2 of 2

৫৪. বিম্ববতীর কক্ষ

বিম্ববতীর কক্ষ এবং সেদিকের মহলটি এখন নিয়েছে গঙ্গানারায়ণ। টানা অলিন্দে এখনো সার সার টাঙানো রয়েছে পাখির খাঁচাগুলি, অযত্নে অবহেলায় বেশ কিছু পাখি ইতিমধ্যেই মরেছে, জীবিত আছে আঠারো-কুড়িটি। এতদিন পর কুসুমকুমারী আবার সেই পাখিগুলির ভার নিল। সে তাদের খাদ্য ও জল দেয়, প্রত্যেকটি পাখির সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে সুমিষ্ট স্বরে কথা বলে তাদের সঙ্গে।

প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করে না। বিম্ববতী চলে যাবার পর কুসুমকুমারী এসে যেন তা আবার ভরে দিয়েছে।

প্রথম প্রথম কুসুমকুমারী লজ্জায় ঘরের বার হতেই চাইতো না। সরোজিনী ছাড়া আর কোনো নারী কথা বলতেও আসেনি তার সঙ্গে। সে ভেবেছিল, এ বাড়ির অন্যান্য মহিলারা এ বিবাহ সুচক্ষে দেখেননি। কুসুমকুমারী বুদ্ধিমতী, সে জানতো এমনটি হবেই। বিধবা বিবাহের ব্যাপারে পাত্র পক্ষের বাড়িতেই প্রতিরোধ বেশী হয়।

কুসুমকুমারী অবশ্য একথা জানতো না যে জোড়াসাঁকোর সিংহদের মতন এত খ্যাতিমান ও ধনী পরিবারে জনসংখ্যা বিস্ময়করভাবে কম। নিকট আত্মীয়ও প্ৰায় কেউ নেই-ই বললে চলে। হেমাঙ্গিনীর মৃত্যু হয়েছে, বিম্ববতী তীর্থবাসিনী হয়েছেন, সুতরাং এদের অবলম্বন করে যেসব দুঃস্থ দূর সম্পর্কিত আত্মীয়রা থাকতেন, তাঁরাও ঝরে গেছেন এক এক করে। তিন তলায় হেমাঙ্গিনীর মহলে চার-পাঁচ জন বয়স্ক স্ত্রীলোক এখনো রয়ে গেছেন বটে, কিন্তু তাঁরা সচরাচর নিচে নামেন না। বিধবা বিবাহকে তাঁরা ব্যভিচারের নামান্তর বলেই মনে করেন, সুতরাং নববধূকে তাঁরা অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেন নি।

এ সংসারের হাল ধরবার কেউ নেই। সরোজিনী নিতান্তই বালিকা, এবং তার বয়সী অন্যান্য বধূদের তুলনায় তার সাংসারিক বোধ আরও কম। তা ছাড়া সে প্রায়ই পিত্ৰালয়ে থাকে। বিম্ববতী নেই বলেই তার যাতায়াত আরও অবাধ হয়েছে। তা ছাড়া পিত্ৰালয়ে থাকাই তার পক্ষে এখন সুবিধাজনক, বরাহনগর থেকে মহাভারত অনুবাদের কাজ সেরে নবীনকুমার অধিক রাত্রে প্রায়ই জোড়াসাঁকো ফিরতে পারে না, সে বাগবাজারেই থেকে যায়।

এ সংসারে কোনো গৃহিণী নেই বলেই ভৃত্যতন্ত্রই সব কিছু চালায়। পুরোনো আমলের গোমস্তা দিবাকর এখনো রয়ে গেছে, দৈনিক বাজার হাট থেকে শুরু করে, গৃহ মেরামত এমনকি দোল-দুর্গোৎসবের ব্যবস্থাও তার হাতে। বিধুশেখরের তীক্ষ্ণ নজর এবং খবরদারিও নেই, সেই জন্য দিবাকরের এখন রীতিমতন পোয়া বারো।

সরোজিনী থাকলে তার সঙ্গে গল্প করে কুসুমকুমারীর সময় কাটে। তা ছাড়া তরু আর নীরু নামী দুটি দাসীকে সে নিয়ে এসেছে বাপের বাড়ি থেকে। কুসুমকুমারীর ভাই ও দাদারাও প্রায়ই তার খবর নিতে আসে। এই বিবাহে কুসুমকুমারীর পিত্ৰালয়ের সকলেই খুব সন্তুষ্ট। গঙ্গানারায়ণের মতন পাত্র পাওয়া তো অতি ভাগ্যের কথা বটেই, তা ছাড়াও সিংহ পরিবারে কুসুমকুমারীর প্রতি অনাদর বা অযত্ন হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই, আজ হোক, কাল হোক, সেই তো এই সংসারের কর্ত্রী হবে।

দুর্গামণির কথা প্রায়ই মনে পড়ে কুসুমকুমারীর। এই বিবাহের কথা দুর্গামণির কানে গেছে নিশ্চয়ই। এ সংবাদ শুনে বোধহয় তার মতন আর কেউ খুশী হয়নি। কুসুমকুমারী আশা করেছিল, দুর্গামণির কাছ থেকে একটি পত্র পাবে। না পেয়ে তার একটু উদ্বেগ হয়, দুর্গামণির কোনো বিপদ ঘটেনি তো! কুসুমকুমারী নিজেই একটা পত্র লেখার কথা ভাবে, লিখতে গিয়েও নিরস্ত হয়, ঐ বাড়ির সঙ্গে কোনো রূপ যোগাযোগ রাখা সমীচীন। কিনা সে বুঝতে পারে না। বস্তুত, কুসুমকুমারী তার পূর্ব স্বামীর পরিবারের সকলের কথাই মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে চায়, একমাত্র দুর্গামণিকে ছাড়া। ওখানকার দুঃসহ দিনগুলিতে দুর্গামণিই ছিল তার একমাত্র ভরসা।

দুর্গামণিকে পত্র লেখা উচিত কিনা এ-সম্পর্কে সে গঙ্গানারায়ণকে জিজ্ঞাসা করার কথা ভেবেছে। কিন্তু বলি বলি করেও বলতে পারে নি। কুসুমকুমারীর পূর্ব-জীবনের কথা একবারও উত্থাপন করে নি গঙ্গার্নারায়ণ। তা হলে কি সে প্রসঙ্গ কুসুমকুমারীর নিজে থেকে তোলা উচিত? কুসুমকুমারী কিছুতেই মনঃস্থির করতে পারে না। এ-ব্যাপারে তাকে পরামর্শ দেবারও কেউ নেই। অথচ দুর্গামণির জন্য তার মন কেমন করে। সে দুর্গামণির কোনো খোঁজ খবর নিচ্ছে না বলে নিজেকে তার অকৃতজ্ঞ মনে হয়।

গঙ্গানারায়ণ সারাদিন ব্যস্ত থাকে। কলকাতার তাদের বিভিন্ন হোসের পরিচালকগণ ও খাতকেরা আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে নবীনকুমারের দেখা না পেয়ে তার কাছেই আসে। বিধুশেখরও যেন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গেছেন। বাধ্য হয়েই গঙ্গানারায়ণকে দায়িত্ব নিতে হয়। ছোট্‌কুর সঙ্গে দু-চার কথা বলতে গিয়েও সুবিধে হয়নি। নবীনকুমার সব দায় তার জ্যেষ্ঠের স্কন্ধে চাপিয়ে দিতে চায়। তহবিল থেকে সে তার প্রয়োজনীয় অর্থ পেলেই হলো, কী ভাবে অথাগম হবে, সে সম্পর্কে তার কোনো দুশ্চিন্তাই নেই। ক্রমশ বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে গঙ্গানারায়ণ জড়িয়ে পড়ছে, যদিও তার মন এর মধ্যে নেই, ঐশ্বর্য ও সম্পদের প্রতি সে কোনোরূপ মোহ বোধ করে না।

 

মামলায় জয় হবার পর গঙ্গানারায়ণ ভেবেছিল সে আবার ইব্রাহিমপুরে ফিরে যাবে, সেখানকার চাষীদের সাহায্য করবে। সে খবর পেয়েছে যে সেখানে এক সদাশয় ন্যায়নিষ্ঠ ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হওয়ায় সেখানকার নীলকর সাহেবরা ইদানীং একটু ঠাণ্ডা হয়ে আছে। চাষীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এটাই উপযুক্ত সময়। কিন্তু গঙ্গানারায়ণের যাওয়া হলো না, তার বিবাহ এবং হরিশ মুখুজ্যের মৃত্যুর মতন দুটি ঘটনায় সব বদল হয়ে গেল। হরিশের মৃত্যুতে গঙ্গানারায়ণও খুব ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু তা সে সামলে উঠতে পারলো। শুধু কুসুমকুমারীর জন্য। এতখানি জীবনে এই প্ৰথম গঙ্গানারায়ণ একজনকে পেয়েছে, যার কাছে মন উজাড় করে দেওয়া যায়। যার সঙ্গে সব কিছু ভাগ করে নেওয়া যায়। সারাদিন গঙ্গানারায়ণ উৎসুক হয়ে থাকে, কখন রাত্রিকালে কুসুমকুমারীর সঙ্গে তার দেখা হবে। এখন গঙ্গানারায়ণ কুসুমকুমারীতে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত। যদিও তার বিবাহের পর তিনমাস কেটে গেছে, তবু এখনো গঙ্গানারায়ণের আদ্যরস হয়নি।

উকিল, মোক্তার ও খাজাঞ্চীদের সঙ্গে কথা সারিতে সারিতে এক একদিন অনেক রাত হয়ে যায়। ওপরে উঠে এসে শয়নকক্ষের দ্বার ঠেলে গঙ্গানারায়ণ দেখতে পায়, মেঝের ওপরেই উপুড় হয়ে শুয়ে কুসুমকুমারী সেজবাতির আলোয় কোনো বই পড়ছে। বইখানির আকার দেখেই সে বুঝেছে সেটি কোন বই। গঙ্গানারায়ণ একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। এই তন্ময় পাঠিকাকে সে বিঘ্নিত করতে চায় না। তবু নারীগণের সহজাত প্ৰবৃত্তিতেই কুসুমকুমারী অল্প সময়ের মধ্যেই অপরের উপস্থিতি টের পায়, সে ধড়মড় করে উঠে বসে।

গঙ্গানারায়ণ নিয়ম করেছে যে রাত্রির আহার সে নিজের শয়নকক্ষেই সেরে নেবে। রাত্রে সে ভাত বা আমিষ কিছুই খায় না, চিঁড়ে-মুড়ি-ফল-দুধ দিয়ে হালকা ভোজন সেরে নেয়। হিমালয়ের ক্রোড়ে কিছুদিন অবস্থান করার পর থেকেই আমিষ আহারে তার রুচি চলে গেছে। নেহাত কেউ পেড়াপোড়ি করলেই সে দু-এক টুকরো মাছ বা মাংস মুখে তোলে। যেমন কুর্তা পাতলুন সে পরতেই চায় না।

গঙ্গানারায়ণকে দেখে কুসুমকুমারী বই মুড়ে রেখে উঠে আসে। দাসীদের ডাকে না, সে নিজেই গঙ্গানারায়ণের খাবার পরিবেশন করে। মেঝেতে গালিচার আসন পেতে সামনে একটু জল ছিটিয়ে দিয়ে সেখানে রূপোর থালাটি রাখে। জল ভরে আনে রূপের গেলাসে। থালায় সাজানো বিশেষ কোনো প্রকার সন্দেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে কুসুমকুমারী জিজ্ঞেস করে, এগুলো মা নিজে তৈরি করে পাটিয়েচেন। আপনাকে আর দুটো দিই?

গঙ্গানারায়ণ হাসে। কুসুমকুমারীর মা প্ৰত্যেক দিন কিছু না কিছু খাদ্যব্যঞ্জন হাতে তৈরি করে এখানে পাঠান। গঙ্গানারায়ণ ভাবে, দেখা যাক, এরকম কদিন চলে

গঙ্গানারায়ণের আহার শেষ হলে তারপর কুসুমকুমারী খেতে যাবে। প্রথম প্রথম গঙ্গানারায়ণ ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে, তার ফিরতে দেরি হলে আগে খেয়ে নিতে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কোনো এয়োস্ত্রীকেই নাকি স্বামীর আগে অন্নগ্ৰহণ করতে নেই। গঙ্গানারায়ণ বলেছিল, হালফিল তো অনেক নিয়ম পালটাচ্ছে, এটা পালটাতে পারে না? কুসুমকুমারী তার উত্তর দিয়েছিল, যে-সব নিয়ম ভালো, সেগুলো তো পালটাবার দরকার নেই!

কুসুমকুমারীর এই ধরনের কথা শুনেই গঙ্গানারায়ণ বেশী মুগ্ধ হয়। যে-কোনো বিষয়েই কুসুমকুমারীর পরিষ্কার স্পষ্ট মতামত আছে। সে মনের কথা মুখের ভাষায় প্রকাশ করতে জানে। গঙ্গানারায়ণের মনে পড়ে লীলাবতীর কথা। শুধু লীলাবতী কেন, অধিকাংশ রমণীই তো নিছক ঘরোয়া কথা ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কিছু বলতেই জানে না। প্রথা-বিরুদ্ধ কোনো প্রসঙ্গ ওঠালেই, ওমা, সে কি! দিয়ে কাজ সারে।

খাওয়া শেষ করে হাত-মুখ প্রক্ষালন করে এসে গঙ্গানারায়ণ কুসুমকুমারীর বইটি খুলে বসলো। কুসুমকুমারী আহার সেরে ফিরে এলে সে বললে, তুমি তো অনেকখানি পড়ে ফেলেচে। কেমন লাগচে?

কুসুমকুমারী উৎফুল্ল মুখে বললো, ভারি ভালো, একবার ধল্লে আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না!

—তুমি সব বুঝতে পারো? তোমার কোনোখানে খটোমটো লাগে না?

—একটুও না! মাঝে মধ্যে একটা দুটো কতার মানে জানি না বটে। তবু সব বুঝতে পারি। আমি আগে কাশীদাসী পড়িচিলুম, কিন্তু তার সঙ্গে কত তফাৎ!

–সত্যি, আমাদের ছোট্‌কু এই একটা মস্ত বড় কাজ কচ্চে! কতই বা বয়েস ওর। আমার চেয়ে অন্তত তোর-চোদ্দ বছরের ছোট, এই বয়েসেই গোটা মহাভারত অনুবাদের কাজ হাতে নেওয়া-কেমন সুন্দর ভাষা-আমাদের এই বংশে ছোট্‌কু একটা প্রতিভা। ওর সঙ্গে তোমার ভালো করে আলাপ-পরিচয় হয়েছে?

নীল চক্ষু দুটি স্থিরভাবে মেলে, ওষ্ঠধরে সামান্য হাসি মেখে, আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে কুসুমকুমারী বলে, না। তবে আগে দেকিচি, আমার মিতেনীর বর হিসেবে—

গঙ্গানারায়ণ বললো, ও খুব ব্যস্ত, তবে আলাপ-পরিচয় তো হবেই, তখন দেকো, ও কেমন পাগল! সব সময় বড় কোনো কাজের চিন্তা মাতার মধ্যে টগবগ করে ফোটে!

মহাভারতের মোট তিনটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। তা কয়েকদিনের মধ্যেই কুসুমকুমারীর পড়া হয়ে যায়। আরও পড়বার জন্য সে ছটফট করে। এ বাড়িতে এসে অফুরন্ত অবসরের মধ্যে তার বই পড়ার নেশা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু অত বাংলা বই সে পাবেই বা কোথায়!

এক রাতে গঙ্গানারায়ণ ফিরলে কুসুমকুমারী জিজ্ঞেস করে, আপনাকে একটা কতা বলবো? আপনি রাগ করবেন না?

গঙ্গানারায়ণ অবাক হয়ে গেল, কী কতা? তোমার ওপর রাগ করবো কেন,কুসুম? তোমার ওপর রাগ কত্তে পারে এমন পাষণ্ড কেউ আচে?

আপনি সারাদিন খেটে খুটে আসেন, তাই বলতে সাহস পাই না। এক একদিন একটু তাড়াতাড়ি এসে আমায় একটু পড়াবেন? আমি তো সংস্কৃত পড়তে পারি না, যদি আমায় পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দেন।

গঙ্গানারায়ণের শরীরে অকস্মাৎ রোমাঞ্চ হয়। স্বপ্নে দেখা বিন্দুবাসিনীর কথা মনে পড়ে। বিন্দুবাসিনী অভিমান করে বলেছিল, তুই আমায় মেঘদূত পড়াবি বলিচিলি, পড়ালি না তো, গঙ্গা! এ যেন অবিকল সেই কণ্ঠস্বর!

গঙ্গানারায়ণ একটুক্ষণ থেমে থেকে তারপর আপন মনে বলতে শুরু করে : কশ্চিৎ কাস্তাবিরহগুরুণা/স্বাধিকারপ্ৰমত্তঃ/ শাপেনস্তংগমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেন ভর্তুং–তারপর ষষ্ঠ শ্লোকের শেষে যাঞ্চা মোঘা বরামধিগুণে নধমে লব্ধকামা-এই পর্যন্ত বলে সে থামে। শ্লোক বলতে বলতে গঙ্গানারায়ণ যেন অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে আবার ফিরে আসে। তারপর বললো, আমার অনেক কাল থেকেই ইচ্ছে, কারুকে মেঘদূত পড়ে শোনাই-তুমি আজ বললে, এসো, কুসুম, আমার পাশে এসে বসো, তোমায় আমি মেঘদূত পড়াবো।

কুসুমকুমারী বললো, মেঘদূত কী? এ বইয়ের নাম তো শুনিনি কখনো। আমার খুব ইচ্ছে করে শকুন্তলা বইটা পড়বার—।

গঙ্গানারায়ণ একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, শকুন্তলা? হঠাৎ শকুন্তলা পড়বার জন্য ইচ্ছে হলো কেন? মেঘদূত পছন্দ নয়?

কুসুমকুমারী হেসে বললো, আমি কি ছাই কোনোটাই জানি! ছেলেবেলায় আমার দাদাদের পোন মশাইয়ের মুকে শকুন্তলার গপ্পোটা শুনিচিলুম, তাও পুরোটা নয়-সেই গপ্পোটা জানতে ইচ্ছে করে। মেঘদূতের তো আমি নামই জানি না!

একটু থেমে থেকে গঙ্গানারায়ণ বললো, তবু প্রথমে মেঘদূতটাই শোনো। শকুন্তলার কতা পরে একদিন বলা যাবে।

মেঘদূত গঙ্গানারায়ণের আগাগোড়া কণ্ঠস্থ। তার বই লাগে না। ফুঁ দিয়ে সে সেজবাতিটা নিবিয়ে দিলে তৎক্ষণাৎ এক ঝলক জ্যোৎস্না এসে পড়ে ঘরের মধ্যে। কুসুমকুমারীর হাত ধরে সে নিয়ে আসে গবাক্ষের ধারে। শরৎকাল, এ সময় আকাশে কাশফুল বর্ণের লঘু মেঘ ভেসে বেড়ায়। সেই রকম একখণ্ড মেঘ দেখিয়ে গঙ্গানারায়ণ বললো, ঐ দ্যাকো মেঘদূত যাচ্ছে।–তুমি মহাভারতে নল দময়ন্তীর গল্প পড়েছে? একটি হংস হয়েছিল ওদের দূত-তেমনি রামগিরি পাহাড়ে এক নির্বাসিত যক্ষ সুদূর অলকায় তার প্রিয়াকে একটি বার্তা পাঠাবার জন্য একখণ্ড মেঘকে দূত হিসেবে নিয়োগ করেছিল।

কুসুমকুমারী জিজ্ঞেস করলো, রামগিরি কোথায়?

গঙ্গানারায়ণ বললো, তোমার মতন সকলেরই এ প্রশ্ন মনে আসবে বলে কবি কালিদাস প্রথম শ্লোকেই সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন-জনকতনয়াস্নানপুণ্যোদকেষু। স্নিগ্ধছায়াতরুষু বসতিং–জনকতনয়া মানে সীতা। বনবাসের সময় রাম আর সীতা এই রামগিরিতে ছিলেন কিছুদিন, এখানকার জলে সীতা স্নান করেছিলেন বলে তাঁর অঙ্গস্পর্শে জল পবিত্ৰা-এইখানেই সেই যক্ষ

—ঐ যক্ষের নাম কী?

—এটাই আর একটা মজা। কালিদাস তাঁর এই কাব্যের নায়কের কোনো নাম দেননি। অর্থাৎ এ যেন জগতের সমস্ত বিরহী মানুষেরই মনের কথা। ধরো, আমি যদি কোনোদিন খুব দূরে চলে যাই, আমায় যদি কেউ নিবাসন দেয়, তখন আমিও তোমার কতা ভেবে এমনভাবেই বিলাপ কর্বো।

—তারপর বলুন।

—আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুং–সেই অভিশপ্ত যক্ষ আটমাস নিবাসনে কাটিয়েচে, দুঃখে-বিরহে রোগ হয়ে গ্যাচে সে, হাত থেকে বলয় খসে পড়ে যায়-এরই মধ্যে এলো আষাঢ় মাসের প্রথম দিন, যক্ষ দেখলে পর্বতের সানুদেশ আলিঙ্গন করে আচে একখণ্ড মেঘ, তার যেন মনে হলো এক পরিণত গজ বপ্রক্রিীড়া কচ্চে, অৰ্থাৎ এক খ্যাপাহাতিমেতে উঠেচে ভূমিখননের খেলায়…কী অপূর্ব সেই দৃশ্য! তখন সে মেঘকে ডেকে বললো…

—মেঘ কি মানুষের কতা শুনতে পায়?

—ঠিক মতো আকূতি দিয়ে ডাকলে নিশ্চয়ই শুনতে পাবে, যেমন এই যক্ষের ডাক শুনেছেল,-তা ছাড়া কবিও বলে দিয়েচেন, যারা কামার্ত, চেতন-অচেতনের প্রভেদ বোঝা তাদের কাচে। আশা করা যায়

গঙ্গানারায়ণ আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ছাতে? কেন! তোমার ভালো লাগচে না?

কুসুমকুমারী গঙ্গানারায়ণের বাহুতে গণ্ড ছুঁইয়ে বললো, ভীষণ ভালো লাগচে, এমন আমি কখনো শুনিনি, আপনি যদি এখন থেমে যান। আমি মরে যাবো।-চলুন ছাতে যাই, সেখেনে খোলা আকাশ, মাতার ওপর দিয়ে মেঘ উড়ে যাবে, সেখেনে বসে শুনতে আরও বেশী ভালো লাগবে।

রাত্রি নিশুতি, সারা বাড়ি নিস্তব্ধ, সকলেই ঘুমন্ত। খুব সস্তপণে শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো কুসুমকুমারী আর গঙ্গানারায়ণ। পা টিপে টিপে উঠে এলো ওপরের সিঁড়ি দিয়ে। যাতে কোনো শব্দ না হয় এমন সাবধানে খুললো দরজা। শরৎকালীন আকাশ থেকে অল্প অল্প শিশিরপাত হচ্ছে, ছাদ ঈষৎ ভিজে ভিজে, কিন্তু তা ওরা গ্রাহ্য করলো না। ছাদে কতকগুলি বৃহৎ মাটির জালায় জল ভরা থাকে, সেরকম একটা জালায় পিঠের ভর দিয়ে পাশাপাশি বসলো। ওরা দুজনে। আজকের রাত্রিটিও বড় উপযুক্ত, কোমল, মিহিন সু-পবন বইছে।

চোখ আকাশের দিকে তুলে তদগতভাবে গঙ্গানারায়ণ বললো, কোথাও নদীর তীরে তীরে চাঁপা ফুল ফুটে উঠচে-কোথাও দাবাগ্নিতে বন পুড়ে গিয়েচিল, হে মেঘ, তোমার বর্ষণে সেখানকার মাটি থেকে মধুর গন্ধ উঠচে। আর সেই গন্ধ শুকতে শুকতে ছুটে যাবে চিত্রল হরিণ…।

সম্পূর্ণ পূর্বমেঘ সমাপ্ত করে গঙ্গানারায়ণ চুপ করলো।

কুসুমকুমারী বললো, থামলেন কেন?

গঙ্গানারায়ণ বললো, আজ এই পর্যন্ত থাক। উত্তরমেঘ তোমায় কাল শোনাবো। খুব ভালো জিনিস একদিনে বেশী গ্ৰহণ কত্তে নেই…যেমন ধরো মধু, এক সঙ্গে যদি বেশী পান করো, কষ্ট হবে।

—আমার কিন্তু এখন ছাত থেকে যেতে ইচ্ছে কচ্চে না।

—এসো, এখানেই বসে থাকি।

—যদি সারা রাত থাকতে চাই, থাকবেন?

—পাগল মেয়ে, তুমি যদি থাকতে পারো, আমি পারবো না?

—আমার ভীষণ ভালো লাগচে, এত ভালো, যেন কষ্ট হচ্ছে বুকের মধ্যে, এমন সুন্দর দিন আমার জীবনে কখনো আসেনি। দেকুন আকাশের দিকে, মনে হচ্চে না চাঁদ যেন ঠিক আমাদের দুজনকেই দেকাচে?

—আমাদের দুজনকে নয়, শুধু তোমাকে। চাঁদ তোমায় হিংসে কচে!

—তা তো হিংসে হতেই পারে। চাঁদ বড় একা।

বেশ কিছুক্ষণ ওরা চুপ করে বসে রইলো এরপর। জাগ্ৰত মানুষের মন কখনো থেমে থাকে না, ওদের চিন্তার স্রোত প্রবাহিত হতে লাগলো দুদিকে।

এক সময় গঙ্গানারায়ণ পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করলো, কুসুম, তুমি একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারো? এই যে মানুষের জীবন, এর উদ্দেশ্য কী?

কুসুমকুমারী বললো, জানি না তো, কখনো ভাবিও নি।

গঙ্গানারায়ণ বললো, এই কতটা আমার এখন প্রায়ই মনে হয়। এই জগৎ সংসারের একজন পরম পিতা আচেন, একদিন তাঁর পায়ের কাচে যখন যাবো, তিনি শুধোবেন, মানুষের জীবন পেয়েছিলে, সে জীবন চরিতার্থ করে এসোচো তো? তখন কি উত্তর দেবো?

—আমি সামান্য মেয়ে, আপনি আমাকে এ কথা জিজ্ঞেস কচ্চেন?

—তুমি সামান্য হবে কেন, কুসুম! তোমারও মন আচে—।

—জীবনের উদ্দেশ্য কী তা আমি জানি না। আসুন আজ থেকে আমরা দুজনে মিলে খুঁজি-এর উত্তর খোঁজবার জন্য আপনি একলা একলা আমায় ছেড়ে কোতাও চলে যাবেন না কতা দিন। প্রশ্নটা শুনে প্রথমটায় যেন ভয় করে উঠলো, কিন্তু আর ভয় পাবো না, আমিও খুঁজবো, আমায় সাহায্য কৰ্বেন, বলুন?

—কতা দিলুম, কুসুম।

কুসুমকুমারী গঙ্গানারায়ণের পায়ে হাত রাখলো। সেই মৃদু জ্যোৎস্নালোকে গঙ্গানারায়ণ দেখলো এই নীলনয়না, স্নিগ্ধ, কোমল, কুমুদিনীর মতন মুখের মেয়েটি বিন্দুবাসিনী নয়, এ অন্য নারী, এর নিজস্ব চরিত্রপ্ৰভায় আর অন্য কারুর কথা মনে পড়ায় না।

গঙ্গানারায়ণ উঠে দাঁড়াতেই কুসুমকুমারী বললো, আপনি চলে যাচ্চেন? এই যে বললেন—

গঙ্গানারায়ণ দু হাত বাড়িয়ে বললো, এসো—।

কুসুমকুমারীও উঠে দাঁড়ালো এবং গঙ্গানারায়ণের আহ্বানে বক্ষলগ্ন হলো। গঙ্গানারায়ণ তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে বললো, জীবনের উদ্দেশ্য যাই হোক, মানুষের একাকিত্ব বড় সাংঘাতিক। আমি অনেকদিন বড় একা ছিলুম গো, কুসুম, এখন থেকে তুমি আমার সেই শূন্যতা সম্পূর্ণ ভরিয়ে দাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *