অষ্টম পরিচ্ছেদ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও যীশুখ্রীষ্ট (Jesus Christ)
প্রত্যূষ (২৮শে অগস্ট) হইল। ঠাকুর গাত্রোত্থান করিয়া মার চিন্তা করিতেছেন। অসুস্থ হওয়াতে ভক্তেরা শ্রীমুখ হইতে সেই মধুর নাম শুনিতে পাইলেন না। ঠাকুর প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া নিজের আসনে আসিয়া বসিয়াছেন। মণিকে বলিতেছেন, আচ্ছা, রোগ কেন হল?
মণি — আজ্ঞা, মানুষের মতন সব না হলে জীবের সাহস হবে না। তারা দেখেছে যে, এই দেহের এত অসুখ, তবুও আপনি ঈশ্বর বই আর কিছুই জানেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — বলরামও বললে, ‘আপনারই এই, তাহলে আমাদের আর হবে না কেন?’
“সীতার শোকে রাম ধনুক তুলতে না পারাতে লক্ষ্মণ আশ্চর্য হয়ে গেল। কিন্তু পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পরে কাঁদে।
মণি — ভক্তের দুঃখ দেখে যীশুখ্রীষ্টও অন্য লোকের মতো কেঁদেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি হয়েছিল?
মণি — মার্থা, মেরী দুই ভগ্নী, আর ল্যাজেরাস ভাই — তিনজনই যীশুখ্রীষ্টের ভক্ত। ল্যাজেরাসের মৃত্যু হয়। যীশু তাদের বাড়িতে আসছিলেন। পথে একজন ভগ্নী (মেরী), দৌড়ে গিয়ে পদতলে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘প্রভু, তুমি যদি আসতে, তাহলে সে মরতো না।’ যীশু তার কান্না দেখে কেঁদেছিলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও সিদ্ধাই — Miracles]
“তারপর তিনি গোরের কাছে গিয়ে নাম ধরে ডাকতে লাগলেন, অমনি ল্যাজেরাস প্রাণ পেয়ে উঠে এল।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার কিন্তু উগোনো হয় না।
মণি — সে আপনি করেন না — ইচ্ছা করে। ও-সব সিদ্ধাই, Miracle তাই আপনি করেন না। ও-সব করলে লোকদের দেহেতেই মন যাবে — শুদ্ধাভক্তির দিকে মন যাবে না। তাই আপনি করেন না।
“আপনার সঙ্গে যীশুখ্রীষ্টের অনেক মেলে!”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আর কি কি মেলে?
মণি — আপনি ভক্তদের উপবাস করতে কি অন্য কোন কঠোর করতে বলেন না — খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধেও কোন কঠিন নাই। যীশুখ্রীষ্টের শিষ্যেরা রবিবারে নিয়ম না করে খেয়েছিল, তাই যারা শাস্ত্র মেনে চলত তারা তিরস্কার করেছিল। যীশু বললেন, ‘ওরা খাবে, খুব করবে; যতদিন বরের সঙ্গে আছে, বরযাত্রীরা আনন্দই করবে।’
শ্রীরামকৃষ্ণ — এর মানে কি?
মণি — অর্থাৎ যতদিন অবতারের সঙ্গে সঙ্গে আছে, সাঙ্গোপাঙ্গগণ কেবল আনন্দই করবে — কেন নিরানন্দ হবে? তিনি যখন স্বধামে চলে যাবেন, তখন তাদের নিরানন্দের দিন আসবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আর কিছু মেলে?
মণি — আজ্ঞা, আপনি যেমন বলেন — ‘ছোকরাদের ভিতর কামিনী-কাঞ্চন ঢুকে নাই; ওরা উপদেশ ধারণা করতে পারবে, — যেমন নূতন হাঁড়িতে দুধ রাখা যায়। দই পাতা হাঁড়িতে রাখলে নষ্ট হতে পারে’; তিনিও সেইরূপ বলতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বলতেন?
মণি — ‘পুরানো বোতলে নূতন মদ রাখলে বোতল ফেটে যেতে পারে।’ আর ‘পুরানো কাপড়ে নূতন তালি দিলে শীঘ্র ছিঁড়ে যায়।’
“আপনি যেমন বলেন, ‘মা আর আপনি এক’ তিনিও তেমনি বলতেন, ‘বাবা আর আমি এক’।” (I and my father are one.)
মণি — আপনি যেমন বলেন, ‘ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।” তিনিও বলতেন, ‘ব্যাকুল হয়ে দোরে ঘা মারো দোর খোলা পাবে!’ (Knock and it shall be opened unto you.)
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, অবতার যদি হয়, তা পূর্ণ, না অংশ, না কলা? কেউ কেউ বলে পূর্ণ।
মণি — আজ্ঞা, পূর্ণ, অংশ, কলা, ও-সব ভাল বুঝতে পারি না। তবে যেমন বলেছিলেন ওইটে বেশ বুঝেছি। পাঁচিলের মধ্যে গোল ফাঁক।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বল দেখি?
মণি — প্রাচীরের ভিতর একটি গোল ফাঁক — সেই ফাঁকের ভিতর দিয়ে প্রাচিরের ওধারের মাঠ খানিকটা দেখা যাচ্ছে। সেইরূপ আপনার ভিতর দিয়ে সেই অনন্ত ঈশ্বর খানিকটা দেখা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, দুই-তিন ক্রোশ একেবারে দেখা যাচ্ছে।
মণি চাঁদনির ঘাটে গঙ্গাস্নান করিয়া ঠাকুরের কাছে ঘরে উপনীত হইলেন। বেলা আটটা হইয়াছে।
মণি লাটুর কাছে আটকে চাইছেন — শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের আটকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ কাছে আসিয়া মণিকে বলিতেছেন, “তুমি ওটা (প্রসাদ খাওয়া) করো — যারা ভক্ত হয়, প্রসাদ না হলে খেতে পারে না।”
মণি — আজ্ঞা, আমি কাল অবধি বলরামবাবুর বাড়ি থেকে জগন্নাথের আটকে এনেছি — তাই রোজ একটি দুটি খাই।
মণি ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন ও বিদায় গ্রহণ করিতেছেন। ঠাকুর সস্নেহে বলিতেছেন, তবে তুমি সকাল সকাল এসো — আবার ভাদ্র মাসের রৌদ্র — বড় খারাপ।