৪ আগস্ট, বুধবার ১৯৭১
আজকাল দিনরাতগুলো একেবারে ঠাসা–ঘটনা দিয়ে, মেহমান দিয়ে, নানারকম পিলে-চমকানো শব্দ দিয়ে। ঐ পিলে-চমকানো শব্দগুলো কানে না এলে আমাদের ভালোই লাগে না। রাতে ঐ শব্দ শুনলে তবে আমাদের আরামে ঘুম আসে। এটা শুধু আমার কথা নয়। দাদাভাই বলেন একথা, মোর্তুজা বলেন একথা, বাঁকা বলেন, ফকির বলেন, পরিচিত বন্ধুবান্ধব অনেকেই হাসতে হাসতে বলেন, ভ্যালিয়ামের বিক্রি কমে গেছে। ঐ শব্দই আজকাল চমৎকার ঘুম আনে।
কোন রাতে ঐ শব্দ না শুনতে পেলেই বরং আতঙ্ক জাগে–তবে কি ওরা—
না, ওরা ধরা পড়ে নি। সন্ধ্যারাতে যদি কোন কারণে মিস যায়, তো মাঝরাতে হঠাৎবু-মমম্ করে বিরাট এক শব্দ চারদিক কাঁপিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন স্নায়ুতে আরামের স্নিগ্ধ প্রবাহ বইয়ে দেয়।
ঢাকায় বিন্দুদের কাজ-কারবার ক্রমেই দুঃসাহসিক হয়ে উঠছে। এই তো গতকাল সন্ধ্যার আগে দিয়ে স্টেট ব্যাঙ্কের গেটে, মিলিটারি পুলিশের নাকের ডগায়, পথচারীদের চোখের সামনে, কয়েকজন বিচ্ছু বোমা ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে। একটাকেও ধরতে পারে নি মিলিটারিরা। ছেলেগুলোর জানের ভয় বলতে কিছু নেই। গ্রেনেডের মতই জানটাকেও হাতের মুঠোয় নিয়ে চলে ওরা। স্বাধীন বাংলা বেতারে শুনি যুদ্ধক্ষেত্রে যারা যুদ্ধ করছে, তারাও এমনি অসম সাহসী। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী–জানের কোন পরওয়া নেই, জীবন-মৃত্যু, সত্যি সত্যিই ওদের পায়ের ভৃত্য।
স্বাধীন বাংলা বেতারে গান বাজছে :
তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে।
আমরা কজন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে রে।
জীবন কাটে যুদ্ধ করি
প্রাণের মায়া সাঙ্গ করি
জীবনের সাধ নাহি পাই।।
ঘরবাড়ির ঠিকানা নাই
দিন-রাত্রি জানা নাই।
চলার ঠিকানা সঠিক নাই।।
জানি শুধু চলতে হবে
এ তরী বাইতে হবে
আমি যে সাগর মাঝি রে।।
ঘরবাড়ির ঠিকানাবিহীন, দিন্ রাত্রির বোধবিহীন, অথই সাগরে দিচিহ্নহীন জানবাজ ঐ নবীন মাঝিদের কথা মনে করে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম।