার একখানা রূপকথার গল্প পেয়ে যায় সে।
সেরকম দিন অবশ্য কমই আসে। অনেক সময় দিনটা অর্ধেক তার মনের মতো হল, বাকি অর্ধেকটা হল অন্য রকম। কিংবা সকালটা ভাল গেল, বিকেলটা মনমরা।
আজকের দিনটা কেমন যাবে তা বুঝতে পারছিল না পটল। লক্ষণ মোটেই ভাল নয়। সকালে মায়ের হাতে চড়চাপড় খেয়ে ঘুম থেকে উঠেছে। উঠতেই মা ধাক্কা দিয়ে তাকে আর গোপালকে নামিয়ে দিয়েছে চৌকি থেকে, যা, যা, বেরো।
রাতে খুব ঝগড়া হচ্ছিল মা আর বাবাতে। প্রায়ই হয়। কাল লাগল কমলালেবু আর আঙুর নিয়ে। এ বাড়িতে ভাল জিনিস যা আসে তা দাদুকেই সবটা দেওয়া হয়। দাদু ইচ্ছেমতো খেয়ে কিছু বাঁচলে তারা ভাগজোখ করে প্রসাদ পায়। কাল সন্ধেবেলা বাবা কয়েকটা কমলালেবু আর এক থোলো আঙুর নিয়ে এসেছিল দাদুর জন্য।
রাতে ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার পর মা ফোঁস করল, অতগুলো লেবু আর আঙুর শ্বশুরমশাইয়ের হাতে দিলে, আমার ছেলে দুটো জুলজুল করে চেয়ে দেখল। খুব ভাল করলে সেটা? উনি তো অনেক খেয়েছেন, খাচ্ছেন, আমার ছেলে দুটো কি খায়? সময়ের জিনিস একটু দিতে হয় না ওদের?
চুপ করো তো! ওদের সামনে অনেক খাওয়া পড়ে আছে। বাবা-মা’র তা নেই। বাপ-মায়ের আশীর্বাদের একটা দাম আছে।
ছাই আছে! উনি তো খান আর হাগেন। কী লোভী লোক বাবা। যা আনা হচ্ছে পেটে সইবে না জেনেও হামলে পড়ে রাক্ষসের মতো খাবেন। পরদিন থেকেই হাগা ছোটে। আশাবাদ না হাতি! নজরও ছোট বাবা, দুটো অবোধ শিশু চেয়ে থাকে, কখনও বলেন না, ওরে পটল, ওরে গোপাল, নে একটু খা।
মিথ্যে কথা বোলো না। বাবা-মা কখনও ওদের না দিয়ে খায়?
দিয়ে মোটেই খায় না। আগে খায়, তারপর তলানি কিছু পড়ে থাকলে দয়া করে দেয়। তা অমন অচ্ছেদ্দার জিনিস আমার ছেলেরা খাবে কেন? ওরা কি ভিখিরি? ওদের বাপের পয়সাতেই তো ভালমন্দ জুটছে!
পটল সভয়ে বুঝতে পারছিল, আবহাওয়া গরম হচ্ছে। তার বাবা যেদিন মদ না খায় সেদিন মাটির মানুষ। খেলেই টং। কপাল খারাপ, মাতাল না হলেও বাবা একটু নেশা করে এসেছিল। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, চুপরও বেয়াদব, বাপ-মাকে খাওয়াই নিজের পয়সায়, তোমার বাপের পয়সায় নয়। বেশি কথা কইলে মুখ ভেঙে দেবো।
মাও ছাড়বার পাত্রী নয়। বলল, মুখ ভাঙবে! ইস কত মুরোদ, বটতলার গুণ্ডারা তো কান ধরে ওঠবোস করায়। তখন বীরত্ব কোথায় থাকে?
কে ওঠবোস করায়, বল মাগী। কে ওঠবোস করায়? কোন সুমুন্দির পুত?
জানি, সব জানি। ভগবান সইবে না বুঝলে, ভগবান সইবে না। দুটো দুধের শিশুকে বঞ্চিত করে রোজ তাদের চোখের সামনে গপ গপ করে খাওয়া— এরও বিচার আছে।
আলবাৎ খাবে। একশবার খাবে।
তারপর ঝগড়া কতদূর গড়িয়েছিল তা আর পটল জানে না। সে ঝগড়া শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সারাদিন মাঠ-ঘাট চষে, সাইকেল চালিয়ে, বাজারহাট করে, সাঁতার কেটে তার শরীর সন্ধের পরই ভেঙে আসে ঘুমে।
সকালে পিঠে পটাপট চাঁটি খেয়ে ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পেরেছিল, ঝগড়াটা সারা রাত ধরেই চলেছে বোধ হয়। মারধরও হয়ে থাকবে, সে টের পায়নি।
কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে সে আর গোপাল কাঠকয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মাজছিল। ফটকিরি আর কাঠকয়লা পিষে মাজনটা মা-ই বানিয়ে দেয়।
দাঁত মাজতে মাজতে অবোধ ভাইটার দিকে চেয়ে পটল বলল, আজ দিনটা খারাপ যাবে রে গোপাল। বউনি ভাল হয়নি।
গোপাল খুব গম্ভীর হয়ে দাদার দিকে চেয়ে থাকে। শুনতে পায় না, বলতেও পারে না। কিন্তু গোপাল বুঝতে পারে। সব বুঝতে পারে।
কুয়ো থেকে জল তুলে আগে গোপালের মুখ ধুইয়ে দেয় পটল। তারপর নিজে মুখ ধোয়। সকালে জলখাবারের পাট আছে কিনা তা বুঝতে পারে না। মা রেগে গেলে রান্নাঘরের দিক মাড়ায় না। বেলা অবধি দেখে ঠাকুমা উনুন ধরাতে বসে। তখন আর জলখাবারের আশা থাকে না।
রান্নাঘর থেকে উনুনের ধোঁয়া বেরোচ্ছে না দেখে পটল নিরাশ হয়ে দাওয়ায় মাদুর পেতে পড়তে বসে গেল। বাড়িতে গোলমাল বাঁধলে বরাবর সে বই নিয়ে বসে যায়। তাতে তার ওপর হামলা কম হয়। পড়ার সময় গোপাল তার গা ঘেঁষে চুপটি করে বসে থাকে। রোজ। পটল পড়ে, গোপাল কি তা বুঝতে পারে?
হ্যাঁ রে গোপাল, তুই কিছু বুঝতে পারিস? এই খাতা নে তো, একটা অ লেখ দিকিনি।
গোপাল খাতা নেয়, পেনসিলও নেয়। কিন্তু কী করতে হবে তা বুঝতে পারে না। পটলের দিকে চেয়ে থাকে শুধু।
পটলের বিশ্বাস, গোপাল একদিন ভাল হয়ে যাবে। লেখাপড়া করবে। তার আশা, একদিন এক সন্ন্যাসী এসে হাজির হবেন। লম্বা জটাজূট, হাতে ত্রিশূল। গোপালকে শিকড়বাকড় বা মাদুলি দিয়ে ভাল করে দিয়ে যাবেন।
গোপালকে আরও কাছে টেনে নিয়ে একটু আদর করে পটল। যে যাই করুক, সে কখনও গোপালকে মারে না, বকে না, অবহেলা করে না। নিজের ভাগ থেকে ওকে খাবার দেয় পটল। পয়সা থাকলে মারবেল, ঘুড়ি বা লাট্ট এনে দেয়।
খিদের চোট সামলানো মুশকিল। পেটে চনচন করছে খিদে, কিন্তু রান্নাঘরে কোনও নড়াচড়া নেই। ওপাশের ঘরের দাওয়ায় দাদু বসে আছে রোদে পা মেলে। ঠাকুমা এখনও ওঠেনি। ঠাকুমা উঠে দাঁত মাজবে, কাপড় ছাড়বে, ঠাকুর পুজো করবে, তারপর রান্নাঘরে গিয়ে বউমার খোঁজ নেবে। উনুন ধরবে তারও পর।
পটল চাপা গলায় বলে, তোর খিদে পায়নি গোপাল?
একথাটা যেন গোপাল বুঝতে পারল। একটা অদ্ভুত ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করল হঠাৎ। এ শব্দের মানে শুধু পটল জানে। তার মানে, গোপালের খিদে পেয়েছে।
বাবা বাড়ি নেই। মা বোধ হয় ঘুমোচ্ছ। কী যে হবে!
খিদে পেলে সবসময়েই ভাল ভাল খাবারের কথা মনে পড়ে। এই যে কিছুদিন আগে মামাবাডি গিয়েছিল তখন একদিন ছোটমামা তাকে আর গোপালকে নিয়ে গিয়ে হিং-এর কচুরি খাইয়েছিল একটা দোকানে। সেই স্বাদটা যেন এখনও জিবে লেগে রয়েছে, নাকে গন্ধটাও আসছে যেন। এখন সেই কচুরি পেলে ক’খানা খাবে পটল? গোটা কুড়ি উড়িয়ে দিতে পারবে না? খুব পারবে।
একমুঠো মুড়ি পেলেও এখন হত। কিন্তু মা নিয়ম বেঁধে দিয়েছে জিজ্ঞেস না করে কোনও খাবার জিনিসে হাত দেওয়া যাবে না। কিন্তু জিজ্ঞেস করাটাই এখন সমস্যা। মা আর বাবায় যেদিন খুব ঝগড়া হয় তার পর দিন দুই সময়টা ভাল যায় না তাদের।
ও দাদু!
বিষ্ণুপদ ওপাশের দাওয়ায় বসে হাঁ করে পেঁপেগাছের ডগার দিকেই চেয়ে ছিল বুঝি। দাদু যে সারাদিন কি করে এত বসে থাকতে পারে সেটাই পটল বুঝতে পারে না। বসে থাকে আর চেয়ে থাকে। এ গাঁয়ের অন্য সব দাদুরা তার দাদুর মতো নয়। তারা নাতিপুতির সঙ্গে খুব মেলামেশা করে, গল্প করে, বেড়াতে নিয়ে যায়, লাঠিপেটাও করে। তার দাদু যেন বড্ড দূরের মানুষ। কোথা থেকে বেড়াতে এসেছে, আবার চলে যাবে। দাদু এ বাড়ির একমাত্র লোক যার সঙ্গে কারও ঝগড়া নেই, তর্ক নেই। দাদুকে যে যা বলে মুখ বুজে সয়ে যায়।
দাদু সাড়া দিল না দেখে পটল ফের চাঁপা গলায় ডাকে, ও দাদু!
সাড়া নেই। বেশি জোরে ডাকাও যাচ্ছে না। মার হয়তো ঘুম ভেঙে যাবে। দাদু বা ঠাকুমার ওপর মা মোটেই খুশি নয়। আড়ালে সবসময়ে রাগে গরগর করে। কেন যে রাগ তা বুঝতে পারে না পটল। দাদু ভালমন্দ খায় বলেই কি? এই যে তার বাবা সবসময়ে দাদু আর ঠাকুমার জন্য ভালটা মন্দটা নিয়ে আসে এটা কি খারাপ কাজ? দাদু আর ঠাকুমাকে একটুও খারাপ লাগে না পটলের।
পটল আর দাদুকে ডাকল না। সন্তর্পণে দাওয়া থেকে নামল, তারপর উঠোন পেরিয়ে সোজা ঠাকুমার ঘরে গিয়ে ঢুকল।
ও ঠাকুমা, এখনও ঘুমোচ্ছো যে?
নয়নতারা পাশ ফিরে বলল, এই উঠছি। কেন রে?
মা ওঠেনি। বড্ড খিদে পেয়েছে যে।
তোর মা ওঠেনি কেন?
মনে হয় উঠবে না। বাবার সঙ্গে রাতে ঝগড়া হয়েছে।
নয়নতারা একটু যেন কষ্ট করে উঠে বসল, কোমরটায় রস নেমে এমন অবস্থা যে, শোয়া থেকে উঠতে গেলে প্রাণটা বেরিয়ে যায়। তা কি নিয়ে ঝগড়া হল আবার?
চালাক পটল সেটা ভাঙল না। বলল, তা জানি না।
ঝগড়ায় ঝগড়ায় সংসারটাই ঝাঁঝরা হয়ে গেল। গোপালটার মুখ তো দেখছি শুকিয়ে গেছে। আহা, অবোলা ছেলে। ওই ওখানে দেখ তো, তাকের ওপর কমলালেবু রাখা আছে, দুটো নিয়ে গিয়ে দু’জনে খা। আমি ঠাকুর পুজো সেরে রুটি করে দিচ্ছি।
কমলালেবুর ছিড়ে কখনও ফেলে না তারা। সবটা গিলে ফেলে। জোটে অবশ্য খুবই কম। দু’ভাই গপাগপ কমলালেবু খেয়ে ফেলল। কিন্তু একটু ভুল করে ফেলল পটল। খোসাগুলো সময়মতো ফেলে দিয়ে আসেনি। মাদুরের ওপরেই রেখে দিয়েছিল জড়ো করে, পরে ফেলবে বলে। কিন্তু সময় পাওয়া গেল না।
হঠাৎ রাঙা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল, এসব কি?
এ মা তার রোজকার চেনা মা নয়। রেগে থাকলে তার মা একদম অন্য রকম। সবসময়ে ফুঁসছে, দাঁত কিড়মিড় করছে সামান্য কারণেই, ফেটে পড়ছে রাগে। এ মাকে পটল ভীষণ ভয় পায়।
সে ভয়ে ভয়ে বলল, আমি চাইনি, ঠাকুমা দিল।
দিল! বলে মা মুখ ভেঙচে হঠাৎ নিচু হয়ে তার চুলের মুঠি ধরে মাথাটা নামিয়ে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা থাপ্পড় বসাল পিঠে। পিঠ জ্বলে গেল পটলের।
লজ্জা করল না ওই লেবু হাত পেতে নিতে? কাঙালী না ভিখিরি? কতকালের উপোসী তুই যে হ্যাংলার মত নিলি? যাদের জন্য সোহাগ করে এনে দিয়েছে তারাই গিলুক, তোদের অত নোলা কিসের?
পটলকে ছেড়ে গুম গুম করে গোপালের পিঠেও কয়েকটা কিল বসাল রাঙা। গোপাল কাঁদতে পারে না। শুধু বু বু করে কয়েকটা শব্দ করল মুখ দিয়ে।
দাওয়া থেকে নেমেই রাঙা কুয়োতলার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, খবরদার আপনি কখনও আমার ছেলেদের হাতে কোনও কিছু দেবেন না। কালীর দিব্যি রইল। আমার ছেলেরা ভিখিরি নয় যে দয়া করে তাদের এঁটোকাঁটা খাওয়াবেন। নিজেরা ঘরে বসে যেমন গিলছেন তেমনই গিলুন, আমাদের ভাগবাঁটোয়ারার দরকার নেই।
নয়নতারা বড় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর মুখ কুলকুচো করে বলল, কি হল হঠাৎ? দুটো কমলালেবু দিয়েছি, তাতে দোষটা কি হল?
আপনাদের দোষ হবে কেন? আপনারা তো গৃহদেবতা। আর আমরা সব বানের জলে ভেসে এসেছি। খবরদার বলে দিলাম, আর কখনও ওদের দয়া দেখাতে আসবেন না।
পটল দেখতে পেল তার দাদুর চোখ। পেঁপেগাছ থেকে নেমে এসেছে। চেয়ে আছে তার দিকে। চোখ দুটো বড় করুণ।
এ বাড়ি ছেড়ে পটল একদিন পালাবে। গোপালকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। এ বাড়িতে বড় অশাস্তি। কখন যে কার সঙ্গে কার লেগে যায় তার কিছু ঠিক নেই। জ্যাঠার মতো লেখাপড়া জানা থাকলে কত ভাল হত। জ্যাঠা এ বাড়ি ছেড়ে কবে চলে গেছে। ছোটকাকা গেছে। একদিন তাকেও যেতে হবে।
ঘণ্টা খানেক বাদে উনুনে আগুন ধরল। ভাত চাপল। কিন্তু তখন আর সময় নেই পটলের। ইস্কুল বসে যাবে। সে নিঃশব্দে উঠে পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ল। কেউ পিছু ডাকল না, কেউ ডেকে বলল না, ওরে, দুটো খেয়ে যা।
ইস্কুলে যেতে যেতে কত কী ভাবল পটল। সে একটা জিনিস টের পায়, তাদের বড় পয়সার অভাব। অনেক টাকাপয়সা থাকলে তাদের এত অশান্তি হত না।
ইস্কুলে হেঁটেই যায় পটল। সাইকেল নিলে বন্ধুরা চড়তে চায়। চড়তে গিয়ে সাইকেল এখানে ওখানে ফেলে দেয় বা এবড়োখেবড়ো মাঠে চালাতে গিয়ে টায়ারের:বারোটা বাজায়। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে খিদেটা আজ চড়ে যাচ্ছে।
ইস্কুলে ঢুকেই সে পেট পুরে টিউবওয়েল থেকে জল খেয়ে নিল। তারপর জামায় মুখ মুছে ক্লাসে গিয়ে ঢুকল। মাথা ঝিমঝিম করছে। একটা বমি-বমি ভাব হচ্ছে।
সে শুনেছে, বড় জ্যাঠাও না খেয়ে বহু দিন ইস্কুলে গেছে। তখন এমন অবস্থা যে, রোজ ভাত রান্নাই হত না। জ্যাঠা শুধু পড়তই না, নিজের হাতে জমিতে লাঙল দিত, টিউশনি করত; জুতো জামারও জোগাড় ছিল না। জ্যাঠা পারলে সে পারবে না কেন? তবে একটা কথা, জ্যাঠা প্রতি পরীক্ষায় ফার্স্ট হত, সে টেনেমেনে পাস করে মাত্র। জ্যাঠার মাথা ছিল, তার নেই।
পড়াশুনোয় কেন যে সে মন দিতে পারে না তা বোঝে না পটল। যতবার কোমর বেঁধে জোর করে মন দিতে গেছে, কিছুক্ষণ পরেই টের পেয়েছে, তার মনে নানা আজেবাজে চিন্তা চলে আসছে। আনমনা হয়ে যাচ্ছে সে। এক পড়া চৌদ্দবার পড়েও মুখস্থ হচ্ছে না।
আজও ইংরিজি কবিতা মুখস্থ বলতে গিয়ে ঠেকে গেল পটল। বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হল। অঙ্ক ক্লাসে একটা গাঁট্টা খেতে হল মাথায়।
শেষ ক্লাসটা ছিল ড্রিলের। ড্রিল স্যার নেই বলে ছুটি হয়ে গেল আজ। বাড়িতে যখন ফিরল তখন শরীরটা বেশ কাহিল লাগছে।
রান্নাঘরে গিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখল, না, ভাত ঢাকা রয়েছে। উপোস থাকতে হবে না। হাতমুখ ধুয়ে এসে ভাত ক’টা গোগ্রাসে খেল সে। ঘরে গিয়ে দেখল আর গোপাল জড়াজরি করে ঘুমোচ্ছ। দৃশ্যটা বড় ভাল লাগে তার। মাকে সে ভালবাসে বড়। মাও তাকে বাসে। তবু মাঝে কী যে সব ঘটে যায়! গোপালটা তো অবোধ, ও যখন মার খায় তখন বড় কষ্ট হয় তার।
বিকেলে আজকাল বড্ড তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে যায়। শীত পড়েছে খুব, কিছুক্ষণ মাঠে ফুটবল খেলে যখন ঘরে ফিরল পটল, তখন বাড়ির উঠোনে অন্ধকার জমে উঠেছে। বারান্দায় মুড়িসুড়ি দিয়ে দাদু বসে আছে। ঘর থেকে ঠাকুমার পাঁচালি পড়ার আওয়াজ আসছে যেন।
হাতমুখ ধুয়ে কুয়োতলা থেকে আসার পথে দাদুর কাছে একটু দাঁড়াল পটল, দাদু, কী করো?
এই তো বসে আছি। কী আর করব?
একটা গল্প বলবে?
দাদু একটু হাসে, আমার কোন্ গল্পটা তোর শোনা নেই। আমার স্টক ফুরিয়ে গেছে।
পুরনো গল্পই বলো না!
পড়তে বসবি না এখন?
বসব’খন। গল্পটা আগে শুনে নিই?
তোর মা রাগ করবে যে! আজ রেগে আছে।
কথাটা মানতে হল পটলকে। মা রেগে থাকলে সামান্য কারণেই বিরাট চেঁচামেচি লাগিয়ে দেবে।
তা হলে গল্প থাক। তোমার কাছে এসে পড়ব?
বিষ্ণুপদ একটু অসহায় গলায় বলে, সেও বুঝেসুঝে আসতে পারিস।
মা খুব রেগে আছে? দুপুরে কি ঝগড়া হয়েছে ফের?
বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলে, ওসব শুনে তোর কি হবে?
মা দুপুরে খেয়েছে?
বোধ হয় না।
বাবা দুপুরে বাড়ি এসেছিল?
এসেছিল।
তখন কি ফের ঝগড়া হয়েছে দাদু?
সেসব শুনে কি করবি?
পটলের বুক কাঁপছিল। সভয়ে বলল, খুব ঝগড়া হয়েছে নাকি? ফাটাফাটি?
ওই একটু কথা কাটাকাটি।
তুমি বাবাকে বকো না কেন দাদু?
বকব? আমি তো কখনও কাউকে বকিনি।
কখনও না?
না।
তোমার রাগ হয় না দাদু?
বিষ্ণুপদ খুব হাসল, আমার বোধ হয় ওটাই একটা রোগ। কত কী রাগ করার মতো ঘটে কিন্তু আমার কেন যেন রাগ হয় না। আমার রক্তটাই ঠাণ্ডা। তোর বাপ কাকা জ্যাঠাকে আমি কখনও শাসন-টাশন করিনি। যে যার মতো মানুষ হয়েছে।
পটল একটু চাপা গলায় বলে, বাবা যে মদ খায় দাদু, তুমি বারণ করো না কেন?
বারণ করলে কি শোনে? তবে বারণ করিনি তা নয়। এক-আধবার বলেছি। কিন্তু শোনেনি। রোখ চড়ে গিয়েছিল তো। দাদার সঙ্গে হিংসে করত। কিন্তু কৃষ্ণজীবনের সঙ্গে লেখাপড়ায় তো এঁটে উঠত না। তাই রাগে আক্রোশে নানা রকম করত। একবার রাগের চোটে ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কেটে ফালা ফালা করেছিল।
বাবা ভীষণ রাগী, না দাদু?
পুরুষের রাগ নানা রকম হয়। রাগে কেউ নিজেকে মারে, কেউ আবার রাগের ঠেলায় কেষ্টবিষ্টু হয়ে পড়ে। রাগেরও নানা রকম আছে।
তোমার রাগ হয় না কেন দাদু?
তা কি জানি! আমার ভেতরটা সবসময়ে কেমন যেন ঠাণ্ডা। দেখ না, সবসময়ে নিষ্কর্মার মতো কেমন বসে থাকি। ভাবি এ সময়ে কত কাজও তো করতে পারতাম। ইচ্ছেই যায় না, আমি হলাম জড়ভরত। আমার মতো কখনও হোসনি দাদা, আমাকে দেখে শিখতে হয় কেমনটি হতে নেই।
পটল দাদুর কথায় হি হি করে হাসল।
বিষ্ণুপদ নিজেও হাসল, তোর কি মা বাবাকে খুব ভয়?
রেগে গেলে ভয় করে। নইলে নয়। আর বাবা মদ খেলে কেমন যেন হয়ে যায়। কী সব খারাপ খারাপ কথা বলে।
ভাবিস না। তাড়াতাড়ি বড় হ। মা বাপকে জুড়িয়ে দেওয়ার মতো কিছু কর, তা হলেই হবে। আমি আমার মা-বাপকে খুব ভালবাসতাম।
আমিও বাসি দাদু।
বাসবিই তো। বাসবারই কথা কিনা। তোর বাবাও বাসে। এত ভালবাসে যে তার জন্য কথা শুনতে হয়, তাও বাসে। দুনিয়ার ভাল-মন্দ আমি তেমন বুঝি না রে দাদু, তবে মনে হয়, মা-বাপকে ভালবাসলে মানুষের ভালই হয়।
জ্যাঠা তোমাকে কেমন বাসে দাদু?
কৃষ্ণ! সে তো ভালইবাসত। কিন্তু থাকতে পারল না তো কাছে। দূরের মানুষ হয়ে গেল।
আমার খুব জ্যাঠার মতো হতে ইচ্ছে যায়।
সে তো খুব ভাল কথা।
জ্যাঠা কি তোমার কাছে পড়ত?
তা পড়ত। প্রথম প্রথম আমি পড়া দেখিয়ে দিতাম। তারপর নিজেই পড়ত। মাথাটাই এত ভাল ছিল যে, পড়াতে হত না।
তা হলে তোমার কাছে আমিও পড়ি না কেন দাদু?
বিষ্ণুপদ একটু হাসল, আমি যে একসময়ে পড়াতাম তা আজকাল কারও মনেই নেই। আমিও সব ভুলে গেছি।
মাকে জিজ্ঞেস করে আমি এবার থেকে তোমার কাছেই পড়ব দাদু। তাতে বোধ হয় ভালই হবে।
হ্যাঁ, মাকে আগে জিজ্ঞেস করে নিস। নইলে হিতে বিপরীত হয়ে বসবে।
পরদিন মায়ের মেজাজ ঠাণ্ডা বলে পটল কথাটা বলল, মা, দাদুর কাছে পড়া বুঝে নেবো?
রাঙা প্রথমটায় ভ্রূ কোঁচকাল, তোর দাদু আবার কি পড়াবে?
বাঃ, দাদু যে ইস্কুলে মাস্টারি করত।
রাঙা একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ওঃ ভারি তো মাস্টারি! গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুল। তা তোর ইচ্ছে হলে পড়িস।
পটল সোৎসাহে বইখাতা নিয়ে দাদুর কাছে হাজির হল, দাদু, পড়াও, মা বলেছে।
দিন সাতেক যেতে না যেতেই পটল বুঝতে পারল তার মাথায় পড়া ঢুকছে। সে বুঝতে পারছে। অঙ্ক কষে যাচ্ছে, ভুল হচ্ছে না, কয়েকটা বাক্যরচনা লিখে স্কুলে বাংলা স্যারের তারিফ পেয়ে গেল।
দাদুর পড়ানোটা এত ভাল যে পটল ভারি উৎসাহ পায়। দাদু কখনও বকে না, বা একথা বলে না যে, তোর দ্বারা হওয়ার নয়। দাদু কেবলই বলে, বাঃ, এই তত পারছিস, এই তো হচ্ছে। এমন কি ভুল অঙ্ক করলেও দাদু রাইট দিয়ে দেয়। তারপর খুব আদর করে ভুলটা ধরিয়ে আবার অঙ্কটা কষায়। তার যে হবে, তার যে হচ্ছে একথাটা দাদু ছাড়া কেউ এতকাল বলেনি।
একদিন অঙ্কের স্যার অবধি বাহবা দিয়ে বলল, বাঃ, আজ যে সবক’টা অঙ্ক রাইট করেছিস!