দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ঠাকুর মুক্তকণ্ঠ — শ্রীরামকৃষ্ণ কি সিদ্ধপুরুষ না অবতার?
রাত্রি আটটা হইয়াছে। ঠাকুর মহিমাচরণের সহিত কথা কহিতেছেন। ঘরে রাখাল, মাস্টার, মহিমাচরনের দু-একটি সঙ্গী, — আছেন।
মহিমাচরণ আজ রাত্রে থাকিবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, কেদারকে কেমন দেখছো? — দুধ দেখেছে না খেয়েছে?
মহিমা — হাঁ, আনন্দ ভোগ করছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — নিত্যগোপাল?
মহিমা — খুব! — বেশ অবস্থা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ। আচ্ছা, গিরিশ ঘোষ কেমন হয়েছে?
মহিমা — বেশ হয়েছে। কিন্তু ওদের থাক আলাদা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — নরেন্দ্র?
মহিমা — আমি পনর বৎসর আগে যা ছিলুম এ তাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ছোট নরেন? কেমন সরল?
মহিমা — হাঁ, খুব সরল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঠিক বলেছ। (চিন্তা করতে করতে) আর কে আছে?
“যে সব ছোকরা এখানে আসছে, তাদের — দুটি জিনিস জানলেই হল। তাহলে আর বেশি সাধন-ভজন করতে হবে না। প্রথম, আমি কে — তারপর, ওরা কে। ছোকরারা অনেকেই অন্তরঙ্গ।
“যারা অন্তরঙ্গ, তাদের মুক্তি হবে না। বায়ুকোণে আর-একবার (আমার) দেহ হবে।
“ছোকরাদের দেখে আমার প্রাণ শীতল হয়। আর যারা ছেলে করেছে, মামলা মোকদ্দমা করে বেড়াচ্ছে — কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে রয়েছে — তাদের দেখলে কেমন করে আনন্দ হবে? শুদ্ধ-আত্মা না দেখলে কেমন করে থাকি!”
মহিমাচরণ শাস্ত্র হইতে শ্লোক আবৃত্তি করিয়া শুনাইতেছেন — আর তন্ত্রোক্ত ভূচরী খেচরী শাম্ভবী প্রভৃতি নানা মুদ্রার কথা বলিতেছেন।
[ঠাকুরের পাঁচপ্রকার সমাধি — ষট্চক্রভেদ — যোগতত্ত্ব — কুণ্ডলিনী ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, আমার আত্মা সমাধির পর মহাকাশে পাখির মতো উড়ে বেড়ায়, এইরকম কেউ কেউ বলে।
“হৃষীকেশ সাধু এসেছিল। সে বললে যে, সমাধি পাঁচপ্রকার — তা তোমার সবই হয় দেখছি। পিপীলিকাবৎ, মীনবৎ, কপিবৎ, পক্ষীবৎ, তির্যগ্বৎ।
“কখনও বায়ু উঠে পিঁপড়ের মতো শিড়শিড় করে — কখনও সমাধি অবস্থায় ভাব-সমুদ্রের ভিতর আত্মা-মীন আনন্দে খেলা করে!
“কখনও পাশ ফিরে রয়েছি, মহাবায়ু, বানরের ন্যায় আমায় ঠেলে — আমোদ করে। আমি চুপ করে থাকি। সেই বায়ু হঠাৎ বানরের ন্যায় লাখ দিয়ে সহস্রারে উঠে যায়! তাই তো তিড়িং করে লাফিয়ে উঠি।
“আবার কখনও পাখির মতো এ-ডাল থেকে ও-ডাল, ও-ডাল থেকে এ-ডাল, — মহাবায়ু উঠতে থাকে! সে ডালে বসে, সে স্থান আগুনের মতো বোধ হয়। হয়তো মূলাধার থেকে স্বাধিষ্ঠান, স্বাধিষ্ঠান থেকে হৃদয়, এইরূপ ক্রমে মাথায় উঠে।
“কখনও বা মহাবায়ু তির্যক গতিতে চলে — এঁকে বেঁকে! ওইরূপ চলে চলে শেষে মাথায় এলে সমাধি হয়।”
[পূর্বকথা — ২২/২৩ বছরে প্রথম উন্মাদ ১৮৫৮ খ্রী: — ষট্চক্র ভেদ ]
“কুলকুণ্ডলিনী না জাগলে চৈতন্য হয় না।
“মূলাধারে কুলকুণ্ডলিনী। চৈতন্য হলে তিনি সুষুম্না নাড়ীর মধ্য দিয়ে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর এই সব চক্র ভেদ করে, শেষে শিরিমধ্যে গিয়ে পড়েন। এরই নাম মহাবায়ুর গতি — তবেই শেষে সমাধি হয়।
“শুধু পুঁথি পড়লে চৈতন্য হয় না — তাঁকে ডাকতে হয়। ব্যাকুল হলে তবে কুলকুণ্ডলিনী জাগেন। শুনে, বই পড়ে জ্ঞানের কথা! — তাতে কি হবে!
“এই অবস্থা যখন হল, তার ঠিক আগে আমায় দেখিয়ে দিলে — কিরূপ কুলকুণ্ডলিনীশক্তি জাগরণ হয়ে, ক্রমে ক্রমে সব পদ্মগুলি ফুটে যেতে লাগল, আর সমাধি হল। এ অতি গুহ্যকথা। দেখলাম, ঠিক আমার মতন বাইশ-তেইশ বছরের ছোকরা, সুষুম্না নাড়ির ভিতর দিয়ে যোনিরূপ পদ্মের সঙ্গে রমণ করছে! প্রথমে গুহ্য, লিঙ্গ, নাভি। চতুর্দল, ষড়দল, দশদল পদ্ম সব অধোমুখ হয়েছিল — ঊর্ধ্বমুখ হল।
“হৃদয়ে যখন এল — বেশ মনে পড়ছে — জিহ্বা দিয়ে রমণ করবার পর দ্বাদশদল অধোমুখ পদ্ম ঊর্ধ্বমুখ হল, — আর প্রস্ফুটিত হল! তারপর কণ্ঠে ষোড়শদল, আর কপালে দ্বিদল। শেষে সহস্রদল পদ্ম প্রস্ফুটিত হল! সেই অবধি আমার এই অবস্থা।”