একবিংশ পরিচ্ছেদ
মাস্টার ও ডাক্তার সংবাদ
মাস্টার ডাক্তারের বাড়ি উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ডাক্তার দুই-একজন বন্ধু সঙ্গে বসিয়া আছেন।
ডাক্তার (মাস্টারের প্রতি) — এই একমিনিট হল তোমার কথা কচ্ছিলাম। দশটায় আসবে বললে, দেড় ঘণ্টা বসে। ভাবলুম, কেমন আছেন, কি হল। (বন্ধুকে) ‘ওহে সেই গানটা গাও তো’।
বন্ধু গাহিতেছেন:
কর তাঁর নাম গান, যতদিন দেহে রহে প্রাণ।
যাঁর মহিমা জ্বলন্ত জ্যোতিঃ, জগৎ করে হে আলো;
স্রোত বহে প্রেমপীযূষ-বারি, সকল জীব সূখকারী হে।
করুণা স্মরিয়ে তনু হয় পুলকিত বাক্যে বলিতে কি পারি।
যাঁর প্রসাদে এক মুহূর্তে সকল শোক অপসারি হে।
উচ্চে নিচে দেশ দেশান্তে, জলগর্ভে, কি আকাশে;
অন্ত কোথা তাঁর, অন্ত কোথা তাঁর, এই সবে সদা জিজ্ঞাসে হে।
চেতন নিকেতন পরশ রতন সেই নয়ন অনিমেষ,
নিরঞ্জন সেই, যাঁর দরশনে, নাহি রহে দুঃখ লেশ হে।
ডাক্তার (মাস্টারকে) — গানটি খুব ভাল, — নয়? ওইখানটি কেমন?
‘অন্ত কোথা তাঁর, অন্ত কোথা তাঁর, এই সবে সদা জিজ্ঞাসে।’
মাস্টার — হাঁ, ও-খানটি বড় চমৎকার! খুব অনন্তের ভাব।
ডাক্তার (সস্নেহে) — অনেক বেলা হয়েছে, তুমি খেয়েছো তো? আমার দশটার মধ্যে খাওয়া হয়ে যায়, তারপর আমি ডাক্তারী করতে বেরুই। না খেয়ে বেরুলে অসুখ করে। ওহে, একদিন তোমাদের খাওয়াব মনে করেছি।
মাস্টার — তা বেশ তো, মহাশয়।
ডাক্তার — আচ্ছা, এখানে না সেখানে? তোমরা যা বল। —
মাস্টার — মহাশয়, এইখানেই হোক, আর সেইখানেই হোক, সকলে আহ্লাদ করে খাব।
এইবার মা কালীর কথা হইতেছে।
ডাক্তার — কালী তো একজন সাঁওতালী মাগী। (মাস্টারের উচ্চহাস্য)
মাস্টার — ও-কথা কোথায় আছে?
ডাক্তার — শুনেছি এইরকম। (মাস্টারের হাস্য)
পূর্বদিন শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ ও অন্যান্য ভক্তের ভাবসমাধি হইয়াছিল। ডাক্তারও উপস্থিত ছিলেন। সেই কথা হইতেছে।
ডাক্তার — ভাব তো দেখলুম। বেশি ভাব কি ভাল?
মাস্টার — পরমহংসদেব বলে যে, ঈশ্বরচিন্তা করে যে ভাব হয় তা বেশি হলে কোন ক্ষতি হয় না। তিনি বলেন যে মণির জ্যোতিতে আলো হয় আর শরীর স্নিগ্ধ হয়, কিন্তু গা পুড়ে যায় না!
ডাক্তার — মণির জ্যোতিঃ; ও যে Reflected light!
মাস্টার — তিনি আরও বলেন, অমৃতসরোবরে ডুবলে মানুষ মরে যায় না। ঈশ্বর অমৃতের সরোবর। তাঁতে ডুবলে মানুষের অনিষ্ট হয় না; বরং মানুষ অমর হয়। অবশ্য যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকে।
ডাক্তার — হাঁ, তা বটে।
ডাক্তার গাড়িতে উঠিলেন, দু-চারিটি রোগী দেখিয়া পরমহংসদেবকে দেখিতে যাইবেন। পথে আবার মাস্টারের সঙ্গে কথা হইতে লাগিল। ‘চক্রবর্তীর অহংকার’ ডাক্তার এই কথা তুলিলেন।
মাস্টার — পরমহংসদেবের কাছে তাঁর যাওয়া-আসা আছে। অহংকার যদি থাকে, কিছুদিনের মধ্যে আর থাকবে না। তাঁর কাছে বসলে জীবের অহংকার পলায়ন করে অহংকার চূর্ণ হয়। ওখানে অহংকার নাই কি না, তাই। নিরহংকারের নিকট আসলে অহংকার পালিয়ে খায়। দেখুন, বিদ্যাসাগর মহাশয় অত বড়লোক, কত বিনয় আর নম্রতা দেখিয়েছেন। পরমহংসদেব তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন, বাদুড়বাগানের বাড়িতে। যখন বিদায় লন, রাত তখন ৯টা। বিদ্যাসাগর লাইব্রেরীঘর থেকে বরাবর সঙ্গে সঙ্গে, নিজে এক-একবার বাতি ধরে, এসে গাড়িতে তুলে দিলেন; আর বিদায়ের সময় হাতজোড় করে রহিলেন।
ডাক্তার — আচ্চা, এঁর বিষয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কি মত?
মাস্টার — সেদিন খুব ভক্তি করেছিলেন। তবে কথা কয়ে দেখেছি, বৈষ্ণবেরা যাকে ভাব-টাব বলে, সে বড় ভালবাসেন না। আপনার মতের মতো।
ডাক্তার — হাতজোড় করা, পায়ে মাথা দেওয়া, আমি ও-সব ভালবাসি না। মাথাও যা, পাও তা। তবে যার পা অন্য জ্ঞান আছে, সে করুক।
মাস্টার — আপনি ভাব-টাব ভালবাসেন না। পরমহংসদেব আপনাকে ‘গম্ভীরাত্মা’ মাঝে মাঝে বলেন, বোধ হয় মনে আছে। তিই কাল আপনাকে বলেছিলেন যে, ডোবাতে হাতি নামলে জল তোলপাড় হয়, কিন্তু সায়ের দীঘি বড়, তাতে হাতি নামলে জল নড়েও না। গম্ভীরাত্মার ভিতর ভাবহস্তী নামলে তার কিছু করতে পারে না। তিনি বলেন, আপনি ‘গম্ভীরাত্মা’।
ডাক্তার — I don’t deserve the Compliment, ভাব আর কি? feelings; ভক্তি, আর অন্যান্য feelings — বেশি হলে কেউ চাপতে পারে, কেউ পারে না।
মাস্টার — Explanation কেউ দিতে পারে একরকম করে — কেউ পারে না; কিন্তু মহাশয়, ভাবভক্তি জিনিসটা অপূর্ব সামগ্রী। Stebbing on Darwinism আপনার library-তেa দেখলাম। Stebbing বলেন, Human mind যার দ্বারাই হউক — evolution দ্বারাই হোক বা ঈশ্বর আলাদা বসে সৃষ্টিই করুন — equally wonderful. তিনি একটি বেশ উপমা দিয়েছেন — theory of light. Whether you know the undulatory theory of light or not, light in either case is equally wonderful.
ডাক্তার — হাঁ; আর দেখেছো, Stebbing Darwinism মানে, আবার God মানে।
আবার পরমহংসদেবের কথা পড়িল।
ডাক্তার — ইনি (পরমহংসদেব) দেখছি কালীর উপাসক।
মাস্টার — তাঁর ‘কালী’ মানে আলাদা। বেদ যাঁকে পরমব্রহ্ম বলে, তিনি তাঁকেই কালী বলেন। মুসলমান যাঁকে আল্লা বলে, খ্রীষ্টান যাঁকে গড্ বলে, তিনি তাঁকেই কালী বলেন। তিনি অনেক ঈশ্বর দেখেন না। এক দেখেন। পুরাতন ব্রহ্মজ্ঞানীরা যাঁকে ব্রহ্ম বলে গেছেন। যোগীরা যাঁকে আত্মা বলেন, ভক্তেরা যাঁকে ভগবান বলেন, পরমহংসদেব তাঁকেই কালী বলেন।
“তাঁর কাছে শুনেছি, একজনের একটি গামলা ছিল, তাতে রঙ ছিল। কারু কাপড় ছোপাবার দরকার হলে তার কাছে যেত। সে জিজ্ঞাসা করত, তুমি কি রঙে ছোপাতে চাও। লোকটি যদি বলত সবুজ রঙ, তাহলে কাপড়খানি গামলার রঙে ডুবিয়ে ফিরিয়ে দিত; ও বলত, এই লও তোমার সবুজ রঙে ছোপানো কাপড়। যদি কেহ বলত লাল রঙ, সেই গামলায় কাপড়খানি ছুপিয়ে সে বলত, এই লও তোমার লালে ছোপানো কাপড়। এই এক গামলার রঙে সবুজ, নীল, হলদে, সব রঙের কাপড় ছোপানো হত। এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে একজন লোক বললে, বাবু আমি কি রঙ চাই বলব? তুমি নিজে যে রঙে ছুপেছো আমায় সেই রঙ দাও। সেইরূপ পরমহংসদেবের ভিতরে সব ভাব আছে, — সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের লোক তাঁর কাছে শান্তি পায় ও আনন্দ পায়। তাঁর যে কি ভাব, কি গভীর অবস্থা, তা কে বুঝবে?”
ডাক্তার — All things to all men! তাও ভাল নয় although St. Paul says it.
মাস্টার — পরমহংসদেবের অবস্থা কে বুঝবে? তাঁর মুখে শুনেছি, সুতার ব্যবসা না করলে ৪০ নং সুতা আর ৪১ নং সুতার প্রভেদ বুঝা যায় না। পেন্টার না হলে পেন্টার-এর আর্ট বুঝা যায় না। মহাপুরুষের গভীর ভাব। ক্রাইস্ট-এর ন্যায় না হলে ক্রাইস্ট-এর ভাব বুঝা যায় না। পরমহংসদেবের এই গভীর ভাব হয়তো ক্রাইস্ট যা বলেছিলেন তাই — Be perfect as your Father in heaven is perfect.
ডাক্তার — আচ্ছা, তাঁর অসুখের তদারক তোমরা কিরূপ কর?
মাস্টার — আপাততঃ, প্রত্যহ একজন সুপার্ইন্টেণ্ড করেন, যাঁহাদের বয়স বেশি। কোনদিন গিরিশবাবু, কোনদিন রামবাবু, কোনদিন বলরামবাবু, কোনদিন সুরেশবাবু, কোনদিন নবগোপাল, কোনদিন কালীবাবু, এইরকম।