1 of 2

৫০. কথা শুনে একটু গম্ভীর হতে গিয়ে

কথা শুনে একটু গম্ভীর হতে গিয়েও অবশেষে একটু মুচকি হেসে ফেলে দীপনাথ। বলে, ওসব ছিচকাঁদুনে মেয়েলি সেন্টিমেন্টের কথা তোমার মুখে একদম মানায় না বউদি।

তৃষা চোখ বড় বড় করে বলে, তাই বুঝি? কাল রাতেই তো মাত্র বোমা মেরে গেল। তবু বলছ মেয়েলি সেন্টিমেন্ট? কাল রাতে কপালজোরে বেঁচে গেছি বলেই যে সব ক’টা ফাড়া কাটাতে পারব অত পুণ্যি তো করিনি।

প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দীপনাথ বলে, তুমি মরবে না। তুমি মরলে আমাদের চলবে কী করে?

চলবে কী করে তার আমি কী জানি! আমি অমর নই।

বিরক্ত হয়ে দীপনাথ বলে, বার বার মরার কথা বলে আবহাওয়া ভারী করতে চাইছ কেন বলো তো! এ রকম তো ছিলে না! বুড়ো হচ্ছ নাকি!

তোমার কাছে বুড়ো হব সাধ্য কী! এই না সেদিন রঙিন শাড়ি এনে পড়িয়ে ছাড়লে!

তবে? বুড়ো হওনি, শিগগির মরছও না। এখন যাও তো ভদ্রমহিলাকে ডেকে দাও। পরস্ত্রী ফেরত দিয়ে আসি।

কিন্তু পরস্ত্রীটি যে নড়তে চাইছে না!

কেন বলো তো?

আমার মেয়ে দুটোকে পলিটিকস শিখিয়ে মাথা খাচ্ছে।

তা হলে এক্ষুনি মাল ট্রান্সফার করো, নইলে সর্বনাশ। পলিটিকস অতি বিষাক্ত জিনিস।

নিজে থেকে না উঠলে তুলি কী করে?

ওর ওঠার তেমন ইচ্ছেও বোধহয় নেই। হাওড়া স্টেশনে আমাকে বলছিল দু-একদিন এখানে থেকেও যেতে পারে।

তা থাকুক না। ক্ষতি তো নেই। স্বপ্ন আর মঞ্জুর ঘরেই জায়গা হবে।

একটু ইতস্তত করে দীপনাথ বলে, কাজটা ঠিক হবে না বউদি। ওর হাজব্যান্ডের কাছে থাকার পারমিশান নেওয়া হয়নি।

হাজব্যান্ডকে কি ও মানে?

ও না মানুক, আমি তো ওর হাজব্যান্ড হিসেবে বোস সাহেবকে মানি!

হাজব্যান্ড তো এখানে নেইও শুনেছি।

তাতে কী? ফ্ল্যাটটা তো আছে।

সেখানে কি ও নিরাপদ, দীপু?

তার মানে?

মানে আবার কী? তোমার মরালিটির সেন্স দেখে হাসি পায়। একা ফ্ল্যাটে একটা ছুরি মেয়ে কতগুলো বয়-বাবুর্চির হেফাজতে থাকে, সেটাই বা কোন ভাল ব্যাপার? ওর হাজব্যান্ডের উচিত ছিল কোনও বয়স্কা আত্মীয়াকে ফ্ল্যাটে রেখে যাওয়া বা ওকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া।

দীপনাথ ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখে নেয়। তারপর চিন্তিত মুখে বলে, আমি তোমার মতো করে ভাবিনি। তুমি হয়তো ঠিকই বলছ। তবু আমার দায়িত্ব তো ওকে রক্ষা করা নয়। আমার দায়িত্ব শুধু জায়গা মতো পৌঁছে দেওয়া।

তৃষা একটু হেসে বলে, অত আলগা কথা বোলো না, দীপু। ও তোমার ওপর আরও একটু নির্ভর করে।

দীপনাথ এসব ঠাট্টায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে লজ্জা পেল না। বলল, ইয়ারকি কোরো না। কারও ওপর নির্ভর করার মতো মেয়ে নয়।

তৃষা একটু গম্ভীর হয়ে বলে, কেন মেয়েটাকে ঝোলাচ্ছ বলো তো তুমি! পরস্ত্রীকে ভাগিয়ে নেওয়ার লোক তো নও। তবে ওকে পাগল করছ কেন?

পাগল করছি! হাসালে বউদি। আমাকে পাত্তাই দেয় না।

বরং খুব বেশি পাত্তা দেয়। তোমাকে মৌমাছি কামড়েছে বলে মুখের ভাবখানা কী রকম হয়েছিল দেখোনি?

আচমকাই এবার লাল হল দীপনাথ। একটা শ্বাস ফেলে বলল, ওর চেয়ে তুমিই বেশি পাগল করলে আমায়। এখন যাও তো, যা বলছি করো তো। ডেকে দাও।

যাচ্ছি বাবা।

বলে তৃষা যায়। দীপনাথ অধৈর্যের সঙ্গে পায়চারি করতে থাকে বাগানের রাস্তায়। মেয়েদের বিদায় নিতে অনেক সময় লাগে। শেষ কথার রেশ ছিঁড়তে পারে না সহজে। দীপনাথ বার কয়েক ঘড়ি দেখল। জুতো ঘষল রাস্তার মোরমে। আজকের মৌমাছির হুল বহুকাল মনে থাকবে। কী জ্বালা! কী সুখ! চোখের কোল এখনও বেলুনের মতো ফুলে আছে। ঘাড়ে মাথায় এখনও তিনটে ঢিবি। অল্প ব্যথা। কাল ফোলা মিলিয়ে যাবে, ব্যথা থাকবে না। শুধু স্মৃতি থাকবে।

যখন শেষ অবধি উঠোনের সীমানা ডিঙিয়ে মণিদীপা বেরিয়ে এল তখন সন্ধে হয়-হয়। চারদিকে লঘু ছায়া পড়ে গেছে। হাওয়া দিচ্ছে খুব। দুরে মেঘ ডাকল।

মঞ্জু বলল, আর-একটু দেখে যাওয়া ভাল মণিকাকিমা, বৃষ্টি আসবে বোধহয়।

স্বপ্ন মণিদীপার একটা হাত ধরেই ছিল। বলল, থেকে যাও না কাকিমা!

ওরা খুব জমিয়ে নিয়েছে, বুঝল দীপনাথ। অনায়াসে তুমি করে বলছে। মেয়েরা এসব পারে।

মণিদীপা একবার জিজ্ঞাসু চোখে দীপনাথের দিকে তাকায়। দীপনাথ অস্বস্তির সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়ে মণিদীপার পিছনে দাঁড়ানো তৃষার দিকে তাকায়। তৃষা তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। দীপনাথ চোখ নামিয়ে নেয়।

খুব সংকোচের সঙ্গে দীপনাথ মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি থাকতে চান?

ওরা ছাড়তে চাইছে না। আপনি কী বলেন?

স্বপ্না হাঁ করে কথা গিলছে। দীপনাথ কী বলবে? সে একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ইচ্ছে হলে থাকুন।

আপনি?

আমি? আমাকে যেতেই হবে।

কেন খুব কাজ?

খুব কাজ। আপনি থাকতে পারেন। কাল সকালে বা যখন আপনার ইচ্ছে বউদি লোক দিয়ে পাঠিয়ে দেবে।

লোকের দরকার নেই। একাই পারব।

তা হলে থাকছেন?

ভাবছি।

ভাববার সময় নেই। আপনি থাকুন, আমি চলি।

থাকবে। থাকবে!–বলে স্বপ্না আর মঞ্জু প্রায় আঁকড়ে ধরে মণিদীপাকে।

দৃশ্যটা দেখতে ভালই লাগে দীপনাথের। তবু মনে একটা কাঁটা ফুটে আছে। বোস সাহেবের অনুমতি নেওয়া হয়নি। সে তৃষার দিকে সুপ্রশ্ন চোখে চেয়ে বলে, যাই বউদি?

এসো। মণিদীপা আমাদের কাছে যত্নেই থাকবে।

আসি তা হলো–বলে মণিদীপার দিকে একপলক চেয়ে দীপনাথ তার অভ্যস্ত বড় বড় পদক্ষেপে বেরিয়ে এল বাগানের ফটক খুলে।

স্টেশন অনেকটা পথ। দূরে মেঘ ডাকছে। শরতের দমকা বৃষ্টি এসে কখন ভিজিয়ে দেয় কে জানে। ছাতা নিয়ে কদাচিৎ পথে বেরোয় সে। ছাতা জিনিসটাই তার পছন্দ নয়।

চৌমাথা পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে অনেকটা এসে হঠাৎ এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে গেল দীপনাথ। খুব নির্জন। একটা মস্ত অশ্বথের ঘন ছায়া জায়গাটাকে অন্ধকার কবে রেখেছে। চারদিকে অজস্র ঝোপঝাড়, বাড়িঘর নেই। এই জায়গাতেই সামনাথকে মেরেছিল না গুন্ডারা! কেউ চিনিয়ে দেয়নি দীপনাথকে, তবু তার মনে হল, এই সেই জায়গা। সোমনাথকে কারা মেরেছিল তা আজও সঠিক জানে না দীপনাথ। এর ওর তার কাছে নানা কথা শুনেছে। সোমনাথ বড় বেশি আদরে মানুষ। কখনও শাসন করা হত না বলেই কি একটু অন্যরকম হল সে? কে বলবে? আবার বউদির গুন্ডারাই যদি তাকে মেরে থাকে তবে তারা শমিতার ওপর অত্যাচার করবে কেন? বউদি নিশ্চয়ই ওরকম জঘন্য কাজ করার হুকুম ওদের দেয়নি। ঘটনাটা তাই আজও কিছুতেই বুঝতে পারে না দীপনাথ।

খানিকক্ষণ ঝুঝকো ছায়ায় সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে। বিশ্লেষণ করে। কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারে না।

বৃষ্টি এল বলে। এখনও অনেকটা পথ। দীপনাথ খুব দ্রুত হাঁটতে থাকে। কখনও দৌড়পায়ে। স্টেশনের একেবারে কাছাকাছি তেমাথায় বৃষ্টি তার নাগাল পেয়ে গেল। দোকানে ঢোকা যেত, কিন্তু না ঢুকে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাকি পথটা দৌড়ে পার হল সে।

স্টেশনের চত্বরে উঠে ছাদের নীচে দাঁড়িয়ে রুমালে মাথা ঘাড় মুছল। কলকাতার একখানা টিকিট কাটল। তারপর দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগল। স্টেশনে যাত্রী বলতে প্রায় কেউ নেই। সে একা। খবর নিয়ে জেনেছে কলকাতার ট্রেন আরও মিনিট দশেকের আগে নয়।

মণিদীপা রয়ে গেল। ঘটনায় স্বস্তি পাচ্ছে না দীপনাথ। আনমনে একবার চোখের কোলে ফোলা জায়গাটায় আঙুল রাখল। ফোলাটা অনেক কমে গেছে। ব্যথা নেই, জ্বালা নেই। তবু কী যেন একটু আছে। আঙুল ছোঁয়াতেই রোমাঞ্চ হল গায়ে।

বৃষ্টির মধ্যেই একটা রিকশা ঝড়েব বেগে ছুটে আসছে স্টেশনের দিকে। মোড়ের মাথায় ঘন্টি মারছিল ঘন ঘন। ফিরে দৃশ্যটা দেখছিল দীপনাথ।

কে আসে?

বুকের মধ্যে হঠাৎ দামামা বেজে ওঠে। এত বেসামাল বহুকাল লাগেনি দীপনাথের। অথচ সেই নিত্যদিনের মণিদীপাই তো! মহত্তর কিছু তো নয়, চমকপ্রদও তো কিছু নয়। বিরহ তো মাত্র আধ ঘন্টার।

রিকশাওলাই একটা ছাতা ধরে স্টেশনে তুলে দিয়ে গেল মণিদীপাকে। দীপনাথের দিকে চেয়ে বলল, আপনাকে না পেলে দিদিমণিকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

দীপনাথ জবাব দিল না। নিঃশব্দে গিয়ে আর একখানা কলকাতার টিকিট কেটে আনল।

মণিদীপাও সামান্য ভিজেছে। হাত বাড়িয়ে বলল, আপনার রুমালটা দিন তো। মাথাটা বড্ড ভিজে গেছে।

দীপনাথ রুমাল দিল না। তার শুচিতায় বাধে। পরস্ত্রী কেন অন্য পুরুষের রুমাল ব্যবহার করবে? আর বুকের ভিতরকার সেই দামামা? হ্যাঁ, তাও সত্যি। আর এই দুইকে কখনও মেলাতে পারে না বলেই তো দীপনাথ আজ বড় একা বোধ করে।

কই, রুমালটা দিলেন না!–মণিদীপা হাত বাড়িয়ে আছে।

শাড়ির আঁচলে মুছে নিন। আমার রুমাল নোংরা।

মণিদীপা কোনও কথা বলল না। আঁচলটা ঘুরিয়ে মাথাটা যথাসাধ্য মোছার চেষ্টা করল।

আপনি জানতেন যে, আমি চলে আসব?

না তো! কী করে জানব?–দীপনাথ অবাক হয়ে বলে।

না জানলে এতক্ষণে চলে যাননি কেন?

যেতাম, গাড়ি পেলে। এখনও গাড়ি আসেনি।

চল্লিশ মিনিটেও ট্রেন পেলেন না!

না। আপনার কেন মনে হল আমি আপনার জন্যই যাইনি?

মণিদীপা কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বলে, এমনিই। আপনি চলে আসার পরই জায়গাটা এত বোরিং মনে হল যে থাকতে ইচ্ছে করল না।

দীপনাথের সুস্পষ্টই শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। বুকের মধ্যে তোলপাড়। এত অকপট কোনওদিন ছিল না মণিদীপা। আজ এসব হচ্ছেটা কী?

দীপনাথ কথা বলল না। মণিদীপা খুব দীন ভঙ্গিতে গিয়ে একটা ফাঁকা বেঞ্চে বসল। মাথা নিচু, চোখ নত।

ঘনঘোর বৃষ্টির শব্দের ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে অতিকায় ট্রেন চলে এল।

দীপনাথ বলল, ট্রেন।

মণিদীপা উঠল। বৃষ্টির ভিতর দিয়ে দু’জনে দৌড়ে এসে প্রথম যে কামরাটা পেল, উঠে পড়ল।

প্রায় ফাঁকা কামরা। আলো জ্বলছে। বাইরে ঘন অন্ধকারে অঝোর বৃষ্টি। কামরার মেঝেয় চিনেবাদামের খোসা, কাগজের ঠোঙা, বিড়ি-সিগারেটের টুকরো, দেশলাইয়ের কঁকা খোল। সব মিলিয়ে জনাপাঁচেক লোক এধারে সেধারে শুয়ে-বসে আছে। বেশির ভাগই চাষিবাসী শ্রেণির। মাঝপথেই কোথাও নেমে যাবে।

মুখোমুখি বসেও কেউ কারওর দিকে তাকাতে পারছিল না। আজ পরস্পরের কাছে তারা বড় বেশি ধরা পড়ে গেছে। লুকোনোর কিছু আর রইল না বোধহয়। না কি এখনও কিছু পরদার আড়ালে আছে?

বউদি কী বলল?— অনেকক্ষণ বাদে দীপনাথ আস্তে গলায় প্রশ্ন করে।

কী বলবে?

হঠাৎ চলে এলেন দেখে কিছুই বলল না?

না তো? কিছু বলার কথা নাকি?

কথাই তো। এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি। পাঁচজনে পাঁচ কথা ভেবে নেবে।

মণিদীপা অবাক হয়ে বলে, কী ভাববে?

আপনাকে নিয়ে আর পারি না।

বলুন না কী ভাববে!

দীপনাথ স্নান একটু হাসে। হাল ছেড়ে দিয়ে আপনমনে মাথা নাড়ে একটু। তারপর বলে, মানুষের মনে কতরকম যে প্যাঁচ আছে।

বাট উই আর ফ্রেন্ডস।–বলে মণিদীপা উঠে এসে পাশে বসে।

অফ কোর্স। কিন্তু সেটা কি সবাই বুঝবে?

মণিদীপা অতিশয় ফিচেল হাসি হাসছিল। বলল, সবার আগে দেখা দরকার আপনি বা আমি পরস্পরকে বন্ধু মনে করি কি না।

আমি আপনার অত্যন্ত শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু, বিশ্বাস করুন।

অবিশ্বাস একবারও করিনি।–মণিদীপার সুগন্ধি একটা শ্বাস এই কথার সঙ্গে দীপনাথের ঘাড় ছুঁয়ে গেল।

মণিদীপা এত কাছে ঘেঁষে বসে আছে যে, দীপনাথের অস্বস্তি হতে থাকে। সেই অস্বস্তির মধ্যে এক ধরনের তীব্র সুখ। তার শরীর শিউরে ওঠে।

দীপনাথ কিছু ভেবে না পেয়ে বলল, আমাকে অবিশ্বাস করার কিছু নেই।

আপনার কথাই ওঠে না। আপনি কখনও নিয়ম ভাঙতে ভালবাসেন না। সেই সাহস আপনার নেইও। কাওয়ার্ডদের থাকে না। তাই অধিকাংশ কাওয়ার্ডই হয় নীতিবাগীশ।

তাই নাকি? আপনি খুব নিয়ম ভাঙতে ভালবাসেন, তাই না?

ভীষণ। আর যারা নিয়ম ভাঙে তাদেরই আমার বেশি পছন্দ। নীতিবাগীশরা আমার দু চোখের বিষ।

বুঝলাম মিসেস বোস।

কিছুই বোঝেননি। নীতিবাগীশ আর আদর্শবাদীর মধ্যে অনেক তফাত। কিসের তফাত জানেন? নীতিবাগীশরা জীবনে কিছু করতে পারে না, আদর্শবাদীরা পারে।–মণিদীপার গলার স্বরে রাগের উত্তাপ বাড়ছে।

বুঝলাম। এক্ষেত্রে আপনিই বোধহয় সেই আদর্শবাদী?

নিশ্চয়ই। আর আদর্শবাদীদেরও কিছু শুচিতার বোধ থাকে। কিন্তু আপনি বা বোস সাহেব কোনওদিন আমাকে, সিরিয়াসলি নেননি। আপনারা শুধু জানেন আমি আপস্টার্ট, একস্ট্রাভ্যাগান্ট নটি। তার বেশি কিছু নয়। মণিদীপা ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ছে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে।

আমি ভাবি না।–গোমড়া মুখে দীপনাথ বলে।

টু অফ ইউ আর ইন এ লিগ এগেইনস্ট মি।

না মিসেস বোস।

এ কথায় কী হল কে জানে, মণিদীপার মুখ-চোখ রাগে ফেটে পড়ল। ঘনশ্বাসের ঝোড়ো আওয়াজের সঙ্গে চাপা আক্রোশ ভরা গলায় ‘আমি জানি, আমি জানি’ বলতে বলতে আচমকা অপ্রত্যাশিত, দু’হাত বাড়িয়ে সে খামচে ধরে দীপনাথের জামা টেনে প্রায় ছিড়ে দিতে দিতে বলে, কেন আপনারা ভালবাসেন না আমাকে? কেন বাসেন না? কেন?

শিলিগুড়ি গিয়ে অবধি দীপনাথকে চিঠি দেয়নি প্রীতম। তবে সে যে পৌঁছেছে সে খবর বিলুর কাছে শুনেছে দীপনাথ। আজ মেসে ফিরে প্রীতমের চিঠি পেল সে। বেশ দীর্ঘ চিঠি। হাতের লেখাটা অবশ্য প্রীতমের নয়। অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়েছে, আমি ভাল আছি। কিন্তু এ জায়গাটা কী বিচ্ছিরি হয়ে গেছে বলো তো! মদের দোকান, স্মাগলিং, মারপিট, হই-চই, আগে জানলে কিছুতেই আসতাম না। তুমি কখনও বলোনি তো আমাকে!… বলো তো, গোটা দেশে একটাও কি শান্ত, নিরিবিলি, সুন্দর জায়গা নেই? সব পচে গেছে? সব নষ্ট হয়ে গেছে? বেঁচে থেকে তবে আর কী হবে? কলকাতায় এতকাল বিছানায় শুয়ে শুয়ে কত ভেবেছি, আমার স্বপ্নের শিলিগুড়ি বুঝি গাছপালা পাহাড় নদী আর নির্জনতা সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে আমার জন্য। কোথায় কী? নোংরা হাটুরে চেহারার এই বিকট শহর আগাপাশতলা কলকাতার নকল। আমাকে একটা জায়গার সন্ধান দাও মেজদা।…

একটা শ্বাস ফেলে খামে আবার চিঠিটা ভাঁজ করে ভরে রাখে দীপনাথ।

সুখেন বহুদিন পর বাড়ি গেছে. পড়ুয়া ছেলেটাও দিন-দুই হল দেশে। ঘরে আজ দীপনাথ একা। রাতে সে কিছুই খেলনা। বাতি নিভিয়ে অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইল। সে আর খুব বেশিদিন এই মেসে থাকবে না। আর-একটু ভালভাবে থাকার জন্য সে এবার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেবে। রান্নার লোক রাখবে।

ভাবতে ভাবতে টান টান হয়ে উঠে বসে সে। নিজেকেই প্রশ্ন করে, না হয় বাসা নিলাম, লোক রাখলাম, কিন্তু তারপর? তারপর কি জীবন আমুল পালটে যাবে? নতুন কিছু ঘটবে?

বুকের একটা জায়গায় অসাবধানে মণিদীপার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের তীক্ষ্ণ নখে সামান্য আঁচড় লেগেছিল। ঘামে ভিজে এখন সেই জায়গাটা সামান্য জ্বালা করছে। মৌমাছির হুলের জায়গাগুলো এখনও সামান্য ফুলে আছে। কী করবে দীপনাথ? কী করবে?

নিশিতে পাওয়ার মতো বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। দরজা খুলে রাস্তায় নেমে আসে। নিশুত রাতে ফুরফুরে হাওয়া ছেড়েছে। কুকুররা ঝগড়া করছে মোড়ে। গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখে এত রাতে ঠেলাগাড়িতে কাদের মাল যাচ্ছে কোথায়। আকাশভরা তারা ফুটে আছে। মাঝরাতে এইভাবে জেগে উঠে দীপনাথের কাছে আজ হঠাৎ আবার বহু দূরের এক মহাপর্বতের সংকেতবার্তা এসে পৌঁছোয়। মানুষের জীবন নানা পঙ্কিলতায় ভরা, যুক্তিহীন, পরিণতিহীন, আনন্দহীন— ওই জীবন ছেড়ে চলে এসো দীপু। আমি বহুকাল তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

যাবে দীপনাথ। বড় উচাটন হয়ে ওঠে মন। কোথায় কোন দুর্গম প্রান্তর, পাথুরে জমি, চড়াই-উতরাই ভেঙে যেতে হবে তার তো কোনও ঠিক নেই। কোন দিক থেকে সংকেত ভেসে আসছে, তা সে জানেও না ভাল মতো। শুধু তার পালে সেই পাহাড়-ছোয়া বাতাস এসে লাগে। বলে, উজানে যাও, উজানে যাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *