৫২
চিলেকোঠাটা এত ছোটো যে একটা চৌকিও ভাল করে আঁটে না। টেবিল চেয়ার বা আলনা গোছের কোনও আসবাব চয়নের নেই, তাই রক্ষা। চৌকিটা এঁটে গেল কোনওরকমে। একদিকের দেয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়ার পর অন্য দিকের দেয়ালের সঙ্গে দু বিঘৎ পরিমাণ ফাঁক রইল। লম্বালম্বির দিকটায় ফাঁক পাওয়া গেল ফুট দেড়েক। চয়নের মনে হল, এই ঢের। এর চেয়ে বেশি সে আর কী চায়? আঁটিয়ে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাই তো সে করে এসেছে এতদিন। তার জীবন-সংগ্রাম তো এটুকুই। অল্পের মধ্যে, কমের মধ্যে নিজেকে সন্তর্পণে আঁটিয়ে নেওয়া। ঘরে জায়গা না থাক, ছাদটা আছে। খুব বড় নয়, তবু সেইটাই ঢের বেশি বলে মনে হয় তার। হু-হু করে হাওয়া বয়, বুক ভরে দম নিতে কোনও অসুবিধে নেই। চিলেকোঠার ছাদ নেই, অ্যাসবেস্টস। দু-একটা ফুটো-ফাটা আছে, বর্ষায় জল পড়বে। তা পড়লেও খুব একটা ক্ষতি নেই। বিছানাটা গুটিয়ে রাখলেই হবে। অসুবিধে রান্না নিয়ে। রাঁধবার জায়গা ওই ফুট দেড়েক জায়গা। তারও একটা সমাধান মাথা খাটিয়ে বের করে ফেলেছে সে। চৌকাঠে বসলে ঘরের দিকে মুখ করে ফুট দেড়েক জায়গায় স্টোভ জ্বেলে দুটি ডাভাত ফুটিয়ে নেওয়া শক্ত কাজ নয়। বাথরুমটা অবশ্য একতলায়। নতুন ভাড়াটে এলে সেটা ব্যবহার করতে দেবে কি না সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। দাদা-বউদি এখন তেমন খারাপ ব্যবহার করছে না। হয়তো এই সমস্যারও একটা সমাধান হয়ে যাবে। আপাতত অত ভেবে মনকে ভারাক্রান্ত করে লাভ নেই। খোলা ছাদ ও এক চিলতে ঘর এখন তার কাছে লটারির ফার্স্ট প্রাইজ বলে মনে হচ্ছে। একতলার এঁদো ঘরের চেয়ে এ তো স্বর্গবাস। আরও একটা নিশ্চিন্দির কথা হল, বউদি একশ টাকা করে ভাড়া নিতে রাজি হয়েছে। প্রথমটায় রাজি হচ্ছিল না। বলেছিল, ভাড়া কেন? তুমি বরং এ পাড়াতেই একখানা ভাল ঘর দেখ। এ বাড়িতে তো তোমার অসুবিধেই হচ্ছে!
চয়ন বলেছে, তা নয় বউদি, অসুবিধে আমার নেই। বরং তোমাদেরই হচ্ছে, যতদিন ঘর না পাই ততদিন সামান্য কিছু নাও। ইলেকট্রিক বিল, বাড়ির ট্যাক্স বাবদও তো খরচ আছে।
তোমার সামান্য আয়।
চলে যাবে বউদি। আমার অল্পেই চলে। মা নেই বলে বরং খরচ বেঁচে গেছে খানিকটা।
বউদি দোনোমোনো করল। তারপর বলল, ঠিক আছে, একশ টাকা করে দিও। কিন্তু ঘরেরও খোঁজ রেখো। চিলেকোঠায় আমাদের সব পুরোনো জিনিসপত্র থাকে! তোমার জন্য সব সরাতে। হয়েছে। দোতলায় আর কতটুকুই বা জায়গা বলো একতলায় ভাড়াটে আসছে, সেটাও খালি করে দিতে হবে।
এ ঘরের মেয়াদ কতদিন চয়ন তা জানে না। একটা অনিশ্চয়তা থেকেই গেল। সম্পর্কটা হয়তো এই ঘরের দখলদারি নিয়েই ফের খারাপ হতে থাকবে।
এক রবিবারের সকালে ভাড়াটেরা এল। টেম্পো থেকে যখন তাদের তৈজসপত্র নামানো হচ্ছিল। তখন ছাদ থেকে দেখছিল চয়ন। জিনিসপত্র দেখে অনুমান হল, এরাও নিছক মধ্যবিত্তই। এ বাড়িতে অবশ্য খুব পয়সাওলা লোকের ভাড়া আসবার কথা নয়। তবু প্রত্যাশা তো নানারকম থাকে।
লোকগুলোর চেহারাও মধ্যবিত্ত ধরনেরই। মাঝবয়সী একজন রোগা খেঁকুরে ধরনের লোক, তার সাধারণ চেহারার গিন্নি আর একটি যুবতী মেয়ে। মেয়েটিও কালো, রোগা এবং শ্রীহীন। তবে সে-ই সর্দারি করছিল। কুলিদের ধমক-ধামক দিল, মা-বাবাকেও শাসন করছিল রাস্তায় দাঁড়িয়েই। বেশ ডাকাবুকো এবং মুখরা মেয়ে। চয়ন যুবক হিসেবে কিছুই নয়। তার যৌবন বয়ে যাচ্ছে সে টেরও পায় না। কোনও যুবতীকে দেখলেও তার চাঞ্চল্য হয় না।
এ যুবতীটিকে দেখে অবশ্য চাঞ্চল্যের কারণও নেই।
সামান্য জিনিসপত্র। আধঘণ্টার মধ্যেই জিনিস উঠে গেল ঘরে। নিচের তলায় তেমন সোরগোল উঠল না। নিচের তলার বাথরুম এদের সঙ্গেই ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হবে তাকে—এই দুশ্চিন্তাটা রোববারের সকালটায় তাকে কিছু বিমর্ষ রাখল। এরা যদি আপত্তি করে? যদি অপমান করে তাকে?
ভিতরের উঠোনটা ছাদ থেকে দেখা যায়। চয়ন উঠোনের দিকে চেয়ে লোকগুলিকে অনুধাবন করার চেষ্টা করল। বউদিদের নতুন ঝি তিন কাপ চা আর কয়েকখানা বিস্কুট একটা ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিল ঘরে। তারও কিছুক্ষণ পর বউদিও গেল। অনেকক্ষণ বাদে ভদ্রলোককে দেখা গেল, উঠোনে বেরিয়ে চৌবাচ্চার কাছে এসে এক মগ জল তুলে হাত ধুচ্ছে। ধুতির ওপর গেঞ্জি, তার ওপর একটা ফুলহাতা সোয়েটার। লোকটা ভাল না মন্দ, রাগী না শান্ত তা অনুমান করা শক্ত। চয়ন শুনেছে, ভদ্রলোক বউদির দূর-সম্পর্কের পিসেমশাই এবং রাইটার্সে কাজ করেন। শেয়ালদা নর্থ লাইনে সোদপুর বা কোথাও ভদ্রলোকের একটু জমি কেনা আছে, সেখানেই বাড়ি করে রিটায়ার করার পর চলে যাবেন। এইটুকু তথ্য একজনের চরিত্র সম্পর্কে অনুমান করার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
কিন্তু চয়ন এত উদ্বিগ্ন কেন? চয়ন নিজেই নিজের এইসব উদ্ভট উৎকণ্ঠায় ভীষণ অবাক হয়। পরে যখন উদ্বেগটা প্রশমিত হয় তখন তার নিজের এইসব ছেলেমানুষি উৎকণ্ঠার জন্য সে লজ্জিত হয়। সে আসলে অচেনা লোকদের সম্পর্কে ভীষণ অস্বস্তিতে থাকে। চেনা হয়ে গেলে আর ভয় তত থাকে না।
চেনা হল আরও সাতদিন বাদে।
সকালে টিউশনিতে বেরোবার সময়ে দরজায় তালা লাগাচ্ছিল চয়ন, ঠিক এই সময়ে মেয়েটা এক রাশ ভেজা জামাকাপড় নিয়ে ওপরে এল। একেবারে মুখোমুখি দেখা।
মেয়েটা নিঃসঙ্কোচে বলে উঠল, আপনিই চয়ন তো! অয়নদার ভাই?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমরা নিচে নতুন ভাড়া এলাম।
জানি।
আমার নাম অনিন্দিতা। আপনি তো টিউশনি করেন, না?
হ্যাঁ।
আমিও করতাম। সবে একটা চাকরি পেয়েছি।
ওঃ।
মেয়েটি হাসল। রোগা মুখখানায় শ্রী বলতে ওই হাসিটি। দাঁতগুলির সেটিং খুব ভাল। এবং ঝকঝকে। বলল, তা বলে সাঙ্ঘাতিক কিছু নয়। একটা নার্সিং হোম-এর রিসেপশনিস্ট। কেমন হবে কে জানে! নিয়ে তো নিলাম।
ভালই করেছেন।
টিউশনি আর ভাল লাগছিল না। এ বাড়ি ও বাড়ি দৌড়োদৌড়ি করা কি সোজা? বাস-ট্রামের অবস্থাও তো ভাল নয়। সবসময়ে ভিড়।
ঠিক কথাই তো।
প্রথম পরিচয়ে এরকম নিঃসঙ্কোচ কথাবার্তা বলতে পারাটা আধুনিক যুগের মেয়েদের একটি ভাল লক্ষণ। অকারণ লজ্জা-সংকোচের বালাই নেই। একটু প্রসন্নতার সঙ্গেই চয়ন মেয়েটির দিকে চেয়ে রইল।
আপনার তো শুনেছি শরীর ভাল নয়।
শরীরের কথায় নিবে গেল চয়ন। দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, না, শরীর ভাল নয়। আমি এপিলেপটিক।
তাহলে তো টিউশনি করতে আপনার কষ্ট হয়!
কষ্ট! বলে চয়ন যেন একটু ভেবে বলল, অভ্যাস হয়ে গেছে।
আমাদের ঘরে আসবেন। গল্প করা যাবে।
যাবো।
মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করে মনটা বেশ ভাল লাগছিল চয়নের। আলাপ হওয়াটাই ছিল দরকার। অচেনা থাকলে তার ভয় আর উদ্বেগটা যেত না। এরা বোধহয় তেমন খারাপ লোক নয়। গত সাতদিন ধরে সে নিচের বাথরুমটা ব্যবহার করে আসছে। একটু ভয়ে ভয়েই। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। না, সে অবশ্য ওদের ঘরে গিয়ে গল্প করতে বসবে না। বউদি তাতে বিগড়ে যেতে পারে। এই আলাপ-পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা জিনিসটার মেয়ে-মহলে অন্যরকমের ব্যাখ্যা হয়, সে জানে।
মেয়েটির বাবা এবং মায়ের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে চেনা হয়ে গেল তার। আরও দিন চারেকের মধ্যে। সত্যেশবাবু হিসেবি লোক। বাড়ি করার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে টাকা জমাচ্ছেন। প্রথম আলাপের পাঁচ মিনিটের মধ্যে বলে ফেললেন, এখন ইঁটের দর কত করে যাচ্ছে জানো? আট আনা করে। আমি যখন বাড়ি শুরু করব তখন কোথায় ঠেলে উঠবে তাই ভাবছি। আচ্ছা, ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে কোথায় ইঁট তৈরি হয় জানো?
চয়ন জানে না। তাই মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে না।
বাপ আর মেয়ের মুখশ্রীতে খুব মিল। হনু উঁচু, রোগা, ভাঙা মুখ। তবে মেয়ের মতো বাপেরও দাঁতের সেটিং খুব ভাল। এবং ঝকঝকে।
সত্যেশবাবু বললেন, বাড়ি করতে গেলে মেয়ের বিয়ের টাকা থাকে না। মেয়ের বিয়ে দিলে বাড়ির টাকা থাকে না। অথচ দুটোই দরকার।
চয়নকে কথাটা স্বীকার করতে হল।
সত্যেশবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এইজন্যই লোকে ঘুষ খায়। বুঝলে? কিন্তু সরকারকে কথাটা কে বোঝাবে বলল তো! আমি অবশ্য ওসব টাকা ছুঁই না। কিন্তু তাতে লাভটা কী হল?
চয়নকে একথাটাও মানতে হয় যে, সততার কোনও দামই নেই।
ভদ্রমহিলা পরদিন তাকে চা খাওয়ালেন। সত্যেশবাবু ছিলেন না। অনিন্দিতা আর তার মা ছিল। চা খুব খারাপ কোয়ালিটির। সঙ্গে বিস্কুট ছিল, সেটা খেতে ইচ্ছে করল না চয়নের।
তোমার মায়ের কথা শুনলাম। তুমি নাকি মায়ের খুব ন্যাওটা ছিলে!
চয়ন কী বলবে। না ভেবেচিন্তেই বলল, আমি রোগা বলে মায়ের একটু টান ছিল হয়তো।
ওটাই তো হয়। কমজোরি সন্তানের ওপর মায়ের মায়া বেশি। দাদা-বউদির সঙ্গে তোমার বনিবনা কেমন?
চয়ন সতর্ক হল। সে জানে, চায়ের নেমন্তন্নের সময়টা ওরা বেশ ভালই বেছেছে। আর দাদা-বউদি সিনেমায় গেছে। বাড়ির ঝি শুধু আছে ওপরে। কূটকচালির প্রকৃষ্ট সময়। সে উদাসভাবে বলে, আমার সঙ্গে সম্পর্ক তো খুবই ভাল।
ভাল হলে বুঝি তোমাকে রেঁধে খেতে হত!
অনিন্দিতা মৃদু ধমক দিল, আঃ মা। ওসব কথা থাক।
ভদ্রমহিলা থেমে গেলেন।
মাকে সরিয়ে মেয়ে তার ভূমিকা নিল, আপনি তো গ্র্যাজুয়েট, না?
হ্যাঁ।
দিদি বলছিল, আপনি ইংরিজি আর অঙ্কে খুব স্ট্রং! তাহলে কম্পিটিটিভ দেননি কেন?
চয়ন মৃদু হেসে বলল, দেওয়া হয়নি নানা কারণে।
সংসারের অশান্তি বুঝি?
পোড়-খাওয়া চয়ন শুধু একটু হাসল। কিছু বলল না। এরা তার কাছ থেকে কথা আদায় করতে চায় নাকি? তাহলে এদের সম্পর্কে তাকে আরও সজাগ থাকতে হবে।
সতর্কই ছিল চয়ন। তবু সম্পূর্ণ এড়ানো যায় না। নার্সিং হোমে মেয়েটির শিফট ডিউটি। চয়ন যখন সকালের টিউশনি সেরে এসে দুপুরের ভাত রাঁধতে বসে তখন ডিউটি অফ থাকলে মেয়েটি ছাদে শাড়িটাড়ি মেলতে এসে পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে গল্প করে।
কী রাঁধছেন? আচ্ছা, রোজ ওই খিচুড়ির মতো কী একটা করেন বলুন তো!
চয়ন বলে, এটা খুব স্বাস্থ্যকর। চালডাল সবজি সব একসঙ্গে চাপিয়ে দিই। একবারেই হয়ে। যায়।
এমা! রোজ একরকম খান কী করে?
আমার তো খারাপ লাগে না।
একটু ঘি দিলেও না হয় হত!
ওসব আমার সহ্য হয় না।
মশলা লাগে না?
না, তাও লাগে না।
আপনাকে নিয়ে পারা গেল না। আচ্ছা, একটু শুকতো খাবেন? আমাদের আজ শুকতো হয়েছে।
চয়ন সঙ্গে সঙ্গে আত্মরক্ষার পদ্ধতি নিয়ে বলে, না! আমি আবার ওসব খাই না। এটাই বেশ লাগে।
আপনি বোধ হয় আপনার বউদিকে ভয় পাচ্ছেন। যদি কিছু বলে, তাই না?
চয়ন মৃদু হাসল। তারপর বলল, যতদূর নির্দোস থাকা যায় ততই ভাল।
আপনি খুব সাবধানী মানুষ।
না। আমি খুব ভিতু।
মেয়েটা তার পিঠের খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। এ ব্যাপারটাও তার পছন্দ হচ্ছে না। এ কি বড্ড গায়ে-পড়া? তাহলে তো ঝক্কিই হল একটা। রোজ জ্বালাবে।
ভদ্রতা বজায় রাখতে সে বলে, নতুন চাকরি কেমন?
খুব ভাল মনে হচ্ছে না। কাল একজন পেশেন্ট মারা যাওয়ায় খুব হামলা হল। পেশেন্টর হয়ে কিছু লোক ইট পাটকেল ছুঁড়ে ভাঙচুর করে গেছে। পুলিশ এসেছিল।
ও বাবা!
নার্সিং হোমে এসব অবশ্য হয়। পেশেন্টের ডেলিভারি হতে সময় লাগছিল। তারপর কী সব কমপ্লিকেশন দেখা দেয়। দোষটা ডাক্তারের নয়। আজকাল লোকেরা বড্ড অল্পে রেগে যায়। তাই না?
কথাটা বোধ হয় ঠিক।
খুব ঠিক। কারও ধৈর্য নেই। মা তো শুনে খুব ভয় পেয়ে গেছে। বলছে, চাকরি ছেড়ে দে। আমি বললাম, দেখি আরও কয়েকটা দিন। আটশোটা টাকা হুট করে ছাড়ব কেন?
আটশো!
ট্রেনিং পিরিয়ড বলে কম দিচ্ছে। বারোশো স্টার্টিং। কিছুদিন তো করে দেখি।
এইভাবে কথা গড়ায়। কোথাও পৌঁছোয় না। তবে চয়নের পুঁজিতে একটা অভিজ্ঞতা যোগ হতে থাকে।
নতুন আরও অভিজ্ঞতা যোগ হচ্ছিল অন্য দিক থেকেও। মোহিনীর মা তাকে আর একটা মোটা মাইনের টিউশনিতে নিয়োগ করেছেন। শুধু অঙ্ক এবং মাসে চারশো টাকা। বাড়িটা চয়নের একেবারে অচেনা নয়। মোহিনীদেরই প্রতিবেশী। ছাত্রের মা চারুশীলার সঙ্গে সে একবার হেমাঙ্গবাবুর গাড়িতে চেপে হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। টিউশনিতে নিয়োগের আগে চারুশীলা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, শুধু অঙ্ক করাতে আপনি কত নেবেন বলুন তো!
চয়ন বিনীতভাবে বলল, একটা তো মোটে সাবজেক্ট। দেড়শ দিতে কি আপনার অসুবিধে হবে?
চারুশীলা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, দেড়শ? ওটা তো মেড সারভেন্টের চেয়েও কম মাইনে। আপনার সেলফ্ রেসপেক্ট বলে কিছু নেই দেখছি! ছিঃ, ওই জন্যই তো বাঙালীর উন্নতি হয় না।
চয়ন থতমত খেয়ে বলল, না, ভুল বুঝবেন না। আমি তো মোহিনীকে পড়াতে এদিকে আসিই। এক্সট্রা কোনও পরিশ্রম তো নয়।
চারুশীলা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, মেধার সঙ্গে পরিশ্রম এক করে ফেলবেন না। যাকগে, পাঁচশো টাকার নিচে আমি দিতে পারব না। দিতে আমার লজ্জা হবে।
চয়ন অত্যন্ত বিপাকে পড়ে বলল, এতটা যে রেট নয়। নিতে আমার ভীষণ লজ্জা হবে।
ওই জন্যই তো আপনার জীবনেও উন্নতি হবে না। ঠিক আছে, চারশো টাকা করে নেবেন। রাজি তো!
তাও বেশি হয়ে যাচ্ছে।
আমি কিন্তু মোটেই আপনাকে দয়া দেখাচ্ছি না। রেট এরকমই হওয়া উচিত বলে মনে করি।
বাচ্চা একটা ছেলেকে শুধুমাত্র অঙ্ক করানোর জন্য এত টাকা নিলে অন্যায় হবে না?
তাহলে আপনি ওকে ইংরেজি বা অন্য সাবজেক্টও একটু দেখাবেন। ইংরিজির টিউটর ওর দরকার হয় না। ইংলিশ মিডিয়মেই পড়ে। তবু দেখাবেন। শুনেছি আপনার বেসিক গ্রামারের নলেজ খুব ভাল।
প্রথম দর্শনেই পিন্টুকে ভীষণ পছন্দ করে ফেলল চয়ন। দেবশিশুর মতো নিষ্পাপ চেহারা। বুদ্ধিমান এবং মনোযোগী। একটু দুষ্টুও আছে। তবে সেটাও উপভোগ্য।
মুশকিল হল পিন্টুকে পড়ানোর সময় চারুশীলা প্রায়ই এসে হাজির হন। ভদ্রমহিলার নানারকমের খেয়াল। এসে বললেন, আচ্ছা, আপনার তো বোধহয় সোয়েটার নেই! সোয়েটার গায়ে দেন না কেন?
কলকাতার শীতে লাগে না। র্যাপারেই চলে যায়।
আপনার র্যাপারটা ভাল নয়। চলুন তো, গড়িয়াহাটা থেকে আপনাকে একটা পুলওভার কিনে দিই।
চয়ন প্রমাদ গোনে। কোনও জিনিসের বাড়াবাড়ি ভাল নয়, সে জানে। পরে এই ভালবাসা বা করুণা উলটো রূপ নিতে পারে।
পুলওভার অবশেষে সত্যিই কিনে দিয়েছে চারুশীলা। এবং আজকাল রাতের খাবারও তাকে খেয়ে আসতে হচ্ছে সপ্তাহে তিনদিন।
চারুশীলা অত্যন্ত ছটফটে চঞ্চল মহিলা। এ-ঘর ও-ঘর সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মুহুর্মহু টেলিফোন করছেন, যখন তখন কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়ছেন। কিসের যে অতপ্তি কেন যে এই অস্থিরতা তা অনুমান করতে পারে না চয়ন। তবু এই স্বাভাবিকতার অভাবের জন্যই বোধ হয় চারুশীলাকে তার খুবই ভাল লাগে। মনে হয়, আমার বউদি যদি এরকম হত!
শুনুন, সামনের শনিবার আপনি একটু তৈরি হয়ে আসবেন। আমরা এক জায়গায় যাবো। সকালে।
চয়ন অবাক হয়ে বলে, কোথায়?
ব্যাণ্ডেল। রিয়া আর ছেলেমেয়েরাও যাবে। আর আমার একটা ভাই আছে, হেমাঙ্গ—চেনেন তো! দারুণ আউটিং।
চয়ন মৃদুস্বরে বলে, কিন্তু আমি!
চারুশীলা হেসে বলে, কেন, আপনি কি অচ্ছ্যুৎ!
তা নয়। তবে—
ওসব শুনছি না। সবসময় অত দুঃখ-দুঃখ মুখ করে থাকবেন না তো! মুখে হাসি নেই কেন? জোর করে হাসবেন। হাসতে হাসতে ওটা অভ্যাস হয়ে যাবে। গোমড়া মুখ আমার একদম সয় না।
সুতরাং ব্যান্ডেলেও যেতে হয়েছিল তাকে। চারুশীলা আরও লোক জুটিয়েছিলেন। ঝুমকি আর অনু নামের দুই বোন। রশ্মি রায় নামে একজন প্রায়-মেমসাহেব মেয়ে। পুরুষ বলতে সে, হেমাঙ্গ আর দুইজন ড্রাইভার।
এই ব্যান্ডেলে যাওয়াটা চয়নের কাছে এক বিশাল উন্মোচন। সে জীবনে ব্যান্ডেলে আসেনি, চন্দননগর দেখেনি। কলকাতার বাইরে যাওয়ার সুযোগ তার হয়ই না। তার ওপর গাড়িতে চড়ে, এত আরামে।
চারুশীলা মাসখানেকের মধ্যে তাকে একটা নতুন টেরিকটনের জামা, একজোড়া জুতো এবং একটা দামী জাপানী ফাউন্টেন পেন উপহার দিয়ে ফেললেন। চয়নের হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। রিয়া এবং মোহিনীরাও ভাল। তবে তাদের সংযম আছে। চারুশীলা অনেকটাই উদ্দাম।
প্রায় বছরখানেক বিদেশবাসের পর চারুশীলার স্বামী ফিরলেন দেশে। ভদ্রলোক বিদেশে একটা বিরাট কনস্ট্রাকশনের কাজ করছিলেন। প্রচুর টাকার কাজ। তাঁর দেশে ফেরাটাকে চারুশীলা একটা উৎসব দিয়ে সেলিব্রেট করলেন। বিরাট পার্টি হল বাড়িতে। এবং এ্যান্ড হোটেলে হল আর একটা রিসেপশন। দুই জায়গাতেই হাজির ছিল চয়ন। পার্টি এবং গ্র্যান্ড হোটেলের অভ্যন্তর দুটোই যোগ হল তার অভিজ্ঞতায়।
আর যোগ হলেন সুব্রত। চারুশীলার স্বামী। এমন তদ্গত, কর্মপ্রাণ মানুষ সে বড় একটা দেখেনি। মানুষটি খুব লম্বা চওড়া নন, বরং মাঝারি বা ছোটখাটো মাপেরই। কিন্তু মুখের আদলটি মায়ায় মাখানো। সর্বদাই মুখে হাসি। ইনি কয়েক কোটি টাকার মালিক এবং প্রতি বছরই কোটির কাছাকাছি আয় করেন তা চেহারা দেখে ধরাই যায় না।
চয়ন জীবনের অন্যান্য দিক দেখছে আর অবাক হচ্ছে। সে শুনেছে সুব্রত নকশাল আন্দোলন করতেন, একবার জেলও খেটেছেন। তাঁর এই রূপান্তর কিছু বিস্ময়কর।
সুব্রত দেশে ফেরার পর চয়নের ওপর থেকে চারুশীলার মনোযোগ একটু অপসৃত হল। চারুশীলা স্বামীর সঙ্গে নানা আউটিং ও নিমন্ত্রণে যেতে লাগলেন। চয়ন হাঁফ ছাড়ল।
তারপর চারুশীলা একদিন সব্রতকে ডেকে আনল পড়ার ঘরে, একে তুমি একটা চাকরি দাও।
সুব্রত হাসছিলেন, বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, হবে।
হবে-টবে নয়। এখনই দাও। এ ছেলেটা হাসতে ভুলে গেছে। ভীষণ দুঃখী হয়ে থাকতে ভালবাসে।
চয়ন লজ্জায় পড়ে গেল।
সুব্রত বললেন, একটু সময় দেবে তো।
সময় দিলে চলবে কি করে? ছেলেটা খুব ভাল, জানো? আমি পাঁচশো টাকা মাইনে দিতে চেয়েছিলাম, নেয়নি। কারটেল করে চারশোতে নামালো।
সুব্রত হাসতেই লাগলেন। কিছু বললেন না।
এর দিন সাতেক বাদে চারুশীলা আবার পড়ার ঘরে হানা দিয়ে বললেন, শুনুন, সামনের রবিবার আমরা ফের আউটিং-এ যাচ্ছি। সাঙ্ঘাতিক জায়গায়।
কোথায়?
তা কে জানে! আমার পাগলা ভাই কোথায় অজ্ঞাতবাস করবে বলে জঙ্গলের মধ্যে একটা মাটির বাড়ি কিনেছে। কাউকে ঠিকানা বলছে না। আমি গোয়েন্দা লাগিয়ে ঠিকানা জোগাড় করেছি। ও শুক্রবার শুক্রবার সেখানে পালায়। আমরা রবিবার গিয়ে ওকে সারপ্রাইজ দেবো। আপনিও যাচ্ছেন কিন্তু।