ইরাকের হিরাহ সম্রাট নেমানের ফতিমা নাম্নী এক কন্যা ছিলো। সে ছিলো যেমনি সুন্দরী, তেমনি বদরাগী। তার স্বভাবের জন্য সম্রাট নেমান তাকে এক নির্জন প্রাসাদে অন্তরীণ করে রাখেন, প্রাসাদের বাইরে সম্রাট শক্ত প্রহরার ব্যবস্থা করেন। একমাত্র ফতিমার নিজস্ব দাসদাসীবৃন্দ ছাড়া অন্য কারো সে প্রাসাদে প্রবেশের অধিকার নাই। কন্যার সম্মান রক্ষা ও তার চরিত্রের পরিবর্তনের জন্যই সম্রাট এতো সব আয়োজন করেন। নির্জনে বসে রাজকন্যা সময়ে অসময়ে বিষণ্ণ হয়ে পড়তো, তখন সে দেওয়াল বেয়ে প্রাসাদের চূড়ায় উঠে বসে থাকত। উন্মুক্ত রাস্তায় লোকজন দেখতে দেখতে এক সময় তার বিষণ্ণতা দূর হয়ে যেত।
একদিন প্রাসাদ-চূড়ায় সময় কাটাতে কাটাতে সে দেখতে পায় ইবনাত ইজলান নামী তার এক দাসী এক আকর্ষণীয় পুরুষের সাথে আলাপে রত। পরে দাসীটির কাছে অনুসন্ধান করে সে জানতে পারে পুরুষটি সুবিখ্যাত কবি মুরাকিশ।
দাসী ইবনাত সুন্দরী এবং প্রাণবন্ত মহিলা। মুরাকিশের দেহসৌষ্ঠব ও কাব্যপ্রতিভার কথা বলতে গিয়ে সে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইবনাতের প্রশংসা বাক্যে রাজকন্যা ফতিমা মুগ্ধ হয়ে যায়। সেই আকর্ষণীয় বাগ্মী পুরুষকে দেখবার জন্য, তার সান্নিধ্য লাভের জন্য সে উন্মুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু একজন সভ্রান্ত রাজকন্যা হয়ে সে এমন হটকারীর মত কাজ করতে ইতস্ততঃ করে। কবি মুরাকিশের বংশ-মর্যাদা তার রুচিবোধ ইত্যাদি সম্পর্কে খোঁজখবর না নিয়ে সে কিছু করতে অক্ষম। তখনকার দিনে আরবদের আচরণই ছিলো এই রকম, প্রতি ৬৬ পদক্ষেপে তারা বংশ-মর্যাদা মেপে কাজ করত।
রাজকন্যা তাই কৌশলে কবি মুরাকিশের বংশ-মর্যাদা ও রুচির পরিমাপ নিয়ে ব্রতী হয়। ইবনাত ইজলানকে সে বলে,-আগামী কাল তুমি তার সাথে আবার দেখা করবে। এই সুগন্ধী কাঠের তৈরী দাঁত-কাঠিটি সাথে রাখো আর এই নাও একটি ধুনুচি। কাল যখন তার সাথে দেখা করবে তখন এটিতে কিছু সুগন্ধী ধূপ প্রজ্জ্বলিত করে নিয়ে যেও। মনোেযোগ দিয়ে লক্ষ্য করবে দাঁত-কাঠিটি ব্যবহার করার পূর্বে তিনি এর ডগাটি ভেঙে ছুঁচলো করে নেন কিনা। আর ধূপের ধোয়াতে তিনি তার পোষাকের অভ্যন্তরভাগ সুগন্ধী করে নিতে চেষ্টা করেন কিনা তাও লক্ষ্য করে দেখবে। তাই যদি করেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি নিচ বংশজাত। যতই বাগ্মী কবি হোন না কেন, একজন ভদ্রবংশীয়া রাজকন্যার যোগ্য তাকে বলা চলবে না কখনই।
পরদিন প্রাতে দাসীটি কবির বাসভবনে যায়। কবির বাসভবনে গিয়ে সে ধুনুচিটিতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে, তারপর সুগন্ধী ধূপ ছিটিয়ে দেয়। কবি মুরাকিশ কাছেই ছিলেন। দাঁতকাঠিটি তাকে উপহার দিয়ে ইবনাত ধূপের সুগন্ধটি কেমন তা পরখ করে দেখতে অনুরোধ করে। কবি জানান, ধুনুচি এখানে নিয়ে এসো।
ইবনাত ধুনুচিটি তার সামনে এনে রাখে, সুগন্ধী ধোঁয়া ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কবি মুরাকিশ তার লম্বা দাড়ি ও দীর্ঘ চুল ধোঁয়ায় সিক্ত হয়ে উঠলে সেগুলির ঘ্রাণ নেন যত্নে। তারপর সেই দাঁতকাঠিটা তুলে নিয়ে সেটির প্রান্তভাগ ভেঙ্গে ফেলেন এবং একটি ব্রাশের আকৃতিতে সেটিকে কেটে নিয়ে নিজের দন্ত মার্জন করেন। সবশেষে তিনি তার দাঁতের ঘ্রাণ নিতে প্রবৃত্ত হন।
বাঁদী ইবানত সোৎসাহে তার এই দ্বৈত পরীক্ষার বিশদ বিবরণ জানায় রাজকন্যাকে। রাজকন্যা ফতিমা উত্তেজিত স্বরে জানান,—এই অভিজাত কবিকে যেমন করে পার নিয়ে এসো আমার কাছে।
কিন্তু প্রহরী-বেষ্টিত রাজপুরীতে সে কেমন করে নিয়ে আসবে মুরাকিশকে? শেষ পর্যন্ত সে একটি উপায় আবিষ্কার করে। রাত্রের অন্ধকারে সে মুরাকিশকে নিজের পিঠে তুলে নেয়, তারপর একটি ভারী চাঁদরে উভয়কে আচ্ছাদিত করে সে রাজপুরীতে প্রবেশ করে। কবির সাহচর্যে রাজকন্যা বিমোহিত হয়ে পড়ে সহজেই। সুন্দরী ফতিমার কোমল উষ্ণ আবেষ্টনীতে কবি মুরাকিশের রাত কেটে যায়। ভোর রাতের অন্ধকারে ইবনাত তাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসে।
সকালে সম্রাট নেমানের প্রহরীরা ফিরে এসে দেখতে পায় বালিতে মাত্র এক জোড়া পায়ের ছাপই ফুটে আছে, সে ছাপ তাদের চেনা। সম্রাটকে সংবাদ দিতে গিয়ে তারা জানায়,-জাঁহাপনা, ইবনাত ইজলান ছাড়া আর কারো পায়ের ছাপ চোখে পড়লো না। তবে সে বোধহয় ভারী কিছু বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, কারণ তার পায়ের ছাপ বেশ গভীর হয়ে বসে গেছে বালির মধ্যে।
রাজকন্যা ফতিমা ও কবি মুরাকিশের প্রেম ক্রমশঃ মধুর থেকে মধুরতর হয়ে উঠতে থাকে। এইভাবে দিন কেটে সপ্তাহ যায়, মাসের পর মাসও কেটে যেতে থাকে।
মুরাকিশের এক অন্তরঙ্গ দোস্ত ছিলো, সুন্দরী ফতিমার গল্প শুনে সে তাকে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। কবি মুরাকিশ কোমল স্বভাবের লোক ছিলেন। সুপ্রিয় বন্ধুর ক্রমাগত অনুরোধে অবশেষে সে একদিন মত না দিয়ে পারে না। রাত্রের অন্ধকারেইবনাতের পিঠেকবির বদলে তার বন্ধু চেপে বসে। রাজকন্যা ফতিমার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ইবনাত তাকে নামিয়ে দেয়।
সুন্দরী ফতিমা বুদ্ধিমতী মহিলা, আপন স্পর্শবোধের সাহায্যে সে সমস্ত ছলচাতুরী ধরে ফেলে। বুঝতে পেরেই সে বিছানা থেকে ছিটকে নেমে যায়, ঘৃণা-পূর্ণ পদাঘাতের সাহায্যে আগন্তুককে বিতাড়িত করে। ইবনাত ইজলান তাকে ঘাড়ে চাপিয়ে ফেরত দিয়ে আসে। ইতিমধ্যে ভোর হয়ে আসে, গল্প থামিয়ে শাহরাজাদ চুপ করে রইলো।
নয়শত ছিয়াত্তরতম রজনী :
সে আবার বলতে শুরু করে :
মুরাকিশের বিশ্বাসঘাতকতায় ফতিমা অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।কবিকে সে আর এক মুহূর্তের জন্য কাছে আসতে দিতে অস্বীকার করে। মুরাকিশ অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন। রাজকন্যা কিন্তু তার প্রতিজ্ঞায় অটল, কিছুতেই সে আর কবির মুখ দর্শন করবে না। ফতিমার বিরহে কবি মুরাকিশ একটি গাথা রচনা করেন, এমনই সে গাথার আবেদন যে, যুগ যুগ ধরে লোকমুখে তা অমর হয়ে আছে।
ফতিমার বিরহে শোকতপ্ত কবি অবশেষে একদিন মৃত্যু বরণ করেন। ইতিহাস বলে, তিনি প্রেমের জন্যই অবশেষে একদিন আত্মাহুতি দিয়েছেন।
যুবকটি তার অতিথিবৃন্দের দিকে ফিরে চেয়ে বলে, বন্ধুগণ কবি মুরাকিশ আর সুন্দরী ফতিমার গল্প এখানেই শেষ হলো। এবার আমি তোমাদের বলবো কিণ্ডাইটের সম্রাট হজর ও তার স্ত্রী হিন্দের গল্প।