৪. রণারঘাট
গঙ্গার এক উপনদী চূর্ণীর কিনারে আর একটি জনপদ গড়ে উঠেছিল। সেখানে ছিল,অনেক আগেকার কালে অবশ্য—এক দস্যু সর্দার। তার নাম রণা-ডাকাত। তার প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী কালীর ‘থানে’ নাকি সেকালে নরবলি হত। সেই’রণার ঘাঁটি’ থেকে পরে জনপদটার নাম হয় : রানাঘাট।
এসব অবশ্য গালগল্প। শহরের ক্রোশ দুই দূরে চূর্ণীনদীর দুইতীরে ছিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত দুটি নদীনিবাস—হরধাম-আনন্দধাম। কে জানে যমুনার দুই পারে কৃষ্ণতাজ ও শুভ্রতাজ গড়ার শাহজাহানী খোয়াবে সে দুটি নির্মিত হয়েছিল কিনা। তার ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি আছে নদীয়ারাজ প্রতিষ্ঠিত : চিন্ময়ী কালী।
রানাঘাট হচ্ছে বিখ্যাত জমিদার বংশ পালচৌধুরীদের আদি নিবাস। আলোচ্য শতাব্দীর মাঝামাঝি ঐ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কৃষ্ণকান্তি পাল। তাঁর নামটা স্মরণ করছি একটি বিশেষ হেতুতে। পলাশী যুদ্ধের পরে ওয়ারেন হেস্টিংস্ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করতে চান। স্বাদেশিকতার প্রভাবে অনেকেই পরবর্তীকালে ইংরাজের দেওয়া খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। যতদূর জানি, কৃষ্ণকান্তি মহাশয়ই বোধহয় সেই জাত্যাভিমানীদলের প্রথমসূরী। তিনি বিদেশী বেনিয়াদের দেওয়া সেই খেতাবটি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। সে-সংবাদে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ৰ—হ্যাঁ, ততদিনে তিনি নিজে আর ‘রাজা’ নন, ‘মহারাজা’—ওঁকে ‘পাল-চৌধুরী’ উপাধি প্রদান করেন। সেই অবধি ওঁরা ‘পালচৌধুরী।
রানাঘাটের সাড়ে-চার ক্রোশ দূরে ‘দেগার ঢিবি’ একটি প্রাচীন জনপদ। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে দেগার দে-পাল রাজার উল্লেখ আছে; তিনি ছিলেন কুম্ভকার শ্রেণীর এক ভূস্বামী। পরে এই জায়গাটি গভীর জঙ্গলে ঢেকে যায়। এখন অবশ্য বনজঙ্গল সাফা করে জনবনতি হয়েছে। যাঁরা নতুন করে বাড়ি বানাতে চান তাঁরা বনিয়াদ খুঁড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে অপরূপ কারুকার্য-করা পোড়ামাটির টালি উদ্ধার করে অবাক হয়ে যান—এ জিনিস কোথা থেকে এল?
ঐ দে-পাল বা দেবপালের নামে একটি লোকগাথা আজও শোনা যায়।
একবার স্থানীয় মুসলমান শাসনকর্তার সঙ্গে রাজা দেবপালের মনোমালিন্য হয়। দু-পক্ষই দিল্লীতে বাদশাহের কাছে দরবার করতে যান। যাত্রাসময়ে দেবপাল দুটি সুশিক্ষিত পারাবত সঙ্গে নিয়ে যান। একটি শুভ্রবর্ণের, একটি কৃষ্ণবর্ণের—তাদের নাম জয় ও বিজয়। স্বীয় মহিষীকে এই নির্দেশ দিয়ে যান যে, যদি তিনি মামলায় জয়লাভ করেন তাহলে শুভ্রবর্ণের ‘জয়’কে আকাশে ছেড়ে দেবেন। সে দ্রুতগতিতে ফিরে এসে রানীমাকে শুভবার্তা জ্ঞাপন করবে। আর যদি সংবাদ অশুভ হয় তাহলে তিনি কৃষ্ণবর্ণের ‘বিজয়’কে উন্মুক্ত করে দেবেন। সে-ক্ষেত্রে স্থানীয় মুসলমান শাসনকর্তার অত্যাচার অনিবার্য হয়ে পড়বে। গঙ্গা বেয়ে রাজামশায়ের প্রত্যাবর্তনের জন্য দু-তিন মাস সময় লাগবে। প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলমান শাসনকর্তা সেই সুযোগে তাঁর রাজ্য আক্রমণ করতে পারে। রানী সব শুনে বলেছিলেন, আপনি চিন্তা করবেন না, সে-ক্ষেত্রে আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য আমি যথাকর্তব্য করব।
কাহিনীটি করুণ। দিল্লীর বাদশাহ্ দেবপালের অনুকূলেই রায় দিলেন। মহারাজ মামলা জিতে তাঁর দিল্লীস্থ শিবিরে ফিরে এসে জয়কে বন্ধনমুক্ত করতে গিয়ে দেখেন যে, পিঞ্জরে দ্বিতীয় পারাবতটি অনুপস্থিত। তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারলেন, তাঁর একান্ত সহচর তথা দেহরক্ষীটিও পলাতক।
মুসলমান শাসনকর্তার পক্ষে মামলা পরিচালিত করতে যে লোকটি দিল্লী গিয়েছিল সে ছিল খলিফা। দেবপালের দেহরক্ষীকে উৎকোচে বশীভূত করে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে।
দেবপাল তাঁর শুভ্রবর্ণের পারাবতটিকে তৎক্ষণাৎ আকাশে উড়িয়ে দিলেন।
জয় ও বিজয় দুজনেই অত্যন্ত দ্রুতগতি সংবাদবহ। সমান ব্যবধানে তারা একের পর এক এসে উপস্থিত হল রণার ঘাঁটির উপকণ্ঠে সেই দেগার ঢিবিতে। কালীক ব্যবধান তিনদণ্ডের আড়াই শ যোজন, অর্থাৎ প্রায় দুই হাজার মাইল পথ উড়ে এসে শুভ্রবর্ণের জয় দেখল রাজপ্রসাদ শোকে আচ্ছন্ন। প্রায় অর্ধদণ্ড পূর্বে রাজমহিষীর মৃতদেহ অন্তঃপুরস্থ পুষ্করিণী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সে দেহ এখনো সৎকার করা হয়নি। নিদারুণ শোকে প্রাসাদে সকলেই নিমজ্জমান। শুধু কার্নিশে নিঃঝুম বসে আছে তার সঙ্গী, বিজয়। ক্লান্ততনু, বিষণ্ণ, বকবক করতেও ভুলে গেছে। সে যেন বুঝে উঠতে পারছে না : এত জোরে উড়ে এসেও সে যেন মালকিনকে খুশি করতে পারেনি!
দেবপাল দুইমাস পরে নৌকাযোগে ফিরে এলেন প্রাসাদে। নিদারুণ সংবাদে তিনিও আত্মঘাতী হলেন। মুসলমান শাসনকর্তা এবার নির্বিবাদে দখল করে নিল রাজপ্রাসাদ।
কাহিনীতে শুধু দুটি তথ্য অনুক্ত। দেবপালের সেই দেহরক্ষীকেই কি বিজয়দর্শী মুসলমান পরস্বাপহারক ঐ রাজার সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল? এবং সেই লোকটাই কি ছিল মীরজাফর আলী খাঁর গুরু-মুর্শেদ?
দেগাঁর ঢিবির অনতিদূরে চৌবেড়িয়া গাঁয়ের নাম শুনেছ? সেই গাঁয়ের এক দুরন্ত দামাল ছেলে কী-একটা নাটক বুঝি লিখেছিল, যার ইংরেজী অনুবাদ করে যশোরের সাগরদাঁড়ি গাঁয়ের সেই জাত-খোয়ানো কবিটা, আর তার প্রায়শ্চিত্ত করতে ‘লঙ-এর হল কারাগার’!
এই চৌবেড়িয়া গাঁয়ের মাঝখানে ছিল এক দুর্ভেদ্য দুর্গ—তার চারিদিকেই যমুনা নদীর পরিখা, তাই তার নাম ‘চতুর্বেষ্টিত দুর্গ’। সেই দুর্গের দুর্গাধিপ ছিলেন কাশীনাথ রায়। পাঠান-বিজয়ে মোগল বাহিনীকে সাহায্য করায় যিনি সম্রাট আকবরের কাছ থেকে ‘সমরসিংহ’ উপাধি লাভ করেন। এত কথা বলছি, কারণ ‘নীলদর্পণে’র মতো এই চতুর্বেষ্টিত দুর্গের সঙ্গেও বাংলাসাহিত্যের একটি অচ্ছেদ্যবন্ধন ঘটেছিল পরবর্তী জমানায়। এই দুর্গটিই রমেশচন্দ্র দত্তের ঐতিহাসিক কাহিনীর পটভূমি : ‘বঙ্গবিজেতা’।
দুর্গটি বর্তমানে সম্পূর্ণ নদীগর্ভে। উপন্যাসটি কিন্তু সগৌরবে টিকে আছে বিভিন্ন বঙ্গসাহিত্য-প্রেমিকের সঞ্চয়ে।