2 of 2

৫৪. টেলিফোন রেখে মণিদীপা

টেলিফোন রেখে মণিদীপা মেসেজটার দিকে তাকাল। কিছুই তেমন বুঝল না। কতকগুলো ব্যবসায়িক সংকেতবার্তা মাত্র। তবু আনমনে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কাগজটা সে ঠিক দেখছে না, অন্য কথা ভাবছে। বেশ কিছুকাল আগে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে গিয়ে অনেক টাকা ছড়িয়ে পড়েছিল মেঝেয়। দীপনাথ সেগুলো নিচু হয়ে কুড়িয়ে দিচ্ছে। মাথা নিচু লোকটাকে দেখে সেদিন তার মনে হয়েছিল, লোকটার ব্যাকবোন নেই। আজও তাই মনে হয়। লোকটা পাহাড় ভালবাসে। একদিন বলেছিল খুব উঁচু একটা পাহাড়ে একদিন একা গিয়ে উঠবে। আর ফিরবে না। দীপনাথ এখন সেইসব উঁচু পাহাড়ের খুব কাছাকাছি। যদি না ফেরে?

বেয়ারাকে ডেকে মেসেজটা বোসের শোওয়ার ঘরে পাঠিয়ে দেয় মণিদীপা। বলে দেয়, সাহেব এলে মেসেজটার কথা বোলো।

নিষ্কর্মা বসে থাকতে বা কিছু নিয়ে ভাবতে মণিদীপা ভালবাসেনা। বড্ড একঘেয়ে যাচ্ছে ক’দিন। তেলের দাম আর এক দফা বাড়ল। ফলে গাড়ি নিয়ে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছে বোস। গাড়ির চাবি নিজের স্টিলের আলমারিতে রেখেছে। জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে টাকা রাখছে না। এসব হচ্ছে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। মণিদীপা মার্কেটিং-এ যায় না বহুদিন। গাড়ি চালিয়ে বেড়ায় না প্রায় মাস দুই। ড্রাইভিং ভুলেই গেল বুঝি। কিন্তু এ নিয়ে বোসের সঙ্গে কথা বলতে রুচি হয় না। বললেই ঝগড়া লাগবে। আজকাল তাদের ঝগড়া বড় বেশি কুৎসিত পর্যায়ে চলে যায়। রেগে গেলে মণিদীপার ঝোড়ো মগজ থেকে যেসব কথা বেরোয় তা স্বাভাবিক অবস্থায় সে চিন্তা করতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য, ঝগড়ার সময় ঠিক কথাগুলো জিভে চলে আসে।

রোজ ভাবে, এবার চলে যাব। আজ বা কাল। কিন্তু যাই-যাই করলেও মণিদীপার যাওয়ার জায়গা নেই। বাপের বাড়ির কথা সে ভাবতেই পারে না। নির্যাতিত এবং অবসরপ্রাপ্ত রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তার বাবা খুব সামান্য একটা ভাতা পায় পার্টি থেকে। বাড়িতে দু’খানা ঘর ভরতি তার ভাইবোন। একবেলা খাবার জুটলে অন্য বেলা জুটতে চায় না। এক দাদা মোটামুটি ভাল চাকরি করে। সংসারের হাঁ-মুখ দেখে সে মানে মানে নিজের বউ বাচ্চা নিয়ে অন্য জায়গায় সরে পড়েছে।

ছিল স্নিগ্ধদেব। সব জুড়ে ছিল তার। বিশ্বাস ছিল, সব আশ্রয় ছিন্ন হলে স্নিগ্ধদেব এগিয়ে আসবে ঠিক। বুদ্ধিমান ও সাহসী স্নিগ্ধদেবের অনেক গুণ। তবে সবচেয়ে বড় ছিল তার হৃদয়। ভারী নরম সুন্দর মানুষ।

দাঁতে দাঁত ঘষছিল মণিদীপা, অথচ চোখ ফেটে যাচ্ছে জলের তোড়ে। রাগ, একমাত্র পাগলা রাগটাকে খুঁচিয়ে তুললে তবেই এই ভাবাবেগের বৃথা কান্নাকে আটকানো যাবে।

দীপা!

ডাক শুনে মণিদীপা জানালার কাছ থেকে মুখটা সামান্য ফেরাল। তার চুলের গুছি মুখটাকে আড়াল করেছে। বুনু তার চোখের জল দেখতে পাবে না। মুখে কিছু বলল না সে।

চ্যাটার্জি আর কিছু বলেনি?

বুনো থেকে বুনু। এই নামে বিয়ের পর বেশ কিছুদিন স্বামীকে ডেকেছে মণিদীপা। তখন বন্য বরাহের মতোই প্রেম নিবেদন করত বুনু। মণিদীপা বোসের লম্বা থলথলে অপদার্থ চেহারা আর চরিত্রহীন মুখের দিকে চেয়ে বলল, না।

যদি কাল আবার ফোন করে—

কাল আমি বাড়ি থাকব না।—ঝেঁঝে ওঠে মণিদীপা।

ওঃ, দেন ইটস্ অলরাইট।

বোস চলে গেলে মণিদীপা খাবার ঘরে এল। বোস আজকাল প্রায়ই রাতে বাড়িতে কিছু খায়। তাই টেবিলে সাজিয়ে গুছিয়ে খাবার দেওয়া নেই। ঢাকনা খুলে মণিদীপা চিংড়ির ঝোল আর ভাত নিজেই নিয়ে একা বসে খেল, ছড়াল। পাতের দিকে তাকিয়ে তার একটু ভয় হল, এই ভাতের অভাবে সে কখনও কষ্ট পাবে না তো!

এর চেয়ে চাকরি করলে কি সুখী হওয়া যেত? বোধহয় না। মণিদীপা ওই বাঁধা দশটা-পাঁচটার কাজ করতে পারত না কিছুতেই। তবে?

তবে নিয়ে ভাবতে ভাবতে শোওয়ার ঘরে এল সে। নিজস্ব কাঠের আলমারি খুলে শাড়ি ব্লাউজ উলেন টেনে হিঁচড়ে ফেলতে লাগল মেঝেয়। কোথাও কোনও খাঁজে কোণে যদি কিছু টাকা খুঁজে পাওয়া যায়।

পেল কিছু। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ টাকাও নয়। এতে কী হবে?

আই মাস্ট সেল সামথিং। আই মাস্ট সেল।—বলে দাঁত দাঁত পিষে বিয়েতে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া ট্রাংকটা খুলল সে। ট্রাংকটা এ বাড়ির পক্ষে খুবই বেমানান। তার রং গোলাপি এবং ডালায় একটু রঙিন নকশা। তবে মজবুত বলে মণিদীপা এর মধ্যে গয়না রাখে।

গয়না বলতে বাপের বাড়ি থেকে কিছুই প্রায় পায়নি সে। তার ওপর সোনার গয়নায় একটা ঘেন্না ছিল বলে তো বিয়ের পরও তেমন কিছু করায়নি। গয়না একে সেকেলে, তার ওপর গয়না রাখার অর্থ সোনা হোর্ডিং। আজ গয়নার কাঠের বাক্সটা বের করে সে কিন্তু হতাশ হল। দুটো বাউটি, চারগাছা চুড়ি, একটা পাতলা হালকা নেকলেস। বিয়েতে একছড়া হার দিয়েছিল শাশুড়ি, তাতে কিছু সোনা আছে। তবু সব মিলিয়ে সাত-আট ভরির বেশি নয়।

গয়নার ওপর এক বিন্দু মায়া নেই মণিদীপার। তবু আজ বাক্সটা খুলে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। চেয়ে দেখল, এই তার শেষ সম্বল।

বোসের সঙ্গে আপস করতে হবে নাকি? ঘেন্না করে যে! চলে যাবে? কিন্তু কোথায়?

এই কোথায় প্রশ্নটা আজকাল বিশাল হয়ে ডানা মেলে পথ আটকায়।

বুনুর কাছে বোধহয় আর টাকা চাওয়া যায় না। যায়? মাসের প্রথমে বুনু আজকাল তাকে চারশো টাকা হাতখরচা দেয়। তার বেশি দেওয়ার উপায় নেই, বলে দিয়েছে। চাইলে হয়তো দেবে, কিন্তু অপমান করবে। এখন একটুও অপমান সইতে পারবে না সে।

দীপনাথ বাগডোগরায় নিচু হয়ে টাকা কুড়োচ্ছে—দৃশ্যটা আবার দেখতে পেল সে। দীপনাথের সেই হাজার টাকার ঋণ আজও শশাধ করতে পারেনি বুনু। তা নিয়ে তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথাও কম হয়নি। অধস্তন কর্মচারী এবং প্রায় তার দয়ায় মানুষ একজন লোকের কাছে অধমর্ণ থাকাটা বুনুর কাছে এক বিরাট প্রেস্টিজের প্রশ্ন।

মণিদীপা গয়নার বাক্স বালিশের পাশে নিয়ে এল।

সকালে উঠে খানিকটা ভাবল সে, গয়না বেচতে লোকে কোথায় যায়? একবার বাপের বাড়িতে গেলে হয়। তার মা গয়না, ঘটি বাটি বেচে অভ্যস্ত, ঠিক গাইড করতে পারবে। কিন্তু সেইসঙ্গে প্রশ্ন উঠবে, মেয়ে কেন গয়না বেচছে?

থাক, অন্য কিছু ভাবাই ভাল।

এই সংসারে তার তেমন কোনও ইনভলভমেন্ট নেই। সে রাধে না, ঘর গোছায় না, আয়-ব্যয়ের হিসেব দেখে না, বোস সাহেবের প্রতিও তার কোনও ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব নেই। যেমন তার প্রতি নেই বোস সাহেবেরও। বোস সকালে চা খায়, দাড়ি কামায়, স্নান করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে অফিসে চলে যায়। তার মধ্যে মণিদীপার ভুমিকা কী-ই বা হতে পারে। কোনও কাজের জন্য অনুমতিরও দরকার নেই তার। তবু আজ সকালে সে বুনুর ওপর নজর রাখল। গয়না বিক্রির ব্যাপারটা ওর টের পাওয়া উচিত নয়। টের কোনওদিন যে পাবে না তাও জানে মণিদীপা। গয়নার খোঁজই ও রাখে না। তবু নতুন ধরনের এই কাজটা করতে গিয়ে বুনুর কথাই বারবার ভাবছে সে।

বোস অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল মণিদীপা। বাস-ট্রামে এখনও ভিড়, এখনও ট্যাক্সি সুলভ নয়।

বেরোল এগারোটা নাগাদ।

কোথায় গয়না বিক্রি হয় তা জানে না। ট্যাক্সি নিয়ে তাই সে এল অঞ্জুর কাছে।

বহুকাল দেখা নেই। দেখা হতে যে অঞ্জু খুব খুশি হল তাও নয়। অঞ্জু এখন খুবই ব্যস্ত মানুষ। বসন্ত রায় রোডে নিজেদের বাড়ির একতলায় প্রথমে একটা মেয়েদের বিউটি পার্লার খুলেছিল। সেটা তেমন চলছিল না। এখন সে দোকান তুলে দিয়ে মেয়েদের দর্জির দোকান দিয়েছে। রমরম করে চলছে।

আজও কাউন্টারে কঁচি হাতে দাঁড়িয়ে চশমা চোখে খুব মন দিয়ে কী কাটছিল একটা সবুজ সিল্কের কাপড় থেকে। ব্লাউজ বা জিনসের মাপ কিংবা ডেলিভারি নিতে কম করেও এই দুপুরে সাত-আট জন ছুঁড়ি থেকে বুড়ি অপেক্ষা করছে। তিনজন কর্মী মহিলা হিমশিম।

অঞ্জু ফর্সা মোটাসোটা এবং বেশ সুন্দরী। ব্যস্ত অঞ্জু প্রথমটায় প্রায় চিনতেই পারল না। ভ্রু কুঁচকে একটু তাকিয়ে থেকে অনেকটা সময়ের ফাঁক দিয়ে বলল, ওঃ তুমি! কী খবর?

একদম ড্যাম্প গলা, উত্তাপ নেই। চোখ নামিয়ে কাজ করতে করতে বলল, কাটার পালিয়েছে, বুঝলে! যা দেমাক না আজকাল কাটারদের! এত মাইনে দিই তবু হুটহাট কিছু না বলে-কয়ে ঠিক পালিয়ে যাবে। রাইভ্যাল কনসার্নরা ভাগিয়ে নেয়।

তুমি তো আগে দর্জির কাজ জানতে না অঞ্জু!

ঠিকই তো। কবে শেখার সময় হল বলো! ভেবেছিলাম মাইনে করা লোক দিয়েই ব্যাবসা চলে যাবে। কিন্তু ভাল কাটারদের রাখা যে কী ঝামেলা! অর্ডারের তূপ জমে আছে, তার টিকির দেখা নেই। বহুকাল নাকাল হয়ে শেষে নিজেই শিখেছি প্রাণের দায়ে। এখন কারও পরোয়া করি না।

অঞ্জু ব্যস্ত, বিরক্ত, ক্লান্তও বোধহয়। কী করবে মণিদীপা ভেবে পাচ্ছিল না। বসারও জায়গা নেই। টুল বেঞ্চ সব ভর্তি। অঞ্জু ব্যাবসা করে, সুতরাং বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন, আর তাই তার কাছে আসা। একটু পরামর্শ দিতে পারত অঞ্জু। কোথায় গেলে গয়না বিক্রি করতে গিয়ে ঠকতে হবে না, তা বলে দিতে পারত।

বসবে? না কি অন দি ওয়ে?—অঞ্জু জিজ্ঞেস করে।

একটু দরকার ছিল।

আমার কাছে?

হু। কিন্তু তুমি তো ব্যস্ত।

ভীষণ। এ জন্মে আর বিশ্রাম নেই।

খুব রোজগার হচ্ছে তো?

হচ্ছে। খরচও আছে।

আহাঃ কী ই বা খরচ! দোকানের তো ভাড়া লাগে না।

ভাড়াটাই যা বাদ। ট্যাক্স আছে, মাইনে আছে, মেনটেনেন্স আছে। কর্তা তো কিছু দেখবে না। কেবল বলে দোকান তুলে দাও।

বলে বলুক। তুমি তুলে দিয়ো না। এই বেশ রমরমে একটা দোকানঘরে সারাদিন কাটাতে মজা আছে। বার করে না।

সেটাও ঠিক। কাজেরও আনন্দ আছে। আই ফিল ইম্পর্ট্যান্ট ড়ুয়িং সামথিং ফর আদারস অ্যান্ড ক্রিমেটিং অলসো। আমি একটা সামার ড্রেস ডিজাইন বের করছি, জানো? নিউ মার্কেটের কানহাইয়ালাল কন্ট্রাক্ট করে গেছে।

অনেক টাকার কন্ট্রাক্ট?

টাকাই তো সব নয়। দেয়ার ইজ অলসো এ প্লেজার। তবে কানহাইয়ালাল টাকাও ভালই দিচ্ছে।

তোমার হাজব্যান্ড কি এখন ম্যাকনিলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর?

না, দু’নম্বরে আছে। হয়ে যাবে শিগগিরই।

জানো তো, নকশালরা একসময়ে ঠিক করেছিল হাজব্যান্ড আর ওয়াইফদের একসঙ্গে রোজগার করা বন্ধ করে দেবে?

দেওয়ার রোম্যান্টিক ভ্যাগাবন্ডস। আমার হাজব্যান্ড মাসে দশ হাজার টাকা মাইনে পায় বলেই কি আমার কিছু করার নেই? শোনো কথা! আমিও তো মানুষ।

কথা থামিয়ে চারদিকে চেয়ে দেখছিল মণিদীপা। ভিতরে কাচের আলমারিতে বহু রকমের ড্রেস মেটিরিয়ালস সংগ্রহ করে রেখেছে অঞ্জু। কম করেও ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকার জিনিস। দু-দুটো এয়ারকুলার লাগানো। অবশ্য এখন শীতকাল বলে এগুলো চলছে না। কিন্তু সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘এয়ার কন্ডিশনড’। এতে কাজ দেয়, ইজ্জত বাড়ে।

বসবে?—অঞ্জু জিজ্ঞেস করে।

এখানে তো বসার জায়গা নেই।

ভিতরে এসো না! বলে নিজেই গিয়ে কাউন্টারের একপাশে পাটা উঠিয়ে ধরল, এসো।

ভিতরে গোটা চারেক গদিওলা উঁচু টুল। তার একটায় উঠে বসল মণিদীপা।

অঞ্জু বলল, একটু বোসো। হাতের কাজটা মেশিনে দিয়ে নিই।

তুমি কাজ করো না। আমি অপেক্ষা করছি। তাড়া নেই।

তোমার হাজব্যান্ডের কী খবর? গোয়িং আপ অ্যান্ড আপ?

হি ইজ অ্যামবিশাস।

পুরুষমানুষ মাত্রই জেলাস। মিসেসরা কিছু একটা করলেই তাদের গায়ে জ্বর আসে। অথচ নিজেরা! এক নম্বরের কেরিয়ারিস্ট।

তোমার হাজব্যান্ড একদম কো-অপারেট করেন না বুঝি?

না, তা করে। এমনকী ওর অফিসের বিগ বসদের মিসেসরা তো এখান থেকেই সব কিছু বানিয়ে নেয়। ও-ই ইন্ট্রোডিউস করে দিয়েছে। এমনিতে হি ইজ প্রাউড অফ মি। কিন্তু কেবল ন্যাগ করবে, আমার বাচ্চারা তাদের মাকে পাচ্ছে না, হাইসহোল্ড ঠিক মতো চলছে না এটসেটরা। সবচেয়ে বড় কথা হি ওয়ান্টস টু ডোমিনেট মি। আমার একটা সেপারেট পার্সোনালিটি গড়ে উঠুক এটা ও চায় না।

আর ইউ আনহ্যাপি?

অঞ্জু মন দিয়ে একটা সূক্ষ্ম কাটার কাজ সারতে গিয়ে সময় নিল। কিন্তু প্রশ্নটা কানে গেছে ঠিকই। কাপড়টা সরিয়ে রেখে কপাল থেকে চুল সরিয়ে ক্লান্ত মুখে একটু হেসে বলল, আনহ্যাপি কি না তা ভেবে দেখারও সময় পাই না। তবে ও আমাকে অপছন্দ করে না তো, আই অলসো অ্যাডোর হিম।

মণি, উই আর নট আনহ্যাপি।

এই দোকান থেকে তোমার নিশ্চয়ই অনেক রোজগার হয় অঞ্জু!

তৃপ্তমুখে অঞ্জু বলে, হয়।

কত বলো তো!

ইনকাম ট্যাক্সে বলে দেবে না তো! ভালই হয়। এ ফিউ থাউজ্যান্ডস পার, মান্থ।

ফিউ থাউজ্যান্ডস!—মণিদীপা অবাক চোখে চেয়ে থাকে।

আমি লাকি।

তুমি খুব পরিশ্রমীও।

কাজ করতে আমি ভালবাসি।

আমিও বাসি। কিন্তু কী করব ঠিক বুঝতে পারি না।

অঞ্জু পাশের টুলে বসে বলে, আমি বলি, ড়ু সামথিং। আজকালকার পুরুষরা জানো তো, ভীষণ অবিশ্বাসী। আজ তোমার কাছে ফেথফুল আছে, কালই হয়তো থাকবে না। চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, বোঝোই তো! তাই মেয়েদের একটা ফুটিং থাকা ভাল। তাতে অন্তত হাজব্যান্ডরা বুঝবে যে, বেশি ট্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করে লাভ হবে না। ইন ফ্যাক্ট আমার কর্তাটি একসময়ে আমার ওপর খুব হম্বিতম্বি করত। আজকাল সমঝে চলে। ভয়ও পায়।

আমি তোমার মতো লাকি নই, অঞ্জু।

দোকানের কর্মী একটি এসে নিচু গলায় কী পরামর্শ করে গেল। আর-একজনের ব্লাউজের মাপ খাতায় লিখে নিতে হল। টুকটাক এসব কাজ সেরে চশমাটা খুলে একটা টুকরো কাপড়ে মুছতে মুছতে অঞ্জু বলে, তোমার একটা পলিটিক্যাল লাইন ছিল না?

ছিল। এখন নেই।

বেঁচেছ। হায়ার পলিটিকসে পয়সা আছে, শৌখিন পলিটিকসে কিছু নেই। বরং ঘরের পয়সা বেরিয়ে যায়। তাছাড়া টেনশন, ফ্রাষ্ট্রেশন অ্যান্ড আদার হ্যাজার্ডস। তোমার বাবার কথাই ভেবে দেখো। লোয়ার পলিটিকস একদম নন-প্রোডাকটিভ। ড়ু সামথিং প্রোডাকটিভ। আর্ন মানি। লাইফ উইল বি ভেরি এনজয়েবল।

অঞ্জু, আই অ্যাম ইন মানি ট্রাবল!

কেন, তোমার হাজব্যান্ড?

ওর সন্দেহ আমি এক্সট্রাভ্যাগেন্ট। আজকাল টাকা কন্ট্রোল করছে। মাসে মাসে মাত্র চারশো টাকা হাতখরচ দিচ্ছে।

চারশো!–বলে প্রায় নাক সিঁটকোল অঞ্জ।

তুমিই বলো আমার এখন কী করা উচিত।

আর্ন মানি, আর্ন মানি!—অঞ্জু ছড়া কাটার মতো করে বলে।

মণিদীপার চোখ জ্বালা করে। বুকের ভিতরটাও জ্বলছে রাগে আর আকাঙক্ষায়! অঞ্জুর এত রবরবা, এত স্বাধীনতা, এত টাকা তার ভিতরে বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে, টালমাটাল করে দেয়।

অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, আগে তুমি খুব গরিবদের জন্য ভাবতে। আমি বলি কী, ভাবো তাতে ক্ষতি নেই। এমনকী গরিবদের জন্য কিছু করাও ভাল, আমিও তো রেগুলার কিছু দানধ্যান করি। রামকৃষ্ণ মিশন, একটা অনাথ আশ্রম আর একটা ব্লাইন্ড স্কুলে টাকা দিই। গরিবদের জন্য ফিল করা ভাল, কিন্তু গরিব হওয়া ভাল নয়। পভার্টি আমার দু চোখের বিষ।

মণিদীপা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে কথাটা সমর্থন করে। সে জানে, এটা খুব সত্যি। নইলে স্নিগ্ধদেব এত কিছু করে, এত দূর এগিয়ে, হাজার জনার চোখে বিপ্লবের কাজল পরিয়ে দিয়ে অবশেষে নিজেই কেন সরে পড়ে মার্কিন মুলুকে? আজ মণিদীপা তাই নেতৃত্বহীন, অস্থির, দ্বিধাগ্রস্থ।

অঞ্জু একটা সিনথেটিক কাপড় টেনে নিয়ে পটু হাতে দাগ দিয়ে দিয়ে কাটবার তোড়জোড় করছে।

মণিদীপা মৃদু স্বরে বলে, শোনো অঞ্জু, আমার খুব টাকার দরকার। আমি একটা হার বিক্রি করব।

বিক্রি করবে?—যেন এতটা বিশ্বাস করতে পারছে না এমনভাবে তাকায় অঞ্জু।

মণিদীপা একটু লজ্জা পায়, অহংকারেও লাগে। সে তাড়াতাড়ি বলল, অর্নামেন্টস তো পরি না। ঘরে রেখে কী লাভ বলো? প্রিমিটিভনেস।

সে তো ঠিকই। তবে সোনা একবার বিক্রি করলে আর কিন্তু কিনতে পারবে না। সোনার যা বাজার!

জানি। তবু করব। তোমার জানাশোনা স্যাকরা আছে?

আমি বহুকাল ওসব করাইনি। গয়না যা ছিল সব ব্যাংকের ভল্টে। তবে ভবানীপুরে অনেক দোকান আছে পুরনো গয়না কেনে।

তারা তো ঠকাবে।

চিন্তিত মুখে অঞ্জু বলে, অসম্ভব নয়। কিন্তু আমি যে কাউকে চিনি না।

প্রসঙ্গটা আর টানার মানে হয় না বলে মণিদীপা টানল না। কিছুক্ষণ অন্য কথাবার্তা বলে উঠে পড়ল। কিন্তু বুকে তীব্র দহন। মাথা ফেটে যাচ্ছে রাগে, ঈর্ষায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *