2 of 2

৫১. বেয়াল্লিশ সালের গোড়ায়

বেয়াল্লিশ সালের গোড়ায় কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। তেতাল্লিশের শেষের দিকে তার থেকে আরও অনেক বেশি মানুষ এসে ঢুকল কলকাতা শহরে। এরা অন্য ধরনের মানুষ। এরা মরতে এসেছিল।

পটুয়াখালি, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, ২৪ পরগনা, বর্ধমান প্রভৃতি জায়গা থেকে বৃদ্ধ, শিশু, নারী ছুটে আসতে লাগল কলকাতায়। কলকাতায় শান বাঁধানো রাস্তায় তারা আছড়ে পড়ল। রাস্তায় রাস্তায় কিলবিল করছে মানুষ।

কলকাতার নাগরিকরা প্রথম প্রথম ব্যাপারটা দেখে ভুরু কুঁচকেছে। এত গ্রামের মানুষ শহরে কেন? শহরের কি আর মান ইজ্জত রইল না। এর আগে বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে কোনও এলাকায় বিপর্যয় ঘটলে কলকাতার লোকেরা চাঁদা তুলেছে। একদল উৎসাহী লোক হারমোনিয়াম ও খোল করতাল সঙ্গে নিয়ে মিছিল বার করে গান ধরেছে। মেদিনীপুরেতে বন্যা হয়েছে, শোনো শোনো ভাই নগরবাসী। মুষ্টি ভিক্ষা দিয়ে যাও সবে, ক্ষুধিতের পাশে দাঁড়াও আসি…। কোনও বছর যদি আসামে বন্যা কিংবা চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় হয়–তা হলে ওই একই গানে মেদিনীপুরের বদলে সেই জায়গার নাম বসিয়ে গাওয়া হয়। কিন্তু এবার এসব কী? দুর্ভিক্ষের বর্ণনা বঙ্কিমবাবু লিখে গেছেন আনন্দমঠে, সেই সূত্রে লোকে জানে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা। এবারে কি আবার সেই রকম দুর্ভিক্ষ শুরু হল? খবরের কাগজে কী বলে?

খবরের কাগজ অনেক দিন কিছুই বলেনি। যুদ্ধের বড় বড় খবরে সবাই ব্যস্ত দেশের মধ্যেও কংগ্রেস-লিগ কোন্দল খুব মজাদার জায়গায় পৌঁছেছে। গ্রামগুলোতে কী ঘটছে কে খবর রাখবে? তবে আশ্চর্যের বিষয়, তখনকার দিনে বক্সওয়ালা এবং পাট কোম্পানির সাহেব মালিকদের মুখপত্র একটি ইংরেজি দৈনিকেই প্রথম ফলাও করে দুর্ভিক্ষের ছবি ও খবর ছাপা হতে শুরু করেছিল।

গ্রামের মানুষ যখন শহরে এসে মরতে লাগল, তখন সকলের টনক নড়ল। ব্যাপারটা বড় নোংরা। মরতে যদি হয়, চোখের আড়ালে মরাই তো উচিত ছিল। ভিখিরিরা রাস্তায় আর পয়সা ভিক্ষে চায় না, তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাঁচায়, মা, একটু ভাত দাও! কিছু দিন পর তারা ভাতও চায় না। তারা বলে, মা, একটু ফ্যান দাও! ডাস্টবিনে খাবার খোঁজার জন্য কুকুরের ও মানুষের লড়াই, সেই প্রথম দেখা গেল এ শহরে। তারই মধ্যে একটা রসিকতাও চালু হয়ে গেল, অনশনে এক জনও মরেনি, সবাই মরেছে হার্টফেল করে। সরকারি হিসেব মতনই বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা পনেরো লক্ষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে একটি সমীক্ষায় এই সংখ্যা হয়েছিল পঁয়তিরিশ লাখ। বামপন্থীদের কাগজপত্রে বলা হয়েছে, এক কোটি কুড়ি লক্ষ। ইংলন্ডের জনসংখ্যা তখন এর দ্বিগুণ মাত্র। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সৃষ্ট কারণে এই বিপুল মৃত্যুর জন্য কোথাও কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় এর অপরাধীদের কোনও খোঁজ পড়েনি। প্রাণহানির সংখ্যার হিসেবে হিরোসিমা-নাগাসাকির ধ্বংসলীলা বাংলাদেশের তুলনায় কিছুই না। তবু সারা পৃথিবীর কাছে এ-খবর পোঁছোয়নি।

তখন শহরের মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট গুদামে হাজার হাজার বস্তা খাদ্য জমানো রয়েছে, যুদ্ধের জরুরি প্রয়োজনে। এর অনেক চালই শেষ পর্যন্ত পচে নষ্ট হয়েছে। অনেকের পকেটে তখন কাঁচা পয়সা ঝনঝন করছে, হোটেল-শুড়িখানাগুলো জমজমাট, দোকানের শোকেসে ভালো ভালো খাবার সাজানো। একটাও গুদাম লুঠ বা কেড়ে খাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। মানুষ শুধু পুঁকতে ধুকতে মরেছে।

কংগ্রেসের একগুঁয়েমি এবং ভ্রান্ত নীতির ফলে ফজলুল হক তখন বাধ্য হয়ে লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেছেন। বাঙালি মুসলমানরা বড় আবেগপ্রবণ, তারা অনেকেই হিন্দুদের সঙ্গে মিলে মিশেই থাকতে চায়, ভাষার সূত্রে হিন্দুদের আত্মীয় মনে করে। অবাঙালি মুসলমানরা তখন রাজনীতিতে ভাগ বাটোয়ারার আস্বাদ পেয়ে এখানকার মুসলমানদের মধ্য থেকে বাঙালিত্ব মুছে দেবার জন্য বদ্ধপরিকর। কতিপয় নবাবপুত্র এবং ব্যারিস্টাররাই তখন জননেতা। ধর্মের প্রশ্নটি আস্তে আস্তে জিগিরে পরিণত হচ্ছে। হিন্দু এবং মুসলমানের উভয় সংস্কৃতিতে লালিত পালিত, মনে প্রাণে বাঙালি ফজলুল হক তখন দেখছেন ঘটনা প্রবাহ তার অধিকারের বাইরে চলে যাচ্ছে।

কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে মুসলমানদের মন্ত্রিসভা নিজের শক্তিতে টিকে থাকতে পারে কি না–সেটাই তখন সরকারের কাছে বড় প্রশ্ন। কোনও রকম দুর্বলতাই সরকার স্বীকার করতে রাজি নয়। খাদ্যমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দি তেতাল্লিশের ৯ই মে ঘোষণা করলেন, দেশে খাদ্যের কোনও ঘাটতি নেই। মজুতদার আর মুনাফাবাজরাই দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এবং বেশি খাদ্য গ্রহণ করা যে স্বাস্থ্যের পক্ষে কত খারাপ সেকথাও জানালেন।

এদিকে এপ্রিল মাসে বোট অরডিনাসের ফলে পঁচিশ হাজার নৌকো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। গ্রামে গ্রামে মালপত্র চলাচল বন্ধ। আমন ধান সেবার ভালো ওঠেনি। বন্যা হয়েছে নানা জায়গায়। জাপানিরা বার্মা দখল করে নিয়েছে বলে সেখান থেকে আর চাল আসে না।

পরের মাসে অ্যাসেম্বলিতে একজন সদস্য প্রশ্ন তুললেন, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের কথা কি ঘোষণা করা হবে না? সোহরাওয়ার্দি বললেন দুর্ভিক্ষ কোথায়?

ভারতের স্বরাষ্ট্রসচিব স্মিথ বললেন, একদল লোকের সবকিছুই বড্ড বাড়িয়ে বলা স্বভাব।

ভারতসচিব আমেরি বললেন, খাদ্যের স্টক যথেষ্ট আছে আমাদের। তা ছাড়া গমের ফলন খুব ভালো হয়েছে।

আর তখন শুধু সাতক্ষীরার রাস্তাঘাটেই দু’হাজার মানুষের মড়া পড়ে আছে। বিভিন্ন জেলায় স্বামীরা স্ত্রী-পুত্র কন্যা ফেলে পালাচ্ছে। মায়েরা ছেলেমেয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। জলের দামে। এবং সন্তান বিক্রি করা টাকায় শেষ বারের মতন খেয়ে নিয়ে বমি করতে করতে মরছে। মাঠেঘাটে পড়ে-থাকা মানুষদের রাতের অন্ধকারে শেয়ালে এসে খেয়ে যাচ্ছে, তারা অনেকে তখনও বেঁচে। মরা মায়ের বুক থেকে দুধ খাবার চেষ্টা করছে। শিশু–এই ছবি তুলে তুলে সাহেবরাও ক্লান্ত।

১০ই অক্টোবর সোহরাওয়ার্দি ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশ এক অভূতপূর্ব দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে।

তখন মৃতদেহগুলি দাহ করার পালা। খাদ্যদ্রব্যের দাম তখন ছশো গুণ বেড়েছে।

বাদলের জ্যাঠামশাই অতি বৈষয়িক লোক। দুর্ভিক্ষের আঁচ পেয়েই তিনি মস্ত বড় বড় মাটির জালা কিনে তাতে চাল ভরে রাখলেন। নিজে মফসসলে ঘুরে চাল কিনলেন। এবং অচিরেই চালের কারবার সম্পর্কে এমন ওয়াকিবহাল হয়ে গেলেন যে এদিকেও আর একটা ব্যবসা খোলার লোভ হয়েছিল তার। কিন্তু ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা করার ব্যাপারে তাঁর বিবেক শেষ পর্যন্ত সায় দিল না। তবে পুলিশ লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চালের স্টক খোঁজ করছে–এই রকম একটা গুজব ওঠায় তিনি চালের জালাগুলো সব ঠাকুরঘরে লুকিয়ে রাখলেন। এবং পরে র‍্যাশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় তিনি অনেকগুলো ভুয়ো র‍্যাশান কার্ড করিয়ে রেখেছিলেন।

শেষের দিকে পাড়ায় পাড়ায় যখন লঙ্গরখানা খোলার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল, তিনি তাতে উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়েছেন এবং অনেক টাকা দানধ্যান করে সুনাম কিনেছেন। কিন্তু নিজের বাড়ির লোকের গায়ে আঁচড়টিও লাগতে দেননি। বাদলরা গ্রামে থাকতে কষ্ট পেয়েছিল, কিন্তু কলকাতায় তারা ভালো ছিল।

প্রত্যেক দিন অসংখ্য মৃত্যুর গল্প। রাস্তায়ঘাটে হাঁটাচলা করা যায় না। কিশোরের নিষ্পাপ সরল চক্ষু বাড়ির বাইরে তাকালেই বীভৎস দৃশ্য দেখে। এক এক দিন খেতে বসে সে বমি করে ফেলে!

একজন মাঝবয়সি স্ত্রীলোক বাড়ির ঠিক গেটের সামনে সকাল থেকে শুয়ে আছে। কিছুতেই সে যাবে না। অনেক চোখ রাঙানো, অনেক তর্জন গর্জন হল, সে কোনও উত্তর দেয় না—ড্যাবডেবে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। দারোয়ান তাকে লাঠি উঁচিয়ে মারবার ভয় দেখালেও সে ভয় পায় না। কোনও কথারই উত্তর দেয় না সে।

আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তাকে নিয়ে। একজন স্ত্রীলোককে তো সত্যি সত্যি মেরে তাড়ানো যায় না। তা ছাড়া, ওকে বোধহয় মারলেও যাবে না। প্রিয়রঞ্জন বার বার দারোয়াকে হুকুম দিতে লাগলেন ওকে সরিয়ে দেবার জন্য। দারোয়ান নাচার। সে আর সবকিছু করতে পারে, কিন্তু মেয়েছেলের গায়ে হাত দিতে পারে না। অথচ বাড়ির দরজার কাছে একজন একটু একটু করে মরবে–এও কি সম্ভব?

স্ত্রীলোকটির বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের বেশি নয়। তার চেহারাও খুব একটা জীর্ণ শীর্ণ বলা যায় না। বরং শরীরের কোনও কোনও অংশ বেঢপ ভাবে ফুলে ফুলো ও থসথসে। চুলগুলো নোংরা পাটের মতন। তার মুখ ও চোখ দেখলে মনে হয়, পৃথিবীর আর কোনও ডাক্তার তাকে বাঁচাতে পারবে না, মৃত্যু তার দেহভূমিতে পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু এত জায়গা থাকতে এবাড়ির দরজার সামনেই তাকে মরতে হবে কেন? এ তো বড় জ্বালাতনের কথা। অনেক মৃত্যু দেখতে দেখতে মানুষের মন অসাড় হয়ে যায়। দয়ামায়া তখন মনে হয় বিলাসিতা, নিজের এবং প্রিয়জনের বেঁচে থাকাই তখন সবচেয়ে বড় কথা। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে মরছে–সেখানে একজন-আধজনকে নিয়ে মাথা ঘামাবার আর কী মানে হয়। কিন্তু ব্যাপারটা চোখের সামনে ঘটছে বলেই এত অস্বস্তিকর।

প্রিয়রঞ্জন আর চিররঞ্জন এই দুই ভাই মিলেও অনেক চেষ্টা করলেন স্ত্রীলোকটিকে সরিয়ে দেবার। পারলেন না কিছুতেই। চিররঞ্জনের বাস্তব বুদ্ধি কম, তাই তিনি বললেন, দাদা, অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করলে হয় না?

প্রিয়রঞ্জন ভাইয়ের দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন এ রকম একটা নির্বোধ তিনি জীবনে দেখেননি। বললেন, তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে? রাস্তায় রাস্তায় লোক মরে পড়ে থাকছে–আর অ্যাম্বুলেন্স আসবে তাদের নিতে?

তা হলে এদের হবে কী?

কী আবার হবে? মরে গেলে কর্পোরেশানের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যাবে। তারা জ্যান্ত থাকতে থাকতে নেয় না, নিয়ম নেই। হাসপাতালগুলোতে জায়গা আছে? সুস্থ সমর্থ লোকগুলোকে ধরে ধরে জেলখানাগুলোও ভরে ফেলেছে আগেই–সেখানেও জায়গা নেই। যেমন হয়েছে শালার গভর্নমেন্ট।

তা বলে এ রকম আমাদের চোখের সামনে মরবে?

এই দারোয়ান হারামজাদা কোনও কম্মের না। রাত্তিরে এসে যখন বসেছিল তখনই যদি সরিয়ে দিত।

প্রিয়রঞ্জন পাড়ার ছোকরাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করলেন, বেশ কিছু টাকা দিতে চাইলেন। সুবিধে হল না। এইসব ছেলেরা মদ খাবার পয়সা পেলে অনেক সময় বেওয়ারিশ মড়া পোড়াতে নিয়ে যায়। কিন্তু তারাও জ্যান্ত মানুষ নিয়ে কারবার করে না।

প্রিয়রঞ্জনের জরুরি কাজ ছিল, তিনি আর থাকতে পারছিলেন না। যে-কোনও উপায়ে ওকে সরিয়ে দেবার হুকুম দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন, মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি রয়ে গেল।

সারা সকাল স্ত্রীলোকটি গেটের সামনে উবু হয়ে বসে ধুকতে লাগল। বাড়ির বাচ্চারা দূর থেকে তাকে দেখে। চাকরবাকর-দারোয়ান গেট দিতে যাওয়া আসার সময় প্রত্যেক বার তাকে একবার করে ধমকে যায়। একসময় তার বুক দিয়ে ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় শব্দ শোনা যেতে লাগল।

শ্রীলেখার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে, প্রভাসকুমার তাদের নিয়ে ফিরে গেছেন খড়্গপুরে। দুপুরবেলা বাড়িতে চিররঞ্জনই একমাত্র পুরুষমানুষ: গৃহকত্রী তাকে বললেন, ঠাকুরপো, গেরস্তবাড়ির সামনে একজন মেয়েমানুষ এ রকম ভাবে মরছে, এতে বাড়ির অকল্যাণ হবে না?

চিররঞ্জন ব্যস্ত হয়ে বললেন, তা তো ঠিকই। কিন্তু কী করা যায় বলুন তো বউদি?

তুমি একটা যা হোক কিছু করো।

আমি তো অনেক করে বললুম, ও তো কোনও কথাই শোনে না।

ওর কি কোনও কথা শোনার ক্ষমতা আছে? এক কাজ করি। আমার খাবারটা বাপু ওকে দিয়ে এসো, খেয়েদেয়ে যদি যায়–

বউদি আপনার খাবার দেবেন কেন? বরং আমারই আজ খিদে নেই–

তখন দেখা গেল, বাড়ির সকলেই নিজের নিজের খাবারটা দিয়ে দিতে রাজি আছে। কারওরই আজ খিদে নেই। সারা বাড়িতে আজ কেউ এক বারও হাসেনি, জোরে কথা বলেনি– মৃত্যুর এমনই গাম্ভীর্য।

খাবার দিতে গিয়ে আর এক বিপত্তি হল। বাড়ির ঝি খাবার নিয়ে যেই গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে–অমনি কোথা থেকে কাক-চিলের মতন একদল অধোলোঙ্গ কালো কালো মানুষ ধেয়ে এল। তারা সবাই খাবার চায়। গেটের সামনে চঁচামেচি হইহল্লা। তারা ভেবেছে, এবাড়িতে আজ অন্নসত্র বসেছে। তখন দারোয়ানকে লাঠি ঘুরিয়ে সেই ভিড় সামলাতে হল।

চ্যাঁচামেচিতে স্ত্রীলোকটি চোখ মেলে তাকিয়েছিল, একটু নড়েচড়ে বসেছিল। ভিড় ফাঁকা হবার পর ঝি তার সামনে খাবারের থালাটা ধরে বললে, এই খাবি?

অদ্ভুত ম্যাজিকের মতন একটা ব্যাপার ঘটল। স্ত্রীলোকটির চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, দেহটা স্প্রিংয়ের মতন সোজা হয়ে উঠল, ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ভাত? দাও, দাও!

হেলাফেলা করে খাবার দেননি সুপ্রভা, অতিথি নারায়ণকে সেবা করার জন্য যত্ন করে থালা সাজিয়ে দিয়েছেন। গরম গরম ভাত, ডাল, বেগুনভাজা, বাঁধাকপির তরকারি আর এক টুকরো মাছ। খাবার দেখলে মুমুর্মুও জীবন ফিরে পায়। স্ত্রীলোকটি কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, দাও, দাও!

গেটের সামনে খেতে দিলে আবার কাঙালির দল ছুটে আসবে, তাই গেট বন্ধ করে সামনের চাতালেই খাওয়ানো সাব্যস্ত হল। কুকুরের নাকের সামনে খাবার ধরে যেমন তাকে ডাকা হয়, সেই রকম ভাবে বাড়ির ঝি ওই স্ত্রীলোকটির মুখের কাছে খাবারের থালাটা ধরে এক পা এক পা করে পিছিয়ে বলতে লাগল, এ-দিকে আয়, এ-দিকে আয়।

স্ত্রীলোকটির দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। পা দুটিতে পক্ষাঘাত ধরে গেছে। অদ্ভুত কোনও জন্তুর মতন সে মাটিতে ঘষটে ঘষটে এগিয়ে গেল। তারপর ভাতের থালার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ডাল দিয়ে যে ভাত মাখতে হয়, তরকারি যে আলাদা খেতে হয়–এসব নিয়ম সে ভুলে গেছে। সে খাবলা খাবলা করে সব মুখে পুরছে। বাড়ির সব লোক দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে তাকে–কেউ একটিও কথা বলছে না।

স্ত্রীলোকটি সারা সকাল মুখ খোলেনি, কিন্তু এখন সে খেতে খেতে আপন মনে অনেক কথা বলছে, তার কিছুই বোঝা যায় না। যেন সে অন্নের সঙ্গেই কথা বলছে–অভিমানী সন্তানের মতন যে অনেক দিন দূরে ছিল।

সবটুকু সে খেতে পারল না, খানিকটা পরে সে থালার পাশেই শুয়ে পড়ল।

ঝি বলল, ও ভালোমানুষের মেয়ে; তুমি বাপু খাবারটাবার খেয়ে এবার অন্য কোথায় যাও।

স্ত্রীলোকটি ফিক করে হেসে রীতিমতন পরিষ্কার গলায় বলল, যাব গো মা, যাব। একটুখানি শুয়ে নিই!

সুপ্রভা বললেন, আহা থাক। আগে সবটা খেয়ে নিক। একটু জিরিয়ে নিক না হয়।

স্ত্রীলোকটি বলল, বড় ভালো রান্না হয়েছে। আহা ভাতের কী সুন্দর সোয়াদ।

সুপ্রভা বললেন, তোমার কোথায় বাড়ি? তোমার আর কেউ নেই?

সবই ছিল মা, এখন কে আছে কে নেই, জানি না। আমাদের বাড়ি হেতমপুর।

এত দূরে কার সঙ্গে এসেছ?

আমার ছেলে।

সে কোথায়?

স্ত্রীলোকটির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল। আরও কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। যেন তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

সুপ্রভা বললেন, আহা, ওর ঘরসংসার সবকিছুই ছিল।

ও তখন একটা হাত কপালে ছোঁয়াল। যেন সে কিছু একটা বোঝাতে চায়।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে পেটের সবকিছু বমি করে বার করে দিল। এবং কাটা পাঁঠার মতন ছটফট করতে লাগল। তখন তাকে সেখান থেকে সরানো আরও অসম্ভব। হয়ে দাঁড়াল। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস যে পেট ভরে খায়নি, তার পেটে একসঙ্গে এত খাবার বিষের মতন।

প্রিয়রঞ্জন বাড়ি ফিরে এসে সেই দৃশ্য দেখে রাগে একেবারে জ্বলে উঠলেন। কাছেই ছোটভাইকে দেখে বললেন, তুই শেষে এই কাণ্ড করলি? আমার বাড়িতে অলক্ষ্মী ডেকে আনলি? তোকে আমি এত করে বলে গেলাম–

চিররঞ্জন বাধা দিয়ে বলার চেষ্টা করলেন যে তিনি ঠিক নিজের ইচ্ছেয় ওকে ভেতরে আনেননি–বউদিই খাবার দিতে চেয়েছিলেন। প্রিয়রঞ্জন তা শুনলেন না। অনবরত বকতে লাগলেন। ছোটভাইয়ের অকর্মণ্যতা দোষ বিষয়েও খোঁটা দিতেও ছাড়লেন না। রাগলে তার জ্ঞান থাকে না। বার বার বলতে লাগলেন, আমার বাড়িতে এই উৎপাত! দয়াধর্ম যদি করতেই হয় বাইরে গিয়ে করলেই পারিস!

অনেক লোকজন সেখানে জমে গেছে। চিররঞ্জন আর দাঁড়াতে পারলেন না, মুখ নিচু করে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। নিজের ঘরে বসে রইলেন গুম হয়ে।

একটু বাদে হিমানী ব্যস্তসমস্ত হয়ে সে-ঘরে ঢুকে বললেন, ওগো ওর মুখখানা যেন নীল হয়ে যাচ্ছে, আর বোধহয় বেশিক্ষণ নেই–

চিররঞ্জন বিরক্ত ভাবে বললেন, যা খুশি তোক। আমি কিছু জানি না।

তুমি যাবে না একবার?

না। আমি গিয়ে কী করর?

কী হল তোমার?

দাদা আজকাল প্রতি পদে পদে বুঝিয়ে দেন, এটা ওঁর নিজের বাড়ি, এখানে আমি কেউ নয়।

কখন আবার একথা বললেন?

রোজই তো বলেন। একটু আগেই তো সবার সামনে—

হিমানীর মুখে একটা বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল। ঝংকার দিয়ে বললেন, তা বলেন যদি, মিছে কথা তো কিছু বলেন না! তোমাকে থাকতে দিচ্ছেন, খেতে পরতে দিচ্ছেন এই তো যথেষ্ট।

আমিও তো দাদার অফিসের কাজটাজ দেখছি।

ছাই দেখছ! ও তো একটা ভুজুং ভাজুং দিয়ে বসিয়ে রেখেছেন শুধু তোমাকে। তোমার ওপর কোন দায়িত্বটা থাকে? কত করে তখন বললাম, আমার বাপেরবাড়িতেই থাকতে। বাবা কোনও দিন যত্নআত্যির ত্রুটি করেছেন?

চিররঞ্জন রেগে উঠলেন। তীব্র গলায় বললেন, তোমার বাপেরবাড়িতে চিরকাল ঘরজামাই হয়ে থাকব নাকি? তোমার জন্য কি আমার মানসম্মানও রাখতে পারব না?

হিমানীও ঝঝের সঙ্গে বললেন, আর আমিই বুঝি তোমার দাদার বাড়িতে দাসীবাদি হয়ে থাকব সারা জীবন?

মোটেই তোমাকে দাসীবাদি করে রাখা হয়নি।

তুমি কতটুকু জানো? আমার ছেলেকে আমি ইচ্ছে মতন কোনও দিন কিছু খেতে দিতে পারি না পর্যন্ত।

একটি অর্থহীন মৃত্যুর পটভূমিকায় এদের মনের তিক্ততাগুলো বেরিয়ে আসছে। চিররঞ্জন আরও কিছু কঠোর কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। আর কোনও উত্তর দিলেন না। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তাকে তো আরও বেশ কিছু দিন বেঁচে থাকতে হবে–কিন্তু কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচবেন? হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল ছাত্র বয়সের দিনগুলোর কথা। আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটি বাড়িতে থাকতেন, কলকাতায় তখনও কোনও সহায় সম্বল না থাকলেও দিনগুলো অনেক লঘু ছিল। মনে কত আশা ছিল। কখনও কোনও কারণে মনখারাপ হলেও ছাত্রের পিসিমা মলিনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই মন আবার ভালো হয়ে যেত। মলিনা প্রায় তারই সমান বয়সি ছিলেন– কী শান্ত, স্নিগ্ধ দুটি চোখ। মনখারাপ হলেই মলিনা ঠিক বুঝতে পারত, কাছে এসে বলত, আপনার কী হয়েছে আমাকে বলুন তো! চিররঞ্জনের তখন বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠত।

চিররঞ্জন অনুতপ্ত হয়ে ভাবলেন, এবার কলকাতায় এসে এক দিনও আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে দেখা করতে যাওয়া হয়নি। আঃ, এখন যদি মলিনার কাছে গিয়ে বসে থাকা যেত।

হিমানী তখনও বকাবকি করছিলেন বলে চিররঞ্জন বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। নীচে তখন মুমুর্ষ স্ত্রীলোকটিকে ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড়। চিররঞ্জন কী ভেবে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। কাছাকাছি একটা ডাক্তারখানায় গিয়ে বললেন, একবার। আসবেন আমাদের বাড়িতে? এক্ষুনি?

ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার হয়েছে বলুন তো!

চিররঞ্জন সব ঘটনা বললেন।

ডাক্তার গম্ভীর ভাবে সব শুনে বললেন, দেখুন, এটা একজন গৃহস্বামীর সমস্যা হতে পারে– কিন্তু ডাক্তারদের তো করার কিছু নেই?

আপনি চিকিৎসা করতে পারবেন না?

ডাক্তাররা তো ধন্বন্তরি নয় যে একজন মুমুর্ষ রুগিকে গিয়ে এক পুরিয়া ওষুধ দেব কিংবা একটা ইঞ্জেকশন দেব–আর অমনি সে হেঁটে চলে আপনার বাড়ির থেকে চলে যাবে? আর একটু অপেক্ষা করুন–তারপর মুদাফরাশদের খবর দেবেন।

আমি বলছিলাম, ওকে বাঁচানো যায় কিনা। আমি চিকিৎসার খরচ দেব।

ডাক্তার এবার রীতিমতন ব্যঙ্গ করে বললেন, এ কি ছেলেখেলা পেয়েছেন? চিকিৎসা নিশ্চয়ই করা যেতে পারে তা হলে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে খাটবিছানা পেতে শোওয়ান– দেখাশুননা করার জন্য একজন লোক রাখুন। নাকি রাস্তায় ফেলে রেখেই চিকিৎসা? :

চিররঞ্জন তবু ডাক্তারটিকে নিয়ে এলেন। ভিড় সরিয়ে ডাক্তার স্ত্রীলোকটিকে একপলক দেখেই বললেন, আর কিছু করার নেই। আর কয়েক মিনিট, বড় জোর ঘণ্টা খানেক।

সুপ্রভা চোখের জল ফেলতে শুরু করেছেন। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের তিনি সরিয়ে দিয়েছেন সেখান থেকে। ছেলেমেয়েদের অকল্যাণের আশঙ্কাতেই তার বুক। কাঁপছে। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার কাছে ওর অন্ন পাওয়া ছিল, তাই মরার আগে এখানে না এসে পারেনি। হিমানীরও চোখে জল।

মৃত্যুর ঠিক আগে স্ত্রীলোকটির চৈতন্য ফিরে এল। সে জড়ানো গলায় বলল, ওগো, আমাকে বাড়িতে দিয়ে এসো। তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাকে বাড়িতে রেখে এসো।

চিররঞ্জন মুখ ঝুঁকিয়ে বললেন, ও মেয়ে, এখন ভগবানের নাম করো। বলো, কালী-তারা-ব্রহ্মময়ী–

স্ত্রীলোকটি বললেন, বাবু, আমরা মোছলমান। ওসব তো জানি না।

মোছলমান শুনে প্রিয়রঞ্জন একেবারে আঁতকে উঠলেন। লিগ মিনিস্ট্রির আমলে হিন্দুর বাড়িতে মুসলমান মড়া–এতে আবার কোন বিপদ হবে কে জানে। তিনি বললেন, কী। সর্বনাশ, কী সর্বনাশ! মোছলমান তো আমার বাড়িতে কেন? নাজিমুদ্দি-সুরাবর্দির বাড়িতে যেতে পারলে না? তারা কত বড়লোক–

চিররঞ্জন বললেন, দাদা, ওকে একটু শান্তিতে মরতে দাও!

তারপর স্ত্রীলোকটির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, এই সময় তোমাদের মুখে গঙ্গাজল দেবার নিয়ম আছে কিনা জানি না। তুমি তোমাদের ভগবানের নাম করো। বলো, হে আল্লা, হে খোদা, আমাকে তোমার পায়ে স্থান দাও।

স্ত্রীলোকটি বলল, নিয়াম, নিয়ামৎ রে—

ঠিক সেই সময় রাস্তা দিয়ে বিরাট শব্দে কয়েকটি মিলিটারি গাড়ি যাওয়ায় সবাই চমকে সেই দিকে চোখ ফেরায়। তাই মৃত্যুর মুহূর্তটি কারোকে দেখতে হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *