1 of 2

৫০. নীলগঞ্জ জামে মসজিদ

হাজি মতলুব মিয়ার নির্মাণ নীলগঞ্জ জামে মসজিদ এই এলাকার সবচে সুদৃশ্য পাকা দালান। হাজি মতলুব মিয়া জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ধর্মকর্মে মন দেন। তিনি ঘোষণা করেন, আসল ইবাদত হলো হাকুল ইবাদত। জনতার জন্যে কিছু করা। তিনি তখন তকুল ইবাদতের অংশ হিসাবে মসজিদ বানানো শুরু করেন। এই সময় তার বয়স সত্তরের কাছাকাছি। নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত। মসজিদ তৈরি যেদিন শুরু করেন, সেদিন তিনি একটা স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে অলি ধরনের এক মানুষ, যার পরনে সাদা লম্বা কুর্ত, মাথায় পাগড়ি, হাতে বাঁকা লাঠি, তাকে দেখা দেন। সেই সুফি মানুষ হাতের বাঁকা লাঠি দিয়ে তাকে বুকে খোচা দিয়ে বলেন–মতলুব মিয়া, তোমার আয়ু শেষ হয়ে গিয়েছিল। তুমি একটি সৎকর্মে হাত দিয়েছ, এই সৎকর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার মৃত্যু হবে না। সৎকর্ম সুন্দরভাবে সমাধা করো। এই বলেই সুফি পুরুষ অদৃশ্য হয়ে যান। ঘুম ভেঙে মতলুব মিয়া দেখেন এই সুফি পুরুষ তার বুকের যে জায়গায় বঁকা লাঠি দিয়ে খোচা দিয়েছেন সেই জায়গা কালো হয়ে আছে।

তিনি বিপুল উৎসাহে মসজিদ বানানো শুরু করেন। কাজ দ্রুত সমাধা করার প্রয়োজন নাই। ধীরে-সুস্থে হবে। ভালোমতো হবে! যেভাবেই হোক কাজটা লম্বা করতে হবে। মেঝেতে প্ৰথমে সমেন্ট করা হলো। সেই সিমেন্ট উঠিয়ে মোজাইক করা হলো। মিনার একটা করার কথা ছিল। তিনি চার মিনারের সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে সময় বেশি লাগবে। যত ইচ্ছা সময় লাগুক। মসজিদ নির্মাণ পুরোপুরি শেষ করা যাবে না। একটা দরজা কিংবা একটা জানোলা বাকি থাকবে। এই ছিল তার পরিকল্পনা। শরিকল্পনা কার্যকর হলো না। এক মিনার তৈরি হবার পরপরই তার মৃত্যু হলো। মসজিদের শুরু হলো তার জানাজা পাঠের মাধ্যমে।

হাজি মতলুব মিয়ার মসজিদের বর্তমান নাম এক মিনারি মসজিদ। ঈদের দিন দূরদূরান্ত থেকে এই মসজিদে লোকজন নামাজ পড়তে আসে। জুম্মাবারেও মুসল্লিদের ভালো সমাগম হয়।

নীলগঞ্জে মিলিটারি আস্তানা গাড়ার পর জুম্মাবারে লোক সমাগম আরো বেড়েছে। মসজিদের বাইরেও চাটাই বিছাতে হয়। জুম্মাবারে মিলিটারি ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ বাসেত দুএকজনকে সঙ্গে নিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। নামাজের শেষে তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার জন্যে এক ধরনের ব্যস্ততা সমাগত মুসল্লিদের মধ্যে দেখা যায়। ঘটনাটা বিস্ময়কর হলেও সত্যি। দুএকজন কোলাকুলিও করেন।

জুম্মার নামাজ মাওলানা ইরতাজউদ্দিন পড়ান। সেদিন তাঁর পরনে থাকে ইন্ত্রি করা আচকান, ধবধবে সাদা পাগড়ি। জুম্মাবারে তিনি চোখে সুরমা দেন। কানের লতিতে আন্তর। নবি-এ-করিমের সুগন্ধী পছন্দ ছিল। সুগন্ধ ব্যবহার করা সেই কারণেই প্রতিটি মুসলমানের জন্যে সুন্নত।

নামাজ একটার সময় শুরু হয়, তবে মাঝে-মাঝে একটা বাজার পরেও অপেক্ষা করা হয়। ক্যাপ্টেন সাহেবের জন্যে অপেক্ষা। মসজিদের মুয়াজ্জিন মুনশি ফজলুল হক ক্যাপ্টেন সাহেবের অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন। এখান থেকে থানা কম্পাউন্ড পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। ক্যাপ্টেন সাহেব থানা কম্পাউন্ড থেকে ঢোলা কুর্ত পরে যখন বের হন, তখন মুনশি ফজলুল হকের ভেতর অন্যরকম উত্তেজনা দেখা যায়।

ইরতাজউদ্দিন জুম্মাবারে মসজিদে বারোটার মধ্যে এসে পড়েন। তখন মুয়াজ্জিনও আসে না। মসজিদ থাকে খালি। এক একজন করে মুসল্লি আসে, তাদের আসা দেখতে তার ভালো লাগে। কাউকে দেখে মনে হয় তার অসম্ভব তাড়া। বসে থাকতে পারছে না, সারাক্ষণ ছটফট করছে। আঙুল ফোটাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ আসে নিতান্তই অনাগ্রহে। তাদের চোখেমুখে থাকে কী বিপদে পড়লাম? দূর দূরান্ত থেকে কিছু আগ্রহী লোকজনও আসে। এরা হাদিস-কোরান শুনতে চায়। এরা অনেক আগে চলে আসে। তাদের সঙ্গে হাদিসা-কেরান নিয়ে কথা বলতে ইরােতাজউদ্দিন পছন্দ করেন। ধর্মের কত জটিল বিষয় আছে। কত সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি আছে। এইসব নিয়ে আলাপ করতেও उठाনা व्लांकों!

এখন সময় অন্যরকম। এই সময়ের নাম সংগ্রামের সময়। এই সময়ে মানুষজন কোনো বাধাধরা নিয়মে চলে না। জুম্মাবারে মুসল্লিরা প্ৰবল আতঙ্ক নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন এবং কেউ কিছু শুনতে চান না।

ইরতাজউদ্দিন মাথা নিচু করে ইমামের জায়নামাজে বসে আছেন। তাঁর হাতে তসবি। তসবির নিরানব্বইটা দানা তিনি এক এক করে টানছেন এবং একেক দানায় আল্লাহপাকের একেকটি নাম স্মরণ করছেন।

ইয়া রাহমানু : হে দয়াময়।

ইয়া সাদেকু : হে সত্যবাদী।

ইয়া কুদ্দুসু : হে পবিত্র।

ইয়া মুমীতু : হে মৃত্যুদাতা।

ইরতাজউদ্দিন ইয়া মুমীতু বলে থেমে গেলেন। আল্লাহপাকের পরের নামগুলি এখন আর তাঁর মনে পড়ছে না। ঘুরেফিরে মাথায় আসছে ইয়া মুমীতু ইয়া মুমীতু।

মসজিদের বাইরে উঠানের দক্ষিণ পাশে কদমগাছের ছায়ায় চারজন হিন্দু বসে আছে। তাদের একজন মিষ্টির দোকানের মালিক পরেশ, ধুতি পরে আছে। চরম দুঃসময়ে সে ধুতি পরার সাহস দেখিয়েছে। কারণ আজ জুম্মা নামাজের পর তারা মুসলমান হবে। মুসলমান হবার পর লুঙি-পাঞ্জাবি পরবে। কাজেই শেষবারের মতো ধুতি পরা যায়। চারজন হিন্দুর মধ্যে দুজন নমশূদ্র। নমশূদ্ররা সাহসী হয়–এমন কথা চালু থাকলেও এরা ভয়ে কুঁকড়ে আছে।

হিন্দু মুসলমান হচ্ছে–এই দৃশ্য দেখার জন্যে ক্যাপ্টেন সাহেব আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই চার হিন্দুর জন্যে মুসলমান নাম তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন।

আবদুর রহমান।

আবদুর কাদের।

আবদুর হক।

আবদুর সালেহ।

ক্যাপ্টেন সাহেবের ইচ্ছা ছিল চারজনকেই একটা করে কোরান শরীফ দেবেন। নীলগঞ্জের একমাত্র লাইব্রেরিতে কোনো কোরান শরীফ পাওয়া যায় নি। ক্যাপ্টেন সাহেব এতে বিরক্ত হয়েছেন।

যে চারজনকে আজ মুসলমান করা হবে তাদের যেন নিয়মমাফিক খৎনা করানো হয়–সেই বিষয়েও ক্যাপ্টেন সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন। হাজামকে খবর দেয়া হয়েছে। সে ধারালো বাঁশের চল্টা দিয়ে খৎনা করবে। ক্যাপ্টেন সাহেবের ধারণা এই দৃশ্যও উপভোগ্য হবে। তার নিজের ক্যামেরা ছিল না। এই মজার দৃশ্য ক্যামেরায় তুলে রাখার জন্যে তিনি ক্যামেরার ব্যবস্থাও করেছেন।

পৌনে একটায় জুম্মার নামাজের আযান দেয়া হলো। আযানের পরপরই ইরতাজউদ্দিন মসজিদ থেকে বের হয়ে কদমগাছের কাছে গেলেন। গাছের নিচের চারজনই নড়েচড়ে বসল। এদের একজন শুধু তার চোখে চোখ রাখল। অন্যরা মাটির দিকেই তাকিয়ে রইল।

ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনারা ভালো আছেন?

তিনজন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। একজন অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনারাই শুধু মুসলমান হবেন? আপনাদের রবারের কেউ হবে না?

পরেশ বলল, সবেই হবে। প্রথমে আমরা, তারপর পরিবার।

ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনাদের ধর্ম কী বলে আমি জানি না। আমাদের ধর্ম বলে জীবন বাঁচানো ফরজ। মুসলমান হলে যদি জীবন রক্ষা হয়, তাহলে মুসলমান হন। জীবন রক্ষা করেন।

মুকুল সাহা ধুতির এক প্রান্ত দিয়ে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। ইরতাজউদ্দিন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, পবিত্র কোরান মজিদে একটা বিখ্যাত আয়াত আছে— লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দ্বিনি। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। ইসলাম অন্য ধর্মের উপর জবরদস্তি করে না।

ইরতাজউদিনের আরো কিছু বলার ইচ্ছা ছিল, এর মধ্যেই মুয়াজ্জিন মুনশি ফজলুল হক তার কাছে ছুটে এসে বলল, ক্যাপ্টেন সাহেব থানা কম্পাউন্ড থেকে বের হয়েছেন। আজ তাঁর সঙ্গে ছয়জন আছেন। ক্যাপ্টেন সাহেবকে নিয়ে সাতজন।

ইরতাজউদ্দিন বললেন, জুম্মার নামাজ আমি পড়াব না। এখন থেকে আপনি পড়াবেন।

এইটা কী বলেন!

ইরতাজউদ্দিন বললেন, কেন জুম্মার নামাজ পড়াব না। সেই ব্যাখ্যা আজ নামাজ শুরুর আগে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দিব না। আমি এখন চলে যাব।

জুম্মার নামাজও পড়বেন না?

না!

এইসব কী বলতেছেন!

যা বলতেছি চিন্তাভাবনা করে বলতেছি। এখন থেকে আমি জুম্মার নামাজ পড়ব না। পরাধীন দেশে জুম্মার নামাজ হয় না। নবি-এ-করিম যতদিন মক্কায় ছিলেন জুম্মার নামাজ পড়েন নাই। তিনি মদীনায় হিজরত করার পর একতা সূরা নাজেল হয়। সূরার নাম জুমুয়া। সেই সূরায় জুম্মার নামাজের নির্দেশ দেয়া হয়। তখন তিনি জুম্মার নামাজ শুরু করেন।

মাথা খারাপের মতো কথা বলবেন না। ক্যাপ্টেন সাহেব চলে এসেছেন।

আসুক। আমি চলে যাচ্ছি।

 

মাওলানা ইরতাজউদ্দিন বাড়িতে ফিরে জোহরের নামাজ আদায় করলেন। নামাজের শেষে মোনাজাতের সময় তিনি বললেন, হে গাফুরুর রহিম। আমি যদি ভুল করে থাকি আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই। আমার বুদ্ধি এবং জ্ঞান দুই-ই অল্প। আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা আমার অল্প বুদ্ধি এবং অল্প জ্ঞানের ফসল। এতে যদি ক্রটি হয়ে থাকে, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার ক্ষমার সাগরে হাত পাতলাম।

ক্ষমা চাইবার সময় তার চোখে পানি চলে এলো। তিনি অনেকক্ষণ কাদলেন। নামাজের সময় তার চোখে পানি আসে না। অনেকদিন পর চোখে পানি এলো। তিনি মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজে বসে রইলেন। গায়ের পোশাক বদলালেন না। কারণ তিনি জানেন ক্যাপ্টেন সাহেব তাকে ডেকে পাঠাবেন। জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তিনি ক্যাপ্টেন সাহেবকে যা যা বলবেন তা মোটামুটি ঠিক করা আছে। এইসব কথা ক্যাপ্টেন সাহেবের পছন্দ হবে না। যদি পছন্দ না হয় তাহলে নদীর পাড়ে তাকেও যেতে হতে পারে।

মৃত্যু নিয়ে তিনি ভীত না। কে কখন কীভাবে মারা যাবে তা আল্লাহপাক নির্ধারিত করে রেখেছেন। লাওহে মাহফুজে এইসব দলিল রাখা আছে। যে মৃত্যু আল্লাহপাক কর্তৃক নির্ধারিত— সেই মৃত্যুকে ভয় পাবার কিছুই নেই।

ওসি সাহেবের স্ত্রী কমলা এসে কয়েকবার ঘুরে গেছে। ইরতাজউদ্দিন জয়নামাজে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন বলে কিছু বলতে সাহস পায় নি। এইবার সে সাহস করে বলল, চাচাজি, কী হয়েছে?

তিনি বললেন, মনটা সামান্য অস্থির হয়ে আছে। আর কিছু না।

ভাত খাবেন না চাচাজি?

না, এখন খাব না। মা, আমি এখন কী বলব। মন দিয়ে শোন। যদি আমার ভালোমন্দ কিছু হয় তুমি হেডমাস্টার সাহেবের কাছে চলে যাবে। উনি অতি শুদ্ধ মানুষ। উনি যা করার অবশ্যই করবেন। কমলা ভীত গলায় বলল, এইসব কথা কেন বলতেছেন?

ইরতাজউদ্দিন বললেন, আমার মন অস্থির হয়ে আছে বলেই বলতেছি। অস্থির মানুষ অনেক কথা বলে।

চাচাজি, এক কাপ চা কি বানায়ে দেব?

না গো মা, কিছুই খাব না। তবে এক গ্রাস পানি খাব। এই পৃথিবীর যাবতীয় খাদ্যের মধ্যে পানি হলো শ্ৰেষ্ঠ খাদ্য এবং আল্লাহপাকের দেয়া অতি পবিত্র নেয়ামত। যতবার পানির গ্লাসে চুমুক দিবে ততবারই মনে মনে আল্লাহপাকের শুকুর গুজার করবা, তোমার প্রতি এই আমার একমাত্র উপদেশ। আছরাওয়াক্তের আগে আগে ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ বাসেত ইরতাজউদ্দিনকে ডেকে পাঠালেন। তাকে থানা কম্পাউন্ডে নিয়ে যাবার জন্যে থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি দুজন কনষ্টেবল নিয়ে এসেছেন। ওসি সাহেব একবারও ইরতাজউদিনের দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে যে-কোনো কারণেই হোক এই মানুষটির দিকে চোখ তুলে তাকানোর মতো অবস্থা তার না।

ইরতাজউদ্দিন থানার দিকে রওনা হবার আগে অজু করলেন। কমলার ছেলেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। নবি-এ-করিম শিশুদের পছন্দ করতেন। তাদের বলতেন, বেহেশতের ফুল। শিশুদের প্রতি স্নেহ ও মমতা দেখানো সুন্নত। সেই মমতা ইরতাজউদ্দিন কেন জানি দেখাতে পারেন না। শাহেদের মেয়ে রুনি ছাড়া কোনো শিশুই তাকে আকর্ষণ করে না। এটা অবশ্যই তাঁর চরিত্রের বড় একটা দুর্বলতা। তবে কমলার এই ছেলেটার প্রতি তাঁর মায়া পড়ে, গেছে। এই ছেলেকে কোলে নিলেই সে খপ করে তার দাড়ি ধরে ফেলে। তার হাত ছুটানো তখন সমস্যা হয়ে যায়। হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে কাঁদতে শুরু করে।

 

ক্যাপ্টেন বাসেতের সামনে কফির কাপ। চিনি-দুধাবিহীন কালো কফি। তিনি একেকবার কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন, কড়া কফির তিক্ত স্বাদে মুখ বিকৃত করছেন। ইরতাজউদ্দিন তার সামনে চেয়ারে বসে আছেন। তাকেও কফি দেয়া হয়েছে। তিনি কফিতে চুমুক দেন নি।

ক্যাপ্টেন বাসেত সিগারেট ধরালেন। লম্বা করে ধোঁয়া ছেড়ে হাত ইশারা করলেন। ঘরে দুজন সিপাই এবং একজন হাবিলদার মেজর ছিল, তারা ঘর ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়াল। তাদের দৃষ্টি ঘরের ভেতর। ক্যাপ্টেন বাসেত খানিকটা বুকে এসে বললেন, আমি খবর পেয়েছি আপনি জুম্মার নামাজ পড়াবেন না, কারণ আমি জুম্মার নামাজ পড়তে যাই। আমার মতো খারাপ মানুষকে পেছনে নিয়ে নামাজ হয় না–এই জাতীয় বক্তৃতাও না-কি দিয়েছেন।

ইরতাজউদ্দিন শান্ত গলায় ব্যাখ্যা করলেন কেন তিনি জুম্মার নামাজ পড়াচ্ছেন না। ব্যাখ্যা শুনে ক্যাপ্টেন বাসেতের মুখ কঠিন হয়ে গেল।

আপনি বলতে চাচ্ছেন পরাধীন দেশে জুম্মার নামাজের প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ আপনি বলতে চাচ্ছেন পূর্বপাকিস্তান পরাধীন?

জি জনাব।

আপনি কি বুঝতে পারছেন। আপনি কী বলছেন?

বুঝতে পারছি।

আপনার এই কথার জন্যে আপনাকে কী শাস্তি দেয়া হবে তা কি জানেন?

জি-না জনাব।

দেশের যে শত্রু তার শাস্তি একটাই। আপনি মুক্তিদের একজন। আপনি মুক্তির হয়ে কাজ করছেন।

আমি যা করেছি নিজের বিচার ও বিবেকে কাজ করেছি।

আপনি চান না পাকিস্তান থাকুক? আপনি হিন্দুস্তানের পা-চাটা কুকুর হতে চান?

জনাব, আমি নিজেকে খাঁটি মুসলমান মনে করি। একজন খাঁটি মুসলমানের দায়িত্ব জালিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।

ক্যাপ্টেন বাসেত হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে নতুন সিগারেট ধরালেন। কঠিন গলায় বললেন, মাওলানা সাহেব, আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

ইরতাজউদ্দিন চুপ করে রইলেন। ক্যাপ্টেন বাসেত ঠাণ্ডা কফির কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে বললেন, খারাপ মাথা ঠিক করার কৌশল আমি জানি। এমনভাবে মাথা ঠিক করব যে বাকি জীবন আপনি তসবি টানবেন আর বলবেন, পাকিস্তান পাকিস্তান।

ইরতাজউদ্দিন ছোট্ট কবে নিঃশ্বাস ফেললেন।

মাওলানা, চুপ করে থাকবেন না, কথা বলেন।

ইরতাজউদ্দিন বললেন, জনাব, আমার যা বলার ছিল আমি বলে ফেলেছি।

আর কিছু বলার নাই?

জি-না।

আমি আপনাকে কী শাস্তি দেব জানেন? আপনাকে উলঙ্গ করে। সারা গ্রামে ঘুরানো হবে। আমি রসিকতা করছি না। আমি বিশ্বাসঘাতককে কঠিন শাস্তি দেই।

ইরতাজউদ্দিন বললেন, আল্লাহপাক যদি এই লজ্জা আমার কপালে লিখে থাকেন তাহলে এই লজ্জা আমাকে পেতে হবে। পবিত্র কোরান শরীফের সূরা বনি ইস্রায়িলে আল্লাহপাক বলেছেন–আমি সবার ভাগ্য সবার গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। আমার ভাগ্য আমার কপালে লেখা, একইভাবে আপনার ভাগ্যও আপনার কপালে লেখা।

আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি?

জনাব, ভয় দেখানোর মালিক আল্লাহপাক। আমি না।

ক্যাপ্টেন বাসেত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলে টোকা দিতেই সেপাই এবং সুবাদার মেজর ঘরে ঢুকল। ক্যাপ্টেন বাসেত বললেন, ওসিকে বলো এই গাদারকে নেংটা করে সারা গ্রামে ঘুরাতে। তোমরাও সঙ্গে থাকবে।

নীলগঞ্জের অতি শ্ৰদ্ধেয় অতি সম্মানিত মানুষ মাওলানা ইরতাজউদ্দিনকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় প্ৰদক্ষিণ করা হলো। তাঁকে প্রথম নিয়ে যাওয়া হলো নীলগঞ্জ স্কুলে। সেখান থেকে নীলগঞ্জ বাজারে। বাজারে ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটল। দরজির দোকানের এক দরজি একটা চাদর নিয়ে ছুটে এসে ইরতাজউদ্দিনকে ঢেকে দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকল। ঘটনা এতই দ্রুত ঘটল যে সঙ্গের মিলিটারিরা বাধা দেবার সময় পেল না।

ইরতাজউদ্দিন এবং দরজিকে মাগরেবের নামাজের পর সোহাগী নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করা হলো। মৃত্যুর আগে আগে ইরতাজউদ্দিন পরম নির্ভরতার সঙ্গে আল্লাহপাকের কাছে উঁচু গলায় শেষ প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহপাক, যে মানুষটা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাচাতে চেয়েছিল তুমি তার প্রতি দয়া করো। তুমি তার প্রতি তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।*

————–

*নেত্রকনা অঞ্চলের এই সত্য ঘটনাটির স্বাক্ষী যে দরজি সে গুলি খাওয়ার পরেও প্ৰাণে বেঁচে যায়। আমি তার কাছ থেকেই গল্পটি শুনি।–লেখক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *