দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
ছোট নরেন প্রভৃতির ভাবাবস্থা — সন্ন্যাসী ও গৃহস্থের কর্তব্য
গান সমাপ্ত হইল। ভক্তেরা অনেকে ভাবাবিষ্ট। নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছেন। ছোট নরেন ধ্যানে মগ্ন। কাষ্ঠের ন্যায় বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ছোট নরেনকে দেখাইয়া, ডাক্তারকে) — এ অতি শুদ্ধ। বিষয়-বুদ্ধির লেশ এতে লাগে নাই।
ডাক্তার নরেনকে দেখিতেছেন। এখনও ধ্যানভঙ্গ হয় নাই।
মনোমোহন (ডাক্তারের প্রতি, সহাস্যে) — আপনার ছেলের কথায় বলেন, ‘ছেলেকে যদি পাই, বাপকে চাই না।’
ডাক্তার — অই তো! — তাইতো বলি, তোমরা ছেলে নিয়েই ভোলো! (অর্থাৎ ঈশ্বরকে ছেড়ে অবতার বা ভক্তকে নিয়ে ভোলো।)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — বাপকে চাই না — তা বলছি না।
ডাক্তার — তা বুঝিছি! — এরকম দু-একটা না বললে হবে কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার ছেলেটি বেশ সরল। শম্ভু রাঙামুখ করে বলেছিল। ‘সরলভাবে ডাকলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।’ ছোকরাদের অত ভালবাসি কেন, জান? ওরা খাঁটি দুধ, একটু ফুটিয়ে নিলেই হয় — ঠাকুর সেবায় চলে।
“জোলো দুধ অনেক জ্বাল দিতে হয় — অনেক কাঠ পুড়ে যায়।
“ছোকরারা যেন নূতন হাঁড়ি — পাত্র ভাল — দুধ নিশ্চিন্ত হয়ে রাখা যায়। তাদের জ্ঞানোপদেশ দিলে শীঘ্র চৈতন্য হয়। বিষয়ী লোকদের শীঘ্র হয় না। দই পাতা হাঁড়িতে দুধ রাখতে ভয় হয়, পাছে নষ্ট হয়!
“তোমার ছেলের ভিতর বিষয়বুদ্ধি — কামিনী-কাঞ্চন — ঢোকে নাই।”
ডাক্তার — বাপের খাচ্চেন, তাই! —
“নিজের করতে হলে দেখতুম, বিষয়বুদ্ধি ঢোকে কি না!”
[সন্ন্যাসী ও নারীত্যাগ — সন্ন্যাসী ও কাঞ্চনত্যাগ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বটে, তা বটে। তবে কি জানো, তিনি বিষয়বুদ্ধি থেকে অনেক দূর, তা না হলে হাতের ভিতর। (সরকার ও ডাক্তার দোকড়ির প্রতি) কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ আপনাদের পক্ষে নয়। আপনারা মনে ত্যাগ করবে। গোস্বামীদের তাই বললাম — তোমরা ত্যাগের কথা কেন বলছো? — ত্যাগ করলে তোমাদের চলবে না — শ্যামসুন্দরের সেবা রয়েছে।
“সন্ন্যাসীর পক্ষে ত্যাগ। তারা স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। মেয়েমানুষ তাদের পক্ষে বিষবৎ। অন্ততঃ দশহাত অন্তরে, একান্তপক্ষে একহাত অন্তরে থাকবে। হাজার ভক্ত স্ত্রীলোক হলেও তাদের সঙ্গে বেশি আলাপ করবে না।
“এমনকি সন্ন্যাসীর এরূপ স্থানে থাকা উচিত, যেখানে স্ত্রিলোকের মুখ দেখা যায় না; — বা অনেক কাল পরে দেখা যায়।
“টাকাও সন্ন্যাসীর পক্ষে বিষ। টাকা কাছে থাকলেই ভাবনা, অহংকার, দেহের সুখের চেষ্টা, ক্রোধ, — এই সব এসে পড়ে। রজোগুণ বৃদ্ধি করে। আবার রজোগুণ থাকলেই তমোগুণ। তাই সন্ন্যাসী কাঞ্চন স্পর্শ করে না। কামিনী-কাঞ্চন ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়।”
[ডাক্তারকে উপদেশ –টাকার ঠিক ব্যবহার — গৃহস্থের পক্ষে স্বদ্বারা ]
“তোমরা জানবে যে, টাকাতে ডাল-ভাত হয়, পরবার কাপড়, — থাকবার একটি স্থান হয়, ঠাকুরের সেবা — সাধু-ভক্তের সেবা হয়।
“জমাবার চেষ্টা মিথ্যা। অনেক কষ্টে মৌমাছি চাক তৈয়ার করে — আর-একজন এসে ভেঙে নিয়ে যায়।”
ডাক্তার — জমাচ্ছেন কার জন্য? — না একটা বদ ছেলের জন্য!
শ্রীরামকৃষ্ণ — বদ ছেলে! — পরিবারটা হয়তোও নষ্ট — উপপতি করে। তোমারই ঘড়ি, তোমারই চেন তাকে দেবে!
“তোমাদের পক্ষে স্ত্রীলোক একেবারে ত্যাগ নয়। স্ব-দারায় গমন দোষের নয়। তবে ছেলেপুলে হয়ে গেলে, ভাই-ভগ্নীর মতো থাকতে হয়।
“কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলেই বিদ্যার অহংকার, টাকার অহংকার, উচ্চপদের অহংকার — এই সব হয়।”