ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
নরেন্দ্রের গান — ঠাকুরের ভাবাবেশে নৃত্য
রথাগ্রে কীর্তন ও নৃত্যের পর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে আসিয়া বসিয়াছেন। মণি প্রভৃতি ভক্তেরা তাঁহার পদসেবা করিতেছেন।
নরেন্দ্র ভাবে পূর্ণ হইয়া তানপুরা লইয়া আবার গান গাহিতেছেন:
(১) এসো মা এসো মা, ও হৃদয়-রমা, পরাণ-পুতলী গো,
হৃদয়-আসনে, হও মা আসীন, নিরখি তোমারে গো।
(২) মা ত্বং হি তারা, তুমি ত্রিগুণধরা পরাৎপরা।
আমি জানি গো ও দীন-দয়াময়ী, তুমি দুর্গমেতে দুখহারা ৷৷
তুমি সন্ধ্যা তুমি গায়ত্রী, তুমি জগদ্ধাত্রী গো মা।
তুমি অকূলের ত্রাণকর্ত্রী, সদাশিবের মনোরমা ৷৷
তুমি জলে, তুমি স্থলে, তুমি আদ্যমূলে গো মা।
তুমি সর্বঘটে অর্ঘপুটে, সাকার আকার নিরাকারা ৷৷
(৩) তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
এ-সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা ৷৷
একজন ভক্ত নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, তুমি ওই গানটা গাইবে? —
অন্তরে জাগিছো গো মা অন্তরযামিনী!
শ্রীরামকৃষ্ণ — দূর! এখন ও-সব গান কি! এখন আনন্দের গান — ‘শ্যামা সুধা-তরঙ্গিণী।’
নরেন্দ্র গাইতেছেন:
কখন কি রঙ্গে থাক মা, শ্যামা, সুধা-তরঙ্গিনী!
তুমি রঙ্গে ভঙ্গে অপাঙ্গে অনঙ্গে ভঙ্গ দাও জননী ৷৷
ভাবোন্মত্ত হইয়া নরেন্দ্র বারবার গাইতে লাগিলেন:
কভু কমলে কমলে থাকো মা পূর্ণব্রহ্মসনাতনী।
ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছেন, — ও গাইতেছেন, ওমা পূর্ণব্রহ্মসনাতনী! অনেকক্ষণ নৃত্যের পর ঠাকুর আবার আসন গ্রহণ করিলেন। নরেন্দ্র ভাবাবিষ্ট হইয়া সাশ্রুনয়নে গান গাহিতেছেন দেখিয়া ঠাকুর অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন।
রাত্রি প্রায় নয়টা হইবে, এখনও ভক্তসঙ্গে ঠাকুর বসিয়া আছেন।
আবার বৈষ্ণবচরণের গান শুনিতেছেন।
(১) শ্রীগৌরাঙ্গ সুন্দর নটবর তপত কাঞ্চন কায়।
(২) চিনিব কেমনে হে তোমায় (হরি)।
ওহে বঙ্কুরায়, ভুলে আছ মথুরায় ৷৷
হাতিচড়া জোড়াপরা, ভুলেছ কি ধেনুচরা
ব্রজের মাখন চুরি করা, মনে কিছু হয়।
রাত্রি দশটা-এগারটা। ভক্তেরা প্রণাম করিয়া বিদায় লইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, আর সব্বাই বাড়ি যাও — (নরেন্দ্র ও ছোট নরেনকে দেখাইয়া) এরা দুইজন থাকলেই হল! (গিরিশের প্রতি) তুমি কি বাড়ি গিয়ে খাবে? থাকো তো খানিক থাক। তামাক্! — ওহ বলরামের চাকরও তেমনি। ডেকে দেখ না — দেবে না। (সকলের হাস্য) কিন্তু তুমি তামাক খেয়ে যেও।
শ্রীযুক্ত গিরিশের সঙ্গে একটি চশমাপরা বন্ধু আসিয়াছেন। তিনি সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া চলিয়া গেলেন। ঠাকুর গিরিশকে বলিতেছেন, — “তোমাকে আর হরে প্যালাকে বলি, জোর করে কারুকে নিয়ে এসো না, — সময় না হলে হয় না।”
একটি ভক্ত প্রণাম করিলেন। সঙ্গে একটি ছেলে। ঠাকুর সস্নেহে কহিতেছেন — “তবে তুমি এসো — আবার উটি সঙ্গে।” নরেন্দ্র, ছোট নরেন, আর দু-একটি ভক্ত, আর একটু থাকিয়া বাটী ফিরিলেন।