॥ ৫৩ ॥
একটা পঙ্ক্তি কৃষ্ণকান্ত আজকাল প্রায়ই আপনমনে বিড়বিড় করে আওড়ায়। হতো বা প্রান্স্যসি স্বর্গং, জিত্বা বা ভোক্ষসে মহীম। সংস্কৃত শেখা তার কাছে এক নতুন জগতের দরজা খুলে যাওয়ার মতো। এক গহীন চির-প্রদোষের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে আছে। কত ফুল, কত না লতানে গাছ, মহীরুহ। গায়ে কাঁটা দেয়। ব্যাকরণের বেড়াজাল সে অনায়াসে টপকাতে পারে ওই অসম্ভব রূপময় জগতে প্রবেশ করার তীব্র তৃষ্ণায়। বৃক্ষমূলের বেদীতে বসে আছেন ঋষিরা। জ্ঞান ও উপলব্ধির স্নিগ্ধ মহিমা তাঁদের মুখমণ্ডলে। যেখানে মায়ামুগ্ধ হরিণ শকুন্তলার আঁচল চিবিয়ে খায় স্নেহবশে। ন্যগ্রোধ, ইঙ্গুদি, বাহ্বাস্ফোট কত শব্দ কৃষ্ণকান্তর বুকের মধ্যে নানা রকম বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে। কিন্তু কোনো কোনো পঙ্ক্তি তার বুকের মধ্যে গতিময় তীরের মতো এসে আমূল গেঁথে যায়। যদি মরো তো স্বর্গলাভ করবে, যদি জেতো তো ভোগ করবে পৃথিবীকে। এই পঙ্ক্তির মধ্যে লুকোনো এক যাদু তাকে ভিন্নতর কাজে উত্তেজিত করে অনবরত।
মনু পিসি শুধু তাকে সংস্কৃতই শেখায় না। মাঝে মধ্যে এমন সব কবিতার লাইন মুখস্থ করিয়ে দেয় যা দামামার শব্দ তুলে দেয় রক্তে। হায় সে কী সুখ এ গহন ত্যজি, হাতে লয়ে জয়তূরী, জনতার মাঝে ছুটিয়া পড়িতে, রাজ্য ও রাজা ভাঙিতে গড়িতে, অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া হানিতে তীক্ষ্ণ ছবি। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস ঘটনার কথা এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। কৃষ্ণকান্ত সেই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শুনে নিয়েছে মনুপিসির কাছে, মাস্টারমশাইয়ের কাছে। তার শরীর অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট প্রতিশোধস্পৃহায় শিহরিত হয়।
তাছাড়া আছে শশিভূষণ। সে বরিশালের জেলে বন্দী। মামলা উঠবে শীগগীরই। হয়তো ফাঁসি হয়ে যাবে। কিন্তু শশিভূষণের স্মৃতি কিছুতেই তাড়াতে পারে না কৃষ্ণকান্ত। কয়েকদিন তাদের বাড়িতে ছিল লোকটা। অসুস্থ, সংজ্ঞাহীন। তবু সেই লোকটার মুখে এমন এক সর্বস্ব পণ রাখা মরীয়া ভাব ছিল যা সহজে ভুলতে পারে না সে। ভুলতে অবশ্য চায়ও না।
একদিন এই শহরেও বিলিতি কাপড়ে বহ্ন্যুৎসব হয়ে গেল। পুলিস গুলি চালিয়েছিল। কয়েকজন মরেছে। কৃষ্ণকান্ত সময়মতো খবর পায়নি। পেলে যেত। গিয়ে পুলিসদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে হাতের রাইফেল কেড়ে নিত। উল্টে গুলি চালাত দুম দুম।
সিদ্ধান্ত নিতে খুব বেশী দেরী হল না কৃষ্ণকান্তর। একদিন সন্ধেবেলা সে রঙ্গময়ীকে বলল, মনুপিসি, আমি স্বদেশী করব।
রঙ্গময়ী চোখ কপালে তুলে বলে, বলিস কী? তাহলে যে তোর বাবা শয্যা নেবে।
শয্যা নেবে কেন?
স্বদেশী করা কি চাট্টিখানি কাজ রে! জেল আছে, মারধর আছে, ফাঁসিগুলি আছে।
আমি তো ভয় পাই না।
তুই দামাল ছেলে, তাই ভয় পাস না। কিন্তু তোর বাবা যে পায়।
তুমি বাবাকে বোলো না। আমি লুকিয়ে করব।
রঙ্গময় সস্নেহে হেসে বলে, আচ্ছা করিস। বয়স হোক।
কত বয়স?
অন্তত কুড়ি একুশ।
ততদিন বসে থাকতে হবে?
না, ততদিন তৈরি হতে হবে।
তৈরি হতে হয় আবার কী ভাবে?
সে অনেক আছে। স্বদেশীদের ট্রেনিং হয়, জানিস না? শরীরটাকে মজবুত করে তুলতে হয়, অনেক লেখাপড়া আছে, লাঠি খেলা ছোরা খেলা শেখা আছে। বন্দুকের টিপ ঠিক করতে হয়। এ হল একরকম স্বদেশী। আর একরকম আছে, যারা অহিংসার পথে চলে। চরকা বোনে, কাপড় পোড়ায়, অসহযোগ করে। তারা মার খায়, কিন্তু মারে না। যেমন গান্ধীজী।
আমি মারতে চাই।
সে জানি। তোর চোখমুখেই সে কথা লেখা আছে। কিন্তু মারলেই তো হল না। কোন পথটা ঠিক আগে সেইটে বিচার করতে হবে। তার জন্যই বয়স দরকার।
তোমার কাছে কোনটা ঠিক?
আমি মেয়েমানুষ, আমার কথা ছেড়ে দে। বড় হ, বোধবুদ্ধি পাকুক, তখন নিজের বোধবুদ্ধিমতো পথ বেছে নিবি। স্ত্রীবুদ্ধিতে চলতে নেই।
লাঠি ছোরা খেলা কার কাছে শেখা যায় বলো তো।
শেখানোর লোকের অভাব কী? বিপিনের কাছেই শেখ না।
বাবাকে বলে দেবে না তো!
বলব না। তবে তোর বাবাও এক সময়ে মুগুর ভাঁজত। তার কাছেও অনেক শেখার আছে।
কিন্তু বাবা কি শেখাবে?
সেটা বলে দেখতে পারি। অন্য কাউকে না হলেও তোকে হয়তো শেখাবে।
এক আধদিন শিখিয়ে ছিল। তারপর আর গা করে না।
তোর বাবা লাঠিখেলা ছোরাখেলাও জানত এক সময়ে। আমি বলি, বাবার কাছেই শেখ। তোরও কাজ হবে, তোর বাবারও সময়টা কাটবে।
তুমি বাবাকে বলে দাও।
দেবো।
আজই।
আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। আজই।
এক্ষুনি চলো।
রঙ্গময়ী আতঙ্কিত হয়ে বলে, ও বাবা, এখন কি যেতে পারি। রাত হয়েছে।
রাত হয়েছে তো কি?
আমরা বাইরের লোক, হুটহাট অন্দরমহলে ঢাকা আমাদের বারণ।
কে বলেছে তুমি বাইরের লোক?
বাইরের লোক নই? বলিস কী রে! আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার পর্যন্ত কথা উঠেছিল।
সে তো বড়দা আর শচীনদা মিলে করেছিল। যত সব বদমাইশী।
ছিঃ। ও কী কথা? বদমাইশী আবার কী! গুরুজন না।
বদমাইশীই তো। বাড়ির সব লোককে তাড়িয়ে দিল না?
যা করেছে তা তাদের ভালর জন্যই।
ছাই ভাল। হরদা আমাকে কত গল্প বলত। পাগল লোক। তাকে তাড়াবে কেন? ওরা কি আমাদের আপন লোক নয়?
রঙ্গময়ী একটু ম্লান হেসে বলল, বেশ বাবা বেশ। সবাইকে আপন বলে ভাবা তো খুব ভাল। কিন্ত একটু বড় হলে বুঝবে, দুনিয়াটা অত ভাল নয়। সেইজন্যই তো তোকে বড় হতে বলি অত করে।
কী করে তাড়াতাড়ি বড় হওয়া যায় বলো তো! ব্যায়াম করে?
রঙ্গময়ী খুব হাসে। মাথা নেড়ে বলে, বড় কি জোর করে হওয়া যায় রে! যখন বয়স হবে তখন আপনা থেকেই বড় হয়ে যাবি। কসরৎ করতে হবে না।।
একটা কথা বলবে মনুপিসি?
কী কথা?
শচীনদার সঙ্গে কি ছোড়দির বিয়েটা হবে?
বোধহয় না।
কী করে বুঝলে?
যেভাবেই বুঝে থাকি না কেন, তোর তাতে কী দরকার? ওসব নিয়ে ভাববার দরকার নেই তোর।
বড় বউদি কিন্তু বলে, হবে।
রঙ্গময়ী অপ্রতিভ বোধ করতে থাকে। চপলার প্রসঙ্গটা তার কাছেও অস্বস্তিকর। সে বলল, বলুক গে।
তুমি দেখো, বড় বউদি বিয়েটা ঠিক দেবে।
আচ্ছা দেখব। এখন চলো।
কোথায়?
বাবার কাছে।
কাল সকালে যাবো।
না, এক্ষুনি।
তুই বড় জ্বালাস বাবা।।
তুমি তো সবসময়েই বাবার কাছে যেতে আগে। এখন যাও না কেন?
বলিস না ওসব। রঙ্গময়ী আতঙ্কিত গলায় বলে, লোকে কী ভাববে?
তাহলে চলো।
রঙ্গময়ী কিছুক্ষণ এই অত্যন্ত জেদী ছেলেটির দিকে চেয়ে থাকে। জেদটা ভাল না মন্দ তা বুঝবার চেষ্টা করে। তার মনে হয়, ছেলেটার মধ্যে আগুন আছে। কিন্তু আগুনটা কোত্থেকে এল? ওর বাবা তো ভেজা ন্যাকড়ার মতো মানুষ। মা ছিল আর পাঁচজন মেয়েমানুষের মতোই সাধারণ। কৃষ্ণকান্ত কি তবে তার কাকার আগুনটুকু পেল?
নলিনী যত না বিপ্লবী ছিল তার চেয়ে বেশী ছিল সন্ন্যাসী। ওই এক ধরনের মানুষ। সংসাবের মাটি কিছুতেই গায়ে মাখে না। কৃষ্ণকান্ত ঠিক সেরকমও নয়।
রঙ্গময়ী হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণকান্তর কপাল থেকে চুলগুলি সরিয়ে সেই দাগটা আবার দেখল। স্পষ্টতই রাজটীকা। কোনো ভুল নেই। নাসামূল থেকে চওড়া কপাল ভেদ করে মাথা স্পর্শ করেছে গয়ে। সরল ও সুস্পষ্ট। একটা গভীর তৃপ্তির স্বাদ ছাড়ে রঙ্গময়ী।
কী দেখলে পিসি? রাজটীকা?
রঙ্গময়ী চাপা গলায় বলে, খবরদার! কাউকে বলবি না।
বলি না তো! তুমি বারণ করার পর থেকে কাউকে বলিনি। তুমি লম্বা চুল দিয়ে ঢেকে রাখতে বলেছিল। তাই রাখি। তবে বউদি মাঝে মাঝে চুল পাট করে আঁচড়াতে বলে।
রঙ্গময়ী গর্জন করে বলে, শুনবি না।
কৃষ্ণকান্ত একটু ফচকে হাসি হেসে বলে, কেউ দেখে ফেললে কী হবে পিসি? কিছু কি হয়?
তোদের তো শত্রুর অভাব নেই। কার মনে কী আছে! সুলক্ষণ দেখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে হয়তো বিষই খাওয়াবে।
দুর! রাজটীকা কত ছেলের আছে!
তোকে বলেছে।
বলবে কেন? দেখি তো। ক্লাসের অনেক ছেলের কপালে রাজটীকা।
রঙ্গময়ী ঠাট্টা বুঝে হাসে। কৃষ্ণকান্ত আজকাল খুব ঠাট্টা ইয়ার্কি শিখেছে। সে বলে, রাজটীকা অত সস্তা নয় রে। এখন যা। কাল সকালে তোর বাপকে যা বলার বলব।
রঙ্গময়ীর কাছে পড়া শেষ করে প্রসন্নমনে হ্যারিকেন হাতে বাড়ি ফেরার সময় কৃষ্ণকান্তর আবার সেই পঙ্ক্তিটা মনে পড়ে। মরলে স্বর্গে যাবে, বেঁচে থাকলে ভোগ করবে সমস্ত পৃথিবী, সুতরাং তোমার আদর্শ প্রতিষ্ঠায় প্রাণকে বাজি রাখো।
বারবাড়ির অন্ধকার মাঠে একটু দাঁড়ায় কৃষ্ণকান্ত। চরাচর নিঃঝুম। এই নির্জনতায় দাঁড়িয়ে সে অনেক বড় একটা কিছুকে অনুভব করে। সে তার স্বদেশকে টের পায়। তার মনে হয় এই ভারতবর্ষের জন্য তার কিছু করার আছে। তার গায়ে কাঁটা দেয়। ভিতরে ভিতরে এক অদ্ভুত অকারণ আনন্দ ঢেউ দিতে থাকে। সে সামান্য সংসারে বাঁধা থাকবে না। সে সামান্য মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবে না। তার কপালে আছে জন্মগত রাজটীকা। সে একটা কিছু হবে। হবেই।
রাত্রিবেলা বাবার পাশে খেতে বসে কৃষ্ণকান্ত খুব কুণ্ঠিত স্বরে বলল, বাবা, আপনি নাকি অনেক ব্যায়াম জানেন।
হেমকান্ত একটু হাসলেন, কেন, তুমি শিখবে?
শিখলে হয়। শরীরটা মজবুত করা দরকার।
বিপিনের কাছে যেও। সে শেখায়।
আপনি শেখালে আরো ভাল হয়।
আমি সেই কবে করতাম। এখন ভুলেও গেছি বোধহয়।
আপনি শেখালে আমি খুব তাড়াতাড়ি শিখতে পারব।
হেমকান্ত সস্নেহে ছেলের দিকে একটু তাকান। তারপর বলেন, আচ্ছা দেখা যাবে।
হেমকান্তর কাছে শেখার একটা আলাদা আনন্দ আছে। কৃষ্ণকান্ত হঠাৎ টের পেয়েছে তার সংসার-উদাসীন বাবা সব ছেলেমেয়ের মধ্যে তাকেই একটু বেশী ভালবাসেন। কেন বাসেন তা সে জানে না। এই গম্ভীব মানুষটির কাছ থেকে তার স্নেহ কাঙাল মন বারবার ওই রকম ভালবাসা চায়।
কৃষ্ণকান্ত কি হেমকান্তর মধ্যে তার মাকেই দেখতে চায়?
না, কৃষ্ণকান্ত তার মাকে চেনেই না। মাকে সে দেখতে চায়ও না তেমন করে। সে বাবাকেই চায়। পুরোপুরি বাবাকে।
কাল থেকে কি আমি মুগুর ভাঁজবো বাবা?
ক্ষতি কি? ওটাও ভাল অভ্যাস! তোমাকে একটু শিখিয়েছি না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
মুগুর ঘোরালে কাঁধ আর হাতের পেশী শক্ত হয়। খুব ভাল অভ্যাস।
আপনি লাঠিখেলা জানেন?
জানতাম।
ছোরাখেলা?
হ্যাঁ, তুমি কি ওসবও শিখতে চাও নাকি?
হ্যাঁ।
কেন বলো তো?
এমনি! শিখে রাখা তো ভাল।
খাওয়ার মাঝখানে হঠাৎ সামনে এসে বসে চপলা। মাথায় ঘোমটা পুরোপুরি টানা নয়। গা থেকে সুবাস আসছে। ইভনিং ইন প্যারিস। শাড়িটা যথেষ্ট ঝলমলে। মুখে প্রসাধন! বাড়ির বউ নিশ্চয়ই এত রাতে সাজে না। কারণ না থাকলে।
হেমকান্ত সামান্য গম্ভীর হয়ে ভাত মাখতে থাকেন। খেতে রুচি নেই। শুধু মেখেই যান।
চপলা একটু প্রগলভা। কৃষ্ণকান্তকে প্রশ্ন করে, কী কথা হচ্ছিল রে? লাঠি ছোরা খেলবি?
হ্যাঁ বউদি।
কেন? ডাকাতি করবি নাকি?
না, ডাকাত মারব।
তার জন্য বন্দুক শেখ। ছোরা লাঠির দিন আর নেই।
কৃষ্ণকান্ত বলে, স্বদেশীরা লাঠি ছোরার খেলা শেখে কেন তাহলে?
স্বদেশীদের ব্যাপারই আলাদা। তুই তো আর স্বদেশী নয়।
হেমকান্ত উঠে পড়েন। বাইরে থেকে তাঁর গাড়ুর জল ঢালার গব গব শব্দ হয়। কুলকুচো করছেন জোরে।
কৃষ্ণকান্ত তার বউদির মাদকতাময় মুখটির দিকে চেয়ে বলল, আমিও স্বদেশী হবো।
এসব কে তোকে শেখাচ্ছে বল তো?
কে আবার শেখাবে। বলো তো এই লাইনগুলো কার? হায় সে কী সুখ এ গহন ত্যজি হাতে লয়ে জয়ত্রী, জনতার মাঝে ছুটিয়া পড়িতে, রাজ্য ও রাজা ভাঙিতে গড়িতে অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া হানিতে তীক্ষ ছুরি।
ও বাবা! বাংলা আবার কোনো জন্মে পড়েছি নাকি? তার ওপর আবার কবিতা। কার লেখা রে।
বলব কেন? তুমি খুঁজে বের কর।
লাইনগুলো বেশ ভাল। তবে স্বদেশী-স্বদেশী গন্ধ আছে।
তুমি শশীদাকে চেনো?
শশীদা আবার কে?
আমাদের বাড়িতে যে স্বদেশী লোকটা লুকিয়ে ছিল।
চিনব কী করে? তখন তো আমি এখানে ছিলাম না। কেন সে কী করেছে?
দারুণ লোক। বরিশালে একটা সাহেব মেরেছিল।
ওঃ দারুণ কাজ তো।
দারুণ নয়?
শুনেছি একজন নিরীহ পাদ্রীকে খুন করেছিল। নিরীহ মানুষকে মারা তো খুব বীরত্বের কাজ!
লোকটা ছিল স্পাই।
ওসব মারার পর বানিয়ে বলেছে।
তুমি কিছু জানো না।
আমি অনেক জানি। সাহেবরা এখনো সপ্তাহে তিনচারদিন আমাদের বাড়িতে ডিনার খায়।
তোমরা মুর্গী খাও?
খেলে কী?
এঃ মা।।
ওঃ, খুব বৈষ্ণব হয়েছিস তোরা, না। তোর বড়দাও তো খায়।
খায়?
খায় মানে। ঠ্যাং চিবোতে বসলে জ্ঞান থাকে না।
দাঁড়াও বাবাকে বলে দেবো।
দিস। কিছু হবে না। আমরা ছেলেবেলা থেকে মুর্গী খাই। বাবা বনমোরগ মেরে আনত, আমরা বেঁধে খেতাম।
ঘেন্না করে না?
ঘেন্নার কী রে বাঁদর? মুর্গী কি অখাদ্য?
তোমাদের জাত যায় না?
আমরা তো সাহেব।
সাহেবরা আমাদের শত্রু।
তোর মাথা।
একশবার শত্রু। বলে আচমকা চেঁচিয়ে ওঠে কৃষ্ণকান্ত। তার মুখ চোখে ক্রোধবহ্নির হলকা।
চপলা একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
কৃষ্ণকান্ত বউদির দিকে চেয়ে ছিল। চোখের ভিতর থেকে যে হলকা বেরিয়ে আসছিল তার তা হঠাৎ স্তিমিত হয়ে গেল। চমৎকার একটু হেসে সে বলল, এসব বাবাকে বোলো না।
চপলার বিস্ময় তখনো কাটেনি। বলল, তুই কী রে?
আমি আবার কী?
এইমাত্র তোর চেহারাটা কেমন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
কৃষ্ণকান্ত লজ্জা পায়। মাথা নামিয়ে হাসে।
চপলা হঠাৎ বলল, তোর রাগ তো সাঙ্ঘাতিক। বড় হয়ে মানুষ খুন করবি না তো।
না। শুধু ইংরেজ।
চপলা একটু ইংরেজ-প্রেমিক। কিন্তু এই বালক দেওরটির সঙ্গে তার আর তর্ক করার সাহস হল না! কৃষ্ণকান্তর চোখের আগুনের কথা সে ভুলতেও পারল না। অনেক রাত্রি পর্যন্ত সে বার বর অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কী দেখল সে কৃষ্ণকান্তর মধ্যে? কী?
কয়েক দিনের মধ্যেই কৃষ্ণকান্ত প্রবল বেগে মুগুর ঘোরাতে লাগল, নানাবিধ ব্যায়াম শুরু করে দিল। যে মনোযোগ নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে সে এসব করে তা দেখে হেমকান্ত অবাক। খুশিও। তাঁর অন্য ছেলেদের মধ্যে এ জিনিস নেই। তাঁর নিজের মধ্যেও নেই।
হেমকান্তর শরীরেও কি নবযৌবন এল? তিনি ইদানীং যে জবুথবু ভাবটা অনুভব করছিলেন তা এক লহমায় কেটে গেল কৃষ্ণকান্তর পাল্লায় পড়ে।
ভোরবেলা কাক ডাকার আগেই তিনি ওঠেন। কৃষ্ণকান্তকে ডাকতে হয় না। তার ভিতরে যেন নির্ভুল এক ঘড়ি টিক টিক করে সর্বদা। হেমকান্ত উঠে রোজই দেখতে পান, কৃষ্ণকান্তও উঠে তৈরি হচ্ছে।
বাপব্যাটায় তারপর বেরোন দৌড়োতে। দৌড়োলে দম বাড়ে, ফুসফুস শক্তিশালী হয়, সারা শরীরে রক্তে সঞ্চালন ঘটে। শেষ রাত্রির অন্ধকারে নদীর ধারের রাস্তা ধরে দৌড়োবার সময় একটা পরিশ্রত লগন্ধময় বাতাস এসে ঝাপটা দেয়। শরীরের কোষে কোষে ঢুকে যত পাপতাপ দূষিত জিনিস শুষে নিয়ে যায়। বড় ভাল লাগে হেমকান্তর।
লাকড়ির ঘর থেকে ধূলিধূসর বিস্মত কয়েকখানা লাঠি বেরোলো। চমৎকার পাকা বাঁশের লাঠি, পেতলে বাঁধানো গাঁট। মুছেটুছে তেল চকচকে করে তোলা হল সেগুলোকে। তারপর একদিন ভিতরের উঠোনে মালকোঁচা মেরে লাঠি হাতে লাফ দিয়ে নামলেন হেমকান্ত।
ঠকাঠক লাঠির শব্দে বাতাস গরম হয়ে ওঠে। হেমকান্তর রক্ত চনমন করতে থাকে। বিস্মৃত বিদা আবার ফিরে আসতে থাকে তাঁর কাছে। প্রথম যৌবনের মতোই এখনো দ্রুত চলছে তাঁর পা, হাত। তেমনি বিদ্যুৎ বেগে ঘোরাফেরা করছে চোখ। নিজের সক্ষমতা দেখে তিনি নিজেই অবাক।
আরো অবাক, যখন দেখেন কৃষ্ণকান্ত স্বভাব-লাঠিয়ালের মতো এক এক লহমায় লাঠির এক একটা কৌশল চমৎকার শিখে নিচ্ছে। চোখে সেই তদগত দৃষ্টি, যা সাধকদের থাকে। তবে বৈরাগ্য ও নিস্পৃহতা নয়। চোখে একধরনের ধিকিধিকি আগুন আছে কৃষ্ণকান্তর।
অদ্ভুত! অদ্ভুত! মনে মনে বারবার বলেন হেমকান্ত। তাঁর বিস্ময়ের ঘোর আর কাটতেই চায় না। এক পরিপূর্ণ আনন্দে তাঁর হৃদয় মথিত ও ব্যথিত হতে থাকে।
কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যেবেলা কৃষ্ণকান্তর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। লোক লস্কর চারদিকে ছুটল। হেমকান্ত চিন্তিতভাবে পায়চারী করছিলেন বারান্দায়। হঠাৎ কী খেয়াল হতে তিনি ধীরে ধীরে গিয়ে নলিনীর পরিত্যক্ত ঘরে হাজির হলেন।
দরজাটা ভেজানো। খুব সন্তর্পণে দরজাটা ঠেলে ঢুকলেন তিনি। তারপর থমকে দাঁড়ালেন। নলিনীর ঘর এখনো যেমনকে তেমনই আছে। সেই চৌকি, টেবিল, চেয়ার, দেয়ালে পাবনার ঠাকুরের সেই ছবি। নলিমী তাঁর শিষ্য ছিল।
চৌকির ওপর চুপ করে বসে আছে কৃষ্ণকান্ত। শিরদাঁড়াটা সোজা। চোখ মুদ্রিত। ধ্যানস্থ। মশা ছেঁকে ধরেছে তাকে। কিন্তু সে বোধহয় টেরই পাচ্ছে না।
হেমকান্ত মৃদুস্বরে ডাকলেন, কৃষ্ণ!
কোনো জবাব নেই।
হেমকান্ত দরজাটা ভেজিয়ে এসে চৌকিতে বসলেন। ছেলের মুখোমুখি। তারপর মেরুদণ্ড সোজা করে চোখ বুজলেন।