এখন কৃষ্ণপক্ষ, কোনও কারণে আজ রাস্তার গ্যাসের বাতিও জ্বলেনি, সমস্ত নগরী অন্ধকার। ছোট বারান্দাটিতে দড়িয়ে আছে ভরত, অন্যমনস্কভাবে একটা চুরুট ফুঁকছে। এই অন্ধকারের মধ্যেও পথ দিয়ে চলাচল করছে কিছু মানুষ, তাদের দেখাচ্ছে প্রেতলোকের ছায়ামূর্তির মতন। রাস্তার দু পাশে খোলা নর্দমা, পা পিছলে যে-কেউ পড়ে যেতে পারে, একজন কেউ পড়ে গেলে অন্যরা হাসে, হাসতে হাসতে পতিত ব্যক্তিটিকে টেনেও তোলে। মধ্যে মধ্যে ঝমাঝম শব্দ করে ছুটে যাচ্ছে ফিটন গাড়ি, কোচোয়ান চিৎকার করছে, সামালকে, সামালকে, হঠ যাও, হঠ যাও!
ভরত পথের দিকে তাকিয়ে আছে, অথচ কিছুই দেখছে না। কোনও শব্দও কানে যাচ্ছে না। তার। কদিন ধরে গরম পড়েছে খুব, ভরতের ধুতি-পরা খালি গা, পিঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। খানিক আগে দ্বারিকা এসেছিল, তার নৈশ অভিযানে ভরতকে সঙ্গী হবার জন্য ঝুলো বুলি করেছিল অনেকক্ষণ, ভরত রাজি হয়নি। সামনে পরীক্ষা, ভরত এখন সন্ধের পর বাইরে যেতে চায় না, তাকে ভাল রেজাল্ট করতেই হবে। দ্বারিকা প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হয়েছে, সে হয়তো আর পরীক্ষাই দেবে না। দ্বারিকা অনেকরকমে প্রলোভন দেখিয়েছিল, এমন কথাও বলেছিল যে বসন্তমঞ্জরী ভরতকে দেখতে চেয়েছে, সে ভরতের জন্য ব্যাকুল! ভরত যায়নি, কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠাতেও আর মন বসাতে পারছে না।
মানিকতলা বাজারের কাছে একটি বেশ বড় দোতালা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে দ্বারিকা, হস্টেল থেকে দুজন বন্ধুকে আশ্রয় সেখানে, ইরফান সে বাড়ির ম্যানেজার। শুধু বিলাসিতাতেই অর্থব্যয় করছে না দ্বারিকা, সাহায্য করছে অনেককে, দিলদরিয়া মেজাজের জন্য তাকে বেশ ভালই লাগে ভরতের, অথচ দ্বারিকার সংসর্গ সে এড়িয়ে থাকতেও চায়। ভরত নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছে, সে কিছুতেই মদ্যপানে আসক্ত হবে না। দ্বারিকা প্রায়ই বন্ধুদের বড় বড় হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে যায়, ভরত সংকোচবোধ করে, বারবার অন্যের পয়সায় অতি সুখাদ্যও তার মুখে রোচে না। সে গরিব, সবসময় সে মনে রাখে। যে এসব হচ্ছে গরিবের পক্ষে ঘোড়া রোগ। দ্বারিকা তার মানিকতলার বাড়িতেও ভরতকে টেনে নিতে চেয়েছিল, সেখানে কয়েকটি ঘর খালি পড়ে আছে, ভরত কেন শুধু শুধু ভাড়া দিয়ে এই ছোট্ট জায়গায় থাকবে? কিন্তু ভরতের সূক্ষ্ম আত্মসম্মানবোধ আছে, শশিভূষণের দেওয়া মাসোহারাতেই সে কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে দেয়, অনেক লোকজনের সঙ্গে থাকার চেয়ে এই নিরালা ছোট ঘরটিই তার পছন্দ।
বসন্তমঞ্জরী নামী সেই রমণীটির কক্ষে ভরত আর একবারও যায়নি। কিন্তু তাকে সে ভুলতেও পারে না কিছুতেই। প্রথম দেখা সেই দৃশ্য, ঘরখানি আলোকোজ্জ্বল, মস্ত বড় একটা পালঙ্কে শুয়ে আছে এক যুবতী, ঘুমন্ত, সারা শরীরে প্রচুর অলঙ্কার, জরির চুমকি বসানো মূল্যবান শাড়ি পরা, দু গালে লাল রঙ। এমন সাজে কেউ ঘুমোয় না। দ্বারিকা গান গেয়ে তার ঘুম ভাঙাল, ঠিক যেন রূপকথার মতন। চোখ মেলে সেই মেয়েটি বলল, ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে আমি কত জায়গায় যাই, কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, সেইজন্যই আমি সেজে থাকি! এরকম কথা ভরত কখনও শোনেনি। ঘুমের মধ্যে ভ্ৰমণ, মানুষ যে-দিন যে-পোশাক পরে শুতে যায়, স্বপ্নে সেই পোশাকই দেখা যায় নাকি? ভরতের কোনও স্বপ্নই মনে থাকে না।
বসন্তমঞ্জরী কুপল্লীতে থাকে, সে নষ্ট মেয়ে, তবু সে অমন সুন্দর কথা বলে কী করে? তার মুখখানিও কলঙ্কিনীর মতন নয়, চতুর নয়, সারল্য মাখানো, এমন মেয়ে বিপথে আসে কিভাবে? দ্বারিকা যেই বহু টাকা পয়সার মালিক হল, অমনই সে একটি মেয়ের সন্ধান পেয়ে গেল হঠাৎ? ভরত ওখানে আর কোনওদিন যাবে না, বসন্তমঞ্জরীকে সে আর দেখতেও চায় না। তবু অল্পক্ষণের জন্য দেখা সেই মেয়েটির মুখ বারবার ফিরে ফিরে আসে চোখের সামনে। ভরত ওর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি, কিন্তু তার সর্বাঙ্গে শিহরন হয়েছিল, তার দুই কানের লতিতে যেন অগ্নি-বিন্দুর ছ্যাঁকা লেগেছিল, হঠাৎ যেন তার শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল উষ্ণতার স্রোত। ভরতের জীবনে এ এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। সে কোনও মতেই ওই যুবতীর প্রতি একটুও আকৃষ্ট হয়নি, দ্বারিকা অমন একটা জায়গায় তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সে বিরাগবোধ করছিল, অথচ শরীরে অমন ছটফটানির ভাব এল কেন? ভরতের কাছে এটা যেন একটা ধাঁধা।
মেয়েটি বলেছিল, সে ভরতকে আগে দেখেছে, অন্তত স্বপ্নে দেখেছে। এটা নিশ্চয়ই নিছক কথার কথা। ওরা সবাইকেই এমন বলে। কিন্তু কথাটা শোনামাত্র ভরত কেঁপে উঠেছিল। তার মনে হয়েছিল, ভূমিসূতার সঙ্গে ওই বসন্তমঞ্জরীর মুখের আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে, কণ্ঠস্বরও যেন একরকম! ভূমিসূতাকে অমন জমকালো সাজপোশাকে কখনও দেখেনি ভরত, সে অনাথা, তার ওসব কিছুই নেই, তবু আবরণ-আভরণের অন্তরালের যে মানুষ, তাকে চিনতে পারা যায়, সেইখানে ওদের মিল। বসন্তমঞ্জরী তীব্রভাবে মনে পড়িয়ে দিয়েছিল ভূমিসূতার কথা। তারপর থেকে অনবরত এক একবার বসন্তমঞ্জরীর মুখটা মনে আসছে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে ভূমিসূতায়।
বসন্তমঞ্জরীর কাছে ভরত ইচ্ছে করলেই আবার যেতে পারে, কিন্তু সে যাবে না। আর শত ইচ্ছে থাকলেও ভূমিসূতার কাছ তার যাবার উপায় নেই।
অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভরত অস্ফুটভাবে বললঃ
You did wish that I would make her turn:
Sir, She can turn, and turn, and yet go on.
And tum again; and She can weep, sir weep…
দিন দিন ভরতের ধারণা হচ্ছে, মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্যের নজরে পড়লে ভূমিসূতা আর কিছুতেই মুক্তি পাবে না। মহারাজ তাকে গ্রাস করবেন। বিশেষ কেউ না জানলেও ওই মহারাজ বীরচন্দ্র তার পিতা তো বটেই, তাঁর রক্ত আছে ভরতের শরীরে। সেই পিতাই ভরতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তিনি কেড়ে নেবেন ভূমিসূতাকে। তিনি ঈৰ্ষাপরায়ণ, মনোমোহিনীর প্রতি কখনও লালসার দৃষ্টিতে তাকায়নি। ভরত, কখনও তাকে স্পর্শ করেনি, মনোমোহিনীকে শুধু একদিন জানলায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছিলেন মহারাজ, সেই অপরাধেই তিনি ভরতের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। হ্যাঁ, ভরত পরে অনেক ভেবে দেখেছে, মহারাজের সম্মতি ছাড়া কি আর কেউ তাকে জঙ্গলের মধ্যে পুঁতে রাখতে পারত? মহারাজ তো ভরতের অস্তিত্বের কথা জানতেন, ভরত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, তবু তিনি একবারও তার খোঁজ করলেন না?
ভরত আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদ নেই, দু একটি নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে। রাত্তিরবেলা ভরত আর আকাশ দেখতে চায় না। তাকালেই তার সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিগুলির কথা মনে পড়ে। গলা পর্যন্ত মাটিতে গাথা, আহত, ক্ষুধার্ত, শেষের দিকে তার মাথার গোলমাল হয়ে আসছিল, কিছুই মনে রাখতে পারছিল না, কারা শেষ পর্যন্ত তাকে উদ্ধার করে গঞ্জে পৌঁছে দিয়ে গেল, তা সে আজও মনে করতে পারে না। তার বেঁচে থাকাটা এখনও অলৌকিক মনে হয়।
সেই রাতের মতন, ভরত মাথা নাড়তে নাড়তে বলতে লাগল, পাখি সব করে রব, পাখি সব, পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল…।
কই, ভরতের জীবনের রাত্রির যে অবসান হচ্ছে না কিছুতেই। সে তার জন্ম কিংবা পিতৃপরিচয় মুছে ফেলতে চায়, কিন্তু মহারাজের সঙ্গে তার নিয়তি যেন বাঁধা। ভবানীপুরের বাড়ি ছেড়ে ভূমিসূতাকে মহারাজের প্রাসাদে যেতে হল কেন? ভরতের ধারণা, মহারাজ ঠিকই টের পেয়ে যাবেন তার বেঁচে থাকার কথা, এবার আর তিনি এই অপ্রিয় পুত্রটিকে নিষ্কৃতি দেবেন না। ভরত লেখাপড়া শিখে একজন স্বতন্ত্ৰ মানুষ হতে চেয়েছিল। কিন্তু ভূমিসূতা তাকে তার পিতার সঙ্গে জড়িয়ে দিল!
রান্নাঘরের দিকে ধুপ করে একটা শব্দ হতেই ভরত পেছন ফিরে তাকাল। নিশ্চয়ই পাশের বাড়ি থেকে পুরুতঠাকুরটি এসেছে।
বাণীবিনোদ বলল, কী হে ভাইটি, সব অন্ধকার করে রেখেছি কেন, লণ্ঠন জ্বালনি?
চুরুট খাওয়ার সময় দেশলাইটি ভরতের হাতেই থাকে। বারান্দা থেকে এসে সে একটা মোমবাতি জ্বালল। বাণীবিনোদকে দেখে সে খুশিই হয়েছে। এর সঙ্গে কিছুক্ষণ এলেবেলে কথা বললেও মনের ভাব অনেকটা কেটে যেতে পারে।
সে বলল, বসুন দাদা, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।
বাণীবিনোদের হাতে একটি ছোট্ট মাটির হাঁড়ি। সে বলল, একটু পরে চ্যা খাব। ভাইটি, তোমার জন্য মিষ্টি এনেছি, খাও, খেয়ে দেখ, বড় সরেশ জিনিস।
হাড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বাণীবিনোদ একটি সন্দেশ বার করল। সাধারণ দোকানের সন্দেশের চেয়ে সেটি প্রায় চার গুণ বড়। ভরতের বিস্ময় দেখে বাণীবিনোদ হাসতে হাসতে বলল, হে হে হেঁ, বাপের জন্মে। এরকম সন্দেশ দেখেছি কখনও। এ হল রাজবাড়ির জিনিস। এস্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি।
ভরত জিজ্ঞেস করল, আজ বুঝি আবার জানবাজারে রানী রাসমণির বাড়িতে ভোজ ছিল?
বাণীবিনোদ ঠোঁট উল্টে বলল, না হে না। ওনাদের মুঠো আঁট হয়ে গেছে, এরকম বঢ়িহা মাল আর খাওয়ায় না। ওরা রাজাও নয়। এ একেবারে বড় দরের রাজ-বাজড়াদের ব্যাপার। মহারাজের চেহারাখানাও কি জবরদস্ত, ইয়া বড় গোঁফ!
– নতুন যমজান পেয়েছ বুঝি?
– তুমিই তো সন্ধান দিয়েছিলে! বাঃ, তোমার মনে নেই, তুমি বলেছিলে ত্রিপুরার রাজবাড়ির কথা? আমি তক্কে তক্কে ছিলুম! বাড়িতে রাধা-কৃষ্ণ যুগল দেবতা আছে। পুরুতও ওনারা নিয়ে এসেছিলেন ত্রিপুরা থেকে। খপর এসেছে, সেই পুরুতের ছেলের খুব অসুখ, সে ফিরে যেতে না যেতেই গেটের সামনে আমি হাজির!
ভরতের বুকের মধ্যে দুমদুম শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ যেন একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল। যে বাড়িতে বন্দিনী আছে ভূমিসূতা, সেখানে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে বাণীবিনোদ। এবার ভূমিসূতার সঙ্গে যোগাযোগ করা অসম্ভব নয়।
অতি কষ্টে উত্তেজনা দমন করে ভরত জিজ্ঞেস করল, এত সহজে আপনার কাজটা জুটে গেল?
বাণীবিনোদ বলল, কেন, আমার চেহারা দেখলে আমার সৎ ব্ৰাহ্মণ মনে হয় না? আমি কি মন্ত্র জানি না? পাশাপাশি লাইনে একশোটা পুরুতকে দাঁড় করাও তো। প্রথমে আমার দিকেই চোখ পড়বে। আমি আমার মায়ের মুখ পেয়েছি, বুঝলে, মাতৃমুখী ছেলে জীবনে উন্নতি করে। এইবার দেখ না কী হয়!
ভরত বলল, আগের পুরুতমশাই যে চলে যাবেন, তা আপনি টের পেলেন কী করে?
বাণীবিনোদ বলল, সেই পুরুতের সঙ্গে আমি আগেই ভাব জমিয়েছিলুম যে! হরনন্দন ভট্টাচার্যি, ডিগডিগে চেহারা, চোখে ছানি, দন্তের সে আর তালব্য শয়ে তফাত করতে পারে না। তা লোকটি ভাল মানুষ, গ্যাঁজা টানার অভ্যেস আছে।
ভরতের এখনও বুক কাঁপছে। হরনন্দন ভট্টচার্যের কথা তার মনে আছে, ওঁর সাত মেয়ের পর একটি ছেলে জন্মেছিল, রাজবাড়ির সবাই জানে, সেই ছেলের অসুখের সংবাদ পেয়ে উনি তো বিচলিত হবেনই। তাহলে বাণীবিনোদ একেবারে মন গড়া কথা বলছে না।
— দাদা, ঠাকুরঘর কি বাড়ির একেবারে ভেতরে?
— তা নয়তো কি হেঁজিপোঁজিদের মতন বাইরে হবে? এ হল গিয়ে রাজবাড়ি। ওনারা নতুন এসেছেন, এখনও তো মন্দির প্রতিষ্ঠে করেননি, অন্দরমহলে গৃহদেবতার পুজো হয়।
— রাজবাড়ির ভেতরটা কেমন দেখলেন?
— সে তুই বাপের জন্মে দেখিসনি। বারান্দায়, সিঁড়িতে সব জায়গায় লাল মখমল পাতা। মেঝেতে পা দিতেই হয় না। মেঝে অবশ্য শ্বেতপাথরের, ধুলোর ছিটেফোঁটাও নেই, তারপর ইয়া ইয়া সব ঝাড়লণ্ঠন।
– দাদা, আপনি প্রায়ই আমার বাপ তুলে কথা বলেন কেন?
— ওটা আমার কথার লবজ। আমি নিজেকেও মাঝে মাঝে বাপ তুলি। তুই গায়ের ছেলে, তোর বাপ যা দেখেছে শুনেছে, তুই তার থেকেও অনেক বেশি কিছু দেখবি, তোর ছেলেকে আর কেউ বাবা তুলবে না।
— ওটা তো ঠিক রাজবাড়ি নয়। সাহেববাড়ি ভাড়া নিয়েছেন, তাই না?
– তুই জানলি কী করে?
— ত্রিপুরার রাজা কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে এখানে আছেন, এ খবর কাগজে ছাপা হয়নি? অমৃতবাজার পত্রিকায় কত বড় করে লিখেছে। ঠাকুর ঘরখানি কেমন?
– তা মনে কর, তোর এই ঘরখানার আট ডাবল। ধপধপে সাদা।
— আপনি একলাই পুজো করেন, না কেউ আপনাকে সাহায্য করে?
— দুটো মেয়েছেলে সবসময় আমার দুপাশে বসে থাকে। আমার কখন কী লাগবে, যা বলি, এক ছুট্টে এনে দেয়।
– তাঁরা বুঝি রানী?
— কী তোর বুদ্ধি! এই না হলে চাষা? রানী কেন ছুটোছুটি করে জিনিসপত্র আনবে? নাঃ, রানী ফানি কেউ আসে না। পুরুতঠাকুর চোখ বুজে ঘণ্টা নাড়ে বটে, কিন্তু সব খপরই তার কানে যায়। শুনেছি, মহারাজের অনেক গণ্ডা রাণী। কিন্তু তাঁর পাটরানী একটা কম বয়সের ছুঁড়ি। তাকে দেখিনি। যে দুজন মেয়েছেলে ঠাকুরঘরে থাকে, তাদের মধ্যে একজন বুড়ি আর একজনের বয়েস, এই ধর বছর ত্রিশ-বত্রিশ হবে, খাসা মুখখানি, সে রানী না হলেও মাসি-পিসি ধরনের কেউ হবে, আমার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে পেন্নাম করে।
ভরত অনেকখানি নিরাশ হয়ে গেল। ভূমিসূতা ঠাকুরঘরে আসে না? ভবানীপুরের বাড়িতে সেই-ই তো পুজোর সব ব্যবস্থা করত, ফুল তোলার দায়িত্বও ছিল তার। এখন সে ও বাড়িতে কী কাজ করে?
বাণীবিনোদ বলে চলল, তবে একটা কী জানো তো ভাইটি, ওই রাজপরিবারে পুরুতঠাকুরের মাইনে দেবার নিয়ম নেই। আমার যে একটা কিছু বাধা রোজগার হবে, তা নয়। এই চাল-কলা, সন্দেশ, গামছা, দুটো-একটা টাকা প্ৰণামীএই সব জোটে, তাও মন্দ নয়।
ভরতের আর ওসব শোনবার উৎসাহ নেই। সে বাণীবিনোদের দিকে চেয়ে রইল। ভূমিসূতার সঙ্গে দেখা না হলেও বাণীবিনোদ ভূমিসূতার খুব কাছাকাছি যায়, হয়ত বাণীবিনোদ যখন সিঁড়ি দিয়ে ওঠে তখন ভূমিসূতা দাঁড়িয়ে থাকে দরজার আড়ালে, এই নৈকট্যের জন্যই বাণীবিনোদ তার চেয়ে অনেক বেশি ভাগ্যবান।
প্রথমদিনেই বেশি কৌতূহল দেখান ঠিক নয় ভেবে ভরত আর কোনও প্রশ্ন করল না। ভূমিসূতার সঙ্গে বাণীবিনোদের একদিন না একদিন দেখা হবেই।
পরদিন কলেজে যাদুগোপাল একটা প্রস্তাব দিল ভরতকে। আর কয়েকদিন পরই ক্লাস শেষ হয়ে যাবে, তারপর পরীক্ষার প্রস্তুতি। যাদুগোপাল হস্টেল ছেড়ে দিচ্ছে। সে তার দিদির বাড়িতে থাকতে পারে বটে, কিন্তু সেখানে সব সময় হইচই হট্টমেলা চলে, পড়াশুনোর সুবিধে হবে না।
কৃষ্ণনগরে যাদুগোপালের মামাবাড়ি প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে। ওর একমাত্র মামা সরকারি কাজ নিয়ে এখন সপরিবারে নৈনিতালে থাকেন, কৃষ্ণনগরে এক বুড়ি দিদিমা ছাড়া আর কেউ নেই। সেখানে নিরিবিলিতে মন দিয়ে লেখাপড়া করা যাবে। ভরতকেও সে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। একজন সহপাঠী থাকলে পরস্পরের সাহায্যও হয়।
ভরত সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটি লুফে নিল। সে কলকাতা শহরের বাইরে বাংলার আর কিছুই দেখেনি। কৃষ্ণনগরের বিদ্যাচর্চার খ্যাতি আছে। অনেক কৃতী মানুষ কৃষ্ণনগরে জন্মেছেন। যাদুগোপালের সংসৰ্গও ভরতের খুব পছন্দ। যাদুগোপাল রসিক, নানারকম গান জানে, কিন্তু তার নিজস্ব নীতিবোধ আছে।
কিছু জামাকাপড় ও বইপত্র একটা পুঁটুলিতে বেঁধে দুদিন পরই সে যাদুগোপালের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। শিয়ালদা স্টেশনে এসে টিকিট কাটার আগে যাদুগোপাল বলল, কী রে, ভরত, তোর টিকিট কাটার পয়সা আছে তো? আমার সঙ্গে যাচ্ছিস বলে যে আমার ঘাড়ে চাপবি, তা চলবে না। যাতায়াতের খরচা যার যার নিজের। পান-তামাকের খরচ নিজের নিজের। আমার মামাবাড়িতে যাচ্ছিস বলে সে রোজ রোজ দুধ-ভাত আর মণ্ডা-মিঠাই পাবি, তেমন খাতির যত্ন আশা করিস না। আমার মামাবাড়ির অবস্থা খুব সাধারণ। তবে হ্যাঁ, ডাল-ভাত জুটবে, সেজন্য তোর পয়সা লাগবে না।
ভরত হাসতে হাসতে বলল, বাঁচিয়েছিস, বেশি খাতির-যত্ন পাওয়া আমার অভ্যেস নেই। ডাল-ভাতই আমার অমৃত।
যাদুগোপাল বলল, রোজ ব্রাহ্ম মুহূর্তে বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে। ওই সময়ে অধ্যয়নে পূর্ণ মনঃসংযোগ হয়। তোকে কেউ রাই জাগো, রাই জাগো গান গেয়ে ঘুম ভাঙাবে না। সকালের আহার শুধু সিদ্ধ ছোলা আর এখোগুড়। বেশি খাওয়াদাওয়া করলে মেধায় ভাটা পড়ে। আমাদের মুনি-ঋষিরা ওই জন্য স্বল্পাহারী ছিলেন।
ভরত বলল, শুনেছি রামমোহন রায় নাকি গোটা একটা পাঠার মাংস খেতে পারতেন? আর বঙ্কিমবাবুও।
যাদুগোপাল ধমক দিয়ে বলল, উদাহরণ টানবি না! যে-কোনও প্রসঙ্গে ঝাঁট করে মহাপুরুষদের নাম টেনে আনতে নেই। ওঁরা ব্যতিক্রম। ওঁর নমস্যা। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের আহার-সংযম দরকার। দৈনিক আঠেরো ঘণ্টা পড়াশুনো আর ছ। ঘণ্টা ঘুম, এর মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার মতন বাজে ব্যাপারে সময় ব্যয় করা অর্থহীন। একদিন অন্তর একদিন উপবাস করলেই ভাল হয়। ওখানে রেঁধে দেওয়ারও তো কেউ নেই, আমার দিদিমার বয়েস একাশি, তিনি তো আর রোজ রোজ আমাদের ভাত-ডাল রেঁধে দিতে পারবেন না। তুই তো রাঁধতে জানিস, তুই চাল-ডাল ফুটিয়ে নিবি!