৫২. মা

৫২
আজাদের মায়ের অনুরোধে পুলিশ সুবেদার খলিল একবার যান নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে৷ তখন ঢাকার আকাশ দিয়ে চক্কর দিচ্ছে ভারতীয় বিমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তখন ঘন্টার হিসাবে গণনা করার বিষয় মাত্র৷ জেলখানার এক বাঙালি কর্তার সঙ্গে দেখা করেন তিনি৷
বলেন, ‘আমার এক আত্মীয় অ্যারেস্ট হইছিল৷ খোঁজ পাওয়া যাইতেছে না৷ দেখেন তো আছে নাকি ?’
‘নাম বলেন৷ পিতার নামসহ…’
‘মাগফার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আজাদ, পিতা ইউনুস আহমেদ চৌধুরী ?’
অফিসারটি বন্দিদের নামের তালিকা উল্টেপাল্টে দেখেন৷ ‘না, নাই তো ?’
‘আবুল বাশার চৌধুরী ?’ খলিল সাহেব আজাদের মায়ের নিজের হাতে লেখা তালিকাটা পকেট থেকে বের করে পড়েন৷
‘না নাই৷’
‘বদিউল আলম ?’
‘নাই৷’
‘আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ?’
‘নাই৷’
‘চুল্লু ?
‘আছেন’-কর্তাটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷
‘সামাদ ?’
‘আছেন’-কর্তাটির মুখ হাসি হাসি৷ ‘মুক্তিযোদ্ধা আরো আছেন৷ বরিশালের কাজী ইকবাল…’
খলিল সাহেব শঙ্কিত বোধ করেন৷ তিনি তো বলেননি যে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে এসেছেন…
কর্তাটি তাঁর মুখের ভাষা পড়তে পারেন৷ বলেন, ‘আর বেশি দেরি নাই৷ দেশ স্বাধীন হতে চলেছে…’
খলিল সাহেব বলেন, ‘আর সবাই কোথায় ?’
‘অন্য জেলে থাকতে পারে৷’
‘তা পারে৷’ খলিল সাহেব মাথা নাড়েন৷
এই একটা সান্ত্বনা হয়তো তিনি সাফিয়া বেগমকে দিতে পারবেন৷ ঢাকা জেলে আজাদ নাই৷ অন্য কোনো জেলে থাকতে পারে৷ তিনি ধীরে ধীরে কারাগার চত্বর ত্যাগ করেন৷
মালিবাগে যান আজাদের মায়ের কাছে৷
সাফিয়া বেগম দরজা খুলে তাঁর দিকে তাকান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে৷ তিনি বোঝার চেষ্টা করেন, কী নিয়ে এসেছে খলিল৷ সুসংবাদ, নাকি দুঃসংবাদ৷
‘কী খবর খলিল, কোনো খোঁজ পেলে ?’ তিনি কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন৷
‘না৷ এই জেলখানায় নাই৷’
‘তাহলে অন্য কোনো জেলখানায় রেখেছে!’ সাফিয়া বেগম অকম্পিত স্বরে বলেন৷
খলিল জোরে বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বুবু৷ অরা তা-ই কইল৷ বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারে আইনা রাখছে ঢাকায়, ঢাকার ছেলেদের ঢাকার বাইরে পাঠায়া দিছে৷’
‘তুমি বসো৷ তোমাকে চা দেই৷’ সাফিয়া বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে খলিল একটা বড় শ্বাস ফেলে যেন মুক্তির আস্বাদ পান৷
এই মুহূর্তটা বড় কঠিন হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন৷ কী করে তিনি আজাদের মাকে বলবেন যে আজাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, এই নিয়ে তিনি সারাটা পথ ভেবে ভেবে সারা হয়ে যাচ্ছিলেন৷
কী রকম শক্ত একজন মহিলা হতে পারেন, খলিল ভাবেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *