বিলু কোনওদিনই খুব সুন্দরী ছিল না, তবে সাদামাটা চেহারার মধ্যেও কারও কারও যেমন একএকটা অদ্ভুত আকর্ষণ থাকে, বিলুরও তাই! হয়তো সেই আকর্ষণটা নেহাতই একটা গজদন্তে বা চোখের পাতার একটা কালো আঁচিলের মতো তুচ্ছ জিনিসকে নিয়ে তৈরি হয়। বিলুরও সেইরকম একটা কিছু আছে, কিন্তু সেটা যে কী তা আজও স্পষ্ট করে ধরতে পারেনি প্রীতম।
বিলু যখন ঘরে এল তখন সেই পুরনো আকর্ষণটা আজ বঁড়শির মতো কণ্ঠায আটকে টানছিল তাকে। টানছিল বিলুর দিকেই। কয়েক পলক বিলুর দিকে চেয়েই চোখ সরিয়ে নিল প্রীতম। কলকে ফুলের গাছটার দিকে চেয়ে রইল। বুকে একটু অস্বস্তি।
ঘরে ঢুকেই বিলু বলল, মেয়ে লজ্জায় আসতে চাইছে না তোমার কাছে। তুমি ডাকো।
থাক, লজ্জা ভাঙলে আসবে।
বিলু বিছানায় এসে বসল। দীপনাথ সামনেই চেয়ারে বসা। প্রীতম চোখ বুজে বলল, ছুটি পেলে তা হলে?
বিলুকেই বলা, একটু কুণ্ঠার সঙ্গে বিলু বলে, অনেক কষ্টে, অরুণের বাবা নিজে ইনিশিয়েটিভ নিয়ে গ্রান্ট করিয়েছেন। চাকরি তো পাকা নয়, বছরও পোরেনি, এখনই ছুটি কি পাওনা হয়, বলো?
ক’দিনের?
আপাতত দশ দিন।
অরুণের বিয়েটা হয়ে গেছে নাকি?
এ প্রশ্নটার জবাব দিতে কয়েক সেকেন্ড বেশি সময় নিল বিলু। গলার স্বরও এক পরদা নেমে একটু মিয়োনো শোনাল। বলল, ঠিক হয়ে আছে। মাঝখানে অরুণ দু’মাসের জন্য বাইরে গিয়েছিল হঠাৎ, তাই ক’দিন পিছোতে হয়েছে।
প্রীতম নীরবে শুনল, কিছু বলল না। অরুণের বিয়ের ব্যাপারটা তার কাছে আজও গুরুতর। অরুণ মাঝে মাঝে বিদেশে যায়। বিদেশে যাওয়ার নানা সুযোগও আছে তার। কিন্তু তাই বলে বিয়ে পিছোবে এমন কোনও কথা নেই। প্রীতম একটু বড় করে শ্বাস ফেলে বলে, যাও, তোমরা একটু জিরিয়ে-টিরিয়ে নাও। এখানে খুব ঠান্ডা। লাবু সম্পর্কে সাবধান।
যাই। সারা রাত ভাল ঘুম হয়নি।–বলে বিলু উঠে গেল। বোধহয় পালালই।
বিলু চলে গেলে প্রীতম দীপনাথের দিকে তাকায়। দীপনাথ ছোট একটা নোটবইতে ডটপেন দিয়ে কী লিখছে খুব মন দিয়ে।
কী করছ ওটা?
চোখ না তুলেই দীপনাথ বিরক্তির শব্দ করে বলে, আর বলিস না। থাকব মোটে দু’দিন, চোদ্দোটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট। দার্জিলিং, কালিম্পং, গ্যাংটক, জলপাইগুড়ি দৌড়াদৌড়ি।
বলতে বলতেই দীপনাথ ওঠে।
ও কী? চললে কোথায়?
পিসির বাড়িতে একবার দেখা করে বেলা দশটা সাড়ে দশটার মধ্যেই একটা জিপ নিয়ে দার্জিলিংটা আজ সেরে আসি।
আমি ভাবছিলাম, তুমি এবার আমাদের বাড়িতে থাকবে।
থাকার উপায় নেই। দার্জিলিং থেকেই আজ সোজা চলে যাব জলপাইগুড়ি। ওখান থেকেই কাল সকালে চলে যাব গ্যাংটক। পরশু কালিম্পং হয়ে ফিরব। পরদিনের ফ্লাইটে কলকাতা। তোর তো দুঃখের আর কিছু নেই রে, প্রীতম, বিলু তো এসেছে।
আমার দুঃখ কি শুধু বিলুর জন্য? তুমি যে পর হয়ে গেলে, বড় বেশি ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে গেলে, স্কেয়ারস হয়ে গেলে!
আমি? দূর বোকা, কোম্পানি চাকরের মতো খাটায়। আমিও খাঁটি। তোর চিকিৎসা কে করছে রে প্রীতম?
আমাদের সেই পুরনো ডাক্তার। তা ছাড়া শতম হোমিয়োপ্যাথিও দিচ্ছে কোত্থেকে এনে।
ভ্রু কুঁচকে দীপনাথ কী একটু ভেবে বলল, নট ব্যাড, নট অ্যাট অল ব্যাড।
তুমি কি আমাকে ভাল দেখছ, সেজদা?
অনেক ভাল। এত ভাল তোকে বহুকাল দেখিনি।
নিভে যাওয়ার আগে এটা শেষবারের জ্বলে ওঠা নয় তো?
তুই সহজে নিভে যাবি বলে মনে হচ্ছে না।
ঠিক বলছ?
ঠিকই বলছি।
যদি বাঁচি মেজদা, তবে কী করব জানো? অনেক অনেক দূর পর্যন্ত শুধু হাঁটব। হেঁটে হেঁটে বহুদূর চলে যাব।
দীপনাথ ঘড়ি দেখল। বাস্তবিকই সময় নেই।
উঠি রে।
দীপনাথ অবশ্য প্রীতমের বাড়ি থেকে সহজে ছাড়া পেল না। ঘর থেকে বেরোতেই প্রীতমের বোন আর শতম এসে ধরে নিয়ে গেল ভিতরবাড়িতে। এত সকালে দীপনাথ কিছু খেতে পারে না। তবু লুচি, আলুভাজা, সন্দেশ আর চা অনিচ্ছের সঙ্গে কোঁত কোঁত করে গিলতে হল খানিক।
দশটার মধ্যে পিসির বাড়ির সামনে জিপ হাজির থাকবে। মোটোয়ানিকে খবর দেওয়া আছে। দেরি করা চলে না।
কলকাতা যাওয়ার আগে দেখা করে যেয়ো সেজদা।–বিলু রওনা হওয়ার মুখে বলল।
যাব।
কলকাতায় গিয়ে বাসাটায় একবার হানা দিয়ো। বিন্দু একা রয়েছে। অচলাকে তো সঙ্গে নিয়ে এলাম।
অন্যমনে একটা হুঁ দিয়ে দীপনাথ গিয়ে রিকশায় উঠে পড়ল।
বেলা সাড়ে দশটায় যখন উত্তরমুখো পাহাড়ের দিকে জিপ ছাড়ল তখনই সত্যিকারের একা হতে পারল দীপনাথ। সঙ্গে মোটোয়ানিরও আসার কথা ছিল। এভারেস্ট হোটেলে লাঞ্চ দিচ্ছে শিবরামন। কিন্তু মোটোয়ানিরও কাজ পড়ে যাওয়ায় এল না। ফলে জিপটার ড্রাইভার ছাড়া শুধু দীপনাথ। সৌভাগ্যই বলতে হবে।
গাড়িটা অবশ্য ঠিক জিপ নয়। জোংগা ডিজেল। তার রাখঢাক আছে। কোলা জিপ হলে তিনধারিয়ায় পৌঁছোতে পৌঁছোতেই শীতে নাক-কান অবশ হয়ে যেত। এই ঢাকাওলা জোংগাতেও সেটা কম হচ্ছিল না। কিন্তু অবিরল পাহাড়ের মধ্যে যেতে যেতে সব অনুভূতি হারিয়ে যাচ্ছিল দীপনাথের। সে একদিন একা মহাপ্রস্থানে বেরিয়ে পড়বে। একা নির্জন সাদা এক মহাপর্বত অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। সেই সাদা মস্ত অপার্থিব পাহাড়ের কথা ভাবলে নিজের তুচ্ছতা ব্যর্থতা। কামনা-বাসনা আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বড় আবছা হয়ে আসে। এক নির্জনতা ঘিরে ধরে তাকে।
বার বার কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উচ্চতায় ওঠার জন্য। ঢোক গিলে কানের ছিপি খুলছে সে। ঠান্ডায় ক্রমে সিঁটিয়ে আসছে হাত-পা, চোখে জল আসছে, কান কনকন করছে ব্যথায়। তবু যাত্রাটি খুব উপভোগ করে দীপনাথ। রাস্তাঘাট ফাঁকা, নির্জন। এই শীতে ট্যুরিস্ট নেই বলে রাস্তায় গাড়ি খুব কম। মাঝে মাঝে একটু মেঘলা করে আসে। কুয়াশার মতো মেঘ নেমে আসে রাস্তায়। বাক্যহীন নেপালি ড্রাইভারটি সম্পূর্ণ একাত্ম হয়ে আছে জোংগা গাড়িটির সঙ্গে। অজস্র ঘুণচক্কর পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে গাড়ি। আরও নির্জনতা, আরও শীত, মহান পর্বতের আরও কাছাকাছি হওয়া। তিনধারিয়ায় একবার, কার্শিয়াঙে আর-একবার চা খেয়ে নিল দীপনাথ আর তার নেপালি ড্রাইভার। দীপনাথ স্বচ্ছন্দে নেপালি ভাষা বলতে পারে। কিন্তু ইচ্ছে করেই সে ড্রাইভারটার সঙ্গে ভাব জমাল না। এই পথটুকু সে নীবব থাকতে চায়।
লাবুর সঙ্গে ভাব জমতে দুপুর হল। ভাব জমার পর অবশ্য লাবুকে আর থামায় কে! কথা আর শেষ হয় না। জানো বাবা!’বলে বারবার প্রীতমের থুতনি ধরে টেনে নিজের দিকে মুখখানা ফিরিয়ে নেয় আর তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব গল্প বলে যেতে থাকে।
তুমি আমাকে ভুলে যাওনি তো, লাবু?
তোমাকে? না তো। আমি তো সব সময়ে বাবা বাবা করি, তাই মা বলে–যাঃ, তোকে বাবার কাছে শিলিগুড়িতেই রেখে আসব। আমি বাপ-সোহাগি তো!
তাই নাকি? তবে থাকবে আমার কাছে?
তোমাকে তো সবচেয়ে ভালবাসি বাবা, কিন্তু মাকে ছেড়ে যে থাকতে পারি না।
মা তো অফিসে যায়, তোমার একা লাগে না?
না তো! অচলা মাসি থাকে তো।
আর কে থাকে?
আর কেউ না।
অরুণ মামা মাঝে মাঝে আসে না?
রোজ আসে। আমরা অরুণ মামার গাড়িতে কত বেড়াই। রবিবারে জু, আইসক্রিম, লাঞ্চ।
লাঞ্চ! কোথায় লাঞ্চ করো?
পার্ক স্ট্রিটে।
তোমার অরুণ মামা তো খুব সুন্দর, না লাবু? আমার চেয়ে অনেক সুন্দর।
তুমি একটু রোগা। কিন্তু তুমি খুব সুন্দর।
আর অরুণ মামা?
অরুণ মামাও সুন্দর। আমাকেও সবাই খুব সুন্দর বলে, বাবা। আমি সুন্দর তো! না বাবা!
তুমি? তুমি ভীষণ সুন্দর। এ বাড়িটা তোমার কেমন লাগছে, লাবু?
খুব ভাল। অনেক বড় তো বাড়িটা! কত গাছ!
পাহাড় দেখেছ?
হ্যাঁ, ছোটকাকু ছাদে নিয়ে গিয়ে দেখাল। আমাদের দার্জিলিং নিয়ে যাবে বড়কাকু, জানো বাবা?
দুরে একটা সাদা পাহাড় দেখেছ?
ওটা তো কাঞ্চনজঙ্ঘা। ছোটকাকু কী বলে জানো?
কী বলে?
বলে কাঞ্চনজঙ্ঘাটা নাকি একটা মস্ত বড় আইসক্রিম। সত্যি, বাবা?
আইসক্রিম? না, ঠিক তা নয়। দুপুরে তুমি একটু ঘুমোবে না লাবু?
আজ আমি ঘুমোব না। বড়কাকু একটু বাদে আমাকে মোটরসাইকেলে চড়িয়ে বেড়াতে নিয়ে যাবে।
ও বাবা! যদি পড়ে-উড়ে যাও?
যাঃ! আমি তো সকালবেলায় বড়কাকুর সঙ্গে কতটা ঘুরে এলাম। তিলক ময়দান, নিউ মার্কেট, সেভক মোড়, পুরনো স্টেশন। শিলিগুড়ি খুব সুন্দর, না বাবা?
তোমার ভাল লাগলেই ভাল।
তোমার ভাল লাগে না?
কী করে লাগবে? এখানে যে তুমি থাকো না। একা কি ভাল লাগে?
আমি একটু বড় হলেই এখানে চলে আসব।
তখন মাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?
পারব। বিয়ে যখন হবে তখনও তো মা-বাবাকে ছেড়ে থাকতেই হবে। বলো বাবা!
তা তো ঠিকই।
ছোটকাকুটা না ভীষণ বাজে কথা বলে।
কী বলে?
বলে এখানে নাকি কলকাতার চেয়েও উঁচু মনুমেন্ট আছে। আমি বললাম, কোথায় দেখাও। তখন না পাহাড়টা দেখিয়ে বলল, ওই তো আমাদের মনুমেন্ট, আছে তোদর কলকাতায় ওরকম মনুমেন্ট?
বটে!
হ্যাঁ, আর বলে কী জলদাপাড়ায় নাকি কলকাতার চেয়েও অনেক বড় জু আছে! সত্যি বাবা?
জলদাপাড়া একটা জঙ্গল।
তা হলে তো চিড়িয়াখানা হল না, বলো বাবা!
তা বটে।
শোনো না বাবা, আর বলে, কলকাতাটা পচা জায়গা। এখানে নাকি একটা দুধের পুকুর আছে, সেখানে ড়ুব দিলে সব অসুখ সেরে যায়। তোমাকে নাকি সেখানে নিয়ে গিয়ে চান করাবে, আর তুমি ভাল হয়ে যাবে। সত্যি, বাবা?
কে জানে!
চলো না বাবা, দুধের পুকুরটায় চান করে আসবে।
কথা বলতে বলতে একসময়ে লাবু পাশটিতে শুয়ে কখন বেখেয়ালে ঘুমিয়ে পড়ল। লেপটা ওর গায়ে ভাল করে টেনে দিল প্রীতম।
বাড়িটা নির্জন, চুপচাপ। শতম, মরম বা রূপম নিশ্চয়ই বাড়িতে নেই। বাবা অফিসে। মা বোন সবাই ঘুমোচ্ছে এই শীতের দুপুরে। এ সময়ে বিলু একবার আসবে কি?
প্রীতম কাগজপত্র টেনে নিয়ে হিসেব মেলাতে বসল। চোখ কান আনমনে প্রতীক্ষা করছিল বিলুর জন্য।
বিলু অবশ্য এল না। দোষ নেই, ট্রেনে ওর ভাল ঘুম হয়নি। দুপুরে ঘুমোচ্ছে একটু। বিলু এল বিকেল গড়িয়ে। ঘুমিয়ে চোখ-মুখ ফুলিয়েছে।
এসেই বলল, কী ঠান্ডা! আমার বোধহয় সর্দি লেগে গেল।
প্রীতম কোনও জবাব দিল না। তবে কাগজ কলম সরিয়ে বেখে বালিশে হেলান দিয়ে বসল।
বিলু চেয়ার টেনে আনল কাছে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কখন এসে তোমার কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে দেখো!
কলকাতায় কি লাবু আমার কথা বলে?
সারাক্ষণ।
আমাকে মনে রেখেছে তা হলে?
সে তো রেখেছেই, অন্যদেরও ভুলতে দিচ্ছে না।
ভুলতে কেউ চাইছে কি?
গম্ভীর হয়ে বিলু বলল, কে জানে বাবা!
প্রীতম একটু হাসল। বলল, অচলা একবাবও এ ঘরে এল না তো!
বিলু তেমনি থমথমে মুখে বলে, এখানে তো তোমার জন্য ওর কিছু করার নেই। তুমি ডাকলে আসবে।
বিলুর অভিমান-টভিমান নেই। তাই হঠাৎ এই গাম্ভীর্যটা কেন তা প্রীতম ভেবে দেখছিল। গত কয়েক মাসে বিলুর স্বভাবের খুঁটিনাটি দিক অনেকটাই ভুলে গেছে সে। একদিন চোখের আড়ালের বিলুকে কল্পনায় যেরকম ভাবত, আসল বিলু তার চেয়ে অনেক বেশি বর্ণহীন, অনুত্তেজক।
প্রীতম বলল, চেয়ারটা টেনে বসো।
বসবার সময় নেই। পাড়াসুদ্ধ মেয়ে-বউ ঝেটিয়ে এসেছে দেখা করতে। সামনে না গেলে কী ভাববে! আমি বরং অচলাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি গিয়ে।
বিলু চলে গেলে প্রীতম ঘুমন্ত লাবুর গায়ে হাত রেখে গভীর চোখে মেয়ের টুলটুলে মুখখানা দেখল। শীতে ঠোঁট দুখানা শুকিয়ে রয়েছে। গাল ফেটেছে। গা থেকে শিশু-শরীরের মাতলা গন্ধ আসছে। পৃথিবীর কোনও সুগন্ধই এর কাছে দাঁড়াতে পারবে না। মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে প্রীত আপনমনে ভাবল, তুমি আমার বড় আপন লাবু, বড় আপন।
কেমন আছেন?
আচমকা অচলার গলার স্বরে একটু চমকে গিয়েছিল প্রীতম। মুখ তুলে হাসল, ভাল। তুমি?
আপনি কিন্তু সত্যিই ভাল আছেন। চেহারা ফিরেছে।
মোটা হয়েছি বলছ?
না, তা নয়। তবে ফ্রেশ দেখাচ্ছে।
হয়তো চেঞ্জের ফল।
অচলা মাথা নেড়ে বলে, শুধু চেঞ্জ নয়।
বোসো।
বিছানায় তো বসবে না অচলা, চেয়ারেও নয়। তাই একটু ইতস্তত করে বিছানার পাশে মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে লাবুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কলকাতায় আমরা রোজ রাতে আপনাকে নিয়ে গল্প করি।
আমাকে ভুলে যাওনি তো?
কী যে বলেন! আপনাকে ভোলা কি অত সহজ?
বিলু কি আমার কথা খুব বলে?
আমরা সবাই বলি।
রাতটা জলপাইগুড়িতেই কাটানোর কথা ছিল। কিন্তু রাত দশটার মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেল, মোটোয়ানির জোংগাটা তখনও মজুদ রয়েছে। দীপনাথ তাই ভাবল, থেকে কী হবে!
জলপাইগুড়ির ঘোষমশাই অবশ্য বললেন, আরে আপনার জন্য গেস্টরুমে বিছানা করিয়ে রেখেছি, খামোখা এই ঠান্ডায় যাবেন কেন?
কিছু হবে না। শিলিগুড়িতে আমার রিলেটিভরা রয়েছে। তাদের তো সময় দিতে পারছি না। তাই বাতটা গিয়ে থাকি।
অনিচ্ছের সঙ্গে ঘোষ রাজি হলেন। অবশ্য বললেন, রাস্তা খুব নিরাপদ নয় কিন্তু। নিউ জলপাইগুড়ির তিন বাত্তির মোড়টা ডেঞ্জারাস।
দেশের সব জায়গাই ডেঞ্জারাস।
তা অবশ্য বটে।
কথা না বাড়িয়ে জোংগায় চেপে বসল দীপনাথ। নেপালি ড্রাইভার বোধহয় ঘরে ফেরার তাড়ায় প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এল তাকে।
দার্জিলিং আর জলপাইগুড়ির দুটি অ্যাপয়েন্টমেন্টই খুব গুরুতর ছিল। বোস বলে দিয়েছে, সম্ভব হলে রাত্রেই আমাকে ট্রাংক কল করে জানাবেন কী হল।
জলপাইগুড়ি থেকে টেলিফোন করার সময় হয়নি। রাত পৌনে এগারোটায় দীপনাথ শিলিগুড়ি টেলিফোন এক্সচেঞ্জে হানা দেয়। এখানে পুরনো বন্ধুরা রয়েছে। মোটামুটি সবাই চেনা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বোসের বাড়ির লাইন পেয়ে গেল।
বোস সাহেব?
না, উনি এখনও ফেরেননি। আপনি কে বলছেন?
দীপনাথ হাসল। মণিদীপা তার গলা ভালই চেনে। তবে হয়তো বহু দূরের কল হওয়ায় গলাটা অন্যরকম শোনাচ্ছে।
সে একটু চেঁচিয়ে বলল, আমি দীপনাথ চ্যাটার্জি।
যাঃ! গলাটা অন্যরকম লাগছে কেন?
লাগলে কী করব? আমি তো নিজের গলাতেই কথা বলছি।
ঠান্ডা লাগিয়েছেন নাকি?
না। পাগলদের সর্দি হয় না, জানেন তো!
হয় না? যাঃ বাজে কথা। আমি অনেক পাগল দেখেছি, যাদের সর্দি হয়েছে।
তারা জেনুইন পাগল নয়।
আপনিও জেনুইন পাগল নন। সত্যিই আপনি তো! না কি অন্য কেউ নাম ভাঁড়িয়ে ইয়ারকি করছে।
আমিই।
প্রমাণ দিন।
সেই যে আপনার জন্য রতনপুরে মৌমাছির কামড় খেয়েছিল।
ওঃ মাই গড!
তার মানে?
আমিও এইমাত্র ওই ঘটনাটাই ভাবছিলাম।
তা হলে আমি জেনুইন দীপনাথ তো?
ভীষণ জেনুইন।
বোস সাহেব এলে একটা খবর দিতে পারবেন ওঁকে?
না। আমাদের নন কমিউনিকেশন চলছে কাল থেকে!
হঠাৎ আবার কী হল?
হচ্ছে তো রোজই।
তা হলে খবরটা দেওয়ার কী হবে?
খুব জরুরি?
জরুরি না হলে রাত এগারোটায় কেউ ট্রাংক কল করে?
তা হলে মেসেজটা বলুন, আমি লিখে বেয়ারার হাত দিয়ে ওর ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
খবরটা যেন উনি আজই পান।
পাবেন। মণিদীপা কাজের ভার নিলে করে।
আপনি এত রাত পর্যন্ত জেগে আছেন কেন?
মণিদীপার গা জ্বালানো হাসির শব্দটা এল। বলল, বিরহে। আপনি নর্থ বেঙ্গলে যাওয়ার পর থেকেই এই দশা।
আমি নর্থ বেঙ্গলে এসেছি তা কি আপনি জানতেন?
এমনিতে জানতাম না। তবে হৃদয়ে হৃদয়ে কি টেলিপ্যাথি হয় না?
যা একখানা ফাজিল তৈরি হয়েছেন না! এবার লিখুন তো! হাতের কাছে কাগজ-কলম আছে? আছে। বাদি তৈরি। বলুন।
ছি ছি। আচ্ছা লিখুন।