এক সময়ে দামাসকাস শহরে এক পরম রূপবান নওজোয়ান সওদাগর সারা শহরের তাবৎ কুলকন্যা বিবিবেগমদের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটিয়েছিলো। দোকান খুলে বসা মাত্র নানা কারণে অকারণে সওদা করার ছল-ছুতোয় কুমারী তরুণী বিবাহিতা বিবি বাঁদীরা এসে ভীড় জমাতে থাকতো।
এমনি একদিন সকালে সে দোকান খুলে বসেছে, এমন সময় এক রমণী এসে প্রবেশ করলো। উদ্দেশ্য কিছু কেনা-কাটা করা।
যথাবিহিত সৌজন্য স্বাগত জানিয়ে সে তাকে সাদর অভ্যর্থনা করে বসতে দিলো।
মেহেরবানী করে আদেশ করুন, বান্দা আপনার কি কাজে লাগতে পারে।
মেয়েটি কেমন চঞ্চল বিহ্বল হয়ে বললো, না না, তেমন বিশেষ কিছু না। এই নিন টাকার তোড়া, আজকের মতো যাহোক কিছু একটা দিন, আসল সওদা করতে কাল আসবো আমি। আশা করি আমাকে খুশি করতে পারবেন।
এই বলে সে তাড়াহুড়ো করে দু-একটা তুচ্ছ জিনিসপত্র টেনে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
পরদিন আবার ঠিক একই সময়ে দোকানে এসে দাঁড়ালো। এবার সে একা নয়। সঙ্গে একটি খুব অল্পবয়সী ডাগর ডাসা মেয়ে, পরমাসুন্দরীই বলা যায়। সওদাগর যুবকের চোখ এই ষোড়শীর দিকেই নিবদ্ধ হয়ে রইলো। আগের দিনের খদ্দের তার সঙ্গিনীর দিকে সে ফিরেই তাকালো না আর।
একটুক্ষণ পরে বয়স্কা রমণী সওদাগর যুবকের কানে কানে ফিসফিস করে বললো, তোমার কি একে পছন্দ? বল, কোনও সঙ্কোচ নাই। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব, এ আমার নিজের মেয়ে।
সওদাগর যুবক কৃতার্থ হয়ে বলে, সবই আপনার হাতে বিবিসাহেবা। আমি আপনার কন্যাকে দেখামাত্র আসক্ত হয়ে পড়েছি। এখন আপনি যদি মেহেরবানী করে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন তবেই আমার দেহমন তৃপ্ত হতে পারে। তবে এও ঠিক আপনার কন্যার যা রূপ তাতে আমার সঙ্গে ঠিক মানায় না। আর তা ছাড়া ওর যোগ্য দেনমোহরই কি দিতে পারবো?
বিবিসাহেবা বললো, না না, সে জন্য তোমার চিন্তা করার কোনও কারণ নাই। ও আমার মেয়ে, আমি যা বলবো তাই হবে। দেনমোহর? সেজন্য কিছু আটকাবে না। টাকা-পয়সার দিকে খাই নাই আমাদের। তোমার যা খুশি তাই দিয়ে ওকে ঘরে তুলে নাও, বাবা। তাও যদি তোমার সাধ্যে না কুলায়, বল, আমি শাদীর সব খরচা তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। শুধু আমি দেখতে চাই, আমার আত্মজা তোমার ঘরে গিয়ে সুখের নীড় খুঁজে পেয়েছে। আল্লার কুদরতে আমার অঢেল আছে। তবে এও ঠিক, শুধু অর্থ দিয়েই সব পাওয়া যায় না। সুখ অন্য বস্তু, শান্তি আরও দুর্লভ এবং মহব্বত শুধুমাত্র ভাগ্যবান পুণ্যাত্মারা লাভ করে। তোমাকে দেখা মাত্র আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি, বাবা। ভেবেছি, তোমার কাছে থাকলে আমার মেয়েটি সুখে শান্তিতে ভালোবাসায় দিন গুজরান করতে পারবে।
সওদাগর যুবক বললো, ঠিক আছে, আমি রাজি।
এই সময় রজনী প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
আটশো নব্বইতম রজনী :
আবার সে বলতে থাকে :
তখুনি ঠিক হয়ে গেলো কোনও রকম জাঁকজমক না করে খুব শিগ্নিরই এক শুভলগ্নে শাদীপর্ব সমাধা হয়ে যাবে।
যথানির্দিষ্ট তারিখে কাজী এসে শাদীনামা তৈরি করে দিয়ে গেলো। মা কন্যার হাত ধরে পাত্রের বাসরঘরে পৌঁছে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
তোমাদের জীবন সুখের হোক, বেটা।
সে দিন দামাসকাস শহরে এক নিভৃত কক্ষে দুই তরুণ-তরুণী কপোত-কপোতীর মতো আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে সুখ-সম্ভোগের মধ্যে বাসররাত্রি অতিবাহিত করলো।
পরদিন সকালে শয্যাত্যাগ করে সওদাগর যুবক যথাসময়ে দোকানে চলে গেলো। সারাদিন কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে দেখলো, তার সদ্য পরিণীতা বিবি পর্দার আড়ালে অন্য এক তরুণের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে প্রেমালাপ করছে।
নিমেষে সারা দুনিয়া আঁধার হয়ে এলো তার চোখের সামনে। তড়িতাহতের মতো ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।
দরজার সামনে শাশুড়ীর সঙ্গে দেখা হলো। জামাইকে উদ্ৰান্ত দেখে সে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো, কি হয়েছে, বাবা?
—কী হয়েছে? ঘরে ঢুকে নিজের চোখেই দেখুনক্রোধে ফেটে পড়তে চায় সওদাগর।
শাশুড়ী খুব শান্ত সহজ গলায় বলে, ও তুমি ঐ ছেলেটির কথা বলছো? যে ছেলেটি তোমার বিবির পাশে শুয়ে আছে? তা বাবা, কী করবে বলল, শাদী তো বিনা দেনমোহরে সমাধা হয়েছে। কিন্তু সুন্দরী বিবিকে যোলআনা পেতে গেলে কি মুফতে হয়? তার চেয়ে বরং দু’জনে ভাগাভাগি করে নাও ওকে। কী, আমি খারাপ বললাম কিছু?
এ কথার জবাব দেবে কি সে। ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে তৎক্ষণাৎ তিন তালাক উচ্চারণ করে বললো, আমি ওকে বয়ান তালাক দিলাম। অমন বিবিতে আমার দরকার নাই।
বাইরে দারুণ বাকবিতণ্ডা শুনে ততক্ষণে মেয়েটি বিছানা ছেড়ে উঠে দোরগড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যেই সে তার স্বামীর মুখ থেকে বয়ান তালাক শুনলো অমনি বোরখার নাকাব দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়ালো। কারণ এখন আর সে তার স্বামী নয়, পরপুরুষ মাত্র।
পলকের মধ্যেই ঘটে গেলো এই সব ব্যাপার। কিন্তু সওদাগর যুবক হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো, তার বিবির পাশে আর একটি অল্পবয়সী মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে! তার অঙ্গের সাজাপোশাক বিলকুল এক নওজোয়ান যুবকের মতো!
সওদাগর হতবুদ্ধি নির্বোধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বয়স্কা রমণী হাসতে হাসতে বললো, তোমাকে বোকা বানিয়ে তিন তালাক করিয়ে নেবার জন্য আমি দুঃখিত, বাবা। কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিলো না।
সওদাগর তরুণ আরও অবাক হয়ে বলে, মানে?
-মানে আর কিছু নয়, আমার এই মেয়েটির কয়েকদিন আগে একটি যোগ্য খানদানী পাত্রের সঙ্গে যথাবিহিত জাঁকজমক করেই শাদী হয়েছিলো। কিন্তু এমনই নসীব, শাদীর পরদিনই ঠিক একই ভাবে সেও ভুল বুঝে তাকে বয়ান তালাক দেয়। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হতে থাকে। এর একমাত্র কারণ আমার এই ছোট কন্যা। ওরা দু’জনে পিঠেপিঠি বোন।কিন্তু ছোটটির শখ সব সময় ছেলে সেজে থাকা। আজকের মতো সে দিনও সে তার বোনের পাশে শুয়েছিলো ছোকরা সেজে। তার স্বামী দেখা মাত্র ক্রোধে অন্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে বয়ান তালাক দিয়ে দেয়। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে কি তার কান্নাকাটি। কিন্তু হাদিসের বিধান কী করে অগ্রাহ্য করা সম্ভব। তাই তোমাকে একটি রাতের জন্য বর সাজাতে হয়েছিলো বাবা।
সওদাগরের মুখে করুণ হাসি ফুটে ওঠে, বর নয়, বর্বর বলুন! এই বলে সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সেখানে। ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়লো।
এরপর শাহরাজাদ আর একটি কাহিনী বলতে শুরু করে :