চোখে আলো পড়ায় শশিভূষণের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে তিনি বুঝতে পারলেন না এখন সকাল না বিকেল। তাঁর জাগরণ যেন আকস্মিক, আরও একটু ঘুমের প্রয়োজন ছিল। তিনি দেখলেন, একটি মেয়ে এই ঘরের জানলাগুলি একটার পর একটা খুলে দিচ্ছে। আলোয় ভরে গেল সারা ঘর। এক একটি জানলার আলোর পটভূমিকায় ভূমিসূতাকে মনে হচ্ছে রেখামূর্তি।
শশিভূষণের সারা শরীরে আলস্য। তিনি শয্যা ছেড়ে উঠলেন না। পাশের দেরাজের ওপর রাখা ঘড়ি দেখলেন, সকাল দশটা বেজে গেছে। শশিভূষণ সাধারণত উষালগ্নেই গাত্ৰোখান করেন, সাতটার মধ্যেই তাঁর প্রাতঃকৃত্য সারা হয়ে যায়। গত রাত্রে মহারাজ গান-বাজনার আসর বসিয়েছিলেন, তা শেষ হয়েছে তৃতীয় প্রহরে। রাত্রি জাগরণে মহারাজের ক্লান্তি নেই, তিনি সত্যিকারের সঙ্গীতপিপাসু, কিন্তু শশিভূষণ মাঝে মাঝে ঘুমে ঢুলে পড়ছিলেন। যদুভট্ট দেহত্যাগ করেছেন, কলকাতা থেকে আর দু-একজন গায়ককে মহারাজ ত্রিপুরায় নিয়ে যেতে চান।
জানলাগুলো সব খুলে ভূমিসূতা নত নেত্রে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সদ্য ঘুম ভাঙার পর যুক্তিবোধ ঠিকমতন কাজ করে না। কিসে যেন শশিভূষণের একটা খটকা লাগছে। অন্য দিন তো তিনি ভূমিসূতার একটার পর একটা জানলা খোলার দৃশ্য দেখতে পান না! এবার মনে পড়ল, অন্য দিন তাঁর ঘরের জানলা বন্ধই থাকে না, জানলা খুলে ঘুমোনোই তাঁর অভ্যেস। কাল রাতে জানলা বন্ধ ছিল কেন?
পালঙ্ক থেকে নেমে তিনি একটি জানলার কাছে দাঁড়ালেন। তার পরনে ধুতি ও ফতুয়া, চুলগুলি সব এলোমেলো, চোখের নীচে ঈষৎ ক্লান্তি। জানলার কাছে একটু একটু জল জমে আছে, বাইরে তাকিয়ে বোঝা গেল, শেষ রাতে বেশ জোর বৃষ্টি হয়ে গেছে। তা হলে বৃষ্টির সময় কেউ এসে তাঁর ঘরের জানলা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছিল। কে আবার, ভূমিসূতাই নিশ্চয়।
শশিভূষণের ইচ্ছে হল আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে। মহারাজও এখন ঘুমোবেন, এমন কিছু রাজকাৰ্য নেই আজ সকালে।
একটু পরে ভূমিসূতা একটা ট্রে-তে করে এক কাপ চা, দুখানি বিস্কুট ও আধ গেলাস চুনের জল নিয়ে এল। চুনের জল খেলে পেট ভাল থাকে, প্রতিদিন চায়ের আগে শশিভূষণ আধ গেলাস করে খান।
ট্রে-টি একটি টুলের ওপর নামিয়ে রেখে ভূমিসূতা মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আপনার স্নানের জল দিতে বলব?
শশিভূষণ বললেন, বেলায় স্নান করব। তাড়া নেই আজ।
ভূমিসূতা মাটির দিকে চেয়ে বলল, এগারোটার সময় আপনি উকিলবাবুর কাছে যাবেন বলেছিলেন?
সঙ্গে সঙ্গে শশিভূষণের সমস্ত শরীর সজাগ হয়ে উঠল। তাই তো, আজ এগারোটার সময় হাইকোর্টে যাওয়া নির্দিষ্ট হয়ে আছে, তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন একেবারে। ত্রিপুরা থেকে রাধারমণ জরুরি তার পাঠিয়েছেন এই মামলার ব্যাপারে।
ভূমিসূতা সব মনে রাখে। শশিভূষণের যাবতীয় প্রয়োজনের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখে সে। যে মেয়ে এত ভাল গান গায়, ঘরের কাজেও তার কোনও ভুল হয় না। বৃষ্টির জন্য সে জানলা বন্ধ করে গিয়েছিল, দশটার সময় শশিভূষণকে জাগাবার জন্যই সে জানলা খুলে দিয়েছে।
খালি একটাই ওর দোষ, ও কোনও কথাই বলতে চায় না। কিছু জিজ্ঞেস করলেও শুধু হ্যাঁ বা না বলে। ওর সঙ্গে গল্পগাছা করার কোনও উপায় নেই। মেয়েটি অদ্ভুত রকমের জেদি। মহারাজকে গান শোনাতে কিছুতেই রাজি হল না। অসুখের কথা বলে এতদিন এড়িয়ে গেলেও আর উপায় নেই। এবার ও আর মহারাজের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।
মনোমোহিনী আর এখানে থাকতে চায় না, ত্রিপুরার জন্য তার মন কেমন করছে। মহারাজ তাই ফেরার বন্দোবস্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ভূমিসূতাকে তিনি ভুলে যাননি, তাকে তিনি সঙ্গে নিয়ে যাবেন। শিয়রের কাছে বসে একটি নারী বৈষ্ণবপদাবলি গান শুনিয়ে তাঁকে ঘুম পাড়াবে। এই সাধটি দিন দিনই প্রবল হচ্ছে মহারাজের। তিনি শশিভূষণকে বলেছেন, ও মেয়েটি খুব অসুখে ভুগছে, ত্রিপুরায় গেলেই ঠিক হয়ে যাবে দেখো। ওকে আমি কয়েকদিনের জন্য জস্পুই পাঠিয়ে দেব। সেখানকার বাতাসে সব অসুখ সেরে যায়।
দ্রুত স্নান সেরে এসে শশিভূষণ দেখলেন, ভূমিসূতা তাঁর জন্য লুচি-মোহনভোগ সাজিয়ে রেখেছে।
সব কাজই এর নিখুঁত, কিন্তু এ মেয়ে কখনও কাছে দাঁড়িয়ে পরিবেশন করে না। যদি আর কিছু প্রয়োজন হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করে দরজার আড়ালে। শশিভূষণ যদি আর দুখানা লুচি খেতে চান, তা হলে সে কথা উচ্চারণ করার আগেই ভূমিসূতা কী করে যেন টের পেয়ে নিঃশব্দে এসে আরও কিছু লুচি রেখে যাবে। এই নীরবতার জন্যই তার প্রতি কৌতূহল দিন দিন বাড়তেই থাকে।
দরজার দিকে তাকিয়ে শশিভূষণ বললেন, তোমাকে দু-একদিনের মধ্যেই ত্রিপুরা যেতে হবে। তুমি তৈরি হও।
তারপর কাগজপত্র গুছিয়ে শশিভূষণ বাইরে এসে ঘোড়ার গাড়িতে চাপলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁর বুক দূরদূর করতে লাগল। হাইকোর্টে দেখা করতে হবে প্রখ্যাত ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, লোকের মুখে মুখে তাঁর নাম ডবলু সি বোনার্জি। তিনি নাকি পাক্কা সাহেব, তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আদব-কায়দায় কিছু ভুল হয়ে যাবে না কে জানে!
অবশ্য এই ব্যারিস্টারটি সম্পর্কে আরও কিছু কিছু খবর সংগ্রহ করেছে শশিভূষণ। তা যেন অনেকটা পরস্পরবিরোধী। ইনি খুব বেশি সাহেবমনস্ক, ইংরিজি বুলি ছাড়া কথা বলেন না, ওঁর স্ত্রী খ্রিস্টান হয়েছেন, কিন্তু নিজে ধর্মান্তরিত হননি। সব সময় ইংরেজদের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করলেও ইনি ভারতীয় সমাজের পক্ষ নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে অনেক দাবি পেশ করেন। গত বছর বোম্বাইতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামে কী একটা সভা হয়েছিল, সেখানে ইনিই ছিলেন সভাপতি।
হাইকোর্ট সংলগ্ন উমেশচন্দ্রের চেম্বারে পাঁচেক লোক বসে আছে। কোনও বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক করছে, বড় একটা টেবিলের ওপাশে বসে উমেশচন্দ্ৰ মিটিমিটি হাসছেন। তাঁর চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর বয়েস, থ্রি পিস সুট পরা, মাঝখানে সিঁথি করে মাথার চুল আঁচড়ানো, চোখে রিমলেস চশমা। শশিভূষণ পৌঁছলেন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় এগারোটার সময়, উমেশচন্দ্র তাকে দেখে চোখের ইঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। অন্য যারা উপস্থিত তারা কেউই মক্কেল নয়, ব্যারিস্টার সাহেবের বন্ধুস্থানীয়। আজ আদালতের ছুটির দিন, উমেশচন্দ্ৰও যেন ছুটির মেজাজে আছেন, তিনি তর্কটা থামাতে চাইলেন না।
তৰ্কটা প্রধানত চলছে জানকীনাথ ঘোষাল ও অতুল সেনের মধ্যে, অন্যরা টিপ্পনি কাটছেন। একটুক্ষণ শুনে শশিভূষণ বুঝলেন, বিষয়টা মোটেই রাজনৈতিক নয়, বিবাহ ব্যবস্থা সম্পর্কে। তেজেশচন্দ্ৰ গাঙ্গুলি নামে একজন বিলাত ফেরত ডাক্তার সম্প্রতি একটি নার্সকে বিয়ে করেছেন, তাই নিয়ে সোরগোল পড়ে গেছে। সেই নার্সটি জাতিতে শূদ্র। কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গে শূদ্রের বিবাহ সম্পর্ক হলে সমাজ রসাতলে যাবে, এই অনেকের ধারণা। জানকীনাথ প্রবলভাবে এ বিবাহকে সমৰ্থন করছেন। তাঁর নিজের বিয়ের সময় গণ্ডগোল হয়েছিল, তিনি ঠাকুরবাড়ির মেয়ে বিয়ে করেছিলেন, ঠাকুররা একে পিরিলি তায় ব্ৰাহ্ম, নারায়ণ শিলা মানে না, তাই জানকীনাথের বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। ইন্ডিয়ান মিররের সম্পাদক নরেন সেন তাঁর পক্ষ নিয়ে বললেন, এই বৰ্ণভেদ প্ৰথাই ভারতের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এখন বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ চালু হওয়া অবশ্যই উচিত।
অন্য একজন বিদ্রূপ করে বললেন, ওই যে গাঙ্গুলি ডাক্তারটা একটা শুদ্দুর মেয়েকে বিয়ে করেছে, তা কি সমাজ সংস্কারের জন্য? মোটেই না। এর মধ্যে একটা নির্লজ্জতা প্রকাশ পেয়েছে, তা বুঝতে পারছি না। আগে থেকেই ডাক্তারের সঙ্গে ওই নার্সের আশনাই হয়েছিল, তারপর নিজেরাই বিয়ে ঠিক করেছে।
জানকীনাথ বললেন, এর মধ্যে দোষের কী আছে? বিলেতেও তো বিবাহের পূর্বে কোর্টশিপ হয়।
অন্যজন বললেন, রাখো, রাখো। এ দেশটা বিলাত নয়। আমাদের দেশে যদি বিয়ের আগে নারী-পুরুষে মেলামেশা শুরু হয়ে যায় তাহলে নীতি-ধর্ম বলে আর কিছু থাকবে না।
সবাই হেসে উঠলেন। জানকীনাথ বললেন, মেয়েদের এখন আমরা লেখাপড়া শেখাতে স্কুলে পাঠাচ্ছি, তারা আর অন্তঃপুরে আবদ্ধ নয়, এখনও কি নারী-পুরুষে মেলামেশা আটকানো যাবে? যে কালের যে নিয়ম!
নরেন সেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, না, আটকানো যাবে না। তবে কি জানো ভায়া, আমাদের বয়েস হয়ে গেছে, আমরা আর ওই সুযোগটা পেলাম না!
শশিভূষণকে অবাক করে দিয়ে উমেশচন্দ্ৰ খাটি বাংলায় বললেন, অনেক কথা তো শুনলাম, এবার আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করি। ইংরেজ তনয়ারা কি শূদ্র না বামুন? এখন তো কেউ কেউ মেম বিয়ে করে আনছে, সে বেলায় তো কোনও প্রতিবাদ শুনি না। কবি মধুসূদন দত্ত যে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে নিয়ে এতদিন ঘর করে গেলেন, তার তো জল অচল হয়নি। অনেক মাথা মাথা লোক তাঁর বাড়িতে গিয়ে খানা খেয়েছে! সংস্কৃতে একটা কথা আছে, স্ত্রী রত্নং দুষ্কুলাদপি। তা দুষ্কুল থেকে যদি স্ত্রী রত্ন আনা যায়, শূদ্ররা কী দোষ করল?
জানকীনাথ বললেন, হিয়ার হিয়ার! উমেশচন্দ্র ঠিক রায় দিয়ে দিয়েছেন। প্রণয়ের ব্যাপারে জাতপাতের প্রশ্ন তোলা অবান্তর।
বিরুদ্ধপক্ষীয় ব্যক্তিটি বললেন, উঁহু, উমেশ বললেই মানব কেন? সে তো হাকিম নয়, সে শুধু সওয়াল করতে পারে।
উমেশচন্দ্ৰ এবার শশিভূষণের দিকে চেয়ে বললেন, আমাদের এখানে ত্রিপুরার রাজপরিবারের এক প্রতিনিধি উপস্থিত আছেন। তাঁর কাছ থেকেই শোনা যাক, ত্রিপুরায় বিবাহের ব্যাপারে এরকম শুচিবাই আছে কি না।
ত্রিপুরার রাজবংশের নাম শুনে সবাই কথা থামিয়ে সসম্ভ্রমে শশিভূষণের দিকে তাকালেন। শশিভূষণ বেশ সঙ্কুচিত বোধ করলেন, এঁরা নিশ্চয়ই তাঁকে রাজপুত্র-টুত্র ভেবে বসেছেন।
তিনি বিনীতভাবে বললেন, আজ্ঞে আমি কলকাতারই এক কায়স্থবাড়ির সন্তান। চাকরি সূত্রে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত। তবে ত্রিপুরায় কয়েক বছর থেকে দেখেছি। ওখানে সাধারণভাবে বিয়ের ব্যাপারে জাতপাতের চুলচেরা বিচার হয় না। তবে অনেক উপজাতীয় বিভাগ আছে বটে।
এর পর অল্পক্ষণের মধ্যেই আড্ডা ভেঙে গেল। অন্যরা বিদায় নিলে উমেশচন্দ্র মামলার ব্রিফ বুঝে নিতে লাগলেন। ত্রিপুরায় একটি চা-বাগানের ইজারা নিয়ে একটি ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে জটিল মামলা, অনেকখানি সময় লাগল।
সেখান থেকে বেরিয়ে শশিভূষণ কিছু কেনাকাটি করলেন। মহারাজ বীরচন্দ্ৰ সদলবলে ফিরবেন, ছবি আঁকার রঙ-তুলি থেকে শুরু করে পিস্তলের গুলি পর্যন্ত অনেক কিছুই তাঁর সঙ্গে যাবে। বাইরের লোকদের ধারণা, পয়সা থাকলে কলকাতা শহরে সব কিছুই মেলে, এমন কি বাঘের দুধ পর্যন্ত। মহারাজ বায়না ধরেছেন, তিনি গোটাকতক চাতক পাখি চান, বেশ কয়েকটি পশু-পাখির বাজার ঘুরেও সে পাখি পাওয়া গেল না।
একবার ভবানীপুরে নিজের বাড়ি ঘুরে শশিভূষণ ফিরে এলেন সন্ধের সময়। আজ কবিতার আসর বসবে, কয়েকজন কবিকে আমন্ত্রণ জানান হয়েছে, তারা এখনও এসে পৌঁছননি। শশিভূষণ মহারাজের সঙ্গে দেখা করে সারা দিনের ঘটনাবলি নিবেদন করলেন। মহারাজ জানালেন যে তিনি এক পুরোহিতকে ডেকে আলোচনা করেছেন, আর পাঁচদিন পর, আগামী মঙ্গলবার যাত্রা শুভ, সুতরাং আরও কয়েকটি দিন থাকতে হবে। মঙ্গলবারই তিনি ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে রওনা হতে চান।
নিজের কক্ষে এসে শশিভূষণ পোশাক পরিবর্তন করলেন। আজ আবার বৃষ্টি হবে মনে হয়, গুমোট গরম, এক আঁজলা বাতাসও নেই। শশিভূষণ জানলার কাছে এসে দাঁড়ালেন। মহারাজ চলে গেলে এ বাড়ি নিরিবিলি হয়ে যাবে, তখন শশিভূষণ মন দিয়ে কিছু কাজ করতে পারবেন। মহারাজ বীরচন্দ্ৰ বকাবকি করেন না বটে, তবু রাজ সন্নিধানে কিছুটা তটস্থ হয়ে থাকতেই হয়।
মঙ্গলবারের পর ভূমিসূতাও আর এখানে থাকবে না। মহারাজ তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। একবার ত্রিপুরায় গেলে রাজবাড়ির অন্তঃপুরে হারিয়ে যাবে, আর তাকে কোনওদিন দেখা যাবে না।
শশিভূষণ ক্ষুধা বোধ করছেন, এই সময় তাঁকে কিছু জলখাবার দেওয়া হয়। তিনি যে ফিরে এসেছেন, তা কি ভূমিসূতা টের পায়নি?
ভেতরের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে তিনি দুবার ভূমি, ভূমি বলে ডাকলেন। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। তিনি নিচে নেমে এলেন।
ভূমিসূতার ঘরের দরজার একটি পাল্লা খোলা। ভেতর থেকে ভেসে আসছে চাপা গলার গান।
শশিভষূণ বেশ কয়েকবার ভূমিসূতার কাছে গান শুনতে চেয়েছেন। সে চুপ করে থেকেছে শুধু। মহারাজকে সে গান শোনাবে না, শশিভূষণকেও শোনাতে তার আপত্তি কিসের?
শশিভূষণ দরজার পাশ দিয়ে উঁকি মারলেন। ভেতরের দৃশ্যটি দেখেই তাঁর বুক কেঁপে উঠল। ঘরের মধ্যে রয়েছে দুটি নারী। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছে রানী মনোমোহিনী, কোনও আসন পর্যন্ত পাতা নেই, স্রেফ মেঝেতে, পা দুটি ছড়ানো, এক হাতে রয়েছে তেঁতুলের আচার জাতীয় কিছু, সেটা জিভ দিয়ে চাটছে মাঝে মাঝে, কিন্তু দু চোখে গভীর মনোযোগ। তার একটু দূরেই হাঁটু মুড়ে বসেছে ভূমিসূতা। সে গান গাইছে দুলে দুলে, অনেকটা যেন শেখানোর ভঙ্গিতে, একটি লাইনই গাইছেন বারবার।
এই দৃশ্যটি শশিভূষণকে চুম্বকের মতন টানলেও তিনি সেখানে দাঁড়াতে পারলেন না। সরে গেলেন দূরে। রানী মনোমোহিনীকে এভাবে দেখা তার পক্ষে বেয়াদপি।
কিশোরী রানীটিরও কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। তার পর্দানশীলা থাকার কথা, সে চলে এসেছে দাস-দাসীদের মহলে? ভূমিসূতার ক্রমাগত অসুখের কথা শুনে সে আর কৌতূহল দমন করতে পারেনি, দেখতে এসেছে নিজের চক্ষে।
ভূমিসূতাই বা কোন আক্কেলে তাকে গান শোনাতে গেল! অসুস্থতার ভান করে শুয়ে থাকতে পারত না? এখন যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মনোমোহিনী গিয়ে মহারাজকে বলে দেবে যে ভূমিসূতার কোনও অসুখ নেই। শশিভূষণই মিথ্যেবাদী বলে প্রমাণিত হবেন। তা হলে কি ভূমিসূতা ত্রিপুরায় যাওয়ার জন্য ব্যগ্ৰ? স্বেচ্ছায় সে রাজার রক্ষিতা হতে চায়! কিছুটা সূক্ষ্ম অভিমানে শশিভূষণের বুক ভরে গেল।
ওপরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন শশিভূষণ।
খানিক বাদে একটা পিরিচে কয়েকখানি তিলকুটো ও চন্দ্রপুলি আর এক গেলাস জল নিয়ে এল ভূমিসুতো। শশিভূষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভূমিসূতা নিজের থেকে কোনও কথাই বলবে না। জিনিসগুলো রেখে ভূমিসূতা যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন শশিভূষণ ঈষৎ গম্ভীর গলায় বললেন, ত্রিপুরায় রওনা দিতে হবে মঙ্গলবার। মহারাজ বলেছেন, তোমার যদি শাড়ি-টাড়ই কিছু লাগে, তা কিনে দেওয়া যাবে।
ভূমিসূতা এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে শশিভূষণের দিকে চেয়ে রইল।
ভূমিসূতা যেভাবে শাড়ি পরে, তাতে পায়ের পাতা ঢাকা পড়ে না, হাঁটুর খানিকটা নীচে পর্যন্ত নেমে আসে। বুকে অন্তর্বাস নেই, কিন্তু আঁচলটি যেন দু-তিনটি পাক দেওয়া, তাতেই ঊর্ধ্বাঙ্গের সম্পূর্ণ আবরণ হয়ে যায়। চুলে আলগা খোঁপা, চোখের পাতায় যেন কিসের মায়া লেগে আছে।
শশিভূষণ ফটোগ্রাফার, তাঁর চোখে ভূমিসূতার এক-একটা ভঙ্গি যেন ছবির মতন মনে হয়। সে নির্বাক বলেই যেন তার ভঙ্গিগুলিতে আরও বেশি ছবি-ছবি ভাব আসে।
শশিভূষণ আবার বললেন, তোমার কখানা শাড়ি লাগবে? মহারাজের কাছাকাছি থাকতে হলে সবসময় সেজেগুজে থাকতে হয়। মুর্শিদাবাদি সিল্ক মহারাজের পছন্দ, কয়েকখানা নিয়ে আসব, তুমি পছন্দ করে নিও।
ভূমিসূতা এবার আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে বলল, আমার শাড়ির দরকার নেই। আমি ত্রিপুরা যাব না।
শশিভূষণ ভ্ৰকুঞ্চিত করে বললেন, যাবে না মানে? রানী জেনে গেলেন, তুমি সুস্থ। আর কি ছুতো দেখাবে? তোমার জেদের জন্য আমিই মাঝখান থেকে মিথ্যেবাদী হলাম। যাও, সেখানে তুমি সুখে থাকবে।
ভূমিসূতা আবার বলল, আমি যাব না। মহারানীকে আমি দু-তিনটি গান শিখিয়ে দিচ্ছি, তিনি মহারাজকে শোনাবেন।
শশিভূষণ হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারলেন না। এ কী পাগলের মতন কথা! মহারাজ তো অন্য কারুর গলায় ও গান শুনতে চাননি, তিনি ভূমিসূতাকেই চেয়েছেন। ভূমিসূতাকে নিজের শয্যাসঙ্গিনী করে রাত্ৰিবোলা গান শুনবেন। তা ছাড়া, মনোমোহিনীর কণ্ঠে গান? যে মেয়ে গান শুনতে শুনতে আচার খায়, তার দ্বারা কেমন গান হবে? বৈষ্ণবপদাবলি গান কি দুচার দিনে শেখা যায়?
এত কথা না বলে শশিভূষণ শুধু বললেন, মহারাজের ইচ্ছে হলে তার ওপর না বলা যায় না। মহারাজ তোমাকেই চান।
ভূমিসূতা বলল, আমি চাই না।
শশিভূষণ বললেন, মহারাজকে কী বলে বোঝাব? তিনি যদি জোর-জবরদস্তি নাও করেন, তা হলেও তো এর পর আর তোমার এ বাড়িতে স্থান হবে না। মহারাজের চাকরি করে আমিও তোমাকে ভবানীপুরের বাড়িতে আশ্রয় দিতে পারব না। তা হলে তুমি কোথায় যাবে?
ভূমিসূতা উদাসীন সুরে বলল, জানি না।
হঠাৎ শশিভূষণের স্মৃতি থেকে একটা দৃশ্য উঠে এল। সেই যে বারে তাঁর কঠিন অসুখ হয়েছিল, সিঁড়ি দিয়ে তিন পড়ে গেলেন, কেউ তাঁকে দেখতে পায়নি, সেখানে তিনি কতক্ষণ পড়ে থাকতেন কে জানে, তাঁর কণ্ঠরোধ হয়ে গিয়েছিল, একেবারে অজ্ঞান হবার শেষ মুহূর্তে তিনি একটি নারীর মুখ দেখতে পেয়েছিলেন, তাঁর চোখের সামনে ঝুঁকে আছে, এই সেই মুখ। তারপর আর একদিন শেষ রাতে, রোগযন্ত্রণায় তিনি ছটফট করছিলেন, ফিসফিসিয়ে বলছিলেন, জল, জল, সে ডাক কারুর শুনতে পাওয়ার কথা নয়, তবু তিনি দেখতে পেলেন একটি মুখ, সেই নারী তাঁকে জল পান করাল। এই সেই মুখ।
শশিভূষণের জীবনের দুটি সঙ্কট মুহূর্তে ভূমিসূতা এসে দেখা দিয়েছিল। সেই ভূমিসূতাকে তিনি মহারাজ বীরচন্দ্রের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছিলেন? ছিঃ ছি. ছি. ছি, এমন একটা ভুলের জন্য সারা জীবন তাঁকে আফসোস করতে হত। বরং এই ভুলটা সংশোধন করে শশিভূষণ নিজের জীবনটাকেই বদলে ফেলতে পারেন এবার!
তিনি মিথ্যেই সন্দেহ করেছিলেন যে ভূমিসূতা বুঝি ত্রিপুরায় যাওয়ার জন্য নিজেই আগ্রহী। কী সরল দৃঢ়তার সঙ্গে সে বলছে, যাব না। এর পর আর কোনও কথাই চলে না।
বিদ্যুৎ চমকের মতন শশিভূষণ সহসা এ সমস্যা সমাধানের একটা উপায়ও পেয়ে গেলেন। তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। লোকে পরের দাসত্ব করে অর্থের জন্য শশিভূষণের তো অর্থাভাব নেই। তিনি ত্রিপুরায় চাকরি করতে গিয়েছিলেন অনেকটাই শখে। চাকরি ছেড়ে দিলে মহারাজ আর তাঁর ওপর জোর করতে পারবেন না। তিনি ভূমিসূতাকে নিয়ে চলে যাবেন। কোথায় যাবেন? না, ভবানীপুরের বাড়িতে নয়, শশিভূষণ ওকে বিয়ে করে স্ত্রীর সম্মান দেবেন, সংসার পাতাবেন পৃথকভাবে। ও মেয়ে দাসীর কাজ করুক বা যা-ই করুক, মুখখানি দেখলেই বোঝা যায়, ও পবিত্র। ওর কী জাত তা তিনি জানতে চাইবেন না। আজ সকালবেলা ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেম্বারে যে সব কথাবার্তা শুনেছেন, তা মনে পড়ে গেল। শশিভূষণ এ ভাবে বিবাহ করলে অনেকে আপত্তি জানাবে, তাঁর পরিবারের লোকেরা যে ঘোর প্রতিবাদ করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি কলকাতার বিদ্বজন-সমাজের সমর্থন পাবেন।
ভূমিসূতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কয়েক মিনিটের মধ্যে শশিভূষণের নতুন উপলব্ধি হল, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। ভূমিসূতাকে তিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবেন, সে উপহার পাবে একটি নিজস্ব সংসার। ভূমিসূতাকে ছেড়ে তিনি থাকতে পারবেন না।
বিছানা থেকে নেমে এসে তিনি আবেগভরা কণ্ঠে বললেন, ভূমি, তোমার কোনও ভয় নেই। আমি তোমার মনের প্রকৃত ইচ্ছেটা জানতে চাইছিলাম। শুধু। তোমাকে ত্রিপুরায় কেউ জোর করে নিয়ে যেতে পারবে না। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। তোমার জন্য আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি, ভূমি! কাল-পরশুই একটা বাসা খুঁজে নিয়ে আমরা চলে যাব, আমরা দুজনে সংসার পাতব?
ভূমিসূতা চমকে উঠে বিস্ফারিতভাবে তাকাল। শশিভূষণের এই আকস্মিক পরিবর্তন যেন সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
শশিভূষণ বললেন, এর মধ্যে পাপের কিছু নেই। আমি তোমাকে যোগ্য সম্মান দেব। ইংরেজ সরকার আইন পাস করেছে, রেজিস্ট্রি বিবাহে কোনও বাধা নেই। আমরা ইচ্ছে করলে চন্দননগরে ফরাসি রাজত্বে গিয়ে কিছুদিন থাকতে পারি। কিংবা তুমি যদি চাও তো উড়িষ্যা… কটকে কিংবা জগন্নাথধামে আমরা ঘর বাঁধব।
ভূমিসূতা এবারেও কোনও কথা বলতে পারল না।
শশিভূষণ বললেন, আঃ মুক্তি, মুক্তি! কেনই বা আমি এতদিন চাকরি করছিলাম? আমার জীবনটা শুষ্ক হয়ে ছিল, ভূমি! নারী জাতির প্রতিই আমার কোনও টান ছিল না। কিন্তু তুমি আমার জীবনে একেশ্বরী হয়ে থাকবে। তুমি আমায় গান শোনাবে, তোমার হাতের সেবায় আমার শরীর জুড়োবে। আমি তোমাকে লেখাপড়া শেখাব। আমার ইচ্ছে আছে, একটা বিদ্যায়তন খুলব। অপদাৰ্থ রাজকুমারদের নয়, গরিবঘরের ছেলেদের সেখানে নতুন রকমের শিক্ষা দেব, তুমি আমাকে সাহায্য করবে অন্তরাল থেকে। ছুটির সময় আমরা দেশবিদেশে বেড়াতে যাব। যেখানে তুমি চাও… তুমি এখনও কোনও কথা বলছি না কেন, ভূমি?
ভূমিসূতা এবারে দু হাতে মুখ চাপা দিল। আঙুলের ফাঁক দিয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ল অশ্রু। কান্নায় কম্পিত হতে লাগল তার তনু।