কোন এক সময়ে এক গ্রামে ঈশ্বর-বিশ্বাসী এক ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধ বাস করতো। সংসারে তার বিবি এবং দুটি পুত্র কন্যা ছিলো! ছেলেটি একেবারে আহাম্মক গবেট। মেয়েটির দেহের তুলনায় পাদুখানা ছিলো খুব ছোট।
মৃত্যুকালে বৃদ্ধ তার স্ত্রীকে কাছে ডেকে বলে গেলো, আজ বাদে কাল আমি মরে যাবো। আমার সংসারের সব ভার তোমার ওপরেই দিয়ে যাচ্ছি। কারণ ছেলেটি একেবারে একগুঁয়ে এবং নির্বোধ। একটা কথা, আমার মৃত্যুর পর ছেলেটার কোনও কাজে তুমি বাধা দিও না। ওর যা প্রাণ চায় করবে, তাতে যদি মহা অনিষ্টও ঘটে, মুখ বুজে সহ্য করো তুমি।
স্বামীর শেষ ইচ্ছা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পালন করে একদিন বিবিও দেহ রাখলো। মৃত্যু শয্যায় সে মেয়েকে কাছে ডেকে স্বামীর শেষ ইচ্ছার কথা শোনালো, মা, তোমার ভাই বুদ্ধিতে খাটো এবং ভীষণ একরোখা। তোমার বাবা মারা যাবার সময় আমাকে দিয়ে হলফ করিয়ে নিয়েছিলেন যাতে আমি তোমার ভাই-এর কোনও কাজে বাধা না দিই। তিনি গত হয়েছেন আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। যাবার আগে তাই তোমাকেও বলে যাচ্ছি মা, সে যত অন্যায়ই করুক, তার কোনও কাজে তুমি বাধা দিও না। মেয়েটি মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করলো, সে তার দাদাকে মান্য করে চলবে। তার কোনও কাজে বাধা দেবে না।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
আটশো একাশিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
মায়ের মৃত্যুর পরে গবেটচন্দর বোনকে বললো, জানিস বহিন, এই যে আমাদের ঘরবাড়ি বিষয় সম্পদ যা কিছু দেখছিস আমি সব আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেব ঠিক করেছি।
দাদার কথা শুনে বোন শিউরে ওঠে, সে কি কথা রে দাদা! মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞার কথা সে ভুলে গেলো সেই মুহূর্তে, তা হলে আমরা বাঁচবো কি করে, খাবো কী?
গবেটচন্দর গোঁ ধরে বললো, ওসব আমি জানি না, আমার ইচ্ছে হয়েছে করবো। তাতে যদি তুই বাধা দিতে চাস, আমি মানবো না।
এই বলে সে তখুনি ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলো। এবং লেলিহান অগ্নি শিখা নিমেষে ছড়িয়ে পড়লো বাড়ির সর্বত্র। গরু বাছুর, দানাশস্য পোশাক আশাক আসবাব বিছানা যা কিছু ছিলো সব ছাই হয়ে গেলো।
মেয়েটি দাদার চোখে ধূলো দিয়ে কিছু দামী জিনিসপত্র পাড়া-পড়শীদের কয়েকটি বাড়িতে সরিয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু গোঁয়ার গবেট সে খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশিদের ঘরেও আগুন লাগিয়ে দিলো—সেইদিনই মাঝ রাতে।
পাড়ার তাবৎ লোক মারমুখী হয়ে ছুটে এলো ভাইবোন দু’টোকেই সাবাড় করে ফেলবে বলে। মেয়েটি বিপদ বুঝে দাদাকে এক রকম প্রায় জোর করে হিড়হিড় করে টানতে টানতে, সেই রাতেই চোরের মতো গা ঢাকা দিয়ে গ্রামের বাইরে বেরিয়ে ঊধ্বশ্বাসে ছুটে পালাতে থাকলো।
একটানা সারারাত ধরে ছুটার পর সকালবেলায় তারা এসে পৌঁছলো এক নতুন অচেনা মুলুকে। চলতে চলতে তারা এক চাষীর খামারবাড়ি দেখতে পেলো। মেয়েটি গৃহস্বামীকে বললো, আমরা দুই ভাইবোন অনেক দূর দেশ থেকে আসছি। আমাদের বাবা মা কেউই বেঁচে নাই। ঘরবাড়ি বিষয়সম্পদ যা ছিলো সব আগুনে পুড়ে গেছে। এখন একেবারে সহায়-সম্বলহীন অবস্থা। যদি দয়া করে আপনি আশ্রয় দেন আমাদের, আমরা দুই ভাইবোন গায়ে গতরে। খেটে আপনাদের কাজ উঠিয়ে দেব।
ওদের অসহায় অবস্থার কথা শুনে এবং দু’জনের ভদ্রবংশজাত চেহারা ও আদব-কায়দা প্রত্যক্ষ করে চাষী বললো, ঠিক আছে, তোমরা আমার বাড়িতে থাকো। তোমাদের কিই বা এমন বয়েস, কাজ-কাম বিশেষ কিছুই করতে হবে না, আমার নিজের তিনটি ছেলে আছে তোমাদেরই বয়েসের, তাদের সঙ্গে খেলাধূলা করবে, লেখা-পড়া শিখবে, কেমন?
মেয়েটি বললো, আপনি পরম দয়ালু, তাই একথা বলতে পারলেন।
চাষীর আশ্রয়ে দুই ভাইবোন তোফা দিন কাটাতে থাকলো। মেয়েটি নিজে থেকেই সেধে কিছু কাজ-কাম করে কিন্তু তার দাদা গবেটচন্দর খায় দায় আর গুলতানী করে বেড়ায়।
একদিন সে চাষীর তিন পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বললো—চল আমরা মাঠে যাই। ঐ বাগানের মধ্যে আমরা লড়াই লড়াই খেলবো। তোরা তিন ভাই একদিকে আর আমি একাই একদিকে।
লড়াই-লড়াই খেলাতে কোন্ ছেলের না উৎসাহ থাকে। চারজনে লাঠিসোটা সঙ্গে নিয়ে মাঠের দিকে চলে গেলো।
ঘণ্টা দুই পরে মেয়েটির কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো। তার দাদাকে সে হাড়ে হাড়েই জানে। তিনটি কচি দুধের বাচ্চাকে নিয়ে মাঠের বাগানে গেছে অনেকক্ষণ, এখনও ওরা ফিরলো কেন?
অজানা ভয়ের আশঙ্কায় মেয়েটি প্রায় ছুটতে ছুটতেই বাগানের দিকে চলে গেলো।
ভাই-এর কাণ্ড দেখে আর্তনাদ করে ওঠে মেয়েটি, একি সর্বনাশ করেছিস দাদা? একেবারে জানে মেরে ফেলেছিস তিনজনকে!
গবেটচন্দরের হাতে ধরা একটা মোটা লাঠি, হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে, মারবো না, ওরা যে আমার শত্রুপক্ষ, আমাকে আক্রমণ করেছিলো। আমি যদি না ওদের খতম করতাম, ওরা কি আমাকে সোহাগ করতো? তুমি একটা আস্ত উজবুক, লড়াই-এর এই তরিকা, হয় মারো নয় তো মর।
মেয়েটি ঝাঝিয়ে ওঠে, দেখ দাদা, ওসব বুজরুকি থামা। এবার যদি জানে বাঁচতে চাস তো চলো আর দেরি নয়, এখান থেকেই পালাই। না হলে এখুনি ওর মা-বাবা খবর পেয়ে যাবে।
তারপর আমাদের দু’জনকে কুপিয়ে কুপিয়ে কাটবে।
গবেটচন্দর তখন সাফাই দিতে চায়, কেন কাটবে আমাদের? আমরা তো যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো লড়েছি। হারা জেতা বাঁচা মরাই তো বড় কথা নয় সেখানে—
-তুই থাম দাদা, আর মস্করা করতে হবে না। ঐ শোন্ ওরা বোধ হয় খবর পেয়ে গেছে, গাঁ শুদু লোক বোধ হয় তেড়ে আসছে এইদিকে। কেমন হৈ হৈ রব শুনতে পাচ্ছিস না?
গবেটচন্দর এতক্ষণে বুঝতে পারে বিপদ ঘনায়মান। আর তিলমাত্র দেরি না করে সে বোনকে সঙ্গে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে।
গ্রামবাসীরাও তীর ধনুক সড়কী বর্শা নিয়ে পিছনে পিছনে তাড়া করে চলে ওদের। কিন্তু মেয়েটি ভীষণ বুদ্ধিমতী, সে সোজা পথে না গিয়ে বন বাদাড় জঙ্গল ভেঙ্গে দাদাকে নিয়ে পালাতে থাকে।
সারাটা দুপুর বিকেল ধরে দৌড়তে দৌড়তে সন্ধ্যার প্রাক্কালে ওরা দু’জনে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর পেরিয়ে একটি বাগানের মধ্যে এসে দাঁড়ায়।
ছোট বড় নানা জাতের অনেক গাছপালার বাগান। মেয়েটি বলে, দাদা, রাত হয়ে আসছে।এখন অন্ধকারে পথ চলা যাবে না। আর এই জঙ্গলের এখানে সেখানে সাপ খোপ জন্তু জানোয়ার থাকতে পারে, তাই মাটিতে থাকা নিরপাদ হবে না, এসো আমরা ঐ বড় গাছটার ওপরে উঠে যাই! ওর ডালগুলো বেশ মোটা মোটা। আর তাছাড়া বেশ ঝাকড়াও আছে। ঐ ডালে বসে থাকলে চট করে কেউ নজরও করতে পারবে না।
গবেটচন্দর বোনের বুদ্ধির তারিফ করে, তোর তো দারুণ মাথা রে! ঠিক আছে, চলো ওই গাছটারই উপরে ওঠা যাক। রাতটা কোনও রকমে কাটিয়ে সকালে রওনা দেওয়া যাবে।
একটু পরেই আরও ঘন আঁধার ঘনিয়ে এলো। গাছের ডালে বসে বুঝতে পারলো ওরা, গাছতলায় কারা যেন এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটি দাদার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললো, চু একটি কথাও আর বলবি না এখন। মনে হচ্ছে, আমাদের খুঁজতে খুঁজতে ওরা এই গাছের তলাতেই এসে পড়েছে।
সকালবেলায় দিনের আলোয় মেয়েটি পরিষ্কার দেখলো, সেই গৃহস্বামী এবং তারই কয়েকজন প্রতিবেশী সহচর গাছতলায় শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাদের পাশে রাখা তীর ধনুক বর্শা বল্লম প্রভৃতি নানা মারাত্মক অস্ত্র শস্ত্র।
মেয়েটি গবেটচন্দরকে জাগিয়ে নিচের দৃশ্যটি দেখিয়ে ফিস ফিস করে বললো, ওরা এখন ঘুমে অচৈতন্য। চলো দাদা, গাছ থেকে নিঃশব্দে নেমে চুপিসারে কেটে পড়ি।
গবেটচন্দরের মাথায় তখন অন্য বদ-বুদ্ধির খেলা শুরু হয়ে গেছে। বললো, তুই থাম দিকিনি, ঐ শয়তানগুলোর মুখে আমি পেচ্ছাব করে দেব।
বোনটি অনেক কাকুতি মিনতি করেও দাদাকে নিরস্ত করতে পারলো না। গবেটচন্দর কল কল করে জল ছেড়ে দিলো তাদের মুখে।
সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে পড়ে সবাই। ব্যাপারটা কি হতে পারে কিছুই ঠাওর করতে পারে না কেউ। একজন বলে, এ নিশ্চয়ই শয়তানের কাণ্ড। এই বাগানে হয়তো ওরা থাকে।
আর একজন তীর ধনুক হাতে তুলে নিয়ে বলে, শয়তানই হোক, আর জীন আফ্রিদিই হোক, আমার তীরের ফলার কাছে কেউই জ্যান্ত থাকবে না।
মেয়েটি ফিস ফিস করে গবেটচন্দরকে বলে, গাছটা আকাশ ছোঁয়া উঁচু আছে, দাদা, যদি বাঁচতে চাস আরও উপরে উঠি চলো। তা না হলে ওরা আমাদের তীরে গেঁথে ফেলবে।
গবেট বললো, ঠিক আছে তাই ওঠ পারবি তো?
মেয়েটি বলে, গাছের ডালে ডালে চড়ে বেড়ানো আমার ছোটোবেলার অভ্যেস, তুই কি জানিস না?
ওদের ওপরে উঠে যাওয়ার সময় স্বভাবতই খস খস্ আওয়াজ ওঠে। নিচের একজন-এর চোখে পড়ে যায়। চিৎকার করে ওঠে, ওই যে ওরা গাছের মাথায় উঠে গেলো। চালাও তীর।
কিন্তু গ্রাম্য চাষীর ধনুকের তীর অত ওপরে উঠতে পারলো না। আমরা গাছে উঠে ধরবো। ওদের গৃহস্বামী বললো, তাতেও বিপদ হতে পারে। আমরা জানি না, ওদের সঙ্গে কী কী অস্ত্র আছে। ওরা ওপরে আমরা নিচে। আঘাত করার সুযোগ ওদেরই বেশি। সুতরাং তার দরকার নাই, এসো আমরা গাছটাকেই কেটে মাটিতে ফেলে দিই। তারপর ওরা পালাবে কো পায়?
সঙ্গে সঙ্গে গাছের গোড়ায় কুড়ুলের ঘা পড়তে থাকলো। মেয়েটি দাদাকে বললো, এবার আর বাঁচবার কোনও পথ নাই দাদা একটু পরেই গাছটাকে ওরা মাটিতে শুইয়ে দেবে। নে, এবার খোদার নাম কর, মউ সামনে এসে গেছে আমাদের।
গবেটচন্দর গম্ভীর হয়ে খুব ভারিক্কি চালে বললো, হুম্ আমার জন্যেই দেখছি তোর জানটাও খতম হয়ে গেলো।
কুড়ুলের ঘায়ে ঘায়ে গাছের গুড়ির অর্ধেকের বেশি কাটা হয়ে গেছে ততক্ষণে। আর একটু। পরেই পাহাড় প্রমাণ গাছটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে যাবে নির্ঘাৎ। মেয়েটি হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দাদাকে জড়িয়ে ধরে এ তুই কি করলি দাদা, এইভাবে জান হারাতে হলো?
গাছটা হেলে গেছে। পলকেরই মধ্যে মাটিতে পড়ে যাবে। এমন সময় বিরাট এক বকপাখী আকাশ থেকে এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেলো গবেটচন্দর আর তার বোনটিকে। এবং সেই মুহূর্তেই বন-কাঁপানো আওয়াজ তুলে পড়ে গেলো গাছটা।
বকের থাবায় দুই ভাইবোন আকাশ পথে উড়ে যেতে থাকলো। মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে গেছে, কিন্তু গবেটচন্দরের ভয়ডর বলে কিছু নাই। বকপাখীর বুকে সুড়সুড়ি দিয়ে মজা অনুভব করতে লাগলো সে। বোনটি আঁৎকে উঠলো, সর্বনাশ, একি করছিস দাদা, পাখীটা যদি এই আকাশ থেকে ফেলে দেয় আমাদের, তা হলে যে একেবারে ছাতু হয়ে যাবো। দোহাই দাদা, ওসব করিসনে।
গবেটচন্দর সে কথা কর্ণপাত করে না। বলে, কিন্তু আমার যে ভারি মজা লাগছে। দেখছিস না, সুড়সুড়ি খেয়ে পাখীটা কেমন ছটফট করে উঠছে।
একটা পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে উড়ছিলো পাখীটা। মনে হলো একটা জায়গায় বসবে সে। কিন্তু কী খেয়াল হলো বসতে বসতেও সে বসলো না। আবার মহাশূন্যে উঠে তীরবেগে ছুটে চললো।
প্রাণে বাঁচার ক্ষীণ একটু আশা হয়েছিলো কিন্তু তাও নিমেষে মিলিয়ে গেলো। পাহাড় ছাড়িয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে উড়তে থাকলো পাখীটা।
এই সময় গবেটচন্দর এমনভাবে কাতুকুতু দিতে আরম্ভ করলো যে, পাখীটা আর থাবায় ধরে রাখতে পারলো না ওদের। একেবারে ঝপাত সমুদ্রজলে।
তবে রক্ষে এই, তীর থেকে বেশি দূরে নয়। দুই ভাইবোনই সাঁতার জানতো, তাই প্রাণে রক্ষা পেয়ে গেলো। সাঁতরাতে সাঁতরাতে একসময় কূলে এসে ভিড়লো ওরা।
তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। দুই ভাইবোন সমুদ্র-সৈকতে বসে শীতে কাঁপতে লাগলো। বোনটি বললো এভাবে ভিজা জামাকাপড়ে সারারাত কাটাতে হলে নিমুনিয়া ধরে যাবে দাদা, একটা উপায় বালা।
গবেটচন্দর বললো, দাঁড়া ব্যবস্থা করছি। এই বলে সে এক রাশি শুকনো ডালপালা নিয়ে এসে জড়ো করলো সেখানে। তারপর দু’খানা পাথরের নুড়ি হাতে নিয়ে ঠুকে ঠুকে আগুন জ্বালালো।
সেই আগুনের তাপে জামা কাপড় শুকিয়ে ফেললো ওরা। মেয়েটি বললো, বারে দাদা, তোরও মাথায় কিছু বুদ্ধি শুদ্ধি আছে দেখছি!
সারাটা রাত আগুনের ধুনী জ্বালিয়ে রাখার জন্য গবেটচন্দর গাছের মোটা মোটা ডালপালা এনে ধুনীর ওপরে ফেলতে লাগলো। ফলে, রাত্রির ঘন তমসা কেটে গিয়ে সেই সমুদ্রবেলার অনেকটা অঞ্চল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।
রাত তখন এক প্রহর, হঠাৎ বিকট গর্জন কানে এলো। মনে হলো, হাজার হাজার মোষ তাড়া করে আসছে তাদের দিকে।
একটু পরে এক বিশাল কালো দৈত্য এসে দাঁড়ালো ওদের ধুনীর সামনে। এই দৈত্যটা আলো সহ্য করতে পারে না। সারা দেশটাকে এতকাল ধরে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখে দিয়েছে। এখানে বহুকাল সূর্য ওঠে না। ঐ দৈত্যটা সূর্যকে পিঠ দিয়ে আড়াল করে রেখে দেয়।
দৈত্যটা আগুনের কুণ্ডটাকে নিভিয়ে দেবে আর গবেটচন্দর তা কিছুতে হতে দেবে না। এই নিয়ে বেধে গেলো তুমুল লড়াই। অগ্নিদগ্ধ জ্বলন্ত গাছের ডাল নিয়ে বার বার আক্রমণ করতে থাকলো সে! কিন্তু প্রতিবারই দৈত্যটা তা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত গবেটেরই জিৎ হলো। একবার সে অতর্কিতে একটা জ্বলন্ত ডাণ্ডা সোজা ঢুকিয়ে দিলো তার হায়নার মতো মুখগহ্বরে। মেদিনী কাঁপিয়ে আওয়াজ তুলে সে লুটিয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো। গবেট এবার আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে অন্ধ করে দিলো ওর চোখ দুটো। তারপর পিটাতে পিটাতে সাঙ্গ করে দিলো ওর ইহলীলা।
বোনটা অদূরে পাহাড়-এর কন্দরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো। দৈত্য নিধন করার পর সে পাহাড়-কন্দরে এসে বোনের দেখা পেয়ে বললো, কিরে খুব ভয় পেয়েছিলি?
মেয়েটি বিস্ফারিত চোখে তাকায় দাদার দিকে, তোর গায়ে এতো শক্তি তাতো জানতাম না দাদা! অত বড় একটা বাঘা দানব, তাকে খতম করে দিতে পারলি!
গবেটচন্দর বুক ফুলিয়ে বলে, ওসব দৈত্য দানব আমার কাছে এ নস্যি! নে সর একটু সোয়া যাক। উফ, খুব একটা ধকল গেছে আজ।
সকালে সারা দেশে খবর ছড়িয়ে পড়লো কোন এক মহাবীর দুষমন দৈত্যকে নিধন করে ফেলেছে! সম্রাট তার সেনাপতিদের বললেন, যে দৈত্যের অত্যাচারে আমরা। এতকাল ঘন তমসার মধ্যে বাস করতে বাধ্য হচ্ছিলাম সেই দুরাচারকে যে বীর নিহত করেছে সে নিশ্চয়ই দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ শক্তিধর। তোমরা যাও তার অনুসন্ধান করে মহা সম্মানে নিয়ে এসো
তাকে আমার প্রাসাদে। আমি স্বহস্তে তাকে জয়তিলক পরিয়ে বরণ করবো!
সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের চর এবং সৈন্যসামন্ত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে খুঁজতে একসময় তারা সমুদ্রের তীরে এসে পৌঁছায়। একজন সেনাপতি এক পায়ের চটি দেখতে পেয়ে হাতে তুলে নেয়।
নিশ্চয়ই এই চটি যাঁর, তিনিই নিহত করেছেন এই দৈত্যকে।নিশ্চয়ই তিনি আশেপাশেই কোথাও আছেন, খুঁজে দেখ তোেমরা।
খুঁজতে খুঁজতে পাহাড়ের সেই কন্দরে দুটি কিশোর-কিশোরীকে নিদ্রিত অবস্থায় দেখতে পেলো ওরা।
সৈন্যদের পদশব্দে মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে যায়! সৈন্যরা তাকে জিজ্ঞেস করে এ চটি কার?
মেয়েটি ভীত চকিত হয়ে বলে, আমার। দৈত্যের সাড়া পেয়ে ভয়ে ছুটে আসার সময় খুলে পড়ে গিয়েছিলো।
দৈত্যটাকে নিধন করেছে কে? মেয়েটি তার দাদাকে দেখিয়ে বলে, এই আমার দাদা। এরপর গবেটচন্দর আর তার বোনকে মহা সমাদরে সম্রাটের দরবারে হাজির করলো তারা। সম্রাট গবেটচন্দরকে বাদশাহী মর্যাদায় বীরোচিত অভ্যর্থনা করলেন।
আপন কন্যার সঙ্গে শাদী দিলেন; এবং অর্ধেক সলতানিয়তের সুলতান করে দিলেন তাকে। এবং গবেটের বোনকে শাদী করে হারেমের বেগম-এর মর্যাদা দিলেন তিনি।