এবার পোড়াদহের মেলায় কেষ্ট পালের মুখে থমথমে মেঘ, চোখে ঘোলাটে লাল অন্ধকার। মেলার আগের দিন মঙ্গলবার সন্ন্যাসী ঠাকুরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর কালো মুখে লাল চোখে সে চলে যায় বাড়ির দিকে এবং পরদিন মেলা না দেখে সারাটা দিন কাটায় বটতলায় ঠাকুরের বেদীর নিচে। তার প্রাণটা ধুকধুক করে : এভাবে হেলাফেলা করে আরাধনা হলে ঠাকুরের দৃষ্টি শুভ থাকে আর দ্রুততদিন? এভাবে পূজা হলে মানুষের ভক্তিই বা টেকে কদ্দিন?
মুকুন্দ সাহা তো ভাগলো পূজার আগে আগে, আর নায়েববাবুর দর্শন অনেক কষ্টে যদিও বা মিললো, সন্ন্যাসী ঠাকুরকে নিয়ে কথাবার্তা সে যা বললো নেহায়েৎ বামুনের ঘরে জন্ম হওয়ায় তার মাথায় বজ্রাঘাত হলো না; ছোটোজাতের মানুষ তারা, তাই শুনেই তাদের যা পাপ হলো তার প্রাচিত্তির কোনো শাস্ত্রে আছে কি-না সন্দেহ।
তা নায়েববাবুর আর কী? পরিবার তো ইনডিয়ায় রেখেই এসেছে, নিজেও চলে যাবে দুই এক বছরের মধ্যেই। ইনডিয়া গিয়ে তারা বড়ো বড়ো দেবদেবীর পূজা করবে প্রাণ ভরে। সেখানে কাশী বৃন্দাবন মথুরা, সেখানে কালীঘাট নদীয়া। জাগ্রত দেবদেবীর সেখানে লেখাজোকা নাই। কিন্তু তাদের গ্রামের এই সন্ন্যাসী ঠাকুরকেও যদি অসন্তুষ্ট করে রাখে তো তাদের হালটা হবে কী? মোসলমানদের কি আর বিশ্বাস করা যায়? একটু টাকা পয়সার মুখ দেখলে দুই পাতা পড়াশোনা করলে সন্ন্যাসী পূজায় এরা বাগড়া দিতে আসে। শরাফত মণ্ডল বলেছে, মেলায় তার আপত্তি নাই। কিন্তু পূজার জায়গায়, বটতলায় মোসলমানদের আসা যাওয়া চলবে না। সে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে মোসলমানদের চলতে হবে পাক্কা শরিয়ত মোতাবেক। মেলার দিনে গোলাবাড়ি থেকে সন্ন্যাসীর থান পর্যন্ত এতকালের ঘোড়দৌড়টা সে একেবারে অনুমোদন করে না। কালাম মাঝি অবশ্য তার ওপর টেক্কা দিতে বড়ো বড়ো ঘোড়া আনতে চেয়েছিলো সেরপুরের পশ্চিমে খোন্দকারটোলা থেকে। ঘোড়া নাকি এসেও গিয়েছিলো গোটা পাঁচেক। কিন্তু মেলায় ঘোড়াদৌড়ে সওয়ারি তো সব আসে মাঝিপাড়া থেকে। এবার মেলার দিন ভোরবেলা মাঝিপাড়ার আদ্দেকের কোমরে দড়ি পড়লো। ঘোড়াদৌড় শেষ পর্যন্ত হলোই না। পাকুড়তলার মুনসি কি এটা সহ্য করবে? ঘোড়ায় করে ছুটে এসেছিলো তো মুনসির দলের সর্দার, মজনু শাহ, ভার বেশুমার ফকিরদের সঙ্গে ছিলো মুনসি। মানুষ সেই কথা ভুলে গেলে মুনসির অভিশাপ নেমে আসবে না?
পশ্চিমা সন্ন্যাসীও এবার এসেছে অনেক কম। মানতের গাঁজা ঠাকুরের থানের নিচে গড়াগড়ি যায়। কেষ্ট পাল পুরনো মানুষ, যতোটা পারে ধীরস্থির থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষটা খুব দমে গিয়েছে : বাবুদের ছায়া না পেলে ঠাকুর আর তুষ্ট থাকবে কতোদিন?
মেলা ভেঙে গেলে অনেক রাত্রে বৈকুণ্ঠ গিরি এসে বসে বটতলায় ঠাকুরের বেদীর নিচে। এ বছরেও ভোরবেলা ভবানী ঠাকুরের দর্শন তার ভাগ্যে জুটলো না। গতকাল রাতে, মেলার আগের দিন, পূজার বটতলা যখন পশ্চিমা সন্ন্যাসীতে, পূজায় আরাধনায়, গাজায়, আরতিতে, কামারে কুমারে, জোলায় কলুতে মাঝিতে গমগম করছে, বৈকুণ্ঠ তখন ফিরছিলো হাটের দোকানে। পরদিন ভোর থেকে মেলা, গোলাবাড়ি হাটের দোকানদারদের বেশিরভাগই আজ রাত কাটাবে পোড়াদহ মাঠে। কেষ্ট পালের ছোটভাই বিষ্ণু বলে, বৈকুণ্ঠ তুই হাটে যা। সাহার দোকান খালি না রাখাই ভালো। মানুষের লজর আছে ওই দোকানের উপরে। ঠাকুরের প্রসাদ কিছু নিয়ে এসেছিলো, তারই খানিকটা খেয়ে বৈকুণ্ঠ শুয়ে পড়ে। এমন সময় ফিসফিসে গলায় বৈকুণ্ঠদা শুনে দরজা খুলে দেখে * তমিজ। সন্ধ্যার পরপরই সে মাঝিপাড়া থেকে পালিয়ে এসে লুকিয়ে ছিলো হাটের কাছেই মুচিপাড়ার পাশে এক ঝোপের ভেতর। রাত হলে গোলাবাড়ি হাটে এসে দেখে কেউ নাই।
তার বিবরণ শেষ করতে না দিয়ে বৈকুণ্ঠ বলে, শুনিছি। মেলার মাঠেত সবই তো শুনলাম। আয় ঘরত আয়।
বাঁ হাতের কনুই তমিজের অসম্ভব ফুলে উঠেছে। পিঠের খোঁচাটা তেমন নয়। দিনমান না খেয়ে ছোঁড়াটা কাবু হয়ে গেছে। বৈকুণ্ঠ তাকে পূজার প্রসাদ দিলে সে গল্প গপ করে খায়। কিন্তু একটুখানি খেয়েই নেতিয়ে পড়ে মুকুন্দ সাহার গদির ওপর। তারপর কোঁকাতে থাকলে তার গায়ে হাত দিয়ে বৈকুণ্ঠ দেখে তার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। বৈকুণ্ঠ কী আর করে, টিউবওয়েল থেকে পানি এনে সারারাত ধরে তমিজের মাথায় জলপট্টি দেয়। ভোর হওয়ার অনেক আগেই মুকুন্দ সাহার দোকানের দরজায় আস্তে আস্তে আওয়াজ হলে বৈকুণ্ঠ ফিসফিস করে বলে, পুলিস। তমিজ তার হাত ধরে থাকে। একটু পর বৈকুণ্ঠ বেরুবে ঠাকুরকে দেখার আশায়। এই সময় রাতভর বেজাতের মানুষের সঙ্গে হাত ঘষাঘষি কি কি হচ্ছে? কিন্তু উপায় কী? তমিজকে পুলিসে ধরলে ছোঁড়াটার ওপর কী জুলুমটা যে করবে!
ওদিকে দরজায় আস্তে আস্তে ধাক্কার সঙ্গে শোনা যায় এই বৈকুণ্ঠ। এই বৈকুণ্ঠ।
দোকানের শেষ মাথায় মরিচের বস্তার আড়ালে তমিজকে তুলে নিয়ে বৈকুণ্ঠ তাকে, শুইয়ে দেয় মেঝের ওপর। তারপর ফিরে দরজা খুলতেই গফুর কলু ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে ফিসফিস করে বলে, তমিজেক বার কর্যা দে। পুলিস মাঝিপাড়ার দিকে যাচ্ছে। তমিজ এক লম্বর আসামী।
তমিজ কোটে? বৈকুণ্ঠের এই কথায় গফুর রাগ করে, তমিজ তোর এটি ধরা পড়লে পুলিস তোক বত্তাই জবো করবি। কালামের বেটা খবর দিছে আমতলি থানাত। এই দোকানঘর থ্যাকা তোক সরাবার পারলে কালাম মাঝির আর কোনো কাঁটা থাকে না। বলতে বলতে সে নিজেই চলে যায় দোকানঘরের শেষ প্রান্তে এবং মরিচের বস্তার ওপার থেকে তমিজকে ধরে দাঁড় করায়। তোর বরাত! তার সৌভাগ্যের ব্যাখ্যাটা হলো এইরকম : কাদের কিছুক্ষণ আগে গফুরকে খবর দিয়েছে, তমিজ যেন মিছেমিছি পালাবার চেষ্টা না করে। তমিজকে পেলে গফুর নিজেই যেন তাকে নিয়ে চলে যায়। টাউনে, টাউনে কাদেরের বাসায় রেখে আসে। মেলায় কাদেরের বন্ধুদের নিয়ে আসতে গফুরের এমনিতেই তো টাউনে যাবার কথা, ঐ সময় তমিজকে সে যেন সঙ্গে নেয়। চল, হামি তো সাইকেলেত যামু, তুই ভালো করা আলোয়ান গাওত দিয়া নে। ভয় করিস না। পুলিস তো আসিচ্ছে পুব থ্যাকা, হামরা যামু টাউনের দিকে। চল।
বৈকুণ্ঠের খালি আফসোস হয়, ছোঁড়াটাকে নিয়ে আগেই সে টাউনের দিকে ভাগলো কেন? তমিজ তার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। গফুর কলুকে সে ভয় পাচ্ছে? গফুর কি তাকে নিয়ে কাদেরের টাউনের বাসায় যাবে, না পুলিসের হাতে তুলে দেবে? কাদেরের মতলবটাই বা কী? তমিজকে দিয়ে সে কি মাঝিপাড়ার মানুষকে খেপিয়ে তুলবে কালাম মাঝির বিরুদ্ধে? কালামকে তো সে সহ্যই করতে পারে না। বৈকুণ্ঠ এখন করে কী?
গফুর বিরক্ত হয়, এই শালা মাঝির জাত, ইগলানেক ভালো করবার গেলেও দোষ হয়। থাক শালা এটি থাক। হিন্দুই হোর লিজের মানুষ হলো? শালা হিন্দুটাকও তো মারবু রে।
তমিজ বৈকুণ্ঠকে জড়িয়ে ধরলে সে আস্তে করে বলে, তমিজ, তুই যা, কাদের ভাইয়ের মেলা ক্ষমতা।
তমিজ গফুরের সঙ্গে টলতে টলতে হাঁটে। দরজা পেরোবার সময় সে বৈকুণ্ঠের দিকে একবার তাকায় তার তপ্ত ও লাল দুই চোখ ভরে। বৈকুণ্ঠের মাথাটা দপ করে ওঠে : তমিজের বাপ যেন চেরাগ আলির দিকে তাকিয়ে কারো কোনো দুঃস্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনছে।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে গফুর ভেতরে তাকিয়ে দরজা ভালো করে বন্ধ করার ইশারা দেয়। তমিজ কিন্তু আর একবারো ফিরে তাকায় না।
দেখতে দেখতে রোদ উঠে গেলো। এবারও বৈকুণ্ঠের ঠাকুর দর্শন হলো না। এবার বরং ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হওয়ার দরকারটা ছিলো বেশি। বৈকুণ্ঠ যদি রাত থাকতেই তমিজকে নিয়ে মোষের দিঘির পাড়ে চলে যেতো! বৈকুণ্ঠ তো একরকম ধাক্কা দিয়েই তাকে বার করে দিলো। তমিজকে দেখে মনে হচ্ছিলো, এক পুলিসের হাত থেকে বাঁচাতে তাকে যেন ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আরেক পুলিসের কবজায়। তমিজকে নিয়ে বৈকুণ্ঠ যদি মোষের দিঘির ওপর থেকে সন্ন্যাসী ঠাকুরের দর্শন একবার পায় তো ঠাকুরই তাকে বুকে টেনে নিতো। তমিজের বাপের বেটা কি রাগ করে গেলো তার ওপর? ঘর থেকে বেরিয়ে একবারও ফিরে তাকালো না কেন?
মেলার পর মানুষজন চলে গেছে। কিছু কিছু দোকানের ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছে দোকানদাররা। আলো জ্বলে নটিপট্টিতে। আর এখানে সন্ন্যাসীর বেদি ঘেঁষে বটগাছের নিচে পশ্চিমা সন্ন্যাসী শুয়ে রয়েছে জনা ছয়েক। আর যারা এসেছিলো তারা কেটে পড়েছে। এই ছয়জন ঘুমিয়ে থাকে চারটে কম্বলের নিচে। সন্ন্যাসীরা নিজ নিজ নাভিমূল থেকে ব্রহ্মাকে টেনে হিচড়ে বার করে দিচ্ছে যার যার নাক দিয়ে। একেকজনের নাক ডাকার একেকরকম আওয়াজ বৈকুণ্ঠের কানে বড়ো এলোমোলো ঠেকছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই গোলমেলে ধ্বনিতে একরকম বিন্যাস তৈরি হয়। ভবানী পাঠকের আশীর্বাদে ওই আওয়াজ থেকে নাক ডাকার শব্দ আড়ালে চলে যায়। অচেনা তাল ও লয়ের বাজনা। শুনে বৈকুণ্ঠ বোঝে, এখনি শুরু হবে চেরাগ আলি ফকিরের গান। ঠাকুরের থানে মাথা রেখে সে জিগ্যেস করে, একেবারে নতুন কিসিমের গান বান্ধিছছা ফকির?
মনুষ্যের কী সাধ্য এই সংগীত রচনা করে?-এরকম কঠিন সমস্কৃত কথা চেরাগ আলির জিভে আসবে কী করে?—চমকে উঠে এবং খানিকটা ভয় পেয়েও বটে, বৈকুণ্ঠনাথ গিরি ধোয়া ও উৎকণ্ঠা, নেশা ও উদ্বেগ এবং ভয়ে ও উত্তেজনায় ভারী মুণ্ডু ওপরে তুলে দেখে, তার নয়নের সুমুখে জটাশির, বিভূতিমণ্ডিত ও ঊধ্ববাহু সন্ন্যাসীর বিশাল মূর্তি। সন্ন্যাসীর হাতের ত্রিশূলের তিনটে কাঁটা কুয়াশা ফুড়ে ঢুকে গেছে আকাশের খোপের ভেতর। কাঁটার আঁকশি তিনটেতেই আলো জ্বলে, তিনটেতেই মাছের নকশা জ্বলে জ্বল জ্বল করে। ত্রিশূল দিয়ে সন্ন্যাসী ঠাকুর বিজলি শিকার করবে নাকি? এই মাছের নকশা সন্ন্যাসী কি চেয়ে নিয়েছে মুনসির পাণ্টি থেকে? না-কি মুনসিই ত্রিশূল থেকে একটি এনে বসিয়ে দিয়েছে তার পাণ্টির মাথায়? মাছ কেন? বিজলির কি মাছের লালচ একটু বেশি যে তাকে ধরতে মাছের টোপ লাগাতে হয়? সন্ন্যাসীর মস্ত মাথা নিজের মাথায় নিয়ে বটগাছ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পোড়াদহের মাঠ জুড়ে। বৈকুণ্ঠনাথ চোখ বুজলে তার কানে বেজে ওঠে : সুখনিদ্রাপরিত্যাজে জাগো মৃগরাজতেজে
মীন জাগে তরু জাগে জাগো গিরিগণ।
তোমরা সুপ্ত শয্যাপরি গৃহে প্রবেশিল অরি
বান্ধিল শৃঙ্খলে তোমরা ড্রিাতে মগন।
ভবানী হুঙ্কারে জাগো জাগো গিরিগণ।।
বৈকুণ্ঠের সারা শরীর কাঁপে থরথর করে, এই শাস্তর তো চেরাগ আলির নয়। এরকম শক্ত শক্ত কথা চেরাগ আলির পেটে যদি কোনোদিন থেকেও থাকে তো তার গলা পর্যন্ত আসতে না আসতে তা গলে গেছে, জিভে চড়ার বল তার হয় নি। চেরাগ আলির গলা ভারি, কিন্তু নদীর পানিতে, পানির বাতাসে আর বাতাসের হিমে ও তাপে সেই স্বরে ভাঙনের চিহ্ন, চিড় খাওয়ার দাগ। সেখানে বিজলির এরকম রাগী গর্জন নাই। এই গর্জন আসছে বটগাছের অনেক ওপর থেকে। বটগাছের নিচে দাঁড়ালে বৈকুণ্ঠ টের পায়, সন্ন্যাসীর গান হুঙ্কার দিতে দিতে চলে যাচ্ছে উত্তর পশ্চিমে। এই গানের নিচে নিচে সে চলতে শুরু করে।
হাঁটার জন্যে দুই পা ফেলতে পায়ের নিচে পড়ে বটফল, হাঁটুতে আর কোমরে ঠেকে বটগাছের কচি চারা। একটা দুইটা তিনটা চারা। বটগাছের কচি চারা গায়ে লাগলে তাঁর সর্বাঙ্গ শিরশির করে। ঐ পাতার ছোঁয়া কাটাতে এবং ঐ পাতাওয়ালা চারা থেকে বল পেতেও বটে, বৈকুণ্ঠ তার হাঁটুসমান একটা বটের চারা উপড়ে নেয় বেশ জোরে টান দিয়ে। না, এই অন্ধকার কুয়াশার রাতে খালি হাতে সে যাত্রা করে কীভাবে?
বটতলা থেকে পোড়াদহ মাঠ পেরিয়ে গান এখন উড়াল দিচ্ছে উত্তর পশ্চিমে। বাঙালি নদীর রোগা স্রোতের ওপর দিয়ে গান ওড়ে, বাঙালির স্রোতে তার ছায়া ফেলে, তার বিনিময়ে গান তার ডানায় মেখে নেয় কুলুকুলু বোল। কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়তলা থেকে গানের প্রতিধ্বনি ফিরে আসে, ফেরার সময় তার পাখায় লাগে পাকুড়গাছের ঝিরিঝিরি কথা আর বিলের ঢেউ আর বাঙালি নদীর স্রোতের ভিজে হাওয়া :
জাগো কাতারে কাতারে গিরিরডাঙা কাৎলাহারে
জোট বান্দো দেখো টেকে কয়টা দুষমন।
জোট বান্দো ভাঙো হাতের শিকল ঝন ঝন।
শিকল মিলায় রৌদ্রে শিশির যেমন।।
এই তো মুনসির গান, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, হাওয়ায় হালকা হয়ে ঝরে পড়ছে চেরাগ আলির ভাঙাচোরা ভারি গলায়। কালাহার বিলের রুই কালা, পাবদা ট্যাংরা, শিঙি মাগুর খলসে পুঁটির আঁশটে গন্ধে, ভেড়ার আদলে জেগে-ওঠা গজারের ভেড়ার লোমের বোটকা গন্ধে ম ম করতে করতে চেরাগ আলির গলায় মুনসির গান বারবার ধাক্কা দিচ্ছে বটগাছের নিচে, সন্ন্যাসীর থানে। আর দেরি করা যায় না। তমিজটা কাদেরের হাতে ধরা দিতে গফুরের সঙ্গে রওনা হয়ে বৈকুণ্ঠের দিকে একবারো ফিরে তাকালো না। ছোঁড়াটা তার কাছে ঠাঁই চেয়েও না পেয়ে কী অভিমানটাই করে গেলো গো। বেটার কষ্টে চোরাবালির ভেতরে বাপটা তার না জানি কী ছটফট করে মরছে।–তমিজের বাপের পাশে একবার বসা দরকার। চোরাবালির দিকে যাবার জন্যে বটের চারা হাতে লম্বা লম্বা কদম ফেলে চলে বৈকুণ্ঠ।