কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়
মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে অপিয়াম খেয়ে মরে যেতে। অপিয়াম খেলে আকাশে ভাসব, মেঘের ভেতর খেলা করব—ওই খেলা করতে করতেই হঠাৎ কখন শরীরের কলকজা থেকে নাটবটু খুলে আকেজো হয়ে পড়ে থাকব—আমি নিজে তো বুঝবই না, কেউ এসে নাড়ি ধরলেই আঁতকে উঠবে।
ইদানীং আমার খুব মরতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় একবার ইলেকট্রিক সকেটে পেরেক ঢুকিয়ে পরখ করেছিলাম মৃত্যু দেখতে কেমন। সমুদ্র দেখলেই আমার খুব গভীরে গিয়ে সাঁতরে দেখতে ইচ্ছে করে ঢেউয়ের কামড় শরীরে কেমন লাগে। হাতের কাছে নতুন মার্সিডিজ বেঞ্জ পেলে চোখ কান বন্ধ করে এক্সিলেটরে চাপ দিতে ইচ্ছে করে।
আমি মরে গেলেও পৃথিবীতে ভোর হবে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে, সন্ধ্যা পার হয়ে রাত। আমি মরে গেলে আমার নিন্দুকেরা নিতম্বে তালি বাজিয়ে হাসবে। আমার শুভার্থীরা ক’দিন আর একলা দুপুরে ভাল না লাগায় ভুগবে? বেশিদিন নয়।
এই শহরে আমার কল্যাণকামী অনেকেই আছে, নিন্দুকও কম নয়। ওরা আমার পান থেকে চুন খসলেই হই রই করে তেড়ে আসে, ওরা আমার পদক্ষেপে জোর দেখলেই পায়ের তলার মাটি খুঁড়তে আসে। আমি কি কারও তিলাধ ক্ষতির কারণ? না, তা নয়। আসলে আমি যে কারও বাহু বেষ্টন করে ইটি না, মধ্যরাতে হঠাৎ দুঃস্বপ্নে কারও বুকের আড়ালে মুখ লুকোই না—এ কারও সয় না। সয় না বলে ঝুড়ি খুলে কালসাপ লেলিয়ে দেয় আমার ঘরে, সূচাগ্র সুযোগে সাপ বেহুলা আমাকেই শতবার রক্তাক্ত করে। আমার একটিই দোষ, আমি অবশ্য এটিকে গুণ বলেই বিবেচনা করি যে, আমি কোনও উদ্যত ফণা দেখে তিলমাত্র বিচলিত হই না। আমার সুস্থ স্বায়ুতন্ত্রের কাছে আমি বড় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
আমি আজ খুব স্বার্থপরের মত আমার কথা বলছি। আমি কারও কাধে ভর দিই না বলে প্রশস্ত এবং অপ্রশস্ত দুরকম কাঁধওয়ালা পুরুষই কম দুশ্চিন্তা, কম অপমান এবং কম লাঞ্ছনায় ভোগে না। এবং একইভাবে সেই মেয়েরাও কী ওদের ভোগায় না যারা কারও কাধে ভর দেবার হাতকে সঙ্কুচিত করে?
দীর্ঘ একটি জীবন একা হাঁটব বলে আমার জুতোর সুখতলা পুরু করে মোটা সুতোয় গেঁথেছি। আমার জুতোর দিকে তাকিয়ে পুরুষদের গা কেমন জ্বালা করে—আমি বেশ বুঝতে পারি। এবং সেই মেয়েদের জুতোর দিকেও কী ঈর্ষান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ হয় না যারা কোনও কিছুতে পরোয়া করবার ব্যাপারটি একেবারেই তুচ্ছ করেছে। পরোয়া করব না—সে আমার ব্যাপার। পরোয়া না করলে আমার যদি ক্ষতি বৃদ্ধি না হয় তবে তুমি পুরুষ হয়েছ বলে কত বড় ঈশ্বর বনে গেছ বাবা তুমি আমাকে দেখে নিতে চাও ! সুযোগ বুঝে অপবাদ আওড়াতে চাও !
আমার নিরীহ বাবা-মা আমাকে নিয়ে নানা রকম দুশ্চিন্তায় ভোগেন। ভোগেন, কারণ তাদের ষোল গোষ্ঠীর কোনও নারী শেকল ছিড়ে কখনও উঠে দাঁড়ায়নি। এবং দাঁড়িয়ে তাবৎ প্রতারক পুরুষের মুখে থুতু ছিটোয়নি। আমার নিরীহ আত্মীয়রা মনে মনে আমার মৃত্যু কামনা করে যাবতীয় দুঃসংবাদ থেকে মুক্তি পেতে চান কি না আমি সঠিক জানি না। হতেও পারে। না, এই বলে যে আমি মরে যাবার কথা ইদানীং ভাবছি তা নয়। মরে যাবার ইচ্ছেটা আমার এইজন্য হয় যে, আমি যদি আমার মত করে বাচতে না পারি, তবে আমি বাঁচব কেন? আমাকে কেন অন্যের ইচ্ছের মত বেঁচে থাকতে হবে, জীবনযাপন করতে হবে। অন্যে যাকে পছন্দ করে তাকে আমার অপছন্দ সত্ত্বেও হাই হ্যাঁলো বলে আমার সারা বিকেল মাটি করতে হবে। কেন, আমি মেয়ে বলে? আমি মেয়ে বলে চিৎকার করে জানান দিতে পারি না আমি ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি! নাকি ঘৃণা জাতীয় নিকৃষ্ট ব্যাপারগুলো মেয়েদের মধ্যে থাকতে নেই! মেয়েরা হবে পূত পবিত্র সর্বংসহা।
আমি একথা খুব স্পষ্ট করেই জানি যে এই শহরে আমার যোগ্য একটি পুরুষও নেই। যে পুরুষের দিকে আমি তাকাই, কোনও না কোনও দিক থেকেই তারা আমার তুলনায় তুচ্ছ, অপকৃষ্ট। এই শহরে একটি পুরুষও নেই যার করতলে আমি দ্বিধাহীন রাখতে পারি আমার বিশ্বাসের সব কটি আঙুল। এই শহরে একটি সামান্য পুরুষও নেই যাকে আমি হৃদয়ের শেকড়-বাকড় উপড়ে বলতে পারি ভালবাসি। এই শহরে আমার প্রতিভা ধারণ করবার যোগ্যতা কোনও পুরুষের নেই। আমার মেধা ও মননের অগাধ সৌন্দর্য গ্রহণ করবার শক্তি নেই কারও। আমার বোধের নাগাল পাবার মত দীর্ঘ বাহু কারও নেই।
আমার স্বাধীনতা ছুঁতে পারে এমন সাহস আমি কারও দেখি না। আমাকে ভালবাসবার দুঃসাহস যেন কোনও কাপুরুষের না হয়। বারবার কেবল নিজের কথায় ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাবার একেবারে যে কারণ নেই তা নয়। কারণ আমি একজন নারী। আমি নিজের অভিজ্ঞতা, নিজের বোধ ও বিশ্বাস থেকে সকল নারীকে স্পর্শ করি। যেন প্রতিটি নারী প্রচণ্ড বেঁচে থাকে। যেন বেঁচে থাকবার যোগ্য জল-হাওয়ার এতটুকু কোথাও অভাব না হয়।
আর যদি হয়ই, তবে আর বেঁচে থাকা কেন, অধোমুখে বেঁচে থাকা কী এমন লোভনীয় জিনিস যে নারী তবুও নিলজের মতন বাঁচে!
আমার বাবা মেডিকেল কলেজের ক্লাসে পড়াতেন অপিয়াম খেলে ডেথ খুব পিসফুল হয়। চোখ বুজলেই আমার বাবার সেই কণ্ঠস্বর কানের কাছে শুনি অপিয়াম ইজ দ্য কজ অফ পিসফুল ডেথ আমার বাবা খুব ভাল শিক্ষক ছিলেন। তার ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি এইটুকু বুঝিয়েছিলেন যে অপিয়াম খেলে মনে হয় মেঘের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছি, সামনে অনন্ত নীল আকাশ।
হঠাৎ হঠাৎ আমার ভেতর এরকম মৃত্যু-বাসনা ঘটে, তবে একথা সত্য নয় যে কুচক্রীদের গালে চড় কষাবার শক্তি আমার কব্জিতে কিছু কম, কিছু কম নয় আমার মত আরও নারীরও, কেবল একবার রুখে দাঁড়ালেই হয়। আমি যদি দাঁড়াতে পারি, দেশের আর সকল নারী কেন দাঁড়াবে না?