2 of 2

৫৩. প্রতাপের বাড়ি বেশ দূরে

প্রতাপের বাড়ি বেশ দূরে, তাই মামুন আদালতেই দেখা করতে এলেন। এই ক’মাসে বেশ রোগা হয়ে গেছেন মামুন, মাথার চুল আরও পেকেছে, প্রায় সমবয়স্ক হলেও প্রতাপের তুলনায় তাঁকে বেশি বয়স্ক দেখায়। প্রতাপ একটা মামলার রায় লিখছিলেন বলে মামুনকে কিছুক্ষণ বসতে হলো। কয়েকজন উকিলবাবু গল্প করতে লাগলেন তাঁর সঙ্গে, জয়বাংলার মানুষ সম্পর্কে সকলেরই খুব কৌতূহল। উকিলবাবুদের মধ্যে অনেকেরই বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গে, পুরোনো কথা কার কতটা মনে আছে তা নিয়ে প্রায় একটা প্রতিযোগিতা চলে। যে-কোনো জায়গায় গেলেই মামুন দেখতে পান, পাঁচজনের মধ্যে অন্তত তিনজন এসেছেন পূর্ববঙ্গ থেকে। সাধে কী আর এখানকার কেউ কেউ এক এক সময় বলে ওঠে, ওফ, বাঙালরা কলকাতা শহরটা একেবারে দখল করে নিল!

খানিকবাদে দুই বন্ধু শিয়ালদা কোর্ট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। বাতাসে একটু শীত শীত ভাব, মামুন কুতা-পাজামার ওপর শাল জড়িয়ে এসেছেন, প্রতাপ অবশ্য কোনো গরম জামা পরেননি।

মামুন বললেন, প্রতাপ, তোমার মনে আছে, এখানে নরেন কেবিন বলে একটা চায়ের দোকান ছিল, ছাত্র বয়েসে আমরা সেখানে ডিমের চপ খেতে যেতাম? বেশ বানাতো কিন্তু! সেই দোকানটা আছে এখনও?

প্রতাপ হেসে বললেন, কী জানি! ওদিকে তো আমার অনেকদিন যাওয়া হয় না।

মামুন বললেন, চলো না, আজ সেইখানে গিয়ে চা খাই! নাকি তুমি হাকিম বলে ওইসব জায়গায় তোমার যাওয়া চলে না? নিষেধ আছে?

প্রতাপ বললেন, না, না, নিষেধ আবার কী? রাস্তায় বেরুলে কে হাকিম আর কে আসামী তা কি চেনার উপায় আছে? আমার কথা বাদ দাও, আমি তো একটা চুনোপুঁটি, জেলায় থাকার সময় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের কত ক্ষমতা দেখেছি, কত তাদের তেজ আর দাপট, আবার তারাই যখন রাইটার্স বিল্ডিংসে ডেপুটি সেক্রেটারি বা জয়েন্ট সেক্রেটারি হয়ে আসে, তখন কলকাতার রাস্তায় তাদের কে পোঁছে? কলকাতা সবাইকে গ্রাস করে নেয়।

মামুন বললেন, তাইলে চলো না একবার নরেন কেবিনে যাই?

প্রতাপ বললেন, যাওয়া যেতে পারে। আমাকে একবার ওরা ছুরি মারার চেষ্টা করেছিল, আর বোধ হয় দ্বিতীয়বার মারবে না!

মামুন থমকে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলেন, ছুরি মারতে এসেছিল? কারা?

প্রতাপ বললেন, কারা সেটা বলা মুশকিল। নকশাল, না সি পি এম না কংগ্রেস! কে যে কখন কাকে ছুরি মারছে, তা কি বোঝার উপায় আছে? আমাকে সম্ভবত মারতে এসেছিল নকশালরাই, ওরা দু-একজন জজ-ম্যাজিস্ট্রেটকে খুন করেছে, অথচ আমার ছেলে ছিল ওই দলে। কচি কচি ছেলে, তাদের কারা যে এই সব উসকানি দেয়!

মামুন বললেন, তা হলে যেতে হবে না! তুমি এই কথাটা তো আমাকে আগে বলো নাই?

প্রতাপই এবার মামুনের হাত ধরে টেনে বললেন, চলো যাই, ইচ্ছে যখন হয়েছে, আরে ছাত্রদের ভয় পেলে কি চলে? তারা তো তোমার-আমার ঘরেরই ছেলেপুলে। তবে ইদানীং খুনোখুনি একটু কমেছে।

তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পরেও সেই নরেন কেবিন অবিকল একই রকম আছে। বাঙালীরা ব্যবসায়ের উন্নতি বিশেষ পছন্দ করে না, কোনোমতে টিকিয়ে রাখতে পারলেই হলো। একটা টেবিল-চেয়ারও বাড়েনি কিংবা কমেনি, শুধু দেওয়ালগুলি মলিন হয়েছে। কাউন্টারে একজন। মাঝবয়েসী লোক, সম্ভবত আগেকার মালিকের ছেলে। তার পেছনে ঝুলছে জবাফুলের মালা পরানো একটি কালীঠাকুরের ছবি।

মামুন ভেতরে ঢুকে চারপাশটা দেখলেন আবেগ মাখানো চোখে। এই সময়ে দোকানে। বিশেষ ভিড় নেই, দিনের বেলায় ছাত্ররা চলে গেছে, সন্ধের ছাত্ররা এখনো আসেনি, দুটো তিনটে টেবিলই ফাঁকা। মামুন একদিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ওই টেবিলটায় আমাদের আড্ডা ছিল, তাই না?

তারপর তিনি দোকানের মালিকের দিকে হাতজোড় করে বললেন, নমস্কার। জানেন, ছাত্র বয়েসে আমরা এখানে আসতাম, বহু বৎসর হয়ে গেল, সেকেণ্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের আগে!

মালিকটি প্রতি-নমস্কার করে বললো, জয়বাংলা থেকে এসেছেন? বসুন, বসুন, কী খাবেন?

মামুন বললেন, এগ চপ! একসময় এই নরেন কেবিনের এগ চপ ফেমাস ছিল। এখনও

মালিকটি বললো, অবশ্যই। ডিমের ডেভিল আছে, সেই সঙ্গে মটন ঘুগনি খেয়ে দেখুন। এখন খুব চলছে।

টেবিলে বসার পর মামুন প্রতাপকে জিজ্ঞেস করলেন, দেখেই কী করে বুঝলো আমি জয়বাংলার লোক?

প্রতাপ বললেন, তোমার উচ্চারণ শুনে বুঝেছে।

মামুন বললেন, আমি কলকাতায় এতদিন ছিলাম, ঘটিভাষা পারফেক্ট বলতে পারি।

প্রতাপ বললেন, তবু একটা টান থেকে যায়, বুঝলে! আমি তো টানা এত বছর ধরে আছি, তবু আমার কথা শুনেও অনেকে ধরে ফেলে। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদের উচ্চারণে সেই টান। নেই। এক জেনারেশনে উচ্চারণ চেইঞ্জ করা যায় না।

মামুন বাইরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রিপন কলেজের নাম এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ হয়েছে? আর সেন্ট্রাল কলেজ এখন মৌলানা আজাদ? আর কী কী নাম বদল হয়েছে?

–হয়েছে অনেক কিছু। হ্যারিসন রোডের নাম এখন মহাত্মা গান্ধী রোড তা জানো তো!

–সেটা দেখেছি। এর মধ্যে দুই তিনদিন কলেজ স্ট্রিটে গেছিলাম। আচ্ছা প্রতাপ, আমাদের সাথে যারা পড়তো, লুতফর রহমান, বৈদ্যনাথ, সুবিমল এরা সব কোথায় আছে জানো?

–নাঃ, খবর রাখি না। সুবিমল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের সারভিসে আছে, একবার ট্রেনে দেখা হয়েছিল। চাকরি নিয়ে প্রথমে বেশ কয়েক বছর তো আমাকে মফস্বলে পোস্টিং নিতে হয়েছিল, তাই সকলের সঙ্গে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যায়।

প্রতাপ একটা সিগারেট ধরাতেই মামুন লোভীর মতন তাকালেন। ডাক্তারের নির্দেশে তাঁর সিগারেট খাওয়া একেবারে বন্ধ। কিন্তু আকাঙ্ক্ষাটা যায়নি। তিনি বলেই ফেললেন, একটা সিগারেট খাবো নাকি আজ? পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে এত–

প্রতাপ বললেন, না। ছেড়েছো যখন আর খেও না!

কলেজজীবনের টুকিটাকি গল্প করতে লাগলেন দু’জনে। অনেক স্মৃতি।

একসময় মামুন হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, বুলার খবর কী? সে কোথায় থাকে?

প্রতাপ মামুনের চোখের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে হেসে বললেন, তোমার সেই ‘আশমানের প্রজাপতি’? এখনো মনে রেখেছে তার কথা? নাঃ, তার খবর কিছু জানি না!

–তোমার সাথে তার আর কখনো দেখা হয়নি?

–তা অবশ্য দেখা হয়েছিল। বেশ কয়েকবারই দেখা হয়েছে। তবে গত কয়েক বছর আর দেখা হয়নি। টালিগঞ্জের দিকে থাকে, এইটুকু জানি।

–একবার যাওয়া যায় না তার কাছে? ওর বাড়ির লোকজন কিছু কি মনে করবেন? বুলার স্বামী কী করেন?

–বুলার স্বামী এখানে থাকেন না। স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই বহু বছর। বুলার জীবনটা সুখের হয়নি।

–ইস রে! এত ভালো মেয়ে ছিল, অপরূপ সুন্দর ছিল গানের গলা। আমি তো মনে। করতাম, বুলা একদিন পশ্চিমবাংলার নাম করা গায়িকা হবে। ওর ভালো নাম গায়ত্রী, তাও আমার মনে আছে। সত্যিকারের ট্যালেনটেড মেয়ে, তার জীবনটা এরকমভাবে নষ্ট হয়ে গেল? আমাদের বাঙালীঘরের মেয়েদের অনেক গুণ থাকলেও তারা ব্যবহার করতে পারে না। কেন এমন হলো, প্রতাপ? বুলার স্বামী এমন মেয়ের গুণের কদর করতে পারলো না?

প্রতাপ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।

মায়ের মৃত্যুর পরই দেওঘরের সঙ্গে সম্পর্ক চুকে গিয়েছিল প্রতাপের। বুলা দেওঘরেই থাকে, না টালিগঞ্জে থাকে, তা তিনি জানেন না। এক একবার টালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে বুলার সঙ্গে দেখা করবার বাসনা তাঁর মনে জাগে, আবার তা দমন করে ফেলেন। বুলার সম্পর্কে তাঁর যে টান, তাকে কি ভালোবাসা বলা যায়? না, তিনি তো বুলাকে সেভাবে কখনো চাননি। তবু বুলা সম্পর্কে তাঁর খানিকটা অপরাধবোধ, খানিকটা দুর্বলতা এবং খানিকটা অধিকারবোধও যেন রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে একটা অদৃশ্য বন্ধন।

মামুন বললেন, প্রতাপ, তুমি বুলার বিয়ের খবর শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলে তাই না?

একটু হালকা সুরে প্রতাপ বললেন, বুলাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলে তুমি, কষ্ট পাবার কথা তো তোমার! আমি কষ্ট পাবো কেন? তার সঙ্গে সেরকম কোনো সম্পর্ক তো আমার ছিল না!

মামুনও হেসে বললেন, আরে, আমি তো শুধু কবিতাই লিখেছি। যেমন লোকে। নদী-সরোবর, বৃষ্টি-মেঘ-জ্যোৎস্না নিয়ে কবিতা লেখে, সেই রকমই প্রায়। আমি মুসলমানের ব্যাটা। সেই আমলে কোনো ব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে করার কথা কি স্বপ্নেও চিন্তা করা যেত? তা ছাড়া বুলার বেশি পছন্দ ছিল তোমাকেই, তুমি তাকে অনায়াসে বিয়ে করতে পারতে।

বুলা যে একসময় বেপরোয়া হয়েই নিজের মুখে প্রতাপকে প্রায় বিয়ের প্রস্তাব জানিয়েছিল, সে কথা মামুনকে বলা হয়নি। এতদিন পর আর বলারও কোনো মানে হয় না।

প্রতাপ বললেন, কেন, আমার বউ মমতাকে তোমার পছন্দ হয়নি? সে বুলার চেয়ে কোন অংশে কম?

মামুন লজ্জা পেয়ে বললেন, আরে না, না, ছি ছি, মমতা বউঠানের তো তুলনাই হয় না। এইরকমভাবে বলাটাই আমার বোকামি হয়েছে। ওইসব পুরোনো কথা তোলার আর কোনো মানে হয় না, তাই না? তবু বুলার অসুখী জীবনের কথা শুনে খারাপ লাগলো। আর একবার দেখতে ইচ্ছে করে তাকে।

–তুমি দেখা করতে পারো। তোমরা পাশাপাশি গ্রামের মানুষ, তোমাকে দেখলে সে নিশ্চয় খুশি হবে।

–চলো না। আমরা দুইজনে একবার যাই। প্রতাপ, আমরা দুইজনেই সমানভাবে বুলাকে ভালোবেসেছিলাম, সে কথা এখন অস্বীকার করে লাভ কী? কিন্তু আমাদের ভালোবাসা ছিল নিষ্কলুষ। সেইজন্যই আমাদের দুইজনের মধ্যে রেষারেষি কিংবা বিবাদ হয়নি।

দোকানের মালিক জয়বাংলার অতিথিকে খাতির দেখাবার জন্য নিজের হাতে খাবার নিয়ে এলো। আস্ত ডিম সেদ্ধ করে তার ওপর বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে ভাজা, তারই নাম এগ চপ কিংবা ডিমের ডেভিল। সঙ্গে এক প্লেট করে কিমা মেশানো ঘুগনি।

মাঝখানে খাবার এসে পড়ায় বুলা প্রসঙ্গটা চাপা পড়ে গেল। একদল ছাত্র ঢুকলো হই হই করে। তারা আলোচনা করছে বাংলাদেশ বিষয়ে। তাদের কোলাহলে মামুন আর প্রতাপ চুপ। করে রইলেন একটুক্ষণ।

মুজিবনগরের বাংলাদেশ সরকারকে ইন্দিরা গান্ধী কেন স্বীকৃতি দিচ্ছে না, এই নিয়ে তর্ক বেঁধেছে দুই দল ছাত্রদের মধ্যে। ওরা কয়েকজন সম্প্রতি অনেকগুলি শরণার্থী শিবির দেখতে এবং ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে গিয়েছিল বোঝা গেল। তিরানব্বই লাখ শরণার্থী এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে ভারতে। ক্যাম্পগুলোতে কলেরায়, বন্যায়, অপুষ্টিতে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শয়ে শয়ে, আর কতদিন এরা এইভাবে টিকে থাকতে পারবে? ইণ্ডিয়া গভর্নমেন্টই বা কতকাল এদের। বোঝা বইবে? পৃথিবীর অন্য শক্তিগুলো মুখ ফিরিয়ে আছে। ইন্দিরা গান্ধীর উচিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া, বাংলাদেশ একটা আলাদা রাষ্ট্রের মর্যাদা পেলে তখন ইণ্ডিয়া খোলাখুলি বাংলাদেশকে সামরিক সাহায্য দিতে পারবে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে। নাক গলানো হবে না। ভারতীয় সৈন্যদের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যদের দমন করা ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের আর কোনো গতি নেই।

ছাত্রদের অন্য দলটি বলছে, ভারতীয় সৈন্য কেন ইস্ট পাকিস্তানে ঢুকবে? সেটা অ্যাগ্রেশান। বাংলাদেশের যুবশক্তি মুক্তিযুদ্ধ চালাচ্ছে, তারা সেই গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাক। তাতে যত সময় লাগে লাগুক। মুক্তিযোদ্ধারাই দেশটাকে স্বাধীন করতে পারলে সেটাই হবে তাদের পক্ষে সবচেয়ে সম্মানজনক। সারা পৃথিবীর সামনে তারা গর্বিত মাথা তুলে দাঁড়াবে!

প্রতাপ নিচু গলায় বললেন, এইসব ছেলেরা একদিন চীন, মাও সে তুঙ, ভিয়েতনাম, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এই ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কথা বলতো না। হঠাৎ যে বাড়ির পাশের আগুনের দিকে তাদের চোখ পড়েছে, এটাই আশ্চর্য কথা।

মামুন বললেন, এই যে ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার কথা বলছে, আমাদের জেনারেল ওসমানিরও সেই মত। তিনি ইণ্ডিয়ান আর্মির পারটিসিপেশন ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। এটা একটা সর্বনেশে কথা!

প্রতাপ বললেন, কেন? এ কথাটা তো আমার কানেও মন্দ ঠেকছে না। নিজেদের চেষ্টায় দেশ স্বাধীন করা তো অনেক বেশি অনারেবল!

মামুন বললেন, তোমরা একটা জিনিস বুঝতে পারছে না। অনিশ্চিতভাবে কতদিন এই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? ততদিনে যে দেশটা একেবারে ছারখার হয়ে যাবে। আমাদের কাছে নিয়মিত খবর আসে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আর্মির হাতে মারা যাচ্ছে। লুটপাট চলছে প্রচণ্ড। বাংলাদেশের সোনাদানা সব পাচার হয়ে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা যতই সাহসের পরিচয় দিক, গাদা বন্দুক আর হাতবোমা নিয়ে কি একটা। আধুনিক, অর্গানাইজড সেনাবাহিনীকে খতম করা যায়? মানুষ মারতে ওদের একটুও দ্বিধা নেই, প্রতাপ, কত পরিবার যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, তা তোমরা ঠিক বুঝবে না।

একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মামুন আবার বললেন, আরও একটা কথা আছে। আমরা মুখে বলি বটে, যে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী স্বাধীন বাংলা চায়। কিন্তু আসলে তা তো সত্যি নয়! দেখো, ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন প্রায় বাতিল করে দিয়ে একটা উপ-নির্বাচন। ডাকলো। আমরা এখান থেকে ভেবেছিলাম বাংলাদেশের একটা মানুষও সেই উপ-নির্বাচনে। অংশ নেবে না, তারা সেই নির্বাচন বয়কট করবে। কিন্তু তা তো হলো না! শত শত হঠাৎ গজানো নেতা সেই উপ-নির্বাচনের ক্যাণ্ডিডেট হয়েছে। এইসব মানুষ কারা? আমি এক এক সময় ভাবি, বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয়, তখন এইসব বিশ্বাসঘাতক কী ভূমিকা নেবে? তারপর ধরো, রাজাকার, আল বদর, আল শামস, এইসব বাহিনীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, এরাও তো বাঙালী! পাক আর্মি এখন এদেরই বেশি করে লেলিয়ে দিচ্ছে মুক্তিবাহিনীর দিকে। শান্তি কমিটি, জামাতে ইসলামের লোকেরা বেছে বেছে খুন করছে শিক্ষিত বাঙালীদের। এইসব খবরই আমরা পাই আর শিউরে উঠি। বাঙালীর হাতেই মরছে বাঙালীরা। যাকে আমরা সোনার বাংলা বলি, তার চতুর্দিকে এখন শুধু গোরস্থান আর শ্মশান।

প্রতাপ বললেন, ওঃ, এত হত্যা আর অত্যাচারের কথা আর সহ্য করতে পারি না। এক এক সময় এই মানুষ জাতটার ওপরেই ঘেন্না ধরে যায়।

মামুন বললেন, আরও বিপদ আছে। এদেশে তিরানব্বই লাখ শরণার্থী এসেছে। ভারত সরকার যতদূর সম্ভব সাহায্য করার করছে, তা অস্বীকার করি না। সাধারণ মানুষও খুবই সহানুভূতি দেখাচ্ছে এ পর্যন্ত। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কি এই সহানুভূতি ঠিক থাকতে পারে? পাকিস্তানী এজেন্ট আর কট্টর ইসলামপন্থী এদেশেও কম নেই। তারা যদি কোনোক্রমে। একটা দাঙ্গা বাধিয়ে দিতে পারে, তা হলে আমাদের কী অবস্থা হবে, চিন্তা করতে পারো? আমাদের নেতারা যারা এখনো পর্যন্ত সঙঘবদ্ধ হয়ে আছে মোটামুটি, তারাই বা কতদিন এরকম থাকতে পারবে? তোমাকে একটা ঘটনা বলি শোন। একদিন আমি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেবের আপিসঘরে বসেছিলাম। একসময় আওয়ামী লীগের কয়েকজন মাঝারি গোছের নেতা এলেন দেখা করতে। তেনারা আবার জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য। একথা সেকথার মধ্যে তাঁরা আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের নামে নিন্দামন্দ চালিয়ে যেতে লাগলেন। একজন তো হঠাৎ কামরুজ্জামান সাহেবকে তোল্লাই দেবার জন্য বলেই ফেললেন, আপনি অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, আপনাকে বাদ দিয়ে তাজউদ্দিন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসলেন কীভাবে? আমরা তো ভেবেছিলাম আপনিই…

দেখো প্রতাপ, কামরুজ্জামানকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি, তবু আমার বুকটা একটু কেঁপে উঠেছিল। অতিরিক্ত তোষামোদে পাথরও গলে যায়। বাঙালী পলিটিশিয়ানরা কোন ছার! কিন্তু কামরুজ্জামান উঠে দাঁড়িয়ে চক্ষু লাল করে বললেন, দেশ থেকে বাড়িঘর, বউ ছেলেমেয়ে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছেন, কিন্তু আপনারা চরিত্রটা ফেলে আসতে পারেননি? এখানেও আমাদের মধ্যে ঝগড়া লাগাতে এসেছেন? আগে অন্তত সবাই মিলেমিশে দেশটা স্বাধীন করুন, তারপর ফিরে গিয়ে যত ইচ্ছে দলাদলি করবেন!

ছাত্রদের চ্যাঁচামেচি তুঙ্গে উঠেছে, আর এখানে বসা যায় না। প্রতাপ উঠে পড়ে বিল মেটাতে গেলেন, দোকানের মালিক হাত জোড় করে বললেন, পয়সাটা থাক স্যার!

মামুন বললেন, আরে সে কি! পয়সা নেবেন না কেন?

মালিকটি বললো, আপনারা জয়বাংলা থেকে এসেছেন! আমার দোকানে খেয়েছেন, এতেই ধন্য হয়েছি। এই সামান্য পয়সা আর কী নেবো?

প্রতাপ বললেন, ইনি জয়বাংলার মানুষ, আমার সঙ্গে জয়বাংলার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি এনাকে সঙ্গে করে এনেছি, আমি কেন বিনা পয়সায় খাবো? আপনার ইচ্ছে হলে টাকাটা বাংলাদেশ ফাণ্ডে চাঁদা দিয়ে দেবেন!

প্রায় জোর করেই দু’জনের খাবার ও চায়ের দাম কাউন্টারের ওপর রেখে প্রতাপ বেরিয়ে এলেন।

মামুন বললেন, যাই বলো, এইসব ব্যবহার বেশ টাচিং। সর্বত্রই এইরকম ভালো ব্যবহার পাই। আমাদের কারুর এখন ট্রেনের টিকিট কাটতে হয় না। সঙ্গে পরিচয়পত্র থাকলে ট্রামে বাসেও ভাড়া লাগে না।

প্রতাপ বললেন, একটা কথা তুমি ঠিকই বলেছে। এখন সাধারণ লোকে যে খাতির করছে, আর বেশিদিন থাকলে সেটা আর পাবে না।

মামুন বললেন, অতিথিদের পনেরো দিনের বেশি থাকার কথা নয়। আমাদের প্রায় আট মাসের ওপর হয়ে গেল! কবে যে দেশে ফিরতে পারবো তা জানি না! দাও প্রতাপ, আজ একটা অন্তত সিগারেট দাও! আজ মনটা খুব চঞ্চল লাগছে। হঠাৎ যেন ছাত্র বয়েসে ফিরে গেছিলাম।

ঝুলোঝুলি করে মামুন একটা সিগারেট আদায় করে ছাড়লেন। সেটাতে আরাম করে টান দিয়ে তিনি বললেন, প্রতাপ, তুমি নরেন কেবিনের মালিককে বললে, তুমি জয়বাংলার কেউ না। তুমি বাংলাদেশের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারো? বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তুমি মালখানগরে একবার যাবে না?

একটুও দ্বিধা না করে প্রতাপ বললেন, না!

–সে কি! মালখানগরে তোমাদের বাড়িটা আর একবার দেখতে ইচ্ছে করে না! বাংলাদেশ স্বাধীন হলে যাওয়া-আসার আর কোনো অসুবিধা থাকবে না আশা করি।

–অসুবিধে না থাকলেও হয়তো ঢাকায় যেতে পারি, বেড়াতে, কিন্তু মালখানগরে আর গিয়ে কী হবে বলো? সিক্সটি ফাইভের আগে তো ওদিক থেকে কিছু লোকজন যাওয়া আসা করতো। তাদের মুখে শুনেছি, আমাদের বসতবাড়ির দরজা-জানলাও কারা যেন খুলে নিয়ে গেছে। পুকুরের ওপারে আমাদের যে বাগানটা ছিল, সেটা নাকি একেবারে নিশ্চিহ্ন, সেখানে চাষ হয়। আমাদের বৈঠকখানা বাড়িটা পাকিস্তান সরকারের কী একটা অফিস হয়েছে। এইসব দেখার জন্য ফিরে যাবো? এর মধ্যে বাড়িটা যদি কেউ জবরদখল করে থাকে, সে আমাকে দেখে আঁতকে উঠবে না? কেউ কি সেখানে আমাকে আদর করে বসতে দেবে? না, মামুন, যা গেছে তা গেছে। আমাদের বাড়িটার যে সুন্দর ছবিখানা মনের মধ্যে গেঁথে আছে, সেটাই থাক। ফিরে গিয়ে শুধু কষ্ট পাবো। সেই ছবিটা নষ্ট করেই বা কী লাভ হবে!

মামুন চুপ করে রইলেন।

একসময় প্রতাপ মামুনকে পৌঁছে দিলেন পার্ক সাকাসের বাড়িতে। মঞ্জু হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান তুলছে, সেখানে রয়েছে পলাশ, বরুণ ও আরও তিন চারটি ছেলেমেয়ে। মামুনের মেয়ে হেনা বাড়িতে নেই, সে কয়েকদিনের জন্য গেছে ফাস্ট এইড ও নার্সিং-এর ট্রেইনিং নেবার জন্য। মহেন্দ্র রায় লেনে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে খোলা হয়েছে এই শিবির। বেগম সাজেদা চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন পরিচালনা করছেন সেই শিবির। গৌরী আইয়ুবের সঙ্গে পরিচয় হবার পর তিনিই মামুনকে বলেছিলেন, আপনার মেয়েকেও এই ট্রেইনিং দিইয়ে রাখুন না। স্বাধীনতার জন্য মেয়েদেরও তো কিছু অংশ নিতে হবে!

প্রতাপ কিছুক্ষণ থেকে ছেলেমেয়েদের গানবাজনা শুনে বিদায় নিলেন।

মামুন কিন্তু বুলার কথা ভুললেন না। তিন চারদিন পর আবার একদিন প্রতাপের কাছে এসে বললেন, একবার কি তার বাসায় যাওয়া যায় না? আমরা শুধু দেখা করে দুটো কথা বলবো, তাতে দোষের কী আছে? তুমি তো ওদের বাসা চেনো!

প্রতাপ প্রথমে অন্য প্রসঙ্গ তুলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। টালিগঞ্জে বুলার শ্বশুরবাড়িতে প্রতাপ কখনো যাননি বটে, কিন্তু তাঁর ভতুমামার বাড়ির কাছেই সেই বাড়ি, তিনি দূর থেকে দেখেছেন। ভমামাদের বাড়িতেও প্রতাপের আর যেতে ইচ্ছে করে না।

মামুন অন্য কথায় ভুললেন না। হার্টের অসুখটা হবার পর থেকেই তিনি বড় বেশি স্মৃতি রোমন্থন শুরু করেছেন। বুলাকে তিনি মনে মনে তাঁর যৌবনের শ্রেষ্ঠ কিছু সময় নিবেদন করেছিলেন, এখন তিনি সেই বুলার কাছে আর একবার ফিরে যেতে চান। সে যেন যৌবনেই ক্ষণেকের জন্য ফিরে যাওয়া। বুলা যে এখন একজন প্রৌঢ়া মহিলা, তিনি জানেন, তিনি নিজেও তো প্রায় বৃদ্ধ, তিনি তো আর বুলার রূপদর্শন করতে চাইছেন না, বুলার সঙ্গে তিনি পুরোনো দিনের কথাই বলবেন।

প্রতাপকে শেষপর্যন্ত রাজি হতেই হলো। এসপ্লানেডে এসে তাঁরা টালিগঞ্জের ট্রাম ধরলেন। এ বছরের মতন গরম বিদায় নিয়েছে, বাতাস বেশ মোলায়েম রকমের ঠাণ্ডা। ময়দান দিয়ে ছুটছে ট্রাম, কোনো একটা ফুটবল ম্যাচের পর রাশি রাশি যুবক সেই ট্রামের সর্বত্র বাদুড়ের মতন ঝুলছে, তাদের আনন্দধ্বনি ও খিস্তিখেউড়ে কান পাতা যায় না, তবু মামুন তারই মধ্যে প্রতাপকে শোনাচ্ছেন বুলার বিয়ের দিনটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা।

প্রতাপ অবশ্য তা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না। তাঁর মনে পড়ছে বুলার দেওর সত্যেনের কথা। দেওঘরের সেই সন্ধ্যা, সত্যেন সেদিন বুলাকে ছোট গিন্নি বলে সম্বোধন করেছিল, বুলার হাত ধরে জোর করে টেনে তাকে গান গাইতে বলেছিল। দেওর হিসেবে সে বউদির সঙ্গে কিঞ্চিৎ ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতেই পারে, কিন্তু প্রতাপ কিছুতেই সেটা পছন্দ করতে পারেননি, তাঁর অহেতুক রাগ হচ্ছিল।

সত্যেন এখন বেশ নামী লোক, কাগজে প্রায়ই তার নাম বেরোয়, কিছুদিন আগে তার স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে। সে খবরও প্রতাপ কাগজে পড়েই জেনেছেন। নিজের পয়সায় সত্যেন স্ত্রীর ছবি সমেত বড় করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সত্যেনের যে-কোনো খবরই প্রতাপের চোখ টানে। প্রতাপের সবসময়ই মনে হয়, লোকটা সুবিধের নয়। বুলার স্বামী বেঁচে আছে কি না কে জানে, মোট কথা সে থেকেও নেই, বুলার ছেলে বিদেশে, তা হলে বুলা কি এখন পুরোপুরি সত্যেনের খপ্পরে পড়ে আছে? থাকলেই বা কী, প্রতাপ তো কোনো রকমেই বুলাকে সাহায্য করতে পারবেন না। এসব ক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না।

টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো থেকে নেমে একটুক্ষণ হাঁটার পরেই প্রতাপ থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মনে হলো, তিনি একটা বিষম ভুল করতে যাচ্ছেন।

তিনি বললেন, মামুন, একটা কথা বলি? বাড়িটা আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, তুমি একাই যাও।

মামুন বিরাট অবাক হয়ে বললেন, সে কি, এতদূর এসেও তুমি যাবে না কেন?

প্রতাপ বললেন, বাড়িতে কিছু বলে আসিনি, ফিরতে দেরি হলে ওরা চিন্তা করবে। তুমিই যাও বরং। বুলার শ্বশুরবাড়ির ওরা নারানগঞ্জের লোক, তোমাকে দেখে খুশিই হবে। ওর দেওর সত্যেনবাবু মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক কমিটির একজন হোমরাচোমড়া।

মামুন প্রতাপের হাত ধরে বললেন, আরে একদিন বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলে কী হয়? চলো, চলো, আমরা বেশিক্ষণ থাকবো না।

প্রতাপ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৃঢ়ভাবে বললেন, না, আমি যাবো না। যে-কারণে প্রতাপ মালখানগরের নিজেদের বাড়িটা আর কখনো ফিরে গিয়ে দেখবেন না ঠিক করেছেন, সেই কারণেই বুলার কাছে তিনি আর জীবনে কখনো যেতে চান না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *