৫৩. স্বর্ণকুমারী ভারতী পত্রিকার ভার নিয়ে

স্বর্ণকুমারী ‘ভারতী’ পত্রিকার ভার নিয়ে পত্রিকার চরিত্রটাই বদলে দিলেন অনেকখানি। তিনি ব্যক্তিত্বময়ী রমণী, অপরের কথা শুনে চলার পাত্রী নন। আগে দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রশ্রয়ে রবি নিজেই নানারকম রচনায় এই পত্রিকার অনেকগুলি পৃষ্ঠা ভরিয়ে দিত। অন্তরালবাসিনী হয়েও কাদম্বরীই ছিলেন এই পত্রিকার প্রধান চালিকাশক্তি, আর তাঁর প্রিয়তম লেখক রবি। এখন ভারতীয় পৃষ্ঠার রবির লেখা ক্রমশই কমে আসছে। স্বর্ণকুমারীর বাড়িতেও সাহিত্যের আড্ডা বসে, রবি সেখানে যায় মাঝে মধ্যে। সে সূক্ষ্মভাবে অনুভব করে, তার সাহিত্যপ্রতিভা সম্পর্কে তার দিদির যেন খুব একটা আস্থা নেই। দিদিই সব আলোচনার মধ্যমণি হয়ে থাকতে চান।

সে বাড়িতে সাহিত্যিক পরিমণ্ডল ছাড়াও খানিকটা রাজনৈতিক আবহাওয়া টের পাওয়া যায়। জানকীনাথ ঘোষাল স্ত্রীর সব রকম উদ্যোগে সাহায্য করে যান, এ ছাড়া তিনি কিছু কিছু রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ব্যাপারে খুব উৎসাহী। বোম্বাইতে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে যোগদান করতে গিয়েছিলেন।

কংগ্রেস নামটা এখন কারুর কারুর মুখে শোনা যাচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা যে ঠিক কী বস্তু সে সম্পর্কে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই।

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কারারুদ্ধ করার পর ছাত্র বিক্ষোভ যেভাবে ফেটে পড়েছিল তার জের এখনও থামেনি। পত্র-পত্রিকায় ও বিভিন্ন জনসভায় সরকারি নীতি এবং ইংরেজ রাজপুরুষদের ক্ষমতার অপব্যবহারের সমালোচনা হয় প্রায়ই। সুরেন্দ্রনাথ এবং আনন্দমোহন বসু ছাত্রদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়, ছাত্ররা এঁদের নেতৃত্বে আরও বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার জন্য ফুঁসছে। সুরেন্দ্রনাথ সারা ভারতে ঘুরে ঘুরে অন্যান্য প্রদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে লাগলেন, ছোট ছোট সভায় জনমত সংগঠনেরও চেষ্টা চলতে লাগল। কলকাতায় মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংস্থা আছে, সেটাকে তিনি কাজে লাগাতে চান। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন নামে জমিদার ও ব্যবসায়ী শ্রেণীরও একটি সংগঠন আছে, মুসলমানদের আছে সেন্ট্রাল মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন। সুরেন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, এই সব দলকে একসঙ্গে মেলাতে না পারলে জাতীয়বাদ দৃঢ় হতে পারে না। সব দলগুলি একত্র সঙ্ঘবদ্ধ হলেই ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়বে।

এই উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ বছর তিনেক আগে কলকাতায় একটি জাতীয় মহাসভা বা ন্যাশনাল কনফারেন্সের আয়োজন করেছিলেন। গত বছর আরও বড় আকারে তিনি সেই ন্যাশনাল কনফারেন্সে বসাবার আয়োজন করছিলেন। এখানে, এর মধ্যে একটি কাণ্ড ঘটে গেল।

মাদ্রাজে থিয়োসফিস্টদের একটা বড় আখড়া আছে। এই থিয়োসফিস্টদের মধ্যে ভারত-প্রেমিক এবং ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা অনেক। এদের মধ্যে একজন হলেন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত ভারত সরকারের সচিব অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম। তিনি অনেকদিন ধরেই এ দেশে আছেন, তিনি ভারতীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল বটেন, তবে প্রায়ই সিপাহি বিদ্রোহের দুঃস্বপ্ন দেখেন। তাঁর ধারণা, হঠাৎ যে কোনওদিন ভারতে আবার একটা গণ-বিদ্রোহ ফেটে পড়বে। এ দেশে এখন শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে, এবারে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেবে শিক্ষিতরাই। সুতরাং শিক্ষিত যুব-সম্প্রদায়ের মন অন্য দিকে ফেরানো দরকার। হিউম ভাবলেন, যদি সৰ্বভারতীয় একটা সংগঠন করা যায়, যেখানে ভারতীয় সমাজের নেতারা তাদের অভাব-অভিযোগের কথা ব্যক্ত করবেন, সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করবেন, সরকারও সহৃদয়ভাবে বিবেচনা করে কিছু কিছু ব্যাপারে অন্তত শাসনের মুঠি শিথিল করেন, তা হলে উভয় পক্ষেরই মঙ্গল।

হিউম তার এই প্ৰস্তাবটি থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির এক বার্ষিক সম্মেলনে উত্থাপন করলেন। অধিকাংশের সম্মতিতে ঠিক হল যে সে বছরই পুনায় একটা সৰ্বভারতীয় সম্মেলন হবে। হিউম অবশ্য গোপনে গোপনে এই প্রস্তাবটি নিয়ে সর্বোচ্চ ইংরেজ শাসক মহলের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। কেউ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কেউ কেউ সন্দেহের চোখে দেখেছে, কেউ বলেছে চেষ্টা করে দেখতে পার, আবার কেউ বলেছে, ওই হিউম লোকটার মাথায় ছিট আছে!

যাই হোক, পুনরায় সম্মেলনের প্রস্তুতি চলতে লাগল, হিউম কলকাতায় এলেন বাংলার নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বাংলায় যিনি সবচেয়ে পরিচিত রাজনৈতিক নেতা, যিনি একই উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল কনফারেন্সের আহবান করেছেন, সেই সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে হিউম দেখাই করলেন না। তিনি পরামর্শ করে গেলেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন সেন, মনোমোহন মোষের সঙ্গে। জানকীনাথ ঘোষাল থিয়োসফিস্টদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেই সূত্রে তিনিও সব জানলেন।

কংগ্রেসের জন্মলগ্নেই দলাদলির ইঙ্গিত আছে। সুরেন্দ্রনাথ একদিন দক্ষিণ ভারতের হিন্দু পত্রিকা পড়ে জানলেন যে পুনরায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়ন নামে একটি সর্বভারতীয় সম্মেলন হচ্ছে। তিনি বা আনন্দমোহন নিমন্ত্রিত তো ননই, সময়টাও এমন যে রবাহূত হয়েও তাঁরা সেখানে যোগ দিতে পারবেন না। কারণ সুরেন্দ্রনাথ কলকাতায় ওই একই সময়ে ন্যাশনাল কনফারেন্সের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন আগে থেকেই। সেটা পরিত্যাগ করে তারা যাবেন কী করে? বিভেদের রেখা স্পষ্ট। যেন মনে হয়, সুরেন্দ্রনাথের মতন সে সব নেতা আগে থেকেই ইংরেজ সরকারের রোষাভাজন, পুনার সম্মেলন তাদের এড়িয়ে যেতে চায়।

সম্মেলনটি অবশ্য শেষ পর্যন্ত পুনায় হল না, হঠাৎ সেখানে কলেরা শুরু হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে সম্মেলনের স্থান বদলানো হল বোম্বাইতে। গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজের এই সমাবেশে প্রতিনিধির সংখ্যা ৭২, এঁদের মধ্যে দু’জন মাত্র মুসলমান। হিউম এই সম্মেলনের নাম দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়ন, প্রতিনিধিরা তা বদলে রাখলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস, হিউমের প্রস্তাবে সভাপতি করা হল ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।ঠিক হল, বছরে একবার এই কংগ্রেসের অধিবেশন বসবে ভারতের কোনও শহরে।

এ বছর দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হচ্ছে কলকাতায়। দূরদর্শী সুরেন্দ্রনাথ বুঝলেন যে এখন উপদলীয় কোন্দল কিংবা নেতৃত্বের লড়াইয়ের সময় নয়। বোম্বাই কংগ্রেসে যে-সব প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে তা তাঁর ন্যাশনাল কনফারেন্সেরই অনুরূপ। বোম্বাইতে যে-সব প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন, তারা অধিকাংশই মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের। উদ্দেশ্যের যখন মিল আছে, তখন ভাগাভাগি করা মুর্খতা। বরং বোম্বাই-মাদ্রাজের নেতাদের সঙ্গে বাঙালিরাও মিলিত হলে সংগঠন অনেক শক্তিশালী হবে। বোম্বাইতে যে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তা নিয়ে তিনি কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না। সদলবলে কলকাতার কংগ্রেসে যোগ দিতে রাজি হয়ে গেলেন।

জামাইবাবুর কাছ থেকে রবি এসব শোনে কিন্তু নিজে এই সব সভায় যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ বোধ করে না। তার মনে হয়, সবটাই যেন কথার ফুলঝুরি, উচ্চ ইংরেজি শিক্ষিতদের বাকচাতুর্যই প্রধান হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর যোগ কোথায়? সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা শুধু ইংল্যান্ডে নয়, একযোগে ভারতেও অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত এবং পরীক্ষার্থীদের বয়েস বাড়াতে হবে, কংগ্রেসের এই অন্যতম দাবিতে দেশের অবস্থার কী হেরফের হবে? ইংরেজি শিক্ষিতের সংখ্যা যত বাড়ছে তাত চাকরি কমে যাচ্ছে, আরও চাকরি আদায়কে কেন্দ্র করেই যেন এখনকার রাজনীতি। সরকারের কাছে সব আবেদন বা দাবির মধ্যেই যেন ভিক্ষের সুর।

রবি অবশ্য কলকাতায় আসন্ন কংগ্রেসে অধিবেশনে গান গাইতে রাজি হয়েছে।

কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর তাতে যোগ দেওয়ার জন্য কয়েকজন নেতাগোছের লোক গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কাছে। সব শুনে সেই বৃদ্ধা সোজাসুজি একটা প্রশ্ন করলেন, বাপু হে, দেশের স্বাধীনতা পেতে গেলে শেষ পর্যন্ত যদি তলোয়ার ধরতে হয়, তোমরা রাজি আছ?

নেতারা তো-তো করতে লাগলেন। স্বাধীনতা, তলোয়ার.এসব কী? এ যে রাজদ্রোহমূলক কথাবার্তা।

বিদ্যাসাগর নেতাদের ওই অবস্থা দেখে বললেন, তা হলে আমাকে বাদ দিয়েই তোমরা এই কাজে এগোও! তারা চলে যাওয়ার পর বিদ্যাসাগর অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, বাবুরা কংগ্রেস করছেন, আস্ফালন করছেন, বক্তৃতা করছেন, ভারত উদ্ধার করছেন। দেশের হাজার তাজার লোক অনাহারে প্রতিদিন মরছে, সেদিকে কারও চোখ নেই। রাজনীতি নিয়ে কী হবে? যে দেশের লোক দলে দলে না-খেয়ে প্রত্যহ মরে যাচ্ছে, সে দেশে আবার রাজনীতি কী?

রবিও ইংরেজদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরার পক্ষপাতী নয় ; আয়ারল্যান্ডে ইংরেজরা যে অত্যাচার করছে তার প্রতিরোধ করার জন্য আইরিশরা বোমা-বন্দুক ব্যবহার করে, ইংরেজের ঘরে ডায়নামাইট পাঠায়। খ্রিস্টান সভ্যতার ভান করে যারা পশুবলের উপাসক, যারা অসহায়ের ওপর অকাতরে অত্যাচার চালায়, তাদের কড়া ধরনের মুষ্টিযোগ দেওয়াই দরকার। কিন্তু আইরিশরা যা পারে, ভারত তা পারে না। কারণ মুষ্টিযোগ্য চিকিৎসায় ভারতের বুৎপত্তি নেই। এ দেশের সব মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদা জ্ঞান জাগিয়ে তোলাই জাতির উন্নতির প্রকৃষ্ট উপায়। যার আত্মমর্যাদা জ্ঞান আছে, সে কখনও অন্যায় মেনে নেয় না।

এ দেশের মানুষের সেই আত্মমর্যাদাজ্ঞান জাগাবার জন্য যার যার নিজস্ব ক্ষেত্রে কাজ করে যেতে হবে। রবির মনে হয়, একজন লেখকের কাজ তার ভাষা ও সাহিত্যে উন্নতির জন্য এমনভাবে আত্মনিয়োগ করা, যাতে সাধারণ মানুষের কাছে সেই ভাষা ও সাহিত্য শ্রদ্ধা ও গর্বে বিষয় হয়ে উঠতে পারে।

রবি ইদানীং শুধু লেখা নিয়েই ব্যাপৃত থাকতে পারে না। ইচ্ছেমতন কবিতা, গদ্য ও নাটক রচনা এবং বন্ধুদের সঙ্গে সাহিত্য-বিষয়ক আড্ডাই তার সবচেয়ে প্রিয়, কিন্তু ব্ৰাহ্মসমাজের সম্পাদক হিসেবে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়, চুঁচড়োয় বাবার কাছে নির্দেশ নিতে যেতে হয় প্রায়ই। এই সব ঘোরাঘুরির সময় সাধারণ, দরিদ্র মানুষদের দিকেও তার চোখ পড়ে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কারের ভারে জর্জরিত মানুষদের মুখগুলি দেখে সে পীড়িত হয়। এ দেশে দুর্ভিক্ষ লেগেই আছে, কিছুদিন আগে বীরভূম-বাঁকুড়ায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়ে গেল, তখন রবি অনুভব করেছিল দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট ওই সব মানুষদের জন্য সমবেদনামূলক কবিতা রচনাই যথেষ্ট নয়। আগে মানুষগুলোকে বাঁচানো দরকার। রবি চাঁদা তোলার জন্য তৎপর হয়েছিল, ব্ৰাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে সাহায্য পাঠানো, ওদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য রবি আরও খানিকটা এগিয়েছিল। ঠাকুর পরিবারের নতুন একটা জমিদারি হয়েছে সুন্দরবন অঞ্চলে। এমনকি তাদের বাড়ি ঘর নির্মাণ ও কৃষির সরঞ্জামেরও ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। কিন্তু তাতে বিশেষ সাড়া পাওয়া গেল না। বাঙালিদের এমনই অদ্ভুত স্বভাব, তারা নিজের বাড়িতে থেকে না-খেয়ে মরবে, তবু দূরে কোথাও যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। বিপদ দমন করার প্রচেষ্টার বদলে নিশ্চেষ্ট মৃত্যুতেও তারা রাজি।

কাশিমবাজারে রানী স্বর্ণময়ী প্রতিদিন দু হাজার লোককে আহার দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু বাঁকুড়া-বীরভূম থেকে তেমন কেউ গেল না। তাদের পথ-খরচ দেওয়া হবে, তবু তারা ঘর ছেড়ে যাবে না।

দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে রবির এই প্রথম উপলব্ধি হল, ক্ষুধা কি সাঙ্ঘাতিক বস্তু। অন্যান্য অনেক বিপদ মানুষের মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলে, কিন্তু খিদেয় মনুষ্যত্ব দূর হয়ে যায়। খিদের সময় মানুষ যেন অত্যন্ত একটা ক্ষুদ্র প্রানী, প্রায় পিঁপড়ের মতন। এ মুষ্টি অন্নের জন্য মানুষ হন্যে হয়ে থাকে, সমস্ত মহৎ আশা, আদর্শ ধরাশায়ী হয়ে যায়, মানুষ তখন এমন দীন!

আরও একটি ব্যাপার রবির চোখে পড়ল। শহরের কত মানুষের বাড়িতে অন্ন উদ্বৃত্ত হয়। বিয়ে, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কত খাদ্যের অপচয় যে হয় তার ঠিক নেই, রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় বাসি ভাত, লুচি, মাংস, তখন ক্ষুধিত মানুষদের কথা এই সব শহরবাসীর মনে পড়ে না। আবার এই সব লোকেরাই রাজনীতি করতে গিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়, দেশের মানুষের দুঃখে কেঁদে বুক ভাসায়। রাজনীতির মধ্যে এত ভণ্ডামি থাকলে তাতে দেশের উপকার হবে কী করে? বিদ্যাসাগরমশাই তো ঠিকই বলেছেন!

জ্ঞান্দানন্দিনী ‘বালক’ নামে পত্রিকা বার করেছেন, এখন রবি সেই কাগজেই বেশি লেখে। বস্তুত আগে ‘ভারতী’র  জন্য যে-সব কর্তব্য পালন করতে হত, এখন রবিকে ‘বালক’ এর জন্য সে সবই করতে হয়। জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়িতেই সে সবচেয়ে স্বস্তি বোধ করে। তেরো বছর বয়স্ক বিবিও তাকে একদিনের জন্যও চোখের আড়াল করতে চায় না। বিবি নানারকম দৌরাত্ম্য করে তার এই রবিকার ওপর। যখন তখন সে রবির নাক টিপে দেয়, চিমটি কাটে, রবি অন্যদের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বললে বিবি পেছন থেকে এসে রবির গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ে। সুন্দর ডাগর চেহারা হয়েছে বিবির। কখনও সে মেমসাহেবদের মতন স্কার্ট পরে, কখনও শাড়ি। পড়াশুনোয় যেমন সে মেধাবিনী, তেমনি গানের গলা। রবিকে সে নানান আদরের নাম ধরে ডাকে। তার সবচেয়ে প্রিয় নাম বুজি। রবি কোনওদিন দেরি করে এলে বিবি দৌড়ে গিয়ে তার গলা জড়িয়ে বলতে থাকে, বুজি, বুজি, বুজি, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

সাহিত্য বিষয়ক সভা-সমিতিতে গেলে রবি প্রায়ই বিবিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। অপরাপর পুরুষরা মুগ্ধ বিস্ময়ে এই রূপসী কুমারীটিকে দেখে। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের এখন আর কম বয়েসে বিয়ে হয় না। স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা এনট্রান্স পাস করল, তার বিয়ের কথা চিন্তাই করা হয় না। আর এক দাদার মেয়ে প্রতিভা, রূপে-গুণে সর্বগুণান্বিতা, তার বয়েস কুড়ি পার হয়ে গেল। রবি অবশ্য তার বন্ধু, ব্যারিস্টার আশু চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিভার ঘটকালির চেষ্টা আছে।

বিবি আর রবির স্ত্রী মৃণালিনী প্রায় একই বয়েসী। কিন্তু মৃণালিনী তার সর্বক্ষণের সঙ্গিনী হতে পারে না। বাইরে বেরুবার ব্যাপারে কিছুতেই লাজুকতা কাটিয়ে উঠতে পারে না মৃণালিনী। বাইরের কেউ মৃণালিনীকে চেনে না। ঠাকুরবাড়ির অন্য সব কন্যা কিংবা বধূ বাইরে বেরিয়ে আসছে, অথচ স্ত্রী অন্তঃপুরিকা।

কলকাতার বাইরে কোথাও গেলে রবি সবচেয়ে বেশি চিঠি লেখে বিবিকে। মাঝে মাঝে কবিতা লিখেও বিবিকে উপহার দেয়। রাত্রে মৃণালিনী এবং দিনের বেলা বিবি, এই দুই কিশোরী যেন রবিকে তুলিয়ে রাখে। কাদম্বরীর কথা। তবু একেবারে কি ভোলা যায়? মাঝে মাঝে মুচড়ে ওঠে বুক,জ্বালা করে ওঠে চক্ষু। কবিতায় ঝিলিক দিয়ে যায় নতুন বউঠানের স্মৃতি। জোড়াসাঁকোর বাড়ির জ্যোতিদাদার সেই তিনতলার মহলের বন্ধ দ্বারের দিকে কখনও চোখ পড়লে দীর্ঘশ্বাস আসে। তবু রবি যেন ভুলতেই চায়। এক এক সময় তার মনে হয়, তিনতলার মহলের ওই দ্বার কেন চিরকাল বন্ধ থাকবে? জানলা দরজা সব খুলে দেওয়া হোক, ওখানে নতুন বাতাস আসুক!

রাজনারায়ণ বসু অসুস্থ শুনে রবি দেওঘরে তাঁকে দেখতে গেল। বৃদ্ধ রাজনারায়ণ রবির পিতার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। এই বয়েসেও তিনি রসের সাগর, সবসময় হাস্য-কৌতুকে মেতে থাকেন। সাদা ধপধপে দাড়ি নেড়ে নেড়ে যখন মজার গল্প বলেন, তখন সবাই হেসে গড়াগড়ি যায়।

রাজনারায়ণের কাছে তাঁর এককালের বন্ধু মাইকেল মধুসূদনের অনেক দুরন্তপনার গল্পও শুনেছে। রবি। মাইকেলের কবিতা রবি তেমন পছন্দ করে না বটে, তবে এই সব গল্প শুনতে ভাল লাগে। রাজনারায়ণের কাছেই রবি শুনেছে যে, শেষদিকে মাইকেলের সাহেবিপনা একেবারে ঘুচে গিয়েছিল, তিনি ঘোরতর বাঙালি হয়েছিলেন। কেউ তাঁকে সাহেব বললে তিনি বলতেন, ওহে ভায়া, নিজের শয়নকক্ষে বড় একটা আয়না রেখেছি, সেদিকে প্রতিদিন তাকাই আর গাত্রবর্ণটি দেখে বুঝতে পারি। হাজার চেষ্টা করলেও ইহজন্মে। আমি সাহেব হতে পারব না। আর একটি গল্পও বেশ মজার। মাইকেলের গায়ের রঙ বেশ কালো ছিল আর গলার আওয়াজ ছিল ভাঙা ভাঙা। তাই নিয়ে কেউ একদিন বিদ্রূপের খোঁচা মারতেই মাইকেল বলেছিলেন, তবু তো আমি গলা ভাঙা কোকিল, ফ্যাটফেটে সাদা হাঁসের মতন প্যাঁক প্যাঁক করি না!

রাজনারায়ণ রবিকে দেখে দারুণ খুশি হলেন। বয়েসের কত তফাত, তবু রবি যেন তাঁর বন্ধু। এর মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে উঠেছেন, তবু রবিকে ছাড়তে চান না। রবির অবশ্য বেশিদিন থাকার উপায় নেই, ‘বালক’ পত্রিকার আগামী সংখ্যার জন্য সব লেখা দেখে, কপি সংশোধন করে প্রেসে দিতে হবে। দিন চারেক বাদে সে ফেরার ট্রেন ধরল।

রাত্রের গাড়িতে বেশ ভিড়। রবি একটা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় ওপরের বাঙ্কে জায়গা পেয়েছে। কামরায় রয়েছে কয়েকটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যাত্রী। ঠিক তার মাথার কাছেই একটা আলো, এই আলো চোখে পড়লে ঘুম আসবে না, তাই রবি নিবিয়ে দিল আলোটা।

সঙ্গে সঙ্গে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে আলোটা জ্বেলে দিল। কামরায় আরও আলো রয়েছে। এই একটি আলো নিবিয়ে দিলে আন্যদের কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। রবি সেই কথাটাই বিনীতভাবে জানাল, ওরা গ্রাহ্যই করল না, যেন শুনতেই পায়নি।

রবি আবার আলোটা নিবিয়ে দিতেই আবার সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ানটি দুপদাপ করে উঠে বাতির ঢাকনা খুলে দিল। রবির দিকে তাকাল হিংস্র দৃষ্টিতে। এরা সামান্য ছুতোয় হাতাহাতি শুরু করে।

সূর্যের চেয়ে বালির তাপ বেশি হয়। কিছু কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের স্পর্ধা খাঁটি ইংরেজদেরও ছাড়িয়ে যায়। আর কিছু বলতে গেলে ওরা পেশীর শক্তি দেখাবে। রবি কয়েক মূহুর্ত লোকটির দিকে নীরবে চেয়ে রইল। যেন লোকটিকে সে মুছে দিতে চাইছে। যেন তার কোনও অস্তিত্বই নেই রবির কাছে।

আবার শুয়ে পড়ে রবি ঠিক করল, ঘুম যখন আসবেই না, তখন ‘বালক’ পত্রিকার জন্য একটা গল্পের প্লট ভাবা যাক। খানিকক্ষণ চিন্তা করেও কোনও গল্প মাথায় এল না, ঘুম এসে গেল। ট্রেনের ঘুম অবশ্য তেমন গাঢ় হয় না। আধা ঘুমন্ত অবস্থায় একটা স্বপ্ন দেখল রবি।

একটি মন্দিরের সামনে এক বাপ তার ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের ভেতর থেকে জলের ধারার মতন কী যেন গড়িয়ে এসেছে সিঁড়িতে। ছোট মেয়েটি কাছে গিয়ে দেখে ভীত, ব্যথিত, করুণ গলায় বলল, বাবা, এ কী! এ দেখি রক্ত!

বাবা পশুবলির সেই রক্তের কাছ থেকে মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কথা বলার চেষ্টা করছে, মেয়েটি তবু বারবার বলছে, এ যে রক্ত, এ যে রক্ত!

ঘুম ভেঙে গেল রবির। স্বপ্নটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবল। কী অর্থ হয় এই স্বপ্নের?

একটু পরে রবির আর একটা ঘটনা মনে পড়ল। অনেকদিন আগে রবি একদিন ঠনঠনের কালিবাড়ীর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। সেখানে কত যে পাঁঠাবলি হয় তার ঠিক নেই। রক্তের স্রোত চৌকাঠ উপছে পথে চলে এসেছে। একটি নিম্নশ্রেণীর রমণী সেই রক্তে আঙুল ডুবিয়ে তার কোলের শিশুর কপালে এঁকে দিচ্ছে তিলক। সেদিন রবির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠেছিল ঘৃণায়।

কলকাতায় পৌঁছে রবি সেই স্বপ্নলব্ধ দৃশ্যটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজবংশের প্রাচীন ইতিহাস মিলিয়ে একটা কাহিনী তৈরি করে ফেলল। তাদের সমাজের সহকারি সম্পাদক কৈলাস সিংহের রচনায় সে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের কাহিনী পড়েছিল। ‘বালক’ পত্রিকায় সেই গল্পটি ধারাবাহিক ভাবে বেরুতে লাগল রাজর্ষি নামে।

একদিন জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, রবি, তোমার বউকে আর ইস্কুলে পাঠাচ্ছি না। শুধু শুধু মাইনে দিয়ে কী হবে? রবি একটু ক্ষুন্ন। মৃণালিনীর স্কুলে পড়ার দিকে তেমন মন নেই তা ঠিক। তবু একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে? চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত না?

রবি বলল, কেন?

জ্ঞানদানন্দিনী চোখ মুছে ঘুরিয়ে হেসে বললেন, এই অবস্থায় ইস্কুলে না যাওয়াই তো ভাল। যদি কোনওদিন শরীর-টরির খারাপ হয়!

রবি এবার উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, সে কি! ওর কোনও অসুখ করেছে বুঝি? বললেন, আহা-হা, তুমি জানো না বুঝি ওর কী হয়েছে?

রবি খাটি বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, না, সত্যি জানি না, কী হয়েছে?

জ্ঞানদানন্দিনী বুকে এসে রবির গাল টিপে বললেন, ইস, ছেলে একেবারে যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। তুই যে বাবা হতে যাচ্ছিস রে!

রবি যেন আকাশ থেকে পড়ল। বাবা! সত্যি সে বাবা হতে চলেছে! একটি মানব তাকে বাবা বলে ডাকবে। তার রক্তের উত্তরাধিকার।

রবির বিস্ময় ও লজ্জাকর মুখ দেখে জ্ঞানদানন্দিনী আবার বললেন, তুমি এক কাজ করো, রবি। বউকে নিয়ে কিছুদিন বাইরে কোথাও ঘুরে এসো। এই সময় হাওয়া বদল করলে উপকার হয়, স্বাস্থ্য সারে।

রবি এতদিন পর্যন্ত কারুর না কারুর সঙ্গে বেড়াতে গেছে। একা একা সব দায়িত্ব নিয়ে ব্যবস্থা করা তার ধাতে নেই। একবারই শুধু সস্ত্রীক সে প্রবাসে গিয়েছিল, তাও মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থল সোলাপুরে। মেজদাদাই যাওয়া-আসার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এবারেও নতুন কোনও স্থানে বাড়ি ভাড়া করে থাকার মতন অর্থ সংস্থান নেই রবির, মেজদাদার নতুন কর্মস্থল নাসিকে যাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু মৃণালিনীকে হাওয়া বদল করতে নিয়ে যাওয়া গেল না। দেবেন্দ্রনাথ বোম্বাইয়ে বান্দ্ৰা অঞ্চলে কিছুদিনের জন্য বাসা বেঁধেছিলেন। কখনও পাহাড়, কখনও সমুদ্র তাঁকে টানে। হঠাৎ কলকাতায় খবর এল দেবেন্দ্রনাথ গুরুতর অসুস্থ, রবি অবিলম্বে ছুটিল বোম্বাই।

দেবেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, বান্দ্ৰায় থাকতে থাকতেই একদিন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তিনি শেষনিশ্বাস ফেলবেন, মিলিয়ে যাবেন মহা অসীমে। কিন্তু তাঁর সে সাধ পূর্ণ হল না। অচিরেই তিনি আবার দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং কলকাতার দিকে যাত্রা করলেন।

রবি এ যাত্রায় পিতার সঙ্গী হল না। সে মেজদাদার আহ্বানে কিছুদিনের জন্য থাকতে গেল নাসিকে। কিন্তু সেখানে এসেই তার বিষম আফসোস হল। কেন সে মৃণালিনীকে সঙ্গে নিয়ে এল না? মৃণালিনী তার সন্তানের জননী হতে চলেছে, এটা জানবার পর থেকেই পত্নীর প্রতি তীব্র টান অনুভব করছে রবি। আহা, মৃণালিনীর সঙ্গে ভাল করে দুটো কথাও কওয়া হয়নি আসবার আগে।

মনে পড়ে যায় সোলাপুরের দিনগুলির কথা। সেখানে দুপুরবেলা বাড়িতে আর কেউ থাকত না। সেই নির্জন দুপুরগুলিতে তাদের দুজনের সত্যিকারে মিলন হয়েছিল। উদাম হয়েছিল শরীর। রবি এখন বিরহ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ল।

ফেলো গো বসন ফেলো, ঘুচাও অঞ্চল
পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ
সুরবালিকার বেশ কিরণ বসন।
পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল
জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা…

যে সব কথা রবির কলমের ডগায় কখনও আসেনি আগে, এখন রবি তা নিঃসঙ্কোচে লিখে ফেলতে পারে। প্রথম চুম্বনের স্মৃতিতে সে লেখে :

অধরের কানে যেন অধরের ভাষা
দোঁহার হৃদয় যেন দোহে পান করে।
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে…
বিরহের রতি বিলাপ ফুটে ওঠে আর একটি কবিতায় :
প্ৰতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ তরে।
প্ৰাণের মিলন মাগে দেহের মিলন।
হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে
মুরছি মরিতে চায় তব দেহ ‘পরে।
তোমার নয়ন-পানে ধাইছে নয়ন
অধর মরিতে চায় তোমার অধরে…

এরকম লিখতে লিখতে হঠাৎ একদিন অন্য সুর এসে যায়। রবি নিজেই নিজের লেখার দিকে বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকে। এ যেন অন্য কেউ লেখাচ্ছে তাকে :

আমি নিশি নিশি কত রচিব শয়ন
আকুল নয়নে রে!
কত নিতি নিতি বনে করিব যতনে
কুসুম চয়ন রে!
কত শারদ যামিনী হইবে বিফল
বসন্ত যাবে চলিয়া!
কত উদিবে তপন আশার স্বপন!
প্ৰভাতে যাইবে ছলিয়া!
এই যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া
মরিব কাঁদিয়া রে!
সেই চরণ পাইলে মরণ মাগিব
সাধিয়া সাধিয়া রে…

এই কবিতায় তো স্পষ্ট নতুন বউঠানের ছায়া। সেই চন্দননগরের দিনগুলি, সেই ফুলের বাগান, সেই যৌবনের ক্ৰন্দন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *