মেয়েলি হিসাব – হাজেরা মস্রূর
গুড্ডু সাহেব এইমাত্র ঘরে ফিরলেন! ভালো চাকরি করেন। কিন্তু পুরনো অভ্যাস সাইকেল চালানোর –সেটা এখনও ছাড়তে পারেননি।
চাকর এসে সাইকেলটা ধরে নিল।
অফিস থেকে বাসা কম হলেও দু মাইলের পথ। তার ওপর যা গরম পড়েছে। এই গরমে এই দু মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে আসা মানে রীতিমতো ব্যায়াম করা। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ে। সারা গায়ে ঘাম ছুটে যায়। সে-সময় গুড্ডু সাহেব বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন, তখন এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিল, ‘বিয়ে না করে, বলছি একটা কার কিনে ফ্যালো। আর, যদি কার না-কিনতে চাও, তা হলে মেষ পোষো। এইভাবে সাইকেল চালালে খাঁটি মোষের দুধ খাওয়া দরকার, বুঝেছ?’
কিন্তু গুড্ডু কারও কেনেনি, মোষও পোষেনি। অবশ্য বউ একটা ঘরে তুলেছে। ঘরে ফিরেই তার প্রথম কাজ বউকে খোঁজা
চাকরকে জিগ্যেস করল, ‘ও কোথায়?’
‘ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। বলেছেন, আপনি আসার আগেই ফিরবেন।’
‘তা ফিরলেন কই, আমি তো এসেছি।’
‘তাই তো বলে গিয়েছিলেন।’
ক্লান্ত শরীরটাকে সোফার উপর বিছিয়ে দিল গুড্ডু। এই সময় এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। বউয়ের হাতের চা। চাকরের হাতের চা খেয়ে গুড্ডু সাহেব আরাম পান না। ভাবল, হয়তো এখনই এসেই পড়বে।
গুড্ডু ভাবল, এই সুযোগে গোসলটা সেরে নেওয়া যাক। নলের পানির শব্দের সঙ্গে মিশে গেল যেন কারও গলার আওয়াজ। এসেছে বোধহয়। নল বন্ধ করে শুনবার চেষ্টা করল গুড্ডু। না, মনের ভুল। কেউ আসেনি তো।
গোসল সেরে বেরুল। চা রাখা ছিল তেপায়ার উপর। ইভনিং-ইন-প্যারিসের গন্ধ মেখে নিয়ে চায়ের দিকে তাকাল। চা এখনও যথেষ্ট গরম। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে কিছু ক্ষতি নেই। হয়তো ততক্ষণে এসে যাবে। সকালের খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ল।
পড়তে পড়তে একটা অদ্ভুতদর্শী শিশুর খবরের দিকে নজর গেল তার। কিন্তু বেশিক্ষণ সে-খবর মনটাকে আটকে রাখতে পারল না। এ-পর্যন্ত একটিই ছেলে পেয়েছে সে। তাতেই বউয়ের স্বাস্থ্যটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। অপারেশন করতে হল বলে। নইলে হয়তো এমন হত না।
কে বলেছে সন্তান উৎপন্ন করতে। না হলেই-বা কী ক্ষতি ছিল! স্বাস্থ্যটা তো তা হলে এইভাবে জাহান্নামে যেত না। আর, খবরের কাগজে রোজ রোজ এইরকম খবর। বানরের মতো দেখতে। মাথায় শিং রয়েছে। নাহয়, চারটা হাত, দুটো মাথা নাহয়, পিঠে পিঠে জোড়া লেগে রয়েছে। দুটো বাচ্চা। চারটা হাত, দুটো পা। বিয়ে করলেই এইসব ঝঞ্ঝাট।
আহা, বেগমের কী অবস্থা! হাসপাতালের সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল গুড্ডুর। তিন দিন যাবৎ কেবল চিৎকার করল। শেষে অপারেশন করতে হল। কীরকম আতঙ্কজনক হয়ে উঠেছিল ওর চেহারাটা। হাসপাতাল থেকে যে ফিরল, সে যেন বেগম নয়, বেগমের প্রেতাত্মা। তৌবা। সন্তান জন্ম দেওয়া যেন একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়। যদি মরে যেত, তা হলে! গুড্ডুর দুচোখ আপনা-আপনি ভিজে এল।
কী করছে এতক্ষণ ধরে ডাক্তারের কাছে। নাকি সেখান থেকে আবার অন্য কোথাও গেছে। টাঙায় চাপতে কতদিন নিষেধ করেছে। তাতে শরীর আরও খারাপ হয়ে যায়। ট্যাক্সিতে গেলে শরীরটা আরাম পায়। না, ওই এক বাতিক। পয়সা বাঁচানোর এত ঝোঁক। কী হবে এত টাকা-পয়সা জমিয়ে। জান্ আগে, না পয়সা আগে। আসুক, আজকে ভালোভাবে শুনিয়ে দেবে চাট্টি কথা।
কিন্তু আরও অনেক দেরি করে বেগম যখন ঘরে ফিরল, ওর বিবর্ণ, মলিন মুখ দেখে গুড্ডুর মুখে রা সরল না। বকার কথা একদম ভুলে গেল সে। বাইরে আয়ার কোলে বেবি কাঁদছিল ট্যা-ট্যা করে।
গুড্ডু আদর করে বেগমকে বিছানায় শোয়াতে গেল। কিন্তু বেগম মুখে কোনও কথা না বলে নাক ঝাপ্টা দিয়ে সে আদর প্রত্যাখ্যান করল। সরে বসল গিয়ে সোফার উপর। তার কপালে, নাকের নিচে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। নিঃশ্বাস বয়ে যাচ্ছে জোরে জোরে।
বেগমকে সুন্দরী বলা যায় না। আদৌ না। কিন্তু গুড্ডুর চোখে সে অপরূপা। এতদিন হয়ে গেল, তবু চেয়ে চেয়ে চোখের পিয়াস মেটে না তার। এত যে ভেঙে পড়েছে, যাকে দেখলে এখন তালপাতার সেপাই বলেই মনে হয়, তবু গুড্ডুর কাছে সে স্বর্গের অপ্সরা। গুড্ডু কাছে বসে, মোলায়েম করে হাত ধরে, বেগমের শাড়ির আঁচল দিয়ে তার মুখের ঘাম মুছে দিতে চাইল, কিন্তু বেগম ঝট্কা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল তার। ঝাপ্টা মেরে হাত সরিয়ে দিল গুড্ডুর।
গুড্ডুর খারাপ লাগল না। এইরকম দেখে দেখে তার সয়ে গেছে। এখন কিছু মনে করে না সে এই ব্যবহারকে।
গুড্ডু চা তৈরি করতে শুরু করে দিল। ‘নাও খাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
‘না।’
‘কেন?’ গুড্ডু নিজের কাপটাও নামিয়ে রাখল।
‘ভালো লাগছে না।’
‘বেশ, অল্প-একটু খেয়ে নাও, দু চুমুক।’
কয়েক চুমুক খেল বেগম।
‘ডাক্তার কী বললেন?’
‘রক্ত হচ্ছে না।’
গুড্ডুর খুব রাগ হল। ‘রক্ত হবে কোত্থেকে। টনিক-ওষুধ সব ড্রেনে ফেলেছে। দুধ খাবে না, ডিম খাবে না। গোত দেখলে বমি আসে। শাক-শবজির গন্ধ পর্যন্ত সহ্য করতে পারো না। তা আর খাবে কী। একটুখানি চলাফেরা করতে বলব, তা-ও করবে না। তুমি নিজেই মরতে চাও, তা কে কী করবে, বলো রাগ করলে কী হবে, আমার কথার উত্তর দাও। ওষুধ যদি না-খাবে তো ডাক্তারের কাছে রোজ রোজ কীজন্যে যাচ্ছ? সেই-যে বেবি পেটে থাকার সময় ডিম-দুধ-গোশ্ত খাওয়া ছেড়েছ তো ছেড়েছই– এখনও গন্ধ লাগে। মা কি সাধে বলেন, নখ়া কোরো না। আমার কথা নাহয় না-ই শুনলে, কিন্তু মুরুব্বি মানুষের কথা তো শুনতে হয়। বেশি বললে তো আবার কাঁদতে শুরু করে দেবে।
ঘুরে দেখে, বেগম তার বলবার আগেই কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
ঠোঁট ঝুলিয়ে বাচ্চাছেলের মতো সে কাঁদছে।
‘ব্যস্, খারাপ লেগে গেল আমার কথা। শহরে আরও তো পাঁচটা মেয়েমানুষ আছে। পাড়া-প্রতিবেশীদের দেখেও তো লোকে শেখে।’
‘হুঁ, আমি বুঝি আর পাঁচটা মেয়েলোকের সমান হলাম। তার চাইতে গরু-মোষের সঙ্গে তুলনা দিলেও তো পারতে। গরু-মোষও মার খেলে শিং দিয়ে গুঁতো মারে।’
‘ও, আমি বুঝি তোমাকে মেরেছি, তাই না? অবাক করলে।’
‘তোমার মুখের কথাই মারের চাইতে কি কম? পুরুষ হয়েও শাশুড়ি-ননদের মতো গালাগালি করতে তোমার মুখে বাধে না! আশ্চর্য।’
‘আশ্চর্য? বেশ, আমার অন্যায় হয়েছে, মাফ করে দাও। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটু কথাতেই অমনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠো কেন, বলো তো?’
‘উঁ– বড় এসেছেন মনস্তত্ত্ববিদ্–। শরীরের চিকিৎসা শেষ হয়েছে, এখন মনের চিকিৎসা করবেন।’
‘লক্ষ্মী বেগম, তুমি আমাকে মাফই করে দাও। ঘাট হয়েছে, স্বীকার করছি।’ বকলেও যা, সহানুভূতি জানালেও তাই। ভাবল গুড্ডু।
বেগমের কান্না তবু থামল না। ‘সত্যি বলছি, তোমাকে এখন আমার ঘেন্না করতে ইচ্ছে করছে। আমার কষ্টের কথা তুমি ভাবো না। আমার মনের ভেতরে যে কী হচ্ছে, তা তুমি বোঝো না। আত্মহত্যা করতে মন চাইছে।’
‘শোনো লক্ষ্মীটি, তাই জন্যেই তো বলছি, শরীরটাকে সারিয়ে তোলো। স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে মনও ঠিক থাকবে। কথায় বলে না, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।’
‘না, আমি কিছু শুনতে চাই না। তুমি আমার দু চোখের বিষ। তুমি আমার শত্রু। জীবনে আমার ঘেন্না ধরে গেছে। আমি মরব। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ওয়াক্। আমার বমি আসছে।’
বউকে জোর করে টেনে এনে নিজের কাছে বসাতে চাইল গুড্ডু।
‘উফ্, আমাকে তুমি টেনে-হেঁচড়ে শেষ করে ফেললে। ব্যথা, ব্যথা। উফ্। মলাম, নিষ্ঠুর।’
‘মাফ করে দাও, মাফ করে দাও। অন্যায় হয়েছে। আচ্ছা, এসো। তুমি নিজেই এসো। এসে বোসো। আমার কাছে এসে বোসো। এসো, আমি তোমার মাথা টিপে দিই।’
‘না, না, তুমি আমাকে ছুঁয়ো না। ছুঁলে আমি পাগল হয়ে যাব। স্বার্থপর। নিষ্ঠুর। তোমার কী! আবার মরতে হলে মরব তো আমিই।’
‘দ্যাখো বেগম, তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ। এত তাড়াতাড়ি ছেলে পেতে কি আমিই চেয়েছিলাম নাকি? তুমিই তো মা হওয়ার জন্যে আল্লার কাছে দোয়া চেয়েছিলে, মনে নেই? তবে যে আমার দোষ দিচ্ছ।’
‘বেশ, বেশ, তোমার কথাই সত্য হল। আমিই চেয়েছিলাম। সব বউই বাচ্চা চায়, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। আমার ঘাট হয়েছে, স্বীকার করছি। আর আমি চাইনে। এই যে কান ধরছি। তৌবা করছি। অনেক শাস্তি হয়েছে। আর না। ‘
‘আমিই-বা কবে চেয়েছি, না ভবিষ্যতের জন্যে চাচ্ছি। আমিও তৌবা করছি। তৌবা তৌবা। তোমার চাইতে বেশি তৌবা। ডবল তৌবা।’ গুড্ডু ক্লাউনের মতো কান ধরে কয়েকবার ওঠবোস্ করল।
‘বাহ্, কারও জান যাচ্ছে, আর তুমি তাই নিয়ে করছ আমার সঙ্গে ফাজলামি। সারারাত ঘুম আসে না ভয়ে, তা তুমি জানো?’ বেগম একেবারে বাচ্চাছেলের মতো জোরে জোরে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল।
‘এই নাও, এখন আবার কী হল? তুমি আমাকে পাগল করে ছাড়বে দেখছি।’ কান্না থামানোর চেষ্টাস্বরূপ গুড্ডু তাকে বুকের কাছে টেনে আনতে গেল।
উফ্, মেরে ফেলল রে, মেরে ফেলল। তোমাকে-না বললাম, আমাকে ছুঁয়ো না। তোমার হাতের ছোঁয়া আমার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। তুমি যদি আমার মনে শান্তি দিতে চাও, তা হলে দোহাই তোমার, তুমি আমাকে ছুঁয়ো না।’
‘আশ্চর্য, তুমি আমাকে শুধু শুধু লজ্জা দিচ্ছ। যাই বলো, আমি যে জানোয়ার নই, এতদিনে অন্তত তোমার তা বোঝা উচিত ছিল। আমি তোমার মনে শান্তিই দিতে চাই। আমি চাই, তুমি সেরে ওঠো, সুস্থ হয়ে ওঠো।’
‘ছাই। তোমাকে আমি চিনি না মনে করেছ! একটুখানি ঢিলা দিলেই হল। তোমার কী। মরব তো আমি। আমার শরীরে একফোঁটা রক্ত নেই। কেমন করে যে বেঁচে রয়েছি, ভাবতেও অবাক লাগে। সারাক্ষণ মাথা ভোঁ ভোঁ করে। উঠতে গেলে ঘুরুনি, বসতে গেলে ঘুরুনি। এখন পর্যন্ত সোজা হয়ে হাঁটতে পারি না। পেটে ছুরির দাগ কোনওদিনও মিটবে না।’ আবার কাঁদতে শুরু করে দিল বেগম।
এমনি সময়ে পাশের ঘরে বেবিরও কান্নার রব শোনা গেল।
বেগম হাঁক ছাড়ল, ‘আয়া, বেবিকে নিয়ে এসো!’
‘আয়া, বেবিকে এনো না।’ তারও চাইতে জোরে বলল গুড্ডু।
‘কেন অত দেমাক দেখাচ্ছ? দুধ দেব না বাচ্চাকে? না-খেয়ে মরবে নাকি? দুধ তো ছাই পায়!’ বিড়বিড় করে চোখ মুছল বেগম।
‘মরুক। মরলেই বাঁচি। বুকের দুধ কেন দেবে। ডাক্তারে বলেনি টিনের দুধ খাওয়াতে?’
‘মুখ সামলে কথা বলো, নইলে ভালো হবে না কিন্তু। আমার বাচ্চা কেন মরবে। যে ওর মৃত্যু চায়, সেই মরুক। অতটুকু বাচ্চার সঙ্গে তোমার এত হিংসামি কেন, শুনি?’
‘অমন বেহুদা ছেলে তো আমি কোথাও দেখিনি। সারারাত কাঁদবে, আর তোমাকে ঘুমোতে দেবে না। সেইজন্যেই তো তোমার মেজাজটা আরও তিরিক্ষি হয়েছে। শুকিয়ে শুকিয়ে কাঠ হচ্ছ।’
‘থাক, অত দরদ দেখাতে হবে না। শত্রু, হাড়-শত্রু, আবার দরদ দেখাচ্ছেন। আমি ওকে ন-মাস পেটে ধরেছি। তুমি কী বুঝবে তার জ্বালা। আর, থাকতে হত যদি হাসপাতালে, পেট কেটে বাচ্চা বের করতে হত যদি, তা হলে বুঝতে।’
‘এইজন্যেই তো বাঁদরটার ওপর আমার এত রাগ। বেটা নচ্ছার, মায়ের পেটে ছিলি কেন– বাপের পেটে থাকতে পারিসনি?’ গুড্ডু হাসি সংবরণ করতে পারছিল না।
‘দেখাও-না রাগ, যত পারো দেখাও। কিন্তু আমার তো ওই একটাই বাচ্চা, একটাই মানিক। এই মানিকটাই আমার জীবনের আশা-ভরসা। আমার চোখের মণি। কিন্তু আর আমি ছেলেমেয়ে চাই না। আবার আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে মেরে ফেলতে চাও নাকি? আমি মরলে তোমার আর কী ক্ষতি। আর একটাকে ঘরে তুলবে। তাকে দিয়ে সেপাই-বাহিনী তৈরি করে নিও। যত খুশি।’ আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল বেগম।
গুড্ডু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, কী ভাষায় সে সমবেদনা জানাবে। সমস্যা হয়তোবা জটিল, কিন্তু তার সমাধান কঠিন নয়। নিজেই সে বিজ্ঞের মতো সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে নানাভাবে। কিন্তু তার প্রত্যেকটি কথারই উল্টো অর্থ করছে বেগম।
ততক্ষণে চা ঠাণ্ডা পানি হয়ে গেছে। চা আর খাওয়া হল না। কাজেই গুড্ডু একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটে দ্রুত কয়েকটা টান দিয়ে ভাবতে লাগল। কত সাধ বুকে পুষে অফিস থেকে সে বাসায় ফিরেছিল। কিন্তু বিকেলটা একদম মাটি হয়ে গেল। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে সে নিজের চুলে আঙুল বুলোতে লাগল।
‘ব্যস্, এখন মুখ ভার করে বসে পড়লেন।’ বেগম আবার বাণী বর্ষণ আরম্ভ করে দিল। ‘আমার কথা বুঝবে কেমন করে তুমি। যাক। আমি তোমাকে ঠেকিয়ে রাখতে চাই না। আমি জানি, এই অবস্থায় তুমি আমার ওপর খুশি হতে পারো না। তুমি কেন, কোনও পুরুষই পারবে না। আমার কপাল মন্দ। আমি হতভাগী। তুমি আর একটা বিয়ে করে নাও। আমি তোমার বাড়ির এককোনায় আমার ছেলেকে নিয়ে পড়ে থাকব। তুমি খুশি থাকলেই আমিও খুশি।’ বেগমের রুগ্ণ চেহারায় যেন রাশি রাশি অভিমানের আলো ঝিলিক দিয়ে গেল।
‘শোনো কথা! আশ্চর্য মেয়ে তুমি। তুমি নিজেই নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী মজাটা পাচ্ছ! এই সময় আমার আবার বিয়ে করার প্রশ্ন উঠল কেমন করে!’
উঠতে আর বাকিই-বা থাকল কোথায়। ন্যাকা সাজবার চেষ্টা কোরো না। অকেজো একটা বউ নিয়ে তুমি কদিনই-বা ঘর করবে। এ প্রশ্ন আজ না-উঠলেও একদিন উঠবে। তুমি হলে পুরুষজাত। দয়ামায়া বলে কি কোনও জিনিস আছে তোমাদের মধ্যে!’
‘আশ্চর্য, দু বছর আগে যখন বিয়ে করিনি, তখন বুঝি আমি মরে যাচ্ছিলাম।’
‘হুঁহু, তখনকার কথা আর এখনকার কথা এক নাকি?’
‘কেমন করে বোঝাই বলো তোমাকে। বলছি, এসব কথা ভেবো না। রাত-দিন এই চিন্তা করো বলেই তো তোমার রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে।’
‘করব-না চিন্তা! আমার কী অবস্থা, তা আমিই জানি। একদিকে বছর বছর- ইয়ে, আর অন্যদিকে
‘বছর বছর ছেলেমেয়ে কে চেয়েছে। আমি কি চেয়েছি নাকি যে, বারে বারে এককথা শুনিয়ে যাচ্ছ? আমি বলছি, আমি আর ছেলেমেয়ে চাই না, চাই না, চাই না– এখন হয়েছে তো।’
‘তুমি না-চাইলেও ছেলেমেয়ে হতে পারে। আর, আমার তাতেই মৃত্যু। হবে না বললেই হয় না। কোনও গ্যারান্টি নেই। ‘
‘গ্যারান্টি নেই? তা হলে সায়িন্স কীজন্যে এসেছে?’
‘অসম্ভব। তুমি আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা কোরো না।’
‘আচ্ছা, বেশ। এসো, আমরা তা হলে প্রতিজ্ঞা করি। আমরা দু জন বন্ধুর মতো জীবন-যাপন করব। এখন হয়েছে তো?’ যেন স্বর্গীয় প্রকৃতির বাণী ছাড়ল সে, যার ওপর আর কোনও কথা চলতে পারে না। বলেই সে খুব জোরে হাত চেপে ধরল বেগমের
‘আবার! আবার আমাকে ছুঁলে! একটু আগে কী বলেছ?’
‘কেন, বন্ধু বন্ধুকে ছুঁতে পারে না নাকি?’
‘তা হলে থাক, অমন বন্ধুত্বে আমার কাজ নেই। ছোঁয়াছুঁয়ির বন্ধুত্বকে আমার ভয় লাগছে।’
‘নিশ্চিন্ত থাকো বন্ধু, কোনও ভয় নেই। আমরা প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ নই। আজকে ছোঁয়া মানা। কালকে এক ঘরে থাকা মানা। পরশু বলবে, আমি তোমাকে পর্দা করে চলব। আমাকে বিশ্বাস করো, অত সন্দেহপ্রবণ হয়ো না।‘
‘বেশ, তা হলে প্রতিজ্ঞা করো।‘
‘প্রতিজ্ঞা করলাম। তোমাকেও একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’
‘কী?’
‘যে, সময়মতো ওষুধ খাব। ভালোভাবে খাওয়াদাওয়া করব। প্রত্যেক দিন তোমার সঙ্গে বেড়াতে বেরুব। কোনও দুশ্চিন্তা করব না। ইত্যাদি ইত্যাদি।’
‘অর্থাৎ, আমি আজকাল পাগল আছি, যেন তাড়াতাড়ি মাথাটা ঠিক হয়ে যায়, তাই না? তার পর যেন বেশ ভালোভাবেই আমাকে নিয়ে
‘না, কক্ষনো না। আর একটা কথা। বেবিকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না। এখন থেকে অত আদর করলে একদম বিগড়ে যাবে। বড় হলে কোনও কাজের ছেলে হবে না।
‘বা বা, এখন তুমি মা-ছেলের ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনাবশ্যক অনধিকার চর্চা করছ। আমার ওই একটাই ছেলে। ওর কোন্টা ভালো, কোন্টা মন্দ, তা আমি ভালো করেই জানি।’
‘তা হলে বাপ বুঝি ছেলেকে ভালোবাসে না?’
‘বাসে কি না-বাসে, কে জানে। তবে মায়ের মতো নয় নিশ্চয়। ন’মাস পেটে ধরে যদি ভালোবাসতে পারতে, তবেই হত ভালোবাসা। তোমার কথায় আমার কলজেটা ফেটে যাচ্ছে।’ বেগম আবার ফোঁপাতে আরম্ভ করল।
‘এই নাও, আবার শুরু হয়ে গেল। আমি মাফ চাচ্ছি। যত খুশি আদর করো, ওর বারোটা বাজাও, আমি আর কিছুই বলব না। সত্যিই তো, আমি যখন ন’মাস পেটে ধরিনি, তখন ওকে ভালোবাসার আমার কী অধিকার।’
‘এ-পর্যন্ত ভালোবাসার কী পরিচয় দিয়েছ শুনি। বলেছিলাম, একটা প্যারামবুলেটার কিনে দাও, বেবিকে বেড়াতে নিয়ে যাব। সবসময় কোলে করে নিয়ে বেড়ালে ছেলের অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু দিয়েছ কিনে আজ পর্যন্ত? আজকে নাহয় আয়া আছে। ওর কী ভরসা। কালকে যদি চলে যায়, তখন আমাকেই তো নিয়ে টেনে টেনে বেড়াতে হবে। হবে কি না, বলো?’
‘আমি কি আর দেব না বলেছি, না দিতে চাইনি? এ মাসের বাজেট টাইট। তাছাড়া, সময় পাচ্ছি কোথায়। দশটা-পাঁচটা অফিস করি, তার পর ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরি। কখন কিনব বলো। তা তুমিও তো পারতে একটা প্যারামবুলেটার কিনে আনতে। আনোনি কেন?’
‘হ্যাঁ, একেই বলে ভালোবাসা। সত্যিকারের ভালোবাসা হলে সময়ের অভাব হত না। আমি রুগী মানুষ, আর আমাকেই ঠেলতে চাও বাজারে। হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত আমাকেই আজকে যেতে হল বাজারে প্যারামবুলেটার খুঁজতে।’ বেগমের চোখ আবার ভিজে এল।
‘ও, তাই বলো। বাজার গিয়েছিলে, সেইজন্যে ফিরতে এত দেরি। তা প্যারামবুলেটার আনলে না কেন? দেখে রেখে এসেছ বুঝি পছন্দ করে! ঠিক আছে, পয়লা তারিখে গিয়ে নিয়ে আসব, কেমন?’
‘তোমার সব কাজ পয়লা তারিখে।’
বেগমের কথায় আর কান না দিয়ে গুড্ডু হাঁক ছাড়ল, ‘আয়া, বেবিকে নিয়ে এসো, আমি ওকে ভালোবাসব।’ ভালোবাসার যেন অনেক স্টক জমা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি খালাস করতে চায় সে।
খুশিতে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে আয়া এল একটা প্যারামবুলেটার ঠেলতে ঠেলতে, তার মধ্যে বাচ্চা।
‘আচ্ছা, তাই বলো, কিনে ফেলেছ!’ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গুড্ডু একেবারে দাঁড়িয়েই পড়ল। ‘আহা, এরকম বউ ক-জনের ভাগ্যে জোটে। যার জোটে, তার ঘর স্বর্গতুল্য।’ ছেলেকে কোলে নেওয়ার জন্য সে হাত বাড়াল। কিন্তু বাপের কোলে গিয়ে সে বেজায় চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তার পর মায়ের কোলে মায়ের গায়ের গন্ধ শুঁকে সে চুপ করল কোঁ-কোঁ করে।
চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে প্যারামবুলেটার দেখতে লাগল গুড্ডু। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। হাতল ধরে ঠেলা মেরে দেখল। স্প্রিঙের গতিতে চাপ দিয়ে দেখল।
‘ভারি সুন্দর তো। কত পড়ল?’
যার কাছে জানতে চাওয়া, সে ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছে তন্ময় হয়ে। কাজেই উত্তর এল আয়ার কাছ থেকে। ‘একশো চল্লিশ টাকার গাড়ি কিনলেন বেগম সায়েব। আমি বললাম, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে এই ছোট গাড়িটা নাও। তা উনি বললেন, একদম ছোট্ট চেয়ার বলে মনে হচ্ছে। তখন আমি বললাম, মাঝারি নাও চার কুড়ি টাকা দিয়ে। তা-ও উনার পছন্দ হল না। উনি বললেন, এতেও তো একটামাত্র বাচ্চা বসতে পারবে। দুটো হলে তখন তো দুজনে ঝগড়া বাধবে কি না, বলো। বড়টা জেদ করবে, ছোটটাকে মারতে যাবে, তখন? আমি বললাম, তা ঠিক বলেছ বেগম সায়েব। তার পর, উনি বললেন, বড় দেখে নাও, যেন একসঙ্গে দু-তিনটে বেবি বসতে পারে।’
গুড্ডু প্রথমে অবাক হল। তার পর, সামলে নিয়ে হাসবার চেষ্টা করল। তার পর, ফিফিক্ করে হেসে ফেলল। তার পর, হঠাৎ বিকট জোরে অট্টহাসি জুড়ে দিল ছাদ ফাটিয়ে।
সংযুক্ত কায়দায় বেবিকে দুধ খাওয়াচ্ছিল বেগম। গুড্ডুকে এই প্রথম তার এত অনবদ্য, এত প্রিয়, এত খাঁটি বলে মনে হল –নীল সমুদ্রের কিনারায় একঝাঁক সাদা ফেনার মতো শুভ্র, পবিত্র।
অনুবাদ : নেওয়ামাল বাসির