ও মা, তুই কত বড় হয়ে গেছিস, একদম লেডি। বলতে বলতে একহাতে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন রমলা সেন যে দীপার কান লাল হয়ে গেল। সে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে বলল, বাঃ, চিরকাল ছোট থাকব নাকি?
রমলা সেন যেন কথাগুলো শুনলেনই না। দীপাকে বুকে টেনে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলে যাচ্ছিলেন, কিতদিন বাদে তোকে দেখলাম। সত্যি, ভাবতেই পারিনি তোকে এভাবে দেখতে পাব। কি মিষ্টি দেখতে হয়েছিস তুই।
কথাগুলো মোটেই নিচু গলায় ছিল না। ফুটপাতে যাতায়াত করা মানুষজন, হকাররা তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকাচ্ছে। যেন মজার দৃশ্য দেখছে সবাই। কোনমতে রমলা সেনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দীপা বলল, আপনি এখানে?
বাজার করতে এসেছিলাম। এদিকে তো বেশী আসি না। তাই গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, ভাগ্যিস এলাম। তাই তোকে দেখতে পেলাম। তুই করে কলকাতায় এলি?
অনেকদিন। কলেজে পড়ছি।
তাই নাকি? কি ভাল। কোন কলেজ?
স্কটিশ চার্চ। হোস্টেলে থাকি।
ও, তাই কলেজ ফাঁকি দিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?
বয়ফ্রেন্ড?
ওই যে, একটা ছোকরা আমাকে দেখামাত্র পালিয়ে গেল।
ও শমিত। বয়ফ্রেন্ড হতে যাবে কেন?
আরে ছেলেবন্ধু তো বাবা। কোন ইয়ার?
এবার ফাইন্যাল।
এদিকে সরে আয়, এখানে বড় লোক যাচ্ছে, হাত ধরে টেনে একপাশে সরিয়ে এনে জিজ্ঞাসা করলেন, রমলা সেন, বাবা মা কেমন আছেন?
বাবা নেই। হার্ট অ্যাটাকে–!
সেকি। কবে?
একবছর হয়নি।
বেশী বয়স তো নয়। আহা, মানুষটার কথা কোনদিন ভুলব না। আমি। ইস্। মনে আছে, জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ি খারাপ হলে ওঁর সাইকেলে চেপে তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। নিয়ে তো গিয়েছিলেন অত রাত্রে। তুই অবশ্য তখন এই এতটুকুনি ছিলি। হাত দিয়ে নিজের হাঁটুর মাপ দেখালেন তিনি।
অসম্ভব! আমার সব কথা মনে আছে।
মনে আছে?
স্পষ্ট।
রমলা সেন একটু উদাস হলেন, কি সব দিন ছিল রে। কি ডানপিটে মেয়ে ছিলাম তখন। একেই বলে বয়স, বুঝলি। চল তুই আমার সঙ্গে।
কোথায়?
বললাম না বাজার করতে বেরিয়েছি! রমলা সেন ওর হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন। ধর্মতলার মোড়ের বাস ট্রাম গাড়ির স্রোতে একটু ভয় পেয়েই দীপা বলল, হাত ছাড়ুন নইলে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে।
রমলা সেন হাত ছাড়লেন। চালচলুন, কথাবার্তায় রমলা সেন আর আগের মত নেই। ছটফটানি এমনভাবে আগে ছিল না। তার চেয়ে বড় কথা ইনি বিয়ে করেছেন। সেই রমলা সেন যিনি বাংলাদেশের সমাজকে অস্বীকার করে বন্ধুর সঙ্গে বাস করতে ইচ্ছুক ছিলেন বলে একসময় দীপার মনে বিভ্ৰম এসেছিল। সে কৌতূহল চেপে না রেখে বলল, আপনি বিয়ে করেছেন?
হ্যাঁরে, করে ফেললাম। এখন তো আর বাচ্চাকাচ্চা হবার ঝামেলা নেই। যেন এটাই বিয়ে করার একমাত্র যুক্তি এমন গলায় কথাগুলো বললেন তিনি। হাঁ হয়ে গেল দীপা। যে রমলা সেন নারী স্বাধীনতার কথা বলতেন, যিনি মনের চারপাশে চাপানো বেড়ায় বিশ্বাস করতেন না, সেই রমলা সেন বলছেন বাচ্চা হবার সময় পেরিয়ে গিয়েছে বলে বিয়ে করলেন। দীপার রাগ হল। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার বুঝি বাচ্চাকাচ্চা একদম ভাল লাগে না?
কে বলেছে? খুব ভালবাসি। বাচ্চা আর ফুল কে না ভালবাসে বলেই একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা নিউ মার্কেটটা এদিকে, না?
লোকটা মাথা নাড়লো। রমলা সেন হাঁটতে হাঁটতে মন্তব্য করলেন। কলকাতার রাস্তার মানুষ মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলেই কেমন বর্তে যায়। যত্তসব!
আপনি কি এখন কলকাতায়?
হ্যাঁ। ও তো এখানেই চাকরি করছে। আমিও এসেছি। ইন্টারভিউ দিতে। চাকরি হয়ে গেলে এখানেই পাকাপাকি থেকে যাব।
সেকি? আপনি বিয়ের পরেও শিলিগুড়িতে আছেন?
বিয়ের পর? দুর! বিয়ে তো হয়েছে। পরশুদিন। তারপর আর যাওয়ার সময় পেলাম কোথায়। ওহো, তোকে তো বলিইনি, আমরা পরশুদিন বিয়ে করলাম।
হনহানিয়ে হাটছিলেন রমলা সেন। তাজ্জব হয়ে গেল দীপা। সেই সঙ্গে মজাও লাগছিল, পরশু বিয়ে হলে আজ ফুলশয্যা হওয়া উচিত।
আর জ্বালাসনে। ফুলশয্যা! আমার ওসব আসে টাসে না। সই করলাম, বিয়ে হয়ে গেল, আর আমার কোন দায় নেই। তবে সকালে যখন মনে করিয়ে দিল তখন ভাবলাম আমার উচিত কিছু দেওয়া। ধুতি পাঞ্জাবি কিনেছি, বাকিগুলো মার্কেট থেকে কিনব। মুখে যাই বলুক স্বভাবে একদম ভেতো বাঙালি; বুঝলি?
দীপা সভয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, শিলিগুড়িতে যাকে দেখেছিলাম আপনার বাড়িতে–, মানে–।
সুধাময়?
হ্যাঁ, ওঁকেই বিয়ে করেছেন তো?
আর কাকে করব? ঘাড় থেকে নামলে তো! যখন আমার বন্ধুত্ব করার শখ ছিল তখন যা বলতাম তাই শুনতো। ইদানীং দেখছিলাম বাবু। উড়ু উড়ু করছেন। কথা বললে কানে যায় না। তাই বিয়ে করে ফেললাম।
এটা বিয়ে করার পক্ষে দ্বিতীয় যুক্তি। দীপার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। একজন ওই চরিত্রের মহিলা, যাঁকে সে একসময় আদর্শ করতে চেয়েছিল, তিনি এমন পাল্টে যান কি করে।
নিউ মার্কেটে ঢুকে রমলা সেন দাঁড়িয়ে গেলেন, দ্যাখ, দীপাবলী, এইসব দোকানপাট দেখলে মন খুব ছোট হয়ে যায়, বুঝলি!
কেন?
মনে হয় সব কিনে ফেলি। অথচ কেনার পয়সা নেই। কিছু লোকের পয়সা আছে, আমার নেই। তখনই ঈর্ষা হয় আর মনটা এইটুকুনি হয়ে যায়। রুমালে মুখ মুছলেন তিনি, সুধাময়টা কিন্তু লোক ভাল, কোন চাহিদা নেই।
এই একটু আগে অন্য কথা বললেন।
কি বললাম?
ওই আপনার কাছ থেকে চলে যেতে চাইছিলেন।
ওমা, কখন বললাম?
বললেন না উড়ু উড়ু স্বভাব হয়েছিল।
হ্যাঁ, তাই বলে চলে যেতে চাইছে বলেছি নাকি? ধম্মোকন্মে মন যাচ্ছিল। কোথাকার কোন গুরুদেবের পাল্লায় পড়েছিল। আমায় বলছিল দীক্ষা নিতে। আমারও দোষ, বাড়িতে যেমন কুকুর বেড়াল কিংবা গোপাল থাকে। আমিও ভেবেছিলাম ও তো আছেই। তলায় তলায় ঠাকুর দেবতা কিংবা গুরুদের প্রতি আকর্ষণ বাড়া মানে আমার ওপর টান কমে যাওয়া। সেটা হতে দের না বলেই বিয়ে করলাম।
কি বলবে বুঝতে পারল না দীপা।
রমলা সেন খোঁজ করে করে ছেলেদের আন্ডার গার্মেন্টদের দোকানে পৌঁছে বললেন, চারটি আন্ডারওয়ার আর চারটে গেঞ্জি দিন।
দীপা মনে মনে হোঁচট খেল। ফুলশয্যায় কোন স্ত্রী কি তার স্বামীকে এমন উপহার দেন। ও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না।
সেলসম্যান জিজ্ঞাসা করল, দিদি, সাইজটা বলুন।
সাইজ। চোখ বন্ধ করলেন রমলা সেন কিছুক্ষণ, তারপর চোখ খুলে বললেন, এই, তুই তো সুধাময়কে দেখেছিাস, কত সাইজ হবে বল তো?
দীপা চমকে উঠল। রমলা সেনের কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।
সে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দোকানের দিকে তাকাল, যেন কথাগুলো শোনেইনি। সেলসম্যান বলল, যার জন্যে কিনছেন তার বয়স কত বলুন আমি আন্দাজে সেপ বলছি।
বয়স বললে কিছু হবে না। রমলা সেন মাথা নাড়লেন। এই রোগা, ফিনফিনে কিন্তু বেশ লম্বু। মহা জ্বালা। ছেলেদের এসব জিনিস মেয়েরা কি কিনতে পারে?
দিদি, আমি আপনাকে কয়েকটা সাইজ দেখাচ্ছি, আপনি ঠিক করুন কোনটা নেবেন। প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে পছন্দ চলল। তারপর দাম মেটালেন রমলা সেন। দীপাকে বললেন, বড় হলে হবে, নিজে এসে পাল্টাবে, আমি আর আসতে পারব না। চল রে। ওদিকে যাই।
দীপা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। নিউ মার্কেটের সরু গলিতে হাঁটতে হাঁটতে রমলা সেন আবার থমকে দাঁড়ালেন, আয় এই দোকানে। জবারের অপেক্ষা না করে তিনি যেটায় ঢুকলেন সেটা শাড়ির দোকান। দীপা স্বস্তি পেল। এখানে অস্বস্তিকর কিছু ঘটবে না।
চারটে শাড়ি দেখলেন রমলা সেন। সেলসম্যান আরও ডজনখানেক নামাতে চাইছিল কিন্তু তিনি ধমক দিলেন, অত খাটতে কে বলেছে আপনাকে? পঞ্চাশটা শাড়ি দেখালে আমার মাথা ঠিক থাকবে? এই চারটের মধ্যেই নেব।
সেলসম্যান মিনমিন করল, মেয়েরা তো অনেক শাড়ি দেখতে চান!
কেনেন কটা?
একটা দুটো।
তাহলে বুঝুন, আপনি কেমন বোকা। ওদের সময়ের দাম নেই তাই এখানে এসে খেলা করে আর আপনি গদগদ হয়ে সেই খেলায় সাহায্য করেন। এই দীপা, এদিকে আয়, বল তো। এই চারটের মধ্যে কোন শাড়িটা ভাল।
আপনার জন্যে?
কার জন্যে তা নিয়ে তোর দরকার কি? ভাল তো সবসময় ভালই থাকবে।
দীপা চারটের মধ্যে একটার গায়ে হাত দিয়ে বলল, এইটে।
দাম মিটিয়ে প্যাকেট নিয়ে রমলা সেন বললেন, চল কোথাও বসে চা খাই। বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে। দীপা বলল, আপনার সঙ্গে যখন দেখা হল ঠিক তখনই আমরা চা খেয়ে বের হলাম।
একটা উটকো ছেলের সঙ্গে বসে তুই চা খেলি?
উটকো ছেলে।
নিশ্চয়ই। তোর বয়ফ্রেন্ড যখন নয়। তখন উটকো বটেই। শোন দীপা, এইসব ছেলেদের সঙ্গে একদম মিশবি না। তোর হোস্টেলটা কোথায় বল তো?
দীপা ঠিকানা দিল। বাস স্ট্যান্ট পর্যন্ত সঙ্গে এলেন রমলা সেন। এসে বললেন, এক রবিবার দেখে তোর ওখানে হাজির হব। ভালভাবে থাকবি। মন দিয়ে পড়াশুনা করবি। আর মতলববাজ ছেলেদের সঙ্গে একদম মিশবি না।
দীপা ঘাড় নেড়ে দেখল একটা দুনম্বর বাস আসছে। সে বলল, চলি।
আচ্ছা, এইটে ধর। তোর জন্যে নিয়েছি।
হাঁ হয়ে গেল শাড়ির প্যাকেটটা দেখে। রমলা সেন জোর করে সেটা ধরতে বাধ্য করলেন। দু নম্বর বাস ঠিক তখনই এসে দাঁড়াল পাশে। রমলা সেন বললেন, এটা আমাদের বিয়ের উপহার, তোকে। যা পালা। বলে নিজের বাস ধরতে হাঁটা শুরু করলেন।
লেডিস সিটি খালি ছিল। সিটে বসে হতভম্ব হয়ে রইল দীপা বেশ কিছুক্ষণ। রমলা সেন যে তার জন্যে শাড়ি কিনবেন তা সে একবারও বুঝতে পারেনি। তড়িঘড়িতে প্যাকেট গছিয়ে দিলেন। কিন্তু এখন তার একটুও ভাল লাগছে না। যে রমলা সেন তাকে একদা কিছু বই পাঠিয়েছিলেন সেই রমলা সেন এখন আর নেই। তখন বই নিতে ভাল লেগেছিল। কিন্তু এখন শাড়ি নিতে মন চাইছে না। উনি এমন বদলে গেলেন কি করে? দীপার মনে পড়ল কোথায় যেন সে পড়েছিল ঠিক সময়ে বিয়ে না হলে মেয়েরা বয়স চলে গেলে একটু অস্বাভাবিক হয়ে যায়। বিয়ে না হলেও ওঁর তো বন্ধু ছিল, প্রায় বিয়ের মতনই দীপা মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না। সে শাড়িটাকে আলতো করে ধরেছিল। যতই অন্যরকম হয়ে যান শাড়িটা দেবার সময় রমলা সেনের গলায় এবং মুখে একটা স্নিগ্ধ মেহ উপচে পড়ছিল। অনেক অনেকদিন সে তার স্পর্শ পায়নি। দেটানা বোধহয় সেই কারণেই।
একই সঙ্গে আই এ এস এবং গ্রাজুয়েশনের জন্যে তৈরী হল দীপা। নাটকের দলের সঙ্গে তার আর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। প্ৰথম কয়েকবার ওদের শো-এর সময়ে সে হাজির থেকে চলে এসেছে। শমিত মাঝে মাঝে আসে হোস্টেলে। দুচারটে কথা হয়, চলে যায়। কোনদিন সে হোস্টেটলে ফিরে শোনে শমিত এসেছিল। নিজে উদ্যোগ নিয়ে দেখা করতে যায় না সে। এই ঘটনাহীন নিস্তরঙ্গ মাসগুলোতে দীপা একদম একা। শুধু মাঝখানে রাধা আর তার দাদা এসেছিল সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে। এমন কি তার স্টোভ কড়াই পর্যন্ত। সেগুলোকে আপাতত দারোয়ানের ঘরে জমা রেখেছে সে। দীপা লক্ষ করেছে তার জীবনে যখন ঘটনা ঘটে না তখন ঘটেই না। কিন্তু ঘটলে অনেকগুলো একই সঙ্গে ঘটে যায়। তখন তার টাল সামলানো মুশকিল হয়ে ওঠে।
দুপুরের ডাকে চিঠি এল। খামে। হাতের লেখা অচেনা। কৌতূহলী হয়ে খুলে প্ৰথমে সম্বোধন দেখল, শ্রীদ্ধেয় বউঠান। চমকে উঠল। তড়িঘড়ি নিচের দিকে তাকাল। অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। চিঠিটা পড়ল সে।
শ্রদ্ধেয়া বউঠান। বিশেষ কারণে আপনাকে এই চিঠি লিখছি। প্ৰথমে আমার পরিচয় দেওয়া উচিত। আমি প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদার ছেলে যিনি রাজনীতি করতেন। যতদূর জানি আমার বাবাই আপনার বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন। আমার বাড়ি রায়কত পাড়ায়। বাবা গত বছর পরলোকগমন করেছেন। কিছুদিন আগে আমাদের পাড়ার একটি মেয়ে আমাকে আপনার কথা বলে। সে নাকি একসময়ে আপনার সহপাঠিনী ছিল। আপনি তাকে চিঠি লিখে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর করেছেন। জানি না কি কারণ কিন্তু মনে হল, আপনাকে চিঠি লেখা যায়। কাকাবাবুর মৃত্যুর দিনে আপনাকে শেষবার দেখেছিলাম। বিয়েতে আমি যাইনি, বউভাতে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাই আমাকে আপনার মনে রাখার কোন কারণ নেই।
যাই হোক, কাকাবাবুর বিষয় সম্পত্তি নিয়ে আমি কোনদিন আগ্রহী ছিলাম না। শুনেছি তিনি সোজা এবং বাঁকা পথে প্রচুর আয় করেছিলেন। কিন্তু সেগুলোর কি গতি হয়েছে তাও অজানা। লোকে বলে আপনাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ তিনি প্রচুর অর্থ দিয়েছেন, আপনার পরলোকগত পিতা সেই অর্থ নিয়েছেন, এ ব্যাপারেও কোন সত্যতা আমার জানা নেই। কাকাবাবুর প্রতি আমি কখনই শ্রদ্ধাশীল ছিলাম না। আমার বাবা কেন অতুলের সঙ্গে আপনার বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন এ প্রশ্ন বহুবার করেও জবাব পাইনি। এই কারণে তিনিও আমার শ্ৰদ্ধা শেষদিকে পাননি। কাকাবাবুর জীবনযাত্রা, কাকিমার মৃত্যু এসব নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না।
হঠাৎ সুভাষচন্দ্ৰ নামে এক ভদ্রলোক জলপাইগুড়িতে আসা যাওয়া শুরু করেছেন কাকাবাবুর বিষয় সম্পত্তির তদারকি করতে। যেহেতু আপনি ওই বাড়ির পুত্ৰবধু এবং একমাত্র উত্তরাধিকারিণী তাই আপনার দেওয়া ওকালতনামা নিয়ে তিনি এই কাজ করতে সক্ষম হবেন। লোকমুখে শুনেছি তিনি আমাকে শত্ৰুপক্ষের মানুষ বলে মনে করেন। আমি লিখছি, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। কাকাবাবুর সম্পত্তির প্রতি আমার কোন আসক্তি নেই। আমার সম্পর্কে শঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই।
কিন্তু কৌতূহল জাগছে। আপনার সম্পর্কে আমি যা শুনেছি তাতে মনে হয়েছে। কাকাবাবুর পরবারের সঙ্গে আপনি সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। তাহলে কেন এই তৎপরতা? খৃষ্টতা হলে তা মার্জনা করবেন। ইতি, অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল দীপা। সে চিঠি লিখে সহপাঠিনীর কাছে এর বিস্তারিত ঠিকানা জানতে চেয়েছিল। কারণ দেখিয়েছিল যে, হাকিমপাড়ার সম্পত্তির বিষয়ে লিখতে চায়। ভদ্রলোক হয়তো তাই শুনেছেন এবং এই চিঠি লিখলেন। সে চিঠির উত্তর লিখতে বসল, সুজনেষু, আপনার চিঠি পেয়ে একই সঙ্গে অবাক এবং কিছুটা খুশী হয়েছি। খুশীর কারণটা আগে বলি, আমার সম্পর্কে যা শুনেছেন এবং ভেবেছেন তা অকপটে লিখেছেন। এটা সাধারণত কেউ করে না। অবাক হয়েছি। কারণ আপনি যে আমাকে চিঠি লিখবেন তা কখনও ভাবিনি। আমি আমার সহপাঠিনীকে লিখেছিলাম আপনার ঠিকানার জন্যে। কারণ চিঠি আমিই লিখতাম। আপনি চমক দিলেন।
আপনার কাকাবাবুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ইচ্ছে আমার কখনই ছিল না বা তাঁর বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ আমার নেই। আমার স্বৰ্গত বাবা তাঁর কাছ থেকে যে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছিলেন সেটাও আমার অজানা ছিল। শুনেছি সেই টাকা থেকে আমার পিতাকে কমিশন দিতে হয়েছিল আপনার কাকাবাবুর বন্ধুকে। একথা ঠিক, আমি এখনও ওই টাকায় পড়াশুনা করছি কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা আছে স্বাবলম্বী হওয়া মাত্র টাকাটা আমার মাকে ফিরিয়ে দেব। আমি মনে করি আপনার কাকাবাবু তাঁদের ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকাটা দিয়েছিলেন।
আমি মনে করি নিজের পায়ে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আমি সেই চেষ্টা করছি। আপনার বাবাকে আমি দোষ নিই না। আমার বাড়ির লোক যদি লোভী না হতেন তাহলে আমার জীবন অন্যরকম হতো। অবশ্য এটাও বলা যায়, তিনি অমন কাজ করেছিলেন বলেই আমি আজ এখানে আসতে পেরেছি। যা হোক, এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে আজকাল একটুও হয় না।
কাজের কথা বলি। আমার আত্মীয়স্বজন যাঁরা অর্থকষ্টে আছেন তাঁরা এসে ভিড় করেছেন। আপনার কাকাবাবুর সম্পত্তির জন্যে। আমি এঁদের অনুরোধ শুনতে শুনতে স্থির করলাম কাকার সম্পত্তি যা সামনে এবং আড়ালে আছে তার বিশদ উদ্ধার করে কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করব। আমি নিশ্চিত ছিলাম না। এই কাজের পূর্ণ অধিকার আমার আছে কিনা। তাই মনে হল আপনার অনুমতি নেওয়া দরকার। যাহোক, আপনার চিঠিতে জানলাম। আপনি ওই ব্যাপার বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। জেনে ভাল লাগল।
সবশেষে একটা কথা। শত্ৰু মিত্ৰ জানি না। ওই চিঠি আপনি লিখেছেন বলে আপনার সম্পর্কে চিরকাল শ্ৰদ্ধা রাখব। আশা করি এই চিঠি আপনার কৌতূহল মেটাবে। আপনাকে চিঠি লেখার সুযোগ করে দেবার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ইতি, শুভেচ্ছা সহ, দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়। পুনশ্চ, আমাকে এখনও এই বন্দ্যোপাধ্যায় লিখতে হচ্ছে কারণ স্কুল ফাইন্যালের সার্টিফিকেটে তাই লেখা আছে।
চিঠি লিখে বেশ স্বন্তি হল। খামের মুখ সেঁটে হোস্টেলের বাইরের পোস্ট বক্সে ফেলে দিয়ে গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখল। সুভাষচন্দ্ৰ আসছেন। সে ভেতরে ঢুকে ভিজিটার্স রুমের সিঁড়িতে দাঁড়াল। সুভাষচন্দ্র ঢুকে বললেন, যাক, তোমার দেখা পেয়ে গেলাম। চল, ভেতরে বসি।
কিন্তু মামা, আমাকে বেরুতে হবে।
ওহো। পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিটে হয়ে যাবে।
অগত্যা বসতে হল। সুভাষচন্দ্র বললেন, এতদিন আমি আসিনি বলে ভেবো না চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসেছিলাম। বার দুয়েক জলপাইগুড়ি যেতে হয়েছিল। প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় সম্পত্তির হিসেব পেয়ে গেছি। তবে এখনও পচিশ ভাগ হিসেরের বাইরে আছে এবং তা উদ্ধার করা মুশকিল। যাহোক যা পেয়েছি তাতে মনে হচ্ছে বারো লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে বিত্রী করলে।
দেখি, কি পেয়েছেন!
ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বের করে সুভাষচন্দ্ৰ দীপার হাতে দিলেন, এখানে সমস্ত কাগজ আছে। বারো লক্ষ। ভাবতেই আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে।
কাগজপত্র হাতে নিয়ে দীপা বলল, মামা, এগুলো পেতে আজ পর্যন্ত আপনার পকেট থেকে কত টাকা খরচ হয়েছে বলতে পারবেন?
সুভাষচন্দ্রের চোখ ছোট হল, কেন, বল তো?
দীপা গম্ভীর মুখে বলল, বলুন না। আমার জানা দরকার।
সুভাষচন্দ্র বললেন, এখনই বলা মুশকিল। কয়েকশ, মানে ধরে দুই আড়াইশো খরচ হলে হতে পারে। ও এমন কিছু না। অন্য লোক হলে অনেক বেশী খরচ করতে হতো। কোর্ট কাছারির ব্যাপার তো। কিন্তু আমাকে বোকা বানাবে এমন লোক বেশী জন্মোনি। বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে কথাগুলো বললেন সুভাষচন্দ্ৰ।
দীপা মাথা নাড়ল, তাহলে ঠিক আছে। আপনি আড়াইশো টাকা পারেন।
না, না, ওই টাকা আর আলাদা করে দিতে হবে না আমাকে।
মামা, আপনি ওই টাকাটাই পারেন। আমার জন্যে যে কাজটা করেছেন তা আমি চিরকাল মনে রাখব। আর এই কাজটা করেছেন বলে আরও আড়াইশো টাকা আপনাকে দেবার ব্যবস্থা করব। পারিশ্রমিক হিসেরে। এখনই সময়টা বলতে পারছি না। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনাকে পুরো টাকা ফিরিয়ে দেব। দীপা উঠে দাঁড়াল।
আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না মা।
বোঝার তো অসুবিধে নেই মামা।
না অসুবিধে হচ্ছে। তুমি প্রতুলবাবুর সম্পত্তি আমাদের মধ্যে ভাগ করে দেবে এমন কথা আছে। আমি শুধু আড়াইশো আর আড়াইশো পাঁচশো টাকাই পাব এ কেমন কথা? না, না, বুঝিয়ে বল আমাকে। অস্থির হলেন সুভাষচন্দ্ৰ।
আপনাকে যে ওকালতনামা সই করে দিয়েছিলাম সেটা কোথায়?
ওই যে, ওই কাগজের সঙ্গেই আছে।
খুব ভাল হল। আমি স্থির করেছি। যেহেতু প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক আমি অস্বীকার করেছি। তাই তাঁর সম্পত্তি আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ভাগ করে দেবার কোন অধিকার আমার নেই। আপনারা ভোগ করা মানে পরোক্ষভাবে আমারই ভোগ করা। সেটা আমি হতে দিতে পারি না। সম্পত্তির যে হিসেব আপনি এনে দিয়েছেন তা আমি কোন জনহিতকর প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিতে চাই। মানুষকে অপমান করে কষ্ট দিয়ে প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় যে সম্পত্তি তৈরী করেছিলেন তার কিছুটা অন্তত সাধারণ মানুষের প্রকারে লাওক। এ ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাই না। কাগজপত্রগুলো তুলে নিল দীপা স্মিতমুখে।
সুভাষচন্দ্ৰ হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন। কোন শব্দই যেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। তারপর একসঙ্গে হুড়মুড় করে যেসব কথা বলতে গেলেন তা জড়িয়ে গিয়ে অস্পষ্ট শব্দাবলী ছিটকে উঠল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, অসম্ভব, এ হতে পারে না। কিছুতেই না। তুমি আমাকে কথা দিয়েছ বলেই আমি এসব করেছি। আমাকে বঞ্চিত করতে পারো না তুমি। আমি কোন কথা শুনব না। সম্পত্তির ভাগ আমার চাই চাই।
সুভাষচন্দ্রের গলার স্বর সপ্তমে ওঠায় দারোয়ান ছুটে এল দরজায়। ইশারায় তাকে চলে যেতে বলে দীপা ঘুরে দাঁড়াল, ওইভাবে চিৎকার করে কথা বলবেন না। এটা মেয়েদের হোস্টেটল।
সুভাষচন্দ্ৰ সামান্য গলা নামালেন। কিন্তু তাঁর জ্বালা কমল না, হোস্টেল ফোস্টেল শুরু দেখাতে এসোনা। কলকাতার জল পেটে পড়ামাত্র খুব চাল চালতে শিখে গিয়েছ, অ্যাঁ।
মামা, আপনি ভদ্রভাবে কথা বলুন। শক্ত গলায় বলল দীপা।
ভদ্র। ভদ্রতা শেখাচ্ছ আমাকে? না, আমার টাকা চাই-ই!
আমি আপনাকে কখনও বলিনি যে সম্পত্তির ভাগ দেব।
তুমি বলনি? এত বড় মিথ্যে কথা?
মামা, আবার বলছি ভালভাবে কথা বলুন।
কেন, দারোয়ান ডেকে বের করে দেবে নাকি?
এখনও সেটা চিন্তা করিনি। সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা করতে আপনিই আমার কাছে এসেছেন। মনে আছে যেদিন আমি প্ৰথম জেনেছিলাম। বাবা আমার পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে টাকা নিয়েছেন সেদিন তাঁকে বলেছিলাম, ছিঃ তুমি এত লোভী। বাবা কষ্ট পেয়েছিলেন, হয়তো সেই কারণে তাঁর শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যা সত্যি তা বলতে আমার বাধেনি সেদিন। আজ তো না বলার কোন কারণ নেই। আপনারা আমার জন্যে কিছুই করেননি, আমি কিভাবে কলকাতায় আছি তার খবরও নেননি। অথচ যখন জেনেছেন আমার বাতিল করা সম্পর্কের সূত্র বাঁচালে অনেক সম্পত্তি পাওয়া যাবে তখন ভাগ বসাতে ছুটে এসেছেন।
সুভাষচন্দ্র মাথা নাড়লেন, তুমি, তুমি একথা বললে! তোমাকে আমি কত স্নেহ করি।
কথাটা আজ আপনাকে মুখে উচ্চারণ করে বোঝাতে হচ্ছে। মামা, কলকাতায় তো আমার অনেকদিন হয়ে গেল, এর মধ্যে আপনি আমাকে একবারও আপনার বাড়িতে নিয়ে গেছেন?
সুভাষচন্দ্র মাথা নামালেন, না মানে, তোমার মামীমা, জানোই তো।
আপনি লাখ টাকা পেলে মামী তা ভোগ করবেন না? আপনাদের আমি খুব ভাল করে চিনে গিয়েছি। যিনি আমার জন্মদাতা, যাঁকে আপনি একসময় যত্ন করে ধরে এনেছিলেন, অবশ্য এখন যাঁকে শত্ৰু ভাবছেন, তাঁর চরিত্র আপনার থেকে খুব আলাদা নয়। এত বছর পর তিনি শকুনের মত উড়ে এসেছেন ভাগাড় থেকে মাংস খেতে। অনেক হয়েছে, এবার আপনি আসুন। পাঁচশো টাকা আপনাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করব আমি। দীপা সরে দাঁড়াল।
সুভাষচন্দ্ৰ হঠাৎ বুকের বাঁদিকে হাত রাখলেন। তাঁর মুখে ঘাম জন্মছিল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
সুভাষচন্দ্র মাথা নাড়লেন, না। তারপর চেয়ার ছেড়ে দরজার দিকে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন। আমারই ভুল হয়েছিল। বিধবার গায়ে যখন রঙিন শাড়ি ওঠে তখন তাকে আর বিশ্বাস করতে নেই। অঞ্জলি ঠিক করেছে তোমাকে তাড়িয়ে দিয়ে। ঠিক করেছে। সুভাষচন্দ্র চলে গেলেন। আর পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল দীপা। মুহূর্তেই তার শরীর অসাড়। ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল সে।
সুভাষচন্দ্ৰ যে শেষ পর্যন্ত এমন কথা উচ্চারণ করতে পারবেন তা কল্পনাও করেনি সে। তাহলে কি চারপাশের মানুষজন যারা জানে তার অতীতের কথা এই মুহূর্তে আড়ালে একই ভাবনা ভাবছে? মনে এক আর মুখে আর এক কথা বলছে? অসীম মানতে পারেনি তার অতীত, এই হোস্টেলের অন্য মেয়েরা শুনলেই বড় চোখে তাকরে। সে যদি থান পরে কলেজে ক্লাস করতে যেত তাহলে কি বেশী সহানুভূতি পেত।
কতক্ষণ ওভাবে বিম মেরে বসেছিল দীপা জানে না হঠাৎ দারোয়ান এসে দাঁড়াল দরজায়, দিদিমণি, এক ভদ্রমহিলা আপনাকে খুঁজছেন।
সম্বিত এল কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করল না। হঠাৎ দারোয়ানের পেছন থেকে গলা ভেসে এল, ওমা, তুই এখানে বসে কি করছিস। আমি ভাবলাম হোস্টেলেই নেই। বলতে বলতে রমলা সেন একটা বই-এর প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে এলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই সব চিন্তা উধাও হয়ে বিস্ময় পাহাড়ের মত উঁচু হল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না দীপা। রমলা সেনের মাথায় একটা বড় কালো রুমাল বাঁধা। সে সব ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, এ কি হয়েছে। আপনার?
কি হয়েছে? রমলা সেন অবাক হয়ে গেলেন।
আপনার মাথায় ওটা কি?
ওঃ, তাই বল। এমন করে বললি যে আমি চমকে উঠলাম। বাঁ হাত দিয়ে রুমালের প্ৰান্ত টানলেন তিনি। তারপর বললেন, তোর ঘর কোনটা?
ওপরে। কিন্তু রুমাল বাঁধলেন কেন?
সব চুল ফেলে মাথা কমিয়ে ফেলেছি। চেয়ার টেনে বসলেন তিনি।
আপনি মাথা কমিয়েছেন? মুখে হাত চেপে কোনমতে হাসি চাপল দীপা।
হুঁ। আমি কারো খোঁটা শুনতে পারি না। গম্ভীর গলায় বললেন তিনি।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না, সত্যি ভাবতে পারছি না। দুর, হতেই পারে না! দীপা মাথা নাড়ল।
চটপট রুমালের গিট খুললেন রমলা সেন। সেটা সরাতেই কামানো মাথাটা বীভৎস হয়ে উঠল। আর সেই মাথার সামনের দিকে একটা ছোট সিঁদুরের রেখা যা রুমালের চাপে কিছুটা ধেবড়ে গিয়েছে। দীপা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, প্লিজ, রুমালটা বেঁধে ফেলুন।
রমলা সেন মাথায় রুমাল দিলেন, ঘটনাটা শোন। পরশু রাত্রে খুব খাটাখাটির পর শুয়েছি। হঠাৎ মনে হল সদর দরজাটা খোলা আছে। মানে আমি খিল দিইনি। বিছানা থেকে নেমে দেখতে আলস্য লাগল। সুধাময় বিছানায় পড়লে কাদা হয়ে যায়। পুরুষমানুষের কি ঘুম বাবা। রাগ হল। খোঁচা মেরে তুললাম। বললাম দরজাটা দেখে আসতে। বলল সে নাকি নিজের হাতে খিল দিয়ে এসেছে। আমি একটা আদর করতে গেলাম। আর আমার মাথার চুল ওর নাকে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে নাক টেনে কি বলল জানিস? বলল, ইস, তোমার চুলে কি বিশ্ৰী বোঁটকা গন্ধ। শুনে অ্যাইস্যা রাগ হয়ে গেল যে বিছানা থেকে নেমে কাঁচি দিয়ে মাথার চুল গোছা গোছা কেটে ফেললাম। ও যদি বাধা দিত তাহলে পুরোটা কাটতাম না, বাবু তখন ওপাশ ফিরে ঘুমাতে শুরু করে দিয়েছেন। এলোমেলো কেটে রাগ কমতে শুয়ে পড়লাম। সকালে আয়নায় নিজেকে দেখে চক্ষুস্থির। কোন সেলুন ঠিক করতে পারবে না চুল। ফলে নাপিত ডেকে কামিয়ে ফেলতে হল।
উনি কিছু বলেননি?
না। কিন্তু বেচারা কেঁদে ফেলেছিল রে। আমি অনেক বুঝিয়েছি। মাথার খুস্কি কিছুতেই যাচ্ছিল না, এই সুযোগে সেটা চলে গেল।
দীপা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ।
এই, তুই অমন করে তাকাচ্ছিস কেন?
আচ্ছা, আপনি এমন পাল্টে গেলেন কি করে?
পাল্টে গেছি?
আগের আপনার সঙ্গে এখনকার আপনার কোন মিল নেই।
সুধাময়ও তাই বলে। হাসলেন রমলা দেন, আমি বলি মানুষের জীবন হল নদীর মতন। লছমনঝোলা-হরিদ্বারের গঙ্গার মত কি কলকাতার গঙ্গা? সবসময় এক চেহারা থাকবে? ছেড়ে দে আমার কথা। তোর পরীক্ষা করে?
এই এসে গেল বলে।
পরীক্ষার পর কি করবি! মানে কি পড়বি?
দেখি টেখি না। এইটেই হল প্ল্যান করার ঠিক সময়। বাবা নেই, এখন গার্জেন কে তোর? তার সঙ্গে আলোচনা করেছিস?
আমার এখন কোন গার্জেন নেই।
সেকি?
হ্যাঁ, আমি এখন একা।
দীপার কথা শেষ হওয়ামাত্র দারোয়ান আবার এল, সেই বাবু এসেছে।
কোন বাবু? দীপা জানতে চাইল। দারোয়ান সেখানে দাঁড়িয়েই ইশারা করতে শমিতকে দেখা গেল। ঘরে ঢুকে শমিত রমলা সেনকে দেখে একটু ইতস্তত করে বলল, বোধহয় ডিস্টার্ব করলাম।
না, না। কি ব্যাপার? দীপা হাসল।
রমলা সেন বলে উঠলেন, আরে দীপা, একেই না সেদিন পালিয়ে যেতে দেখেছিলাম?
দীপা প্ৰতিবাদ করল, না, না। পালিয়ে যাবে কেন? কাজ ছিল তাই চলে গিয়েছিল।
তারপর শমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, হঠাৎ, অনেকদিন বাদে?
হ্যাঁ। তোমার জন্যে ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেলে একটা সিট পাওয়া গিয়েছে।