৫৫
প্রথম দিন সারা রাত ঘরের কাছে জলের ঢেউ-ভাঙার অবিরল শব্দ শুনতে পেল সে। শুনল নিশুত রাতে বিচিত্র পাখির ডাক। শুনল ওস্তাদি গানের ঝালার মতো তীব্র ঝিঁঝির শব্দ। কানে বিস্মৃতপ্রায় শেয়ালের দলবদ্ধ চিৎকার। আর বাতাস নানা বিচিত্র হুতাশে কত ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাঁশির শব্দ তুলে বয়ে গেল নিরন্তর। চালের টিনে খটাং খটাং কত যে শব্দ উঠল!
ভাল ঘুম হল না হেমাঙ্গর। বারবার উঠে বসল। বারবার জানালার ঝাঁপ তুলে কুয়াশায় আবছা অন্ধকার নদীকে দেখার চেষ্টা করল। টর্চ জ্বেলে ঘরে সাপ বা বিছে ঢুকেছে কিনা তা তদারক করল। তারপর ফের শুল। উঠল। জল খেল। মাঝে মাঝে একটু একটু ভয়ও করল তার। এই বেড়ার ঘরের নিরপত্তা কতটুকু? বেড়া কেটে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে দুষ্টু লোক, চোর। দামাল নদী যদি হঠাৎ পাড় ভেঙে গ্রাস করে নেয় ঘরসুদ্ধু তাকে? যদি ঝড় এসে উড়িয়ে নেয় ঘরের চাল?
সকালবেলা অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়ল হেমাঙ্গ। জানালা খুলে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় বসে রইল। কালো আকাশে প্রথম দু’খানা আবছা দিগন্তজোড়া পাখনার বিস্তার ফুটে উঠল। আলোর দুটি ডানা। সেই ডানা আকাশের অন্ধকারময়তায় রাতের তারাকে মুছে নিল। একেই কি ভোর বলে—যেমনটা সে কলকাতায় কখনও দেখতে পায় না? এত অপরূপ! দিগন্ত থেকে দিগন্তে হালকা কুয়াশার মায়জালে জড়িয়ে অস্ফুট ভোরের আলো কত ম্যাজিক দেখাতে থাকে। দু’খানা চোখ আজ দৃশ্যের ঐশ্বর্যে ডুবে গেল তার। প্রকৃতির এত অলঙ্কার আছে জানত না সে। কালো নদীর ওপর সোনালি আলপনা এঁকে উঠে আসছে সূর্য। পলক ফেলতে পারে না হেমাঙ্গ। আবেগে তার শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।
তারপর আলোয় আলো হয়ে যেতে লাগল চারদিক। রবীন্দ্রনাথ রোজ কেন সূর্যোদয় দেখতেন তা হেমাঙ্গ যেন একটুখানি বুঝতে পারে।
এখানকার মানুষ রাত থাকতেই উঠে পড়ে। আলো ফুটতে না ফুটতেই বাঁকা মিঞা হাজির। সঙ্গে ছোট ছেলে ফজল। ফজলের হাতে কেটলি। তাতে গরম দুধ। একটা ঠোঙায় বেশ কয়েকটা দিশি নিমকি বিস্কুট।
খেয়ে নিন। এ আমার রাঙা গাইয়ের দুধ।
হেমাঙ্গ আতঙ্কিত স্বরে বলল, দুধ! ও তো আমি কখনও খাই না।
তা বললে চলবে কেন? এ দুধের স্বাদ একটু চেখেই দেখুন। হরিয়ানার গাই বা জার্সি গরু নয় যে, দশ-বিশ সের করে সাদা জল দেবে। এ দিশি গাই, দুধের স্বাদই আলাদা।
হেমাঙ্গ বিরস মুখে বলে, আচ্ছা রাখো। মুখটুখ আগে ধুই, চা খেয়ে নিই, তারপর খাবো।
ফজলকে বলতে হল না। সে বালতির বাসি জল ফেলে টাটকা জল এনে দিল টিপকল থেকে। হেমাঙ্গ দাঁত ব্রাশ করল, মুখ ধুল। ফজলই এনে দিল চা। চায়ের পর দুধটাও খেতে হল তাকে।
কেমন বুঝছেন এ জায়গা?
রাতে খুব শব্দ হয়, না?
কিসের শব্দ?
জলের, বাতাসের, পাখির, ঝিঁঝির—অনেক শব্দ।
বাঁকা মিঞা খুব হাসল। বলল, ওসব সয়ে যায়। থাকুন, দেখবেন ওসব আর কানে আসছে না। তবে থাকতে পারবেন কিনা তাই ভাবছি।
কেন বাঁকা মিঞা, পারব না কেন?
আপনার হল শখের থাকা। শখ তো দু-চার দিনের। তারপর আর গাঁ ভাল লাগে না।
হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, দেখা যাক।
দেখুন। আপনারা এরকম মাঝে-মধ্যে এসে থাকলেও এদিককার লোকের ভাল হয়। তারা বল-ভরসা পায়। বাবুরা আসে না বলেই তো আমাদের দুঃখ।
বাবুরা এসে কি করবে?
কিছু করতে হবে না। আমাদের কোন্ তেপান্তরে বাস দেখছেন তো! এখানকার লোক ভাবে, আমরা বুঝি জন্তুই, মনিষ্যি নয়। এ গাঁয়ে গত পাঁচসাত বছরের মধ্যেও কোনও এম এল এ আসেনি, মন্ত্রী তো দূরস্থান। এখানকার সবচেয়ে বড় ভি আই পি হলেন পাশের গাঁয়ের হাই স্কুলের কয়েকজন মাস্টারমশাই। তাঁরাও তেমন কেষ্টবিষ্টু নন, এখানকারই লোক সব। আপনাদের আনাগোনা হলে আমাদের একটু কেমন যেন ভরসা হতে থাকে। সেটা যে কেমন তা বোঝানো যায় না।
দুধটা সত্যিই ভাল। অভ্যাস নেই বটে, কিন্তু খেতে বেশ লাগল।
বাঁকা মিঞা বলে, গেলাসটায় একটু জল ঢেলে তলানিটা খেয়ে নিন।
কেন?
দুধের পাত্র-ধোওয়া জল খেলে খুব পোস্টাই।
হেমাঙ্গ এই গ্রাম্য সংস্কারের কথা শুনে হাসল। তবে খেলও। হোয়েন ইন বোম, বিহেভ লাইক রোমানস্।
দুপুরে কী খাবেন?
বেশি আয়োজন কোরো না। তোমরা যা খাও তা হলেই আমার হবে।
চালটা কি একটু মোটা ঠেকছে?
খারাপ লাগছে না।
মোটা চালের ভাত খেতে আপনাদের অসুবিধে হয়, কিন্তু এখানে মোটা চাল ছাড়া পাওয়া যায় না। সরু চাল খেতে হলে সেই সন্দেশখালি বা সোনাখালি যেতে হবে।
না না, তার দরকার নেই। আমার খেতে কোনও কষ্ট হচ্ছে না।
বাঁকা মিঞা একটু হাসল, আপনার দেখছি এ জায়গার ভূতে পেয়েছে। সবই ভাল লাগছে। এখানেই আমার হাড়ে ঘুণ ধরল, কিন্তু কই ভাল কিছু তো দেখলাম না। এ হল মরা জায়গা। যা ছিল তাই আছে। এ জায়গার কোনও উন্নতিও নেই, অধোগতিও নেই। অধোগতির আর আছেটাই বা কী বলুন, তলানিতে এসে ঠেকেছি, পাছবেড়ায় পিঠ।
তবু তো আগেকার মতো কলেরা বসন্তে গাঁ কে গাঁ সাফ হয়ে যাচ্ছে না। সেটাও তো একটা ভাল লক্ষণ।
তা যা বলেছেন। কলেরা-টলেরা হয় না আজকাল। টিপকল হয়ে ইস্তক হচ্ছে না। কিন্তু বেঁচে থাকাটাও যে মরার মতোই হচ্ছে। ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে থাকাকে কি আর বেঁচে থাকা বলে? বেড়াতে বেরোবেন নাকি?
নদীর ধার দিয়ে একটু হেঁটে এলে হয়।
তাহলে বেরিয়ে পড়ুন। ডান ধারে যাবেন না, ওদিকটায় লোকে হাগে। বাঁ ধারে একখানা মেটে বাঁধ আছে, অনেক দূর অবধি গেছে। ওদিকটা তত অপরিষ্কার নয়। তবু সাবধানে যাবেন। বাঁধের ওপর রাস্তা আছে। লোক চলাচল আছে।
ঘরে তালা দিতে হবে নাকি?
না দিলেও হয়। তবে ভেজিয়ে রেখে শেকলটা তুলে দিয়ে যাবেন। কুকুর-টুকুর ঢুকে পড়তে পারে।
এই বলে বাঁকা মিঞা চলে গেল। হেমাঙ্গ পোশাক পরে ঘরে শেকল দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রোদ উঠেছে বটে, কিন্তু নদীর ওপর দিয়ে কনকনে বাতাসও আসছে। বাঁধটি চমৎকার। উঠে দাঁড়ালে নদীর বাঁকটা বহু দূর অবধি দেখা যায়। জলে রুপোলি রোদুর খেলা করছে। উজান-ভাটেনে ভটভটি, নৌকো চলছে মন্থর গতিতে।
বাঁধের ধারেও মানুষ প্রাকৃতিক কাজ সারে। দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে দুর্গন্ধ আসছে। নাকে রুমাল চাপা দিতে ইচ্ছে হল তার। আবার ভাবল, এসব সয়ে নেওয়াই ভাল। অত শুচিবাই হলে চলবে না।
এই অজ্ঞাতবাসের কথাও যে জানাজানি হয়ে যাবে তা হেমাঙ্গ জানে। হয়তো জানাজানি হয়েও গেছে এতক্ষণে।
এক রবিবার রাত্রে রশ্মির সঙ্গে তার যে প্রগাঢ় সংলাপ হয়েছিল টেলিফোনে সেটাই হেমাঙ্গকে এত দূর ছুট করিয়েছে। উইক ডে-গুলো তত ভয়ের নয়। ভয় হল শুক্রবার বিকেল থেকে রবিবারের রাত অবধি। রশ্মির বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণের পর নিমন্ত্রণ আসছে আজকাল। পার্টি হচ্ছে ঘন ঘন। বিয়ের কথাটা খুব স্পষ্টভাবে ওরা উচ্চারণ করছে না হেমাঙ্গর সামনে।
কিন্তু বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে প্রস্তাব গেছে এবং গৃহীত হয়েছে।
স্বয়ং বাবাই ডেকে পাঠালেন এক রবিবারে। অতি ব্যস্ত ও অন্যমনস্ক মানুষ। অনেক কথা খেয়াল রাখতে পারেন না। সেদিনও তাঁর কোথায় যেন একটা জরুরি মিটিং ছিল। হেমাঙ্গকে দেখে বেশ ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, ওরা এসেছিল। তা ভালই তো। সবই তো ঠিক আছে। তুমি কি বলো?
বিনা ভূমিকায় এরকম কথা বললে যে তার কোনও মানেই দাঁড়ায় না সেটা দুর্গানাথবাবুর মাথাতেই ছিল না। তিনি বোধ হয় মিটিঙের জরুরিতর বিষয়টি নিয়েই ভাবছিলেন।
হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, কিসের কি ঠিক আছে বাবা?
দুর্গানাথবাবু ছেলের প্রশ্নটি অনুধাবন করতে পারলেন না। অত্যন্ত উদারভাবে বললেন, আমি অবশ্য আমার ছেলেমেয়েদের কেউ বিদেশে বসবাস করুক চাই না। কিন্তু কী আর করা যাবে! তবে আমি মনে করি ছেলেমেয়ে হলে তাদের আর বিলেতে রেখো না। অন্তত স্কুলিংটা এদেশে হলে ভাল হয়। মাতৃভাষাটাও শেখা হয়ে যাবে। তারপর মাধ্যমিক পাস করলে না হয় আবার ফিরে গিয়ে হায়ার এডুকেশন ওখানে নেবে। কি বলো?
হেমাঙ্গ একেবারেই বুঝতে পারছিল না তা নয়। সে অন্তত এটা বুঝতে পারছিল যে, তার ব্যস্ত বাবা ডিটেলসে না গিয়ে, ভূমিকা না করে শুধু স্যালিয়েন্ট পয়েন্টগুলো বলে যাচ্ছেন। বেশি কথায় সময় নষ্ট হয়।
হেমাঙ্গ অবাক হওয়ার ভান করে বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
দুর্গানাথবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, সেরকমই তো সব ঠিক হয়েছে শুনলাম। আমরাও তো মত দিয়েছি।
ঠিক এই সময়ে মা এসে ঘরে ঢুকল। মুখে বেশ একটু হাসি-খুশি ভাব। উজ্জ্বলতাও দেখা যাচ্ছে। জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ওঃ, ঠাকুরের কাছে কত মানত করেছি। ছেলের এতদিনে মতি হল।
হেমাঙ্গ গম্ভীর হল। কিংবা গাম্ভীর্যের মুখোস পরল। বলল, তোমরা কি বিয়ের কথা বলছো মা? কিন্তু আমি তো এখনও মনস্থির করিনি।
দুর্গানাথবাবু একটু অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
মা বলল, ওরে, অত লজ্জা পেতে হবে না। লাভ ম্যারেজ বলে কি আমরা কেউ কিছু আপত্তি করেছি? দিনকাল পাল্টেছে, এখন যুগের হাওয়া মেনে নিতে হবে বৈকি। মেয়েটাও ভারি চমৎকার।
হেমাঙ্গ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, মা, আমি কিন্তু মতামত এখনও দিইনি। আমাকে ভাববার সময় দাও।
দুর্গানাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, ভাববে! ভাববে কি? তাঁরা যে প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছেন! চারু তো বলে গেছে, তোমার নাকি খুবই মত আছে।
চারুদিদি ঠিক কথা বলেনি।
দুর্গানাথবাবু ফের স্ত্রীর দিকে তাকালেন, কী বলছে এ?
মা বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি মিটিঙে যাও তো। আমি সব বুঝে দেখছি।
দুর্গানাথবাবু একটু তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে গেলেন। সংসারের সাতপাঁচের মধ্যে তিনি বিশেষ থাকতে চান না কখনও।
তারপর মা ধরে পড়ল তাকে, কী হয়েছে বল তো! চারু বলছে তার নাকি ও মেয়ের সঙ্গে খুব ভাব। পাত্রীর বাড়ির লোকেও বলছে তোদের নাকি বোঝাপড়া হয়ে গেছে। তাহলে আবার ওসব বলছিস কেন?
মা, বাঙালি ছেলেদের তো বিয়ে করা ছাড়া আর কোনও অ্যাচিভমেন্ট নেই। তা আমার সেটা হয়ে গেলে জীবনে আর কী থাকবে বলো!
বিয়ে করা ছাড়া আর কিছু থাকবে না কেন?
আর কী বলল তো! বাঙালিদের প্রেম হল সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার আর বিয়ে হল মস্ত কীর্তি। ব্যস জীবনের সব সার্থকতা হয়ে গেল।
কথা ঘোরাচ্ছিস! কী হয়েছে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল তো। মেয়েটার সঙ্গে ঝগড়া করেছিস নাকি? সে যে বড় ভাল মেয়ে। বিলেত-ফেরত বলে মনেই হয় না। সহবত জানে খুব।
একটু অধৈর্য হয়ে হেমাঙ্গ বলে, রশ্মি খুব ভাল মেয়ে। তাকে বিয়ে করতেও আমার আপত্তি থাকা উচিত নয়। তবে আমার একটু সময় চাই।
সময়? সে মেয়ে যে আর ক’মাস পর বিলেত চলে যাবে। তার নাকি সেখানে আরও কী সব পড়াশুনো করার আছে, চাকরিও পাকা। ওর বাপ-মা এবার ওকে একা ছাড়বে না, বিয়ে দিয়ে বরের সঙ্গে পাঠাবে।
সেটা ওদের দিককার কথা। ওরা যা বলবে তা-ই আমাকে করতে হবে নাকি? আর এখন আমি বিলেত গেলে তোমার মন খারাপ হবে না বুঝি? যখন গিয়েছিলাম তখন তো প্রতিটি চিঠিতে ‘ফিরে আয়, ফিরে আয়।’
মা হাসল, সে তখন একা ছিলি বলে। এখন তো তা নয়। বউ সঙ্গে থাকবে।
হেমাঙ্গ কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। শুধু বলল, আমাকে বিলেত যেতে হবে কেন তা-ই তো বুঝতে পারছি না। বিলেতে থাকা আমার পছন্দ নয়। ওদের সেটা ভাল করে বুঝিয়ে দাও।
মা চোখ কপালে তুলে বলে, বোঝাপড়া তো তোরাই করেছিস। আমরা এর মধ্যে মতামত দিতে গেলে কি ভাল দেখায়? যা বলার সে তো তুই-ই ওদের বলতে পারিস। কে কোথায় থাকবি না-থাকবি তা কি আমরা জানি?
হেমাঙ্গ এত অসহায় বোধ করতে লাগল যে আর কোনও কথাই বলতে পারল না। রশ্মির সঙ্গে তার একটা ভাবপ্রবণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে না-উঠতেই যে সেটা বিয়ের দিকে এত তাড়াতাড়ি গড়িয়ে যাবে এ তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সবাই কেন ধরেই নিল যে, সে বিয়েতে রাজি? একটা মতামত জিজ্ঞেস করারও কেন কেউ প্রয়োজন বোধ করল না? কেন রশ্মিও নয়?
বিডন স্ট্রিট থেকে সে উদ্ভ্রান্তের মতো গরচায় ফিরে এল। বুঝতে পারল, তার মাথা কাজ করছে না। তার মন অত্যন্ত চঞ্চল। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
রাত্রিবেলা সে নিজেই চারুশীলাকে ফোন করে বলল, তুই কী কাণ্ড করলি বল দেখি!
কি করেছি?
রশ্মির আর আমার মধ্যে কেবলমাত্র বন্ধুত্ব ছিল। সেটাকে রোমান্টিক করে তুললি কেন বল তো! শোন, ইয়ার্কি করিস না। ইয়ার্কির সময় এটা নয়।
চারুশীলা সাবধানী গলায় বলল, কেন, কি হয়েছে?
আজ বিডন স্ট্রিটে গিয়েছিলাম। বাবা ডেকে পাঠিয়েছিল। ওখানে ফর্মাল বিয়ের প্রস্তাব গেছে। আর সেটা আমাকে না জানিয়েই।
তাতে দোষটা কি হয়েছে? অমন সিরিয়াস হচ্ছিস কেন?
হবো না? বিয়ে করব আমি, আমাকে সেটা জানানোই হল না। বিয়ের পর আমি কোথায় থাকব না-থাকব, ভারতে না বিলেতে তাও সব আমাকে না জানিয়েই ঠিক হয়ে যাচ্ছে! আমাকে কি পেয়েছিস তোরা?
সরি। কিন্তু তোকে নেগলেক্ট করে এসব করা হয়নি রে। আসলে সবাই ধরে নিয়েছে যে, বিলেতে থাকতে পোর আপত্তি হবে না।
সেটা কে ধরে নিল?
চারুশীলা একটু চুপ করে থেকে বলল, রশ্মি আমাকে বলেছিল, বিলেতে থাকা তোর পছন্দ নয়। তখন আমি বলেছিলাম যে, তোকে আমিই রাজি করাব।
বিলেতে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তারও আগে প্রশ্ন আছে। আমি বিয়ে করতে রাজি একথা আমি এখনও বলিনি।
সব কথা কি বলতে হয়? বোঝা যায় না?
ভুল বুঝেছিস।
মোটই ভুল বুঝিনি। রশ্মি অত সস্তা মেয়ে নয় যে নিজেই বানিয়ে ওসব কথা বলবে।
রশ্মি কি বলেছে?
বলেছে, তোদের মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।
ওটাকে আন্ডারস্ট্যান্ডিং বলে না। আমাদের সম্পর্কটা এখনও ভাল করে শুরুই হয়নি। উই আর স্টিল ওনলি ফ্রেন্ডস্।
শোন লক্ষ্মী ভাই আমার, তোর ইগোতে একটু লেগেছে বুঝতে পারছি। কিন্তু ওটুকু ক্ষমা-ঘেন্না করে নে। রশ্মি যে ভীষণ ভাল মেয়ে তা তো জানিস। এ মেয়েটাকে কিন্তু ডিচ করিস না। প্লীজ!
ডিচ করব কেন? আমি তো কোনও কথা দিইনি। আমাকে কি জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল না। একবার?
ছিল। একশবার ছিল। কিন্তু তোর হয়ে আমিই যে সব বলে দিয়েছি।
সেটা বুঝতে পারছি। তুই সাঙ্ঘাতিক ভুল করেছিস।
ওরে শোন, তোদর হয়তো আরও একটু সময় দেওয়া উচিত ছিল। মানছি। তবে কী জানিস, রশ্মি তো কিছুদিনের মধ্যেই বিলেত চলে যাবে। ওর হাতে সময় নেই। মেয়েটাকে আমি হাতছাড়া করতে চাইনি। এত ভাল একটা মেয়েকে হাতছাড়া করা কি উচিত? মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভাব তো!
আমার হয়ে সব ভাবনা তো তোরাই ভেবেছিস। আমার জন্য তো ভাববার মতো আর কিছু রাখিসনি।
রাগ করিস না। একটু ভাববার চেষ্টা কর। তোদের সম্পর্কটা হয়তো এখনও ততটা ম্যাচিওর করেনি। কিন্তু একদিন তো করবেই। সিচুয়েশনটা এমন হল যে, ম্যাচিওর করার জন্য অপেক্ষা করা চলে না। রশ্মির মা-বাবাও ওকে প্রেশার দিচ্ছে তাড়াতাড়ি ডিসিসন নেওয়ার জন্য। ওরা বিয়ে না দিয়ে রশ্মিকে ছাড়বে না।
সেটা ওদের ব্যাপার। তার জন্য আমাকে স্কেপগোট করছিস কেন?
স্কেপগোট! সে কী রে! তুই স্কেপগোট হতে যাবি কেন? তোর সেন্টিমেন্ট না-থাক, রশ্নির যে ভীষণ আছে। ও যে তোকে ভালবাসে সেটা বুঝতে পারিস না বুদ্ধ কোথাকার? ওর ভালবাসার দাম দিবি না?
হেমাঙ্গ ফের অথৈ জলে পড়ে গেল। ভালবাসার ব্যাপারটা সে খুব জোরের সঙ্গে অস্বীকারও করতে পারছে না।
তখনই সে বুঝতে পারল, তার কিছুদিন একটু তফাত হওয়া দরকার। গর-ঠিকানিয়া হওয়া দরকার। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া দরকার। কলকাতার সিস্টেমের মধ্যে থেকে নিজেকে ঠিকমতো বুঝতে পারে না সে।
আজ সকালে বাঁধের ওপর দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে গোটা ব্যাপারটাকে বারবার ভাবছিল। সপ্তাহের শেষে দুটি দিন, শনি আর রবি তার পক্ষে একটু বিপজ্জনক। প্রায় প্রতি শনি আর রবিতেই রশ্মিদের বাড়িতে তার নিমন্ত্রণ হচ্ছে। সে এড়াতেও পারে না।
কিন্তু তার মন ভরে যায় বিস্বাদে। রশ্মিকে তার অপছন্দ নয়, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ধরে-বেঁধে তাকে রশ্মির সঙ্গে যুতে দেওয়া হচ্ছে বলেই তার ভিতরটা শক্ত হয়ে উঠছে। উপরন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিলেত-বাস।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর গেল হেমাঙ্গ। চারদিকে নিস্তরঙ্গ জীবন-যাপন, উত্তেজনাহীন প্রকৃতি, ধীর নৌকা, স্থির আকাশ ক্রমে মাথা থেকে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগকে উড়িয়ে দিল।
বাঁ দিকের নাবালে ক্ষেতখামার আছে বটে কিন্তু বুজের তেমন সমারোহ নেই। গাছপালা তেমন ঘনবদ্ধ নয়। এসব জায়গায় আগে হয়তো ঘন বন ছিল। বসত হয়ে জঙ্গল পিছু হটে গেছে।
অনেকটা হেঁটে বেশ খিদে পেয়ে গেল তার। ফিরে এল।
ফজল তার জন্য নাস্তা নিয়ে এল সকাল আটটা নাগাদ। রুটি আর আলুর তরকারি। ছেলেটা লাজুক এবং স্বল্পভাষী। কিন্তু মুখে একটি মিষ্টি হাসি লেগেই আছে। পরনে লুঙ্গি আর একটা পাঞ্জাবি। নিতান্তই কিশোরবয়স্ক।
কোন ক্লাসে পড়িস রে ফজল?
ক্লাস সিক্সে।
বয়স কত হল?
পনেরো ষোলো হবে।
পাস করিস ঠিকমতো?
ফজল খুব লজ্জাটজ্জা পেয়ে বলে, দু’বছর ফেল মেরেছি।
ফেল মারিস কেন?
ফজল নিরুত্তর।
খাওয়া শেষ করে হেমাঙ্গ বলল, যখন আমি এখানে আসব তখন আমার কাছে বই নিয়ে চলে আসবি। পড়া তৈরি করিয়ে দেবো। বুঝেছিস?
জী।
বাসন নিয়ে ফজল চলে গেল। জানালা খুলে ফের নদী দেখতে বসে গেল হেমাঙ্গ। ভাবল, কি দরকার তার কলকাতায় পড়ে থাকার? এই যে সভ্যতাবর্জিত, বিজ্ঞানরহিত, প্রগতিবিহীন একটি গরিব গ্রাম, সে তো বাকি জীবনটা এখানেই কাটাতে পারে। এখানে সে আবার পুরনো দিনের মতো অরণ্য সৃষ্টি করবে, খামার করবে, চারদিকে গাছপালা নিয়ে তার মধ্যে বসবাস করবে। খারাপ কি? যদি বিয়ে করতেই হয় সে তো এখানকার একটি গেঁয়ো মেয়েকেই বিয়ে করতে পারে। বেশ তো হবে তা হলে। শহরের কত লোক পালাচ্ছে প্রকৃতির কোলে।
দুপুরে খাওয়ার সময় সে বাঁকা মিঞাকে বলল, শোনো বাঁকা, আমি যদি এখানে আরও জমি নিতে চাই ব্যবস্থা করে দেবে?
আরও জমি? বাবুর দেখি মাথাটাই খারাপ হল। এখানে জমি নিয়ে করবেনটা কী!
চাষবাস করব, জঙ্গল তৈরি করব, ডেয়ারি করব।
বাঁকা খুব হাসল, সে তো ভাল কথা। কিন্তু শহরে থাকবেন আর এখানে জমিদারি পত্তন করবেন তা কি হয়? দিনকাল খারাপ। বেদখল হয়ে যাবে, লোকে পিছনে লাগবে।
তার জন্য তুমি আছো। ঠেকাবে।
এ গাঁ আপনার মাথাটা খেয়েছে।
এ গাঁ বলে নয়। আমার আর শহরে থাকতে ইচ্ছে হয় না।
কলকাতা এখন একটা নরককুণ্ড তা ঠিক। তবে এখানে চট করে একগাদা টাকা ঢেলে বসবেন না। ভাল করে ভাবুন। বাবুর সঙ্গেও পরামর্শ করুন। আপনার হল ছেলেমানুষী বুদ্ধি।
আমার ওপর তোমার বিশ্বাস নেই?
বাঁকা হেসে ফেলল, শোনো কথা! আপনারা কত বিদ্যে ধরেন, কত মাথা খাটান, দেশটা তো আপনার মতো লোকেরাই চালায়। তবে কিনা আপনার ক্ষতি হয়ে গেলে এই বাঁকার ঘাড়েই দোষ চাপবে। লোকে বলবে, আমিই আপনাকে এইসব বুদ্ধি দিয়েছি।
সেটা আমি বুঝব। তোমাকে কেউ দোষ দেবে না।
এ হল নোনা মাটির জায়গা। ফসল ভাল হয় না।
ফসলের জন্য মাথাব্যথা নেই। বড় গাছ তো হয়।
সব গাছ হবে না। তবে কয়েক ধরনের গাছ হয়।
আমি বড় গাছ করতে চাই। জঙ্গল।
সে তো মেলা জমি লাগবে। জঙ্গল রক্ষা করা কঠিন কাজ।
তবু তুমি জমি দেখ। সস্তা যেন হয়। এক লপ্তে অনেকটা।