2 of 2

৫২. আমরা অনেক মৃত্যু দেখেছি

আমরা অনেক মৃত্যু দেখেছি। যে-যুগে আমরা জন্মেছি, সে-যুগ মৃত্যুতে আকীর্ণ। অবশ্য মানুষের ইতিহাসই তো মানুষ মারার ইতিহাস। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী এসব তো এ-দেশের নিত্যসঙ্গী। তবু এসবেরও পরে মানুষের সৃষ্টি করা কারণে হাজার হাজার মানুষ মরে। সুদূর পোল্যান্ড দেশ সম্পর্কে হিটলারের মনে একটা শখের উদয় হল, সেই কারণে মুর্শিদাবাদের একটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। যাক না, কী আসে যায় তাতে! পৃথিবীতে এত জন্তুজানোয়ার মারছে মানুষ, স্বার্থের কারণে কিছু মানুষকেও যে মারবে–এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? কোনও রকম প্রাকৃতিক বাধা তো নেই। তবু যে মৃত্যুর এত প্রতিবাদ, যুদ্ধ থেমে যাবার পরই শান্তির জন্য চ্যাচামেচিতার একমাত্র অর্থ বোধহয় এই, আমাকে মেরো না, আমাকে বাঁচতে দাও।

মৃত্যু দিয়ে পরিবেষ্টিত এই জীবন এত মোহময়। যে-কোনও মুহূর্তে খেলা শেষ হয়ে যেতে পারে, তবু এই খেলা থেকে বাদ পড়তে ইচ্ছে করে না। সেই কবে থেকে শুরু হয়েছে এই খেলা। ছিলাম মাতৃগর্ভে, এক তরল সমুদ্রে নারায়ণের মতন ভাসমান। নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার, তাময় দিন রাত্রি, শুধু অবিরাম শুনতে পাই একটা দুপ দুপ শব্দ। কোথা থেকে সেই শব্দ আসে জানি না, কোথায় আদি জানি না, বোধ নেই, দৃষ্টি নেই, শুধু সেই শব্দ।

তারপর একদিন সেই তরল সমুদ্রে আলোড়ন ওঠে। যে-রক্ষণশীল দেওয়াল আমাকে ঘিরে রেখেছিল, হঠাৎ সেই দেওয়াল প্রবল শক্তিতে আমাকে চেপে ধরে। কেন এই শাস্তি, কেন ওই সুখশয্যা থেকে আমাকে ঠেলে ফেলে দেবার উদ্যোগ। মাথা টু দিয়ে বেরিয়ে আসি, মুখে অসহ্য কষ্টের চিহ্ন নিয়ে। সেই কষ্ট সামলাবার জন্য আমাকে নিশ্বাস নিতে হয় এই রোগভোগ জীবাণু ও শত্রুতে ভরা পৃথিবীর হাওয়ায়। দম ছেড়ে কান্না বার করতে আমার পাঁচ-ছ’ সেকেন্ড সময় লাগে। কেউ আমার কষ্ট বোঝে না, আমার কান্না দেখে কাঁদে না, তারা হাসে। আমি হাত-পা ছুঁড়ে প্রতিবাদ জানাই, কেন আমাকে এখানে নিয়ে এলে? কেউ ফিরিয়ে দেবার কথা ভাবে না। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এ রকম প্রতিবাদ জানিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমার নাভির কাছে ফুল ফুটে ওঠার অনুভূতি হয়। এখন আমি একটা আলাদা অস্তিত্ব–এখন আমিও সৃষ্টিকর্তা। আমিও একদিন নতুন প্রাণের সৃষ্টি করতে পারব। কিংবা, সামান্য অঙ্গুলি হেলনে অন্যের প্রাণ বিনষ্ট করে দেব। আমি এসেছি। সেই মুহূর্তে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ব্ৰহ্মার নিদ্রার মতন আমারও ঘুমের এক একটি মুহূর্তে কল্পান্ত পার হয়ে যায়। আবার জেগে উঠে দেখি, এ-পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। আমার খিদে পায়।

আমি সেই ঘুম থেকে জেগে না উঠতেও পারতাম। আমি মাতৃগর্ভ থেকে মৃত্যুতে নীলবর্ণ হয়েও বেরোতে পারতাম। কিংবা রক্তমাখা একটা মাংসপিণ্ড হয়ে আমার স্থান হতে পারত ডাষ্টবিনে। সে রকম কিছু হয়নি। আমি এসেছি। তা হলেও মৃত্যু আমার সব সময়ের সঙ্গী। আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় প্রকৃতি–আবার এই প্রকৃতিই সামান্য সুযোগে আমাকে মেরে ফেলবে। এসব জেনেশুনেও বেঁচে থাকার কী অদ্ভুত নেশা মানুষের।

সব মানুষ তার জীবনের অনিশ্চয়তার কথা জানে, তবু ভুলে থাকে। এটাও প্রকৃতির খেয়াল যে মানুষকে মৃত্যুর কথা ভুলিয়ে রাখবে। শুধু এক এক সময় মনে হয় না জন্মালেই বা কী হত।

আমার কৈশোরে আমি দেখেছি দেশ জোড়া অনাচার ও মৃত্যুর তাণ্ডব। তবু সেই সব দৃশ্যও তো আমাকে সর্বাঙ্গীন ভাবে বিমর্ষ করে তোলেনি। সময় পার হয়ে যায়, আমরা সব ভুলে যাই। দু-একটা অকিঞ্চিৎকর ঘটনার স্মৃতিই জ্বলজ্বল করে।

জীবনে তিন বার আমি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছি। মানুষ কেন আত্মহত্যা করতে চায়, তা আমি জানি না। আমি শুধু নিজের কথাই জানি। তবে, এটুকু সাধারণ ভাবে বলা যায় যে, বয়স্ক ব্যক্তিরা সচরাচর আত্মহত্যা করে না, এই ঝোঁকটা দেখা যায় কৈশোর-যৌবনেই বেশি। আমি প্রথম বার চেষ্টা করি আমার পনেরো বছর বয়সে।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। হিরোসিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা পড়েছে। হিটলার এবং নেতাজির বেঁচে থাকা বা মৃত্যু সম্পর্কে গুজবের অন্ত নেই। আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের বিচার হবে লাল কেল্লায়। বিজয় উৎসবের জন্য প্রত্যেক স্কুলে স্কুলে মিষ্টি বিতরণ করে লম্বা ছুটি দেওয়া হয়েছে। সেবার আমি বিষ্ণুদের সঙ্গে দেওঘর বেড়াতে গেলাম। বিষ্ণুদের সঙ্গে আমাকে বেড়াতে যেতে দেওয়ার ব্যাপারে বাবার বরাবরই একটা আপত্তি ছিল। কিন্তু বাবা এখন আর জোর দিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেন না। তা ছাড়া বিষ্ণুদের সঙ্গে আমার এতই ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে যে আপত্তি করার তেমন প্রশ্নই ওঠে না। বাবা আমাকে কুড়িটা টাকা দিয়ে দিলেন আসবার সময়ে।

দেওঘরের বম্পাস টাউনে বিষ্ণুদের কোন আত্মীয়ের বাড়ি। বাড়িখানা বিরাট। বাগানে অজস্র ডালিয়া, গোলাপ, ইউক্যালিপটাস ও আতা গাছ। এসেছেও বিরাট একটি দল। বিষ্ণুর মা-বাবা, রেণুর মা, ছোটকাকা, অংশু আর রেণু, তিনজন ঠাকুর-চাকর। আমার আর বিষ্ণুর ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনেই। আমাদের একটা আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে সকালে-সন্ধ্যায় আমাদের নিয়মিত পড়াশুনো করতে হবে।

জীবনে মানুষকে অনেক পরীক্ষা দিতে হয়, কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষার চেয়ে শক্ত কিছু নেই। আমি পড়াশুনোয় খুব একটা খারাপ ছিলাম না–ক্লাসে ওঠার পরীক্ষায় কোনও বারই তো আটকে যাইনি, তবু ম্যাট্রিক পরীক্ষার কথা ভাবলেই মনে হত ফেল করব। এ যেন লটারি। কেন না, আমাদের আগের বছরে জীমূত ফেল করেছিল। জীমূত আমার থেকে অনেক বেশি ঝকঝকে ছেলে, কত সুন্দর ভাবে সাজিয়ে কথা বলতে পারে, ইংরেজি গল্পের বই পড়ে ডিকশনারি না দেখে, তবু সে অঙ্কে ফেল করেছিল।

বিষ্ণুর অবশ্য আত্মবিশ্বাস বেশি। ও শুধু ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ার কথাই চিন্তা করে না–ও স্ট্যান্ড করার কথা ভাবে। পড়াশুনোয় বিষ্ণুর মনোযোগও অনেক বেশি। আমার মা আমাকে পড়াশুনোর জন্য ইদানীং প্রায়ই বকাবকি করতেন। কখনও কখনও বলতেন, বিষ্ণুকে দেখে শিখতে পারিস না? ওর পা-ধোওয়া জল খা। অথচ বিষ্ণুর চেয়ে যে আমি অঙ্ক ভালো জানি সে কথা কেউ জানে না।

চমৎকার হালকা সব দিন। বাতাসে ধুলোবালি নেই, আকাশ নম্র নীল। রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় নাকে আসে শুকনো পাতার সুগন্ধ।

ভোরবেলা উঠে বাড়িসুষ্ঠু সবাই বেড়াতে যায়। এটা বিষ্ণুর বাবা একেবারে নিয়ম করে দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যের কারণে। স্বাস্থ্যকর জায়গায় বেড়াতে এসে রোজ না হাঁটলে শরীর ভালো থাকে না। বেশির ভাগ দিনই আমরা নন্দন পাহাড়ের দিকে যেতাম। কমপিটিশান দিতাম কে আগে উঠতে পারে। প্রচণ্ড দৌড়োদৌড়ি করে ওপরে উঠে হাপাতাম। আমাদের আরাম দেবার জন্য আকাশ তখন ঠান্ডা সুবাতাস পাঠিয়ে দিত। দূরের ধানখেত হলুদ-সবুজ শতরঞ্চির মতন।

নন্দন পাহাড়ের ওপরটায় দাঁড়ালে দূরে একদিকে দেখা যায় ডিগরিয়া পাহাড় আর একদিকে ত্রিকূট। এই দুই পাহাড় সম্পর্কে আমরা কত রকম গল্প শুনতাম। ডিগরিয়া পাহাড়ে নাকি কেউ কখনও উঠতেই পারে না। ভারতীয়দের তৈরি প্রথম বোমা পরীক্ষার জন্য ফাটানো হয়েছিল ওই পাহাড়ে। যে বাঙালির ছেলেটি বোমাটি নিয়ে গিয়েছিল, সে সেই বিস্ফোরণে মারা যায়, কিন্তু তার দেহটাও অদৃশ্য হয়ে যায়। এই গল্প বললেন বিষ্ণুর বাবা। ডিগরিয়ার তুলনায় ত্রিকূট পাহাড় বেশি উঁচু হলেও মানুষ উঠতে পারে।

একদিন বিষ্ণু আর আমি দু’খানা সাইকেল নিয়ে ঘুরে এলাম ত্রিকূট পাহাড়। অংশু সাইকেল চালাতে জানে না–আমরা ওকে পেছনে ক্যারি করবার চেষ্টা করেছিলাম—কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় একজনকে পেছনে বসিয়ে সাইকেল চালানো অসম্ভব–তাই ওকে নামিয়ে দিয়ে গেলাম। অংশু কথা বন্ধ করে দিল আমাদের সঙ্গে।

কোনও গাইড সঙ্গে না নিয়েই ত্রিকূট পাহাড়ের একটা চূড়ায় উঠেছিলাম বিষ্ণু আর আমি। আমাদের অভিযাত্রী হবার সেই প্রথম পদক্ষেপ। বিষ্ণু দারুণ উৎসাহ পেয়েছিল। কিন্তু পাহাড়ের অনেক উঁচুতে এক পাল মোষ দেখে আমি একটু হতাশ হয়েছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম বুনো মোষ, পরে দেখলাম সঙ্গে রাখাল রয়েছে। যে-পাহাড়ে মোষরাও উঠতে পারে–সেই পাহাড়ে অভিযান করার কৃতিত্ব কোথায়!

প্রাতভ্রমণের পর বাড়িতে এসে জলখাবারের পর্ব। তারপর আমি আর বিষ্ণু পড়তে বসি। আমাদের দেখাদেখি রেণু আর অংশুও বইখাতা নিয়ে আসে। কিন্তু ওরা নীচের ক্লাসে পড়ে বলে ওদের আমরা পাত্তা দিই না। তাড়া দিয়ে বলি, যা, যা, এখানে বিরক্ত করিস না।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আমি আর বিষ্ণু বাড়ির মধ্যে থাকি না। বাগানে একটা ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে আমরা আস্তানা বানিয়ে নিয়েছি। সেখানে শুয়ে থাকি। শুকনো ইউক্যালিপটাস পাতা গুঁড়ো করে নাকের কাছে গন্ধ শুকি। আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে এত ভালো লাগে যে মনখারাপ হয়ে যায়।

একথাও ঠিক যে, তখন মাঝে মাঝেই আমার খুব মনখারাপ হয়ে যেত। সেই মনখারাপের আমি কোনও কারণই খুঁজে পাইনি। মা বাবাকে ছেড়ে থাকবার জন্য আমার মনখারাপ হবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তখন আমার পনেরো বছর বয়স–তখনই মা বাবার সঙ্গে আমার একটু একটু করে দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে’বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতেই আমার বেশি ভালো লাগে। দেওঘরে বন্ধুদের সঙ্গে এত হইচইয়ের মধ্যেও আমার হঠাৎ হঠাৎ মনখারাপ লাগত। ঘরের মধ্যে সবাই মিলে খুব গল্প হচ্ছে হয়তো আমি এক ফাঁকে সেখান থেকে চলে যেতাম। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে একটা বড় সাদা গোলাপ ছিঁড়ে নিয়ে ভাবতাম, আমাদের দুঃখ দেবার জন্যই এই ফুলটা ফুটেছে।

বিষ্ণুর ছোটকাকা সেই অবস্থায় আমাকে দু-এক বার দেখে ঠাট্টা করে বলতেন, আমাদের কবিমশাইয়ের কান্ড দেখো! কী হে বাদলকুমার, কবিত্ব একেবারে উথলে উঠল নাকি?

আমি ওঁকে অনেক বার বলেছি যে আমার নাম বাদলকুমার নয়, বাদলরঞ্জন। কিন্তু সে কথা ওঁর মনেই থাকে না।

সন্ধ্যার সময় বড়রা আলাদা ভাবে বেড়াতে যেতেন। ছোটরা বাড়িতেই থাকবে। কিংবা ছোটরা দলবেঁধে বাইরে গেলেও সাতটার মধ্যে ফিরতে হবে। সন্ধ্যার সময় আমাদের পড়াশুনো বিশেষ হত না–তখন আমরা নানা রকম খেলাধুলোর উদ্ভাবন করতাম। ভূত সাজার খেলাটা ছিল আমাদের খুব প্রিয়। রেণুর সাংঘাতিক ভূতের ভয়– আর ওকে ভয় দেখিয়েই আমাদের বেশি মজা।

খাওয়াদাওয়ার পর অনেক রাত জেগে গল্পের বই পড়তাম বিষ্ণু আর আমি। তখন আমরা বড়দের বইয়ের জগতে উত্তীর্ণ হয়েছি। বিষ্ণু শরৎ চাটুজ্যে শেষ করছে। আমি ছিলাম ডিটেকটিভ গল্পের পোকা-দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্য লহরী সিরিজ, শশধর দত্তের মোহন সিরিজ একটার পর একটা গিলছি। মোহন রমাকে প্রায়ই বলত, ‘ভয়াতুরা কপোতী আমার’– কী ভালো যে লাগত এই উৎপ্রেক্ষাটা! চুপি চুপি আমি এটা একটা কবিতাতেও ব্যবহার করে ফেলেছিলাম পর্যন্ত।

বেশ তো কাটছিল দিন। এর মধ্যে আমার একটু জ্বর হল। সামান্য জ্বর, আর কোনও অসুবিধে হয় না, শুধু শরীর ম্যাজম্যাজ করে। কিন্তু এতেই বাড়িসুষ্ঠু সবাই এমন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন যে আমার খুব লজ্জা করতে লাগল। এই সময় জ্বর হবার কোনও মানে হয়! কোনওক্রমে জ্বরটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় না! কিন্তু জ্বরটা চলতেই লাগল তিন-চার দিন, সেই সঙ্গে পেটে ব্যথা! জ্বরের কথা লুকোনো যায় না কিন্তু পেট ব্যথার কথাটা আমি কারোকে বলিনি। এক এক সময় আমার মনে হত এর থেকে মরে যাওয়াই ভালো। সেই আমার প্রথম মৃত্যুচিন্তা।

একদিন দুপুরবেলা আমি একা একা শুয়ে বই পড়ছি। চাদর দিয়ে আমার শরীর ঢাকা, বাইরে রোদ ফটফট করছে, তবু আমার একটু একটু শীত বোধ হয়। বিষ্ণু আর অংশু কোথায় জানি না হয়তো বাগানে গাছতলায় শুয়ে আছে কিংবা জসিডিতেও যেতে পারে। রেণু ওর মা আর কাকা-কাকিমার সঙ্গে এইমাত্র গেল বৈদ্যনাথ মন্দিরে পূজো দিতে। ছোটকাকা তার নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছেন, এইখান থেকেও শুনতে পাওয়া যায় তার নাকডাকার শব্দ।

বইটা পড়তে পড়তে আমার চোখ টনটন করছিল। একসময় বাগানের গেট খোলার শব্দে জানলার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রেণু ছুটতে ছুটতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। দড়াম করে একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ হল। একটু বাদেই রেণু যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, আমি ডাকলাম, এই রেণু, শোন–

রেণু জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বলল, কী রে?

আমি বললাম, আমাকে এক গেলাস জল দিয়ে যা না।

রেণু ফিরে এল বাড়ির মধ্যে। জলের গেলাস হাতে আমার ঘরে ঢুকে বলল, তুই একলা একলা শুয়ে আছিস? ছোড়দারা কোথায়?

কী জানি। বাগানে নেই?

না তো।

তা হলে বোধহয় জসিডি গেছে। আজ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এখান দিয়ে ট্রেনে করে যাবেন, ছোটকাকা বলছিলেন–

বাড়িতে আর কেউ নেই?

ছোটকাকাই তো রয়েছেন! নাকডাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছিস না?

আমি বসব তোর কাছে?

রেণুর এই কথাটায় আমি একেবারে অভিভূত হয়ে গেলুম। একলা একলা খুব মনখারাপ লাগছিল। অথচ অন্য কেউ যদি আমার জ্বরের জন্য সহানুভূতি দেখিয়ে আমার সঙ্গে থাকতে চাইত–আমি তাতেও লজ্জা পেতুম, আমার জন্যে কারোকে আটকে রাখা পছন্দ করতুম না। কিন্তু রেণু সম্পর্কে সেকথা মনে হল না।

তবুও আমি ক্ষীণ গলায় বললুম, তুই পুজো দিতে গেলি না? ফিরে এলি যে?

রেণু বলল, আগে একদিন তো গেছি। মন্দিরে বড্ড ভিড় হয়, আমার ভালো লাগে না।

কয়েক বছর আগে রেণুর যখন ঘন ঘন অসুখ করত, তখন আমি ওর বিছানার পাশে। বসে ওকে গল্পের বই পড়ে শোনাতাম। জানি না, সে কথা রেণুর মনে আছে কিনা। এই কয়েক বছরে রেণু অনেকটা বদলে গেছে। চোখে চশমা নেওয়ায় মুখখানা অন্য রকম দেখায়–মাথার কেঁকড়া চুল এখন কোমরের কাছ পর্যন্ত নেমেছে। এখনও ফ্রক পরে রেণু, কিন্তু দু-এক দিন শাড়ি পরতেও দেখেছি। আজ পরে আছে একটা গোলাপি রঙের ফ্রক। রেণু পড়াশুনোয় খুব ভালো, প্রত্যেক পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়।

আমি উঠে বসে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিলুম। রেণুকে বললুম, তোর চশমাটা খুলে ফ্যাল তো! চশমা ছাড়া তুই দেখতে পাস না?

দূরের জিনিস ভালো দেখতে পাই না। কাছের জিনিস দেখতে পাই।

আমি তো কাছেই বসে আছি।

রেণু আমার চোখের দিকে তাকাল। আমিও ওর চোখে স্থির দৃষ্টি মেলে রইলাম। এই রকম ভাবে দু’জনে তাকিয়ে আছি তো তাকিয়েই আছি। যেন আমরা স্ট্যাচুর খেলা খেলছি।

একটা জিনিস লক্ষ করলাম, রেণুর সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি কথা খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ অন্য সময় অনর্গল কথা বলি। এখন কিছু বলতে গেলেই মনে হচ্ছে, এটা বলা ঠিক হবে না। রেণুও তো কোনও কথা বলছে না।

একটু বাদে বললাম, তুই শুধু শুধু আমার জন্য এখানে বসে রইলি। কাকিমাদের সঙ্গে গেলে কত কিছু জিনিসপত্তর কেনাকাটি হত।

রেণু বলল, মোটেই আমি শুধু শুধু বসে থাকছি না। আমার ইচ্ছে হচ্ছে, তাই বসে আছি।

তোকে দেখে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল।

মন খারাপ ছিল বুঝি?

হুঁ। তোকে দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়।

সত্যি?

ঠিক ঠাট্টার সুরে নয়, কথাটা বলতে গিয়ে রেণু একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। তারপর বলল, আমারও মাঝে মাঝে খুব মনখারাপ হয়ে যায়।

কেন?

কী জানি!

আমি একটু চুপ করে থেকে বলেছিলাম, রেণু, তুই আর আমি সারা জীবন বন্ধু থাকব। তুই রাজি আছিস?

রেণু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, হু।

আমাদের কখনও ঝগড়া হবে না। তুই যা বলবি, আমি শুনব। আমি যা বলব, তোকেও শুনতে হবে। রাজি?

হুঁ।

আমরা কেউ কারওর ওপর রাগ করতে পারব না। রাগ করলেও ক্ষমা করে দেব আবার। তাই না!

হুঁ।

তুই শুধু হুঁ হুঁ বলছিস কেন? আর কিছু বলছিস না যে?

তুই আমাকে কখনও ভুলে যাবি না?

ভুলব কেন? ভুলে যাওয়া কি সম্ভব নাকি!

না, সত্যি করে বল, ভুলে যাবি কি না!

বলছি তো—

নিজের বুকে হাত দিয়ে বল।

রেণু মাঝে মাঝে এই রকম পাগলামি করে। কখন যে কোন কথাটা কী ভেবে বলে, তা বোঝার উপায় নেই। আমরা দুজনে কাছাকাছি বসে আছি, সারা জীবন আমাদের দেখা হবে–এর মধ্যে আবার ভুলে যাবার কথা আসে কী করে? তবু রেণুর এই ধরনের পাগলামিই আমার অসম্ভব ভালো লাগে।

আমি ওর একটা হাত তুলে নিয়ে আমার মুখে বুলোতে লাগলাম। আমার জ্বরতপ্ত মুখে ওর হাতের স্পর্শ অসম্ভব ঠান্ডা লাগল। আমি বললাম, রেণু, তোর হাতে কী সুন্দর। গন্ধ!

রেণু লজ্জা পেয়ে বলল, যাঃ! আমি তোর গায়ে হাত বুলিয়ে দেব?

না। আমার অসুখ সেরে গেছে।

এখন তো জ্বর রয়েছে।

থাকুক।

আমার মনে হল, রেণুর সমস্ত শরীরটা একটা অয়স্কান্ত মণি। কত ছেলেবেলা থেকে ওকে চিনি, অথচ আজ সবকিছুই অন্য রকম। আমি ঝুঁকে এসে রেণুর ঘাড়ে, গলায়, কপালে, গালে চুমু খেতে লাগলাম।

রেণু বিস্মিত ভাবে বলল, এ কী?

তারপর একটু সরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, এগুলো কি খারাপ কাজ?

আমি তীব্র গলায় বললুম, না।

তুই কী করে জানলি?

আমি ঠিক জানি।

রেণু আবার কাছে এগিয়ে এসে বসল। আমি রেণুর গলা জড়িয়ে ধরলাম। আমার মনের মধ্যে একটা উথালপাথাল চলছিল। আমি কী করছি, নিজেই জানি না। আমি ব্যগ্র ভাবে রেণুর বুকের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি রেণুর বুকের মাঝখানে হাত রেখে বললাম, আমি তোর বুক ছুঁয়ে বলছি, তোকে কখনও ভুলব না।

রেণু আমার হাত সরিয়ে দিতে গেল। আমি ওর বুকে আমার মুখটা ঘষতে লাগলাম।

রেণু বলল, এটা কি খারাপ কাজ?

না।

তোকে কে বলেছে?

আমি বইতে পড়েছি—

যদি বইতে মিথ্যে কথা লেখে!

বইতে কখনও মিথ্যে কথা লেখে না। তোর ভালো লাগছে না?

কী জানি?

তুই নিজে জানিস না? আমার অসম্ভব ভালো লাগছে। দেখ, আর একবার করছি।

কিন্তু এটা যদি খারাপ কাজ হয়?

কক্ষনও নয়।

ইচ্ছে হল রেণুকে আমার বুকে জড়িয়ে একেবারে পিষে ফেলি। ওর ছোট্ট শরীরটা আমার বুকের মধ্যে চলে যাক। রেণুকে শুইয়ে ফেলে আমি ওর ফ্রকের নীচে মাংসল বুক দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠলাম।

রেণু অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। একটু বাদে আমার কাছ থেকে পিছলে সরে গিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল, এটা নিশ্চয়ই খারাপ কাজ। আমি ঠিক জানি।

না, রেণু শোন–

কিছু শুনব না। এটা খারাপ কাজ, এটা অসভ্য, আমি ঠিক জানি–

রেণুর মুখে খানিকটা ভয় এবং খানিকটা ছেলেমানুষি অহংকার মেশানো। সেই মুহূর্তে ওকে ‘ভয়াতুরা কপোতী আমার’ বলার খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু লজ্জা পেলাম।

রেণু চুল ঠিক করতে করতে বলল, খারাপ ছেলেমেয়েরা এইসব অসভ্য জিনিস করে। তুই যদি এ রকম আর কখনও করিস, তা হলে তোর সঙ্গে আমি মোটেই বন্ধুত্ব করতে চাই না।

রেণু, প্লিজ, চলে যাস না।

তোর সঙ্গে আজ আমি কথা বলব না!

তারপর কয়েক ঘণ্টা আমার যে কী ভাবে কাটল, তা আর কেউ জানবে না। সন্ধ্যার পর আমি ঠিক করলাম, রেণুর চোখে যখন আমি ছোট হয়ে গেছি, তখন আর আমার বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না। শুধু এই কারণটুকু নয়, রেণুকে ছাড়িয়ে আমার বিষাদ আরও পরিব্যপ্ত হয়ে গেল। আমার যাবতীয় মনখারাপ এক হয়ে মিলল। আমার বদ্ধমূল ধারণা হল, আমার বেঁচে থাকার কোনও মূল্য নেই, এই পৃথিবীতে আমি অবান্তর। সেই রাত্তিরেই আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করি।

মরিনি যে তা বলাই বাহুল্য। না হলে, পরে আরও দু’বার আমি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কী করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *