নাইমুল বসে আছে টিবির মতো উঁচু একটা জায়গায়। উঁচু থেকে সমতল ভূমির অনেকখানি দেখা যায়। চারদিকে বা বা করছে রোদ। সে বসেছে ছায়ায়। তার মাথার উপর ছাতিম গাছের বড় বড় পাতা ছায়া ফেলে আছে। এই অঞ্চলে ছাতিম গাছের ছড়াছডি। কেউ নিশ্চয়ই হিসাব-নিকাশ করে ছাতিম গাছ লাগায় নি। আপনা-আপনি হয়েছে। গত সপ্তাহে সে যেখানে ছিল, সেখানে আবার শিমুল গাছের মেলা। একটু পরপর শিমুল গাছ। বসার জন্যে শিমুল গাছ ভালো না, গাছ ভর্তি কাটা। গাছে হেলান দিয়ে বসা যায় না। ছাতিম গাছে হেলান দেয়া যায়। তবে ছাতিম গাছ শব্দহীন বৃক্ষ। বড় বড় পাতা বলেই বাতাসে পাতা কাপার শব্দ হয় না।
নাইমুলের পরনে সেলাইবিহীন সবুজ রঙের লুঙ্গি। লুঙ্গির নিচে হাফপ্যান্ট আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে হাফপ্যান্ট ভালো পোশাক। তবে হাফপ্যান্ট পরে চলাচল সম্ভব না। লোকজন প্ৰথম দেখাতেই চিনে ফেলবে। সেলাইবিহীন লুঙ্গিটার প্রয়োজন এইখানেই। অপারেশনের সময় টান দিয়ে খুলে ফেলা যায়। তার গায়ে কালো রঙের হাফ হাতা গেঞ্জি। গেঞ্জির উপর ময়লা সুতি চাদর। কাধে ঝুলানো স্টেইনগান লুকিয়ে রাখার জন্য এই গরমে সুতি চাদর গায়ে রাখতে হচ্ছে। স্টেইনগান নাইমুলের পছন্দের অস্ত্র না। তার সীমা পঞ্চাশ গজ। শত্রুর পঞ্চাশ গজের ভেতরে যাওয়া গেরিলাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে উঠে না।
নাইমুল পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বসেছে। তার পায়ের কাছে যে বসে আছে তার নাম রফিক। বসেছে ব্যাঙের মতো। দেখলেই মনে হয় লাফ দেবে। বয়স ত্ৰিশ-পয়ত্রিশ। ব্যাঙের মতোই বড় বড় চোখ; সামান্য উত্তেজিত হলেই চোখ কোটির থেকে বের হয়ে আসতে চায় এমন অবস্থা।
রফিক বিরাট গল্পবাজ। পরিচয়ের পর থেকেই সে বিরামহীন কথা বলে যাচ্ছে। নাইমুল কী বলছে না বলছে সে বিষযে তার আগ্রহ নেই। তার কথা বলাতেই আনন্দ।
স্যার, আপনে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার?
নাইমুল হাই তুলতে তুলতে বলল, হুঁ। গেরিলাদের প্রধান ট্রেনিং তাদের পরিচয় গোপন রাখা। নাইমুল সেদিক দিয়ে গেল না। প্রয়োজন মনে করল না।
শম্ভুগঞ্জের ব্রিজ উড়াইতে আসছেন? আপনের খবর আছে।
খবর আছে কী জন্যে?
আপনের আগে আরো তিন পার্টি আসছে। সব ঝাঁঝরা। মেশিনগানের গুল্লি ছুটাইয়া ঝাঁঝরা কইরা দিছে।
তুমি মেশিনগান চেন?
চিনব না কী জন্যে? মায়ের কোলের নয়া আবুও অখন মেশিনগান চিনে। মর্টার চিনে। পিকেওয়ান চিনে।
পিকে ওয়ানটা কী?
রফিক চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। লোকটা বলছে সে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার অথচ পিকেওয়ান চেনে না! নাকি লোকটা তাকে খেলাচ্ছে? কেউ তাকে নিয়ে খেলালে রফিকের ভালো লাগে না।
স্যার, আপনের হাতিয়ার কই?
আছে, সবই আছে।
রাখছেন কই?
জেনে কী করবে? শান্তি কমিটির কাছে খবর দিবে?
এইটা কী কন?
এই অঞ্চলে শান্তি কমিটি নাই?
শান্তি কমিটি থাকব না–এইটা কেমন কথা! অবশ্যই আছে। আগের চেয়ারম্যান সাব মুক্তির হাতে মারা পড়ছে। নতুন আরেকজন হইছে চেয়ারম্যান। তারে মারবেন? বাড়ি চিনি। আপনেরে নিয়া ম্যাব?
নাইমুল বলল, চা খাওয়াতে পারবে?
রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, এই মাঠের মধ্যে চা কই পামু? সেটাও একটা কথা। চেয়ারম্যান সাবের বাড়িতে চলেন, চা খাইয়া আসবেন। তার বাড়িতে চায়ের আয়োজন আছে। আপনে মুক্তির কমান্ডার শুনলে লুঙ্গির মধ্যে পিসাব কইরা দিবে। এমন ডরাইল্যা।
চেয়ারম্যান সাহেবের নাম কী?
হাশেম চেয়ারম্যান। বউ দুইটা। ভাটি অঞ্চল থাইক্যা এক বউ আনছে, খুবই সুন্দর। তয় চরিত্রে দোষ আছে। সবেই জানে।
নাইমুল আবার হাই তুলল। টেনশনের সময় তার ঘনঘন হাই ওঠে। এর কারণটা তার কাছে স্পষ্ট না। মানুষের হাই ওঠে অক্সিজেনের অভাব হলে। টেনশনের সময় কি তার শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়? ব্ৰেইন প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন নিয়ে নেয় বলেই কি এই ঘাটতি?
নাইমুলের টেনশনের প্রধান কারণ, তার দলের কারোরই কোনো খোঁজ নেই। গতকাল ভোরে PEK1 (Plastic Explosive) এসে পৌঁছানোর কথা। সঙ্গে থাকবে ফিউজ, কর্ডেক্স, ডিটেনেটর। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিড খুব কম হলে পঁচিশ পাউন্ড লাগবে। পঁচিশ পাউন্ডের কমে ব্রিজের সম্প্যান ভাঙা যাবে না। এখন দুপুর। তারা আসবে নৌকায়। এই অঞ্চলে নৌকায় চলাচল এখনো নিরাপদ। মিলিটারি গানবোট বা লঞ্চ নিয়ে নদীতে নামে নি। তারা শুকনা অঞ্চলেই ঘোরাফেরা করছে। তার প্রধান কারণ পানি হয় নি। ছোট ডিঙ্গি টাইপ নৌকা বা খুন্দাই (তালগাছের নৌকা) ভরসা! মিলিটারিরা এত ছোট জলযানে উঠবে না।
দলটিা কোনো বিপদে পড়ে নি তো? এখন সময় এমনই যে হুট করে বিপদ নেমে আসে। আগে থেকে কিছুই বোঝা যায় না।
রফিক ঝুকে এসে বলল, কমান্ডার সাহেবের নাম কী?
আমার নাম নাইমুল।
সকাল থাইক্যা এই জায়গায় বসা। এর কি কোনো ঘটনা আছে?
নাইমুল আবারো হাই তুলতে তুলতে বলল, কোনো ঘটনা নাই। ছায়ায় বসছি। ছায়া মূল ঘটনা না। নৌকা এখানেই আসবে। ছাতিম গাছ দেখে তালা নৌকা ভেড়াবে। তাছাড়া এখান থেকে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়কের অনেকখানি চোখে পড়ে। এই সড়কে মিলিটারির চলাচল কী রকম সেটা দেখাও উদেশ্য।
রফিক বলল, রইদ চড়া উঠছে। কমান্ডার সাব দেন একটা ছিরগেট, টান দিয়া দেখি কী অবস্থা। আপনের আগে যে কমান্ডার সাব আসছিল, আমারে আস্তা এক প্যাকেট ছিরাগেট দিয়েছিলেন। বিরাট কইলজার মানুষ ছিলেন।
নাইমুল সিগারেট দিল। রফিক আগ্রহের সঙ্গে সিগারেট টানছে। কায়দা করে নাকে-মুখে ধোঁয়া ছাড়ছে। নাইমুলের ধারণা ব্যাঙ-টাইপ এই লোক সিগারেটের আশায় বসে ছিল। আশা পূর্ণ হয়েছে, এখন সে হেলতে দুলতে চলে যাবে। লোকজন জোগাড় করে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারের গল্প করবে। যুদ্ধের কারণে বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। লেখক হলে বাকি জীবন সে এইসব চরিত্র নিয়ে লেখালেখি করে কাটিয়ে দিতে পারত।
কমান্ডার সাব, আপনে কোন বাহিনী? মুজিববাহিনী?
নাইমুল বলল, তুমি মুজিববাহিনীও চেন?
চিনব না কেন? একেক বাহিনীর একেক কায়দা। মুজিববাহিনীর ট্রেনিং ভালো। অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ ভালো। অন্য বাহিনীর সাথে তারার বনে না।
ভালো কারা?
সবই ভালো। মিলিটারি মারা দিয়া কথা। কী কন কমান্ডার সাব?
হুঁ।
শান্তি মারলেও লাভ আছে, তয় শান্তি দেশের মানুষ–এইটা বিবেচনায় রাখতে হয়। আপনে কী কন?
নাইমুল নিজে একটা সিগারেট ধরাল। হিসাবের সিগারেট। দ্রুত শেষ করা ঠিক হবে না। রফিকের সিগারেট খাওয়া দেখে তার খেতে ইচ্ছা করছে।
আগের শান্তি চিয়ারম্যান ক্যামনে মারা পড়ছে সেই গল্প শুনবেন?
না।
আমগাছের সাথে নিয়া যখন বানছে, তখন পেসাব পায়খানা কইরা ছেড়াবেড়া। এমন কান্দন শুরু করল যে কইলজার মধ্যে ধরে। আমি মুক্তি হইলে দিতাম। ছাইড়। বলতাম, তোর শাস্তি নিজের গু নিজে চাটা দিয়া খাবি। জানে মারনের চেয়ে এই শাস্তি ভালো, কী কন কমান্ডার সাব? গু খাওয়া সহজ ব্যাপার না। নিজের গু হইলেও না।
নাইমুল জবাব দিল না। জবাব দেবার প্রয়োজনও নেই। রফিক এই ধরনের মানুষ যে জবাবের অপেক্ষা করে না। নতুন গল্প শুরু করে। রফিক তার সিগারেটে শেষ লম্বা টান দিয়ে বলল, নতুন চিয়ারম্যান সাবের দিনও শেষ। মুক্তি যখন আইসা ঢুকে, তখন তারা আর কিছু করতে পারুক না পারুক শান্তির লোকজন মারে।
আর কিছু করে না?
নাহ্।
মিলিটারি মারতে পারে না?
সত্য কথা বলতে কী পারে না। পাক মিলিটারি তো ঘুঘু পাখি না। গুলাইল
দিয়া মারবেন। পাক মিলিটারি কঠিন জিনিস। সাক্ষাৎ আজরাইল। এরার শইল্যে ভয় ডর বইল্যা কিছু নাই।
পাক মিলিটারি দেখেছ?
দেখব না। কী জন্যে? একবার মাথাত কইরা তারার গুলির বাক্স নিয়া গেছি। খেতে কাম করতেছিলাম, ডাক দিয়া আইন্যা আমারে আর পুব পাড়ার ফজলু ভাইয়ের মাথাত তুইল্যা দিল গুলির বাক্স। আরো বাপ রে–ওজন কী! দুই দিন ছিল ঘাড়ে ব্যথা। কমান্ডার সাব আরেকটা সিগারেট দেন।
আর তো সিগারেট দেয়া যাবে না।
তাইলে উঠি। আপনের সাথে গফ কইরা মজা পাইছি।
উঠতে পারবে না। যেখানে বসেছিলে সেখানে বসে থাকো। গল্প করতে চাও গল্প করো। উঠার চিন্তা বাদ দাও।
রফিক বিস্মিত হয়ে তাকাল। মুক্তিদের হাবভাব বোঝা মুশকিল। এতক্ষণ এই কমান্ডার নরম-সরম গলায় কথা বলেছে। এখন তার গলা কঠিন। চোখের দৃষ্টিও ভালো না।
আমার একটা কাজ ছিল কমান্ডার সাব।
কাজ থাকলেও বসে থাকো; তোমাকে আমি ছেড়ে দেব। আর তুমি সারা অঞ্চলের মানুষকে বলে বেড়াবে মুক্তি ঢুকেছে, তা হবে না। তাছাড়া তোমাকে আমার দরকায়।
কী জন্যে দরকার?
শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি চিনায়ে দিবে। আমি বাড়ি চিনি না। আরো খোঁজ খবর দিবে। শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ কি মিলিটারি পাহারা দেয়?
আমি জানব ক্যামনে? আমি কি ব্রিজের উপরে দিয়া হাটি? রেলগাড়ি চলাচলের পুল। মাইনষের হাঁটার পুল না।
রাজাকাররা থাকে কোথায়?
থানা কম্পাউন্ডে থাকে।
তারা মোট কয়জন?
আমি কি গুইন্যা দেখছি? রাজাকারের হিসাব নেওনের ঠেকা আমার নাই।
রফিক উসখুসি করছে। নাইমুল কড়া গলায় বলল, নড়াচড়া করবে না।
নড়াচড়াও করতে পারব না–এইটা কেমন কথা?
নাইমুল গায়ের চাদরটা সামান্য উঠিয়ে কাঁধে ঝুলালো চাইনিজ স্টেইনগান দেখিয়ে দিল। রফিক নড়াচড়া বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল। তার চোখ কোটির থেকে সামান্য বের হয়ে এলো। মিলিটারিদের যেমন বিশ্বাস নাই, মুক্তিরও বিশ্বাস নাই। হুট করে কী করে বসে না বসে তার নাই ঠিক।
নাইমুল বলল, রাজাকার কমান্ডারের নাম কী?
জয়নাল।
জয়নালের বাড়ি তো তুমি চেন। চেন না?
জি চিনি।
সে বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসে না? চব্বিশ ঘণ্টা সে নিশ্চয়ই থানা কম্পাউন্ডে থাকে না।
জয়নাল ভাইরে কি গুল্লি করবেন?
জানি না করব কি-না। করতেও পারি।
জয়নাল ভাই বৈকালে ছুলুর স্টলে চা খাইতে যায়। একলা যায় না। সাথে সব সময় এক দুইজন থাকে। যন্ত্রপাতি থাকে।
থাকুক।
গুল্লি কোন খানে করবেন? চায়ের স্টলে করবেন না দূরে নিয়া করবেন?
দেখি কী করা যায়। কমান্ডার সাব, আমার বিরাট পেসাব চাপছে। পেসাব করন দরকার। ক্ষেতের আইলে বইস্যা পেস্যাব কইরা আসি।
নাইমুল হাই তুলতে তুলতে বলল, পেসাব এই খানেই করো। নিচে নামার দরকার নাই।
আপনের সামনে পেসাব করব?
উল্টা দিকে ফির। উল্টা দিকে ফিরে পিসাব করো। জায়গা থেকে নড়বে না।
কমান্ডার সাব, আমি কিন্তু জয় বাংলার লোক।
এই জন্যেই তো তোমাকে পাশে বসিয়ে রেখেছি। আমার জয় বাংলার লোকই দরকার।
এই খানে কতক্ষণ বইস্যা থাকবেন?
নাইমুল আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, জানি না।
রফিক বলল, পুরাটা শেষ কইরেন না। আমি দুইটা টান দিব। ইন্ডিয়ান ছিদ্রগেটের মজাই আলাদা।
নাইমুল তাকে আস্ত একটা সিগারেট দিল।
রফিক বলল, ফাইটিং কি আইজ রাইতেই হইব?
হুঁ।
আফনের লোকজন কই?
আমার দলে লোক কম। আমরা মোটে দুইজন।
আরেকজন কে?
আরেকজন তুমি। তোমাকে গ্রেনেড মারা শিখায় দিব। পারবে না?
রফিকের ঠোঁট থেকে জ্বলন্ত সিগারেট পড়ে গেল। সে মনে মনে বলল, ভালো পাগলের হাতে পড়ছি।
গ্রেনেড নিশ্চয়ই চেন। সব অস্ত্রপাতির নাম তুমি জান, গ্রেনেডের নাম জানবে না তা হয় না। লোহার বল।
গ্রেনেড চিনি। গ্রেনেড আছে দুই পদের। ভালটার নাম এনেগ্রা গ্রেনেড। বন্দুকের নলে লাগাইয়া মারতে হয়।
তোমাকে ঐ গ্রেনেড দেব না। তোমাকে যে গ্রেনেড দেব সেখানে একটা পিন থাকে। দাঁত দিয়ে টান দিয়ে পিন খুলতে হয়। পিন খোলার পরে ছুঁড়ে মারতে হয়।
রফিক বিড়বিড় করে বলল, ভাইজান আমার দাঁতে অসুবিধা আছে। দাঁত পোকায় খাওয়া। এই দেখেন।
সে দাঁত বের করে দেখাল। নাইমুল সহজ গলায় বলল, এই দাঁতেও চলবে।
বিকাল পর্যন্ত নাইমুলের দলের লোকজন কেউ এসে পৌঁছল না। এদের কি সমস্যা সেটাও জানার উপায় নেই। সে কি তাদের জন্যে অপেক্ষা করবে না। ফিরে যাবে তাও বুঝতে পারছে না।
দলের লোকজন কি ধরা পড়ে গেছে? ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম, তবে একেবারেই যে নেই তা না। গত মাসে শেরপুরের জহুকান্দিতে কাদের মিয়ার পুরো দল ধরা পড়েছিল। তারা ভুল যা করেছে তা হলো আয়োজন করে খাওয়াদাওয়া করতে গেছে। যে বাড়িতে তারা উঠেছিল, সেই বাড়ির কর্তা মুক্তিবাহিনী দেখে আবেগে উচ্ছসিত হয়ে ছিলেন। সন্ধ্যাবেলায় খাসি জবাই করা হয়েছে তাদের খাওয়ানোর জন্যে। পোলাও রান্না হয়েছে। খাসির মাংস রান্না হতে সময় লাগছিল। এই সময়ই কাল হলো। মিলিটারি বাড়ি ঘিরে ফেলল। ট্রেনিং ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধেয় নিয়ম কানুন ব্যাখ্যা করতে করতে এক পর্যায়ে বলা হতো–আর যাই হও খাসি কাদের হয়ো না।
কাদের দুর্দান্ত সাহসী যোদ্ধা ছিল। সামান্য ভুলের জন্যে তার নাম হয়ে গেল খাসি কাদের। তার বীরত্বের কথা সবাই ভুলে গেল। শুদ্ধ কাজের জন্যে মানুষ মানুষকে মনে রাখে না। মানুষ মনে রাখে তাদের অশুদ্ধ কাজের জন্যে। কাদেরের নাম হওয়া ছিল বীর কাদের অথচ তার নাম হয়ে গেল খাসি কাদের।
কমাণ্ডার সাব?
হুঁ।
আমার কপালে একটু হাত দিয়া দেখেন।
কেন?
জ্বর আসছে। আমার কেঁথার তলে যাওন দরকার। আমার শইলের অবস্থাটা একটু বিবেচনা করেন।
নাইমুল আবারো বলল, হঁ।
রফিক বলল, উঠি কমান্ডার সাব?
নাইমুল বলল, উঠার চিন্তা বাদ দাও। তোমাকে পাঠাব ব্রিজের কাছে রাজাকারদের যে আউট পোস্ট আছে সেখানে।
লাখ টকা দিলেও আমি এর মধ্যে নাই। ভুইল্যা যান।
ভুলে যাব কেন?
ব্রিজ পাহারা দেয় কালা মিলিটারি। এরা সাক্ষাৎ যম।
কালো পোশাক পরা মিলিশিয়া?
মিলিশিয়া কি-না জানি না, এরা যে আসল যম এইটা জানি। এরার ছায়া দেখলেও মৃত্যু।
নাইমুল দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, উঠ।
কই যাব?
কালা মিলিটারির ছায়া দেখে আসি।
আসমানের দিকে চাইয়া দেখছেন আসমানের অবস্থা। দেওয়া নামতাছে।
নাইমুল আকাশের দিকে তাকাল। ঘন হয়ে মেঘ করছে। আকাশের ঘন কালো মেঘ সৌভাগ্যের লক্ষণ। মেঘ-বৃষ্টিতে মিলিটারিরা অভ্যস্ত না। তারা তখন কোঠারে ঢুকে থাকে। তাদের কাছে বজের গর্জনকে কামানের শব্দ বলে মনে হয়। মেঘ ডাকলেই তাদের কলিজা কঁপে। এমন ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দলের লোকজন থাকলে ভালো হতো। ব্রিজের ব্যবস্থা করে ফেলা যেত। দলে নাসিম আছে। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিডের বিষয়ে অতি এক্সপার্ট। ছোটখাটো মানুষ, মনে হয়। হাঁটতে জানে না–লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। তাকে আদর করে ডাকা হয় মিস্টার প্ৰিং।। দলে আছে সুন্নত মিয়া। তাকে সুন্নত মিয়া ডাকলে সে রাগ করে। তাকে ডাকতে হয় গৌরনদীর সুন্নত। এই বিশেষ নামে তাকে কেন ডাকতে হয়— নাইমুল এখনো জানে না। অসীম সাহসী যুবক। প্রতিটি অপারেশনের পর সে গভীর ক্ষোভের সঙ্গে বলে, শহিদ হওয়ার শখ ছিল, হইতে পারলাম না। আফসোস। দেখি পরেরবার পারি কি-না। গ্রেনেডের থলি নিয়ে সে মাটিতে শুয়ে সাপের মতো ভঙ্গিতে আগায়। ক্রলিং-এর সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। শত্রুর খুব কাছাকাছি গিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে গ্রেনেড চার্জ করে। বিড়বিড় করে বলে, যারে পক্ষী যা। জায়গা মতো যা। তার পক্ষী বেশির ভাগ সময়ই জায়গা মতো যায়। সুন্নতের হাতের জোর অসম্ভব। গ্রেনেড থ্রোয়ারে গ্রেনেড পঞ্চাশ গজ পর্যন্ত যায়। সে হাতে ছুঁড়েই চল্লিশ গজ পর্যন্ত পাঠাতে পারে।
সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খোলা নৌকায় নাইমুলের দল চলে এলো। আনন্দে দাঁত বের করে রফিক হেসে ফেলে বলল, এই তো আপনে আপনের লোক পাইছেন। আমারে বিদায় দেন। ছিরগেটে টান। দিতে দিতে বাড়িত গিয়া ঘুমাই। নাইমুল বলল, যেখানে আছ সেখানে থাক। নড়বে না। অনেক কথা বলেছি। আর কোনো কথাও না।
দলটা ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ও অবসন্ন; নাইমুল বলল, অপারেশনের শেষে আমরা খুব আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করব। অপারেশনের আগে কোনো খাওয়া নাই। আমি সব রেকি করে রেখেছি। একটা গাইডও আমার সঙ্গে আছে। রফিক নাম।
রফিক সঙ্গে সঙ্গে বলল, এইটা ভুইল্যা যান কমান্ডার সাব। আমি আপনারার সাথে নাই। নতুন বিবাহ করে করেছি। ঘরে আমার কাঁচা বউ।
নাইমুল বলল, কাঁচা বউ পাকা বউ যাই থাকুক, তুমি আছা সঙ্গে। এখন তোমরা সবাই আমার প্ল্যান অব অ্যাকশান শোন। আমি পুরো ব্যাপারটা অন্যরকমভাবে সাজিয়েছি। মন দিয়ে শুনতে হবে। পরিকল্পনার পরিবর্তন হবে। না। আমি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কিছু ঠিক করি না। এইসব সিদ্ধান্ত তর্কবিতর্কে ঠিক করা যায় না। ব্রিজ পাহারা দেয় ছয় থেকে সাতজন রাজাকারের একটা দল। মাঝে মধ্যে তাদের সঙ্গে দুজন মিলিশিয়া থাকে। আজ তারা নেই।
প্ৰথমে আমরা তাদের কাছে খবর পাঠাব—আজ ভোররাতে ব্রিজ উড়ানো হবে। খবরটা বিশ্বাসযোগ্য হবে কারণ খবরটা সত্যি। ব্রিজ আমরা আজ রাতেই উড়াব। খবর শোনার পর এরা যা করবে তা হচ্ছে হয় সবাই মিলে থানায় মিলিটারির কাছে খবর দিতে যাবে। অথবা একদল যাবে আরেকদল ব্রিজ পাহারা দেয়ার নামে থাকবে। যারা থাকবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের পালিয়ে যাবার কথা। যদি পালিয়ে না যায় ভায়ের চোটে ফাঁকা গুলি করতে থাকবে।
একই সঙ্গে আমরা থানায় খবর পাঠাব। যে ব্রিজ অ্যাটাক করা হবে। খবর পাঠানো হবে স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের মাধ্যমে। থানার মিলিটারিরা ব্রিজ রক্ষার জন্যে একদল মিলিটারি পাঠাবে। তাদের রুট একটাই ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক। আমাদের দলটা তিন ভাগ হবে। এক ভাগ সড়কে মিলিটারিকে অ্যাম্বুশ করবে। এক ভাগ যাবে ব্রিজে, আর এক ভাগ থানা অ্যাটাক করবে। থানা অ্যাটাকে আমরা এনেগ্রা গ্রেনেড ব্যবহার করব। এসএমজি থাকবে ব্রিজের উপরে। এখন ঠিক করি কে কোন দিকে থাকবে। তার আগে শুনতে চাই কেউ কিছু কি বলবে?
রফিক প্রথম কথা বলল, তার কথা দুই শব্দের, আমারে খাইছে রে।
রফিকের কথার পর পর মিস্টার স্প্রিং বলল, চিড়ামুড়ি যাই হোক, কিছু মুখে দিতে হবে।
ঝড়-বৃষ্টি যেমন আচমকা এসেছিল সে রকম আচমকা চলে গেল। রাত নটার দিকে মেঘের ফাকে চাদ দেখা গেল! চাদের আট তারিখ। চাঁদের আলো তেমন জোরালো না আবার খারাপও না। গৌরনদীর সুন্নত বলল, মেঘের মধ্যে জোছনা খারাপ জিনিস। এই জোছনায় ভূত দেখা যায়। আমি মিলিটারি ভয় পাই না। ভূত ভয় পাই।
শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাশেম সাহেব যখন ঘুমুবার আয়োজন করেছেন, তখন তাঁর বাড়ির উঠানে কুকুর ডাকতে লাগল। কুকুরের ডাকের সঙ্গে মনে হলো, অনেক লোকজনও হাঁটাহাঁটি করছে। হাশেম চেয়ারম্যান ভীত গলায় বললেন, কে?
রফিক বলল, চেয়ারম্যান সাব আমি রফিক। উত্তরপাড়ার রফিক।
কী চাও?
একটু বাইর হন। মুক্তির কমান্ডার সাব আসছেন। হাশেম চেয়ারম্যান একা বের হলেন না, তার সঙ্গে বিশাল বাড়ির কয়েকটা দরজা এক সঙ্গে খুলে গেল। মেয়েদের কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যে একটি মেয়ে বেশ রূপবতী। সেই মনে হয় হাশেম চেয়ারম্যানের–ভাটি অঞ্চলের স্ত্রী।
হাশেম চেয়ারম্যানের হাতে টর্চলাইট। গায়ে হাতকটা পাঞ্জাবি। পরনে লুঙ্গি। তার কাছে মনে হচ্ছে লুঙ্গির আঁট নরম হয়ে এসেছে, যে-কোনো সময় লুঙ্গি খুলে পড়ে যাবে। তিনি এক হাতে লুঙ্গি ধরে আছেন। আরেক হাতে টর্চ। তিনি ভীত গলায় বললেন, কে কে?
নাইমুল বলল, আমরা মুক্তিবাহিনীর। আপনি ভালো আছেন?
হাশেম চেয়ারম্যান জড়ানো গলায় বললেন, জি ভালো আছি। জি ভালো আছি।
নাইমুল বলল, ভয় পাচ্ছেন নাকি?
হাশেম চেয়ারম্যান তার জবাবে কাশতে শুরু করল। মেয়ে মহলে কান্নার শব্দ আরো জোরালো হলো। একজন বৃদ্ধা মহিলা ছুটে এসে হাশেম চেয়ারম্যানের হাত ধরল। সম্ভবত চেয়ারম্যান সাহেবের মা। বৃদ্ধ ফোঁপাতে ফোপাতে বললেন, বাবারা আমার একটা কথা শোন।
নাইমুল বলল, আপনি ভয় পাবেন না। আমি কখনো বাঙালি মারি না। কান্না বন্ধ করেন।
সব মহিলার কান্না একসঙ্গে থেমে গেল। নাইমুল শান্ত গলায় বলল, আমার ছেলেরা এখানে এসেছে রেলের পুল উড়ায়ে দিতে। তারা এই কাজটা শেষ করে আপনার এখানে খানা খাবে।
হাশেম চেয়ারম্যান বলল, অবশ্যই, অবশ্যই। অবশ্যই খানা খাবেন। অবশ্যই।
গরম ভাত করবেন। ঝাল দিয়ে মুরগির সালুন।
বৃদ্ধ বললেন, বাবারা পোলাও করি?
করতে পারেন। অনেক দিন পোলাও খাওয়া হয় না।
হাশেম চেয়ারম্যান বলল, আপনারা ঘরে এসে বসেন। চা খান, চা বানাতে বলি।
নাইমুল বলল, চা খাব না। আমরা এখন ব্রিজের কাছে যাব। আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
আপনি থানায় যাবেন। থানায় গিয়ে মিলিটারি কমান্ডারকে বলবেন। মুক্তিবাহিনী ঢুকেছে। তারা ব্রিজ উড়াতে এসেছে। যা সত্য তাই বলবেন। ব্রিজ উড়াবার পর আপনার বাড়িতে যে পোলাও মুরগির মাংস খাব তাও বলতে পারেন, অসুবিধা নাই।
বৃদ্ধ বললেন, আমার ছেলে কোনোখানে যাবে না। তোমরা ফাঁকি দিয়া তারে ঘর থাইক্যা বাইর করতোছ। টাকা-পয়সা কী চাও বলো দিতাছি। সিন্দুকে স্বর্ণের অলঙ্কার আছে। অলঙ্কার নিবা?
নাইমুল বলল, বুড়িমা, আপনি যদি আপনার ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে চান, তাহলে আমি যা বলছি তা করুন। আমি কথা চালাচালি পছন্দ করি না। একেবারেই করি না।
রফিক বলল, চাচিআন্মা, আমরার কমান্ডার সাব এককথার মানুষ। উনার কথা না শুনলে বিপদ আছে।
নাইমুল রফিকের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যাবে ব্রিজে। রাজাকার গ্রুপকে ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার খবর দিবে। তুমি কাজটা ঠিকমতো করছি কি-না তা দেখার জন্যে আড়াল থেকে তোমার পিছনে পিছনে আমাদের একজন যাবে। বেতালা কিছু সন্দেহ হলেই সে গুলি করবে। বুঝতে পারছি?
রফিকের মুখ হা হয়ে গেল। চোখ কোটর থেকে আরো খানিকটা বের হয়ে এলো।
গেরিলা অপারেশনে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় যা ভাবা গিয়েছিল তা হয় না। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়। সব সময় যে সিদ্ধান্ত পাল্টাবার সুযোগ পাওয়া যায় তাও না। একটা মাঝারি আকৃতির দল কয়েকটা ভাগে ভাগ হয়ে গেল, তারা একত্রিত হবার সুযোগই পায় না।
এই ক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে সব কিছু হলো নাইমুলের পরিকল্পনা মতো। রাজাকারদের দল ব্রিজ আক্রমণ হবে খবর পাওয়া মাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল রেখে পালিয়ে গেল।
থানা কম্পাউন্ড থেকে আটজন মিলিটারির একটা ছোট্ট দল গেট থেকে বের হয়ে আবার ঢুকে পড়ল।
নাইমুলের কাছে রাখা গ্রেনেড থ্রোয়ার ঠিকমতো কাজ করল। রাইফেলের নল থেকে দশ-বার গজ দূরে গিয়ে ফাটল না। পর পর দুটা এনেগ্রা গ্রেনেড দেয়াল ফুটো করে ভেতরে ঢুকে গেল।
রাস্তার পাশে অ্যাম্বুশ করে রাখা দলটাকে নাইমুল ঠিক সময়ে থানার দুই দিকে জড় করতে পারল।
মিলিটারির অতি ক্ষুদ্র দলের কাছেও লাইট মেশিনগান থাকে। থানা থেকে লাইট মেশিনগানের কোনো গুলি এলো না। হয় তাদের এলএমজিতে কোনো সমস্যা হয়েছে। কিংবা তাদের গানার নেই।
থেমে যাওয়া বৃষ্টি আবারো শুরু হলো। ঘনঘন বাজ ডাকতে লাগল। থানা কম্পাউন্ডের ভেতরের একটা তালগাছে বাজ পড়ল। সেই শব্দ হলো ভয়াবহ। মিলিটারিরা এই বজ্ৰপাতকে অবশ্যই কামানের আক্রমণ ধরে নিল। তারা গুলিবর্ষণ বন্ধ করল। বাঁশের মাথায় সাদা কাপড় ঝুলিয়ে তারা আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত করল।
নাইমুলের দল গুলিবর্ষর্ণ বন্ধ করুল (নাইমুল শান্ত কিন্তু উন্ন গলায় বলল, Hello Come out. We have stopped firing. মাত্র পাঁচজন মিলিটারির ছোট্ট একটা দল হাত উঁচু করে বের হয়ে এলো। তাদের সঙ্গে আছে তিনজন পাকিস্তানি পুলিশ। তাদের পেছনে থানার ওসি। নাইমুল উঠে এলো থানা কম্পাউন্ডের পাকা বারান্দায়। থানার ওসির দিকে তাকিয়ে বলল, ওসি সাহেব ভালো আছেন?
হতভম্ব ওসি বলল, জি স্যার।
আপনাদের বিশাল পুলিশ বাহিনী স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করছে আর আপনি এদের হয়ে কাজ করছেন–এটা কেমন কথা? আপনি একটা কাজ করুন মিলিটারিদের বেঁধে ফেলুন।
জি স্যার।
এরা সংখ্যায় এত কম কেন? বেশি থাকার কথা না?
বেশিই ছিল। পরশু সকালবেলা জরুরি ম্যাসেজ পাঠিয়ে নিয়ে গেছে।
এখানে ওয়্যারলেস আছে?
জি স্যার আছে।
থানা যে অ্যাটাক হয়েছে সেই ম্যাসেজ কি গেছে?
জি না।
যায় নাই কেন?
অপারেটর নাই স্যার।
মিলিটারিদের বেঁধে সঙ্গে করে নিয়ে ব্রিজের কাছে যান। ব্রিজ উড়ানোর ব্যাপারে সাহায্য করুন।
জি স্যার।
নাইমুল মিলিটারি ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় ইংরেজিতে বলল, তোমরা আত্মসমর্পণ করেছ। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের দেখা আমার দায়িত্ব। সমস্যা হচ্ছে আমরা একটা গেরিলা ইউনিট। দেশের ভেতর ঘুরে ঘুরে কাজ করি। তোমাদের সঙ্গে করে নিয়ে ঘোরা আমার পক্ষে সম্ভব না। ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব না; তাছাড়া আমাদের মুক্তিবাহিনীর অনেক সদস্য তোমাদের হাতে ধরা পড়েছে। তাদের প্রত্যেককে তোমরা ফায়ারিং স্কোয়াডের কাছে পাঠিয়েছ। তোমাদের বেলাতেই বা অন্যরকম হবে কেন?
হাশেম চেয়ারম্যান অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে দেখলেন মুক্তিযোদ্ধার দলটা ফজরের আগে আগে তাঁর বাড়িতে খেতে এলো। দলের কমান্ডার খাবার সময় বিনীত গলায় বাড়ির মহিলাদের কাছে কাঁচামরিচ চাইল। এই ভদ্ৰ-বিনয়ী ছেলে নাকি কিছুক্ষণ আগে পাঁচজন মিলিটারি, তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশকে ব্রিজের উপর থেকে গুলি করে পানিতে ফেলে দিয়েছে।
রফিক গোলাগুলি শুরু হওয়া মাত্র পালিয়ে গিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়ার সময় সে আবারও উপস্থিত হলো এবং অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে খাওয়ার তদারকি করতে লাগল। একবার শুধু ফাঁক পেয়ে নাইমুলকে বলল, স্যার, যতদিন জীবন আছে আমি আপনার সাথে আছি। আর আপনেরে ছাইড়া যাব না। ভয় পাইয়া দৌড় দিছিলাম। আমি গু খাই।
রফিক তার কথা রেখেছিল। কাঁচপুর অপারেশনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে নাইমুলের সঙ্গেই ছিল। সে খুব ভালো এসএমজি চালাতে শিখেছিল। কাঁচপুর অপারেশনে গুলিবিদ্ধ হবার পর থেকে জীবনের শেষমূহুর্ত পর্যন্ত সে এসএমজিতে গুলিবর্ষণ করেছিল বলেই নাইমুল তার দল নিয়ে পালাতে পেরেছিল। একই ধরনের বীরত্ব দেখিয়েছিলেন আরেকজন। তিনি সিপাহি মোস্তফা কামাল। গঙ্গাসাগর আক্রমণের সময় আমৃত্যু মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে তিনি তাঁর প্লাটুনকে পশ্চাদ অপসারণের সুযোগ করে দেন। তাঁর প্রাণের বিনিময়ে পুরো প্লাটুন রক্ষা পায়। সিপাহি মোস্তফা কামালকে বীরশ্রেষ্ঠ সম্মানে সম্মানিত করা হয়। রফিকের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাতেও নেই।