ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ, গিরিশ, শশধর পণ্ডিত প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
ঠাকুরের অসুখ সংবাদ কলিকাতার ভক্তেরা জানিতে পারিলেন। আলজিভে অসুখ হইয়াছে সকলে বলিতেছেন।
রবিবার, ১৬ই অগস্ট, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ; (১লা ভাদ্র, ১২৯২)। শুক্লা ষষ্ঠী। অনেক ভক্ত তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন — গিরিশ, রাম, নিত্যগোপাল, মহিমা চক্রবর্তী, কিশোরী (গুপ্ত), পণ্ডিত শশধর তর্কচুড়ামণি প্রভৃতি।
ঠাকুর পূর্বের ন্যায় আনন্দময়, ভক্তদের সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — রোগের কথা মাকে বলতে পারি না। বলতে লজ্জা হয়।
গিরিশ — আমার নারায়ণ ভাল করবেন।
রাম — ভাল হয়ে যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — (সহাস্যে) — হাঁ, ওই আশীর্বাদ কর। (সকলের হাস্য)
গিরিশ নূতন নূতন আসিতেছেন, ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন, “তোমার অনেক গোলের ভিতর থাকতে হয়, অনেক কাজ; তুমি আর তিনবার এসো।” এইবার শশধরের সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
[শশধর পণ্ডিতকে উপোদেশ — ব্রহ্ম ও আদ্যাশক্তি অভেদ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (শশধরের প্রতি) — তুমি আদ্যাশক্তির কথা কিছু বল।
শশধর — আমি কি জানি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — একজনকে একটি লোক খুব ভক্তি করে। সেই ভক্তকে তামাক সাজার আগুন আনতে বললে; তা সে বললে, আমি কি আপনার আগুন আনবার যোগ্য? আর আগুন আনলেও না! (সকলের হাস্য)
শশধর — আজ্ঞা, তিনিই নিমিত্ত কারণ, তিনিই উপাদান কারণ। তিনিই জীব জগৎ সৃষ্টি করেছেন, আবার তিনিই জীবজগৎ হয়ে রয়েছেন; যেমন মাকড়সা, নিজে জাল তৈয়ার করলে (নিমিত্ত কারণ); আর সেই জাল নিজের ভিতর থেকে বার করলে (উপাদান কারণ)।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আর আছে যিনিই পুরুষ তিনিই প্রকৃতি, যিনিই ব্রহ্ম তিনিই শক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় করছেন না, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলি, পুরুষ বলি; আর যখন ওই সব কাজ করেন তখন তাঁকে শক্তি বলি, প্রকৃতি বলি। কিন্তু যিনিই ব্রহ্ম তিনিই শক্তি, যিনিই পুরুষ তিনিই প্রকৃতি হয়ে রয়েছেন। জল স্থির থাকলেও জল, আর হেললে দুললেও জল। সাপ এঁকে বেঁকে চললেও সাপ; আবার চুপ করে কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকলেও সাপ।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ব্রহ্মজ্ঞানের কথায় সমাধি — ভোগ ও কর্ম ]
“ব্রহ্ম কি তা মুখে বলা যায় না, মুখ বন্ধ হয়ে যায়। নিতাই আমার মাতা হাতি! নিতাই আমার মাতা হাতি! এই কথা বলতে বলতে শেষে আর কিছুই বলতে পারে না; কেবল বলে হাতি! আবার হাতি হাতি বলতে বলতে ‘হা’। শেষে তাও বলতে পারে না! বাহ্যশূন্য।”
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর সমাধিস্থ! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সমাধিস্থ।
সমাধিভঙ্গের পর কিয়ৎকাল পরে বলিতেছেন, ‘ক্ষর’ ‘অক্ষরের’ পারে কি আছে মুখে বলা যায় না।
সকলে চুপ করিয়া আছেন, ঠাকুর আবার বলিতেছেন, “যতক্ষণ কিছু ভোগ বাকি থাকে কি কর্ম বাকি থাকে, ততক্ষণ সমাধি হয় না।[1]
(শশধরের প্রতি) — “এখন ঈশ্বর তোমায় কর্ম করাচ্ছেন, লেকচার দেওয়া ইত্যাদি; এখন তোমায় ওই সব করতে হবে।
“কর্মটুকু শেষ হয় গেলে আর না। গৃহিণী বাড়ির কাজকর্ম সব সেরে নাইতে গেলে ডাকাডাকি করলেও আর ফেরে না।”
১ ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে ৷৷ [গীতা, ২।৪৪]