1 of 2

৪৮. পোড়াদহ মেলার আগের দিন

পোড়াদহ মেলার আগের দিন জোহরের নামাজের পর ফকিরের ঘাটে জাল নিয়ে গেলো আবিতনের বাপ, সঙ্গে ভিড়ে গেলো ভিকু পাগলা। ভিকু সম্পর্কে তার কেমন খালাতো ভাই হয়, আবার শালাও হয়। বাড়ি থেকে হঠাৎ করে তিন চার মাসের জন্যে উধাও হয়ে যাওয়ার অভ্যাসের ফলে, সবসময় পরনে ধুতি ও ময়লা তেলচিটচিটে রামপুরি টুপি মাথায় পরে থাকে বলে এবং প্রায়ই উর্দু বাত করার চেষ্টা করার কারণেও বটে, নামের সঙ্গে সে ঐ উপাধিটি অর্জন করেছে।

মাঘের শেষ বুধবার, কিন্তু শীত পড়েছে বড়ো বেশি; পোড়াদহ মেলার সময় এমন হবেই। আবিতনের বাপ খালাতো ভাই-কাম-শালাকে দিয়ে হুঁকায় তামাক সাজায়, হুঁকায় লম্বা কয়েকটা টান দিয়ে এবং আল্লার নাম নিয়ে ও উত্তর দিকে পাকুড়তলায় মুনসির উদ্দেশ্য মাথা ঝুঁকে সালাম করে তৌড়া জালের একটা খেপ মারে আড়াআড়ি। বিলের এই জায়গাটায় একটা গর্ত আছে, সব সময়ই মাছ থাকে। দাদা পরদাদারা বলে গেছে, সেই কোন আমলে কোথায় ভুমিকম্প হলে যমুনা হঠাৎ করে ফুলে উঠলে তার গতরের উপচে-পড়া পানি ঢেলে দেয় বাঙালি নদীতে। বাঙালি উপচে পানি এলে ভাসিয়ে দেয় এই গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙা গ্রাম। পাকুড়গাছ থেকে মুনসি তখন পা। বাড়িয়ে কষে একটা লাথি মেরেছিলো ছোটো ডোবাটার ঠিক এই জায়গাতেই। তাইতেই তো ডোবা হয়ে গেলো মস্ত কালাহার বিল। বাঙালি পেরিয়ে যমুনার পানি সেখানে ঢোকার জায়গা পেলে দুই গাঁয়ের মানুষ তাদের ভাঙার অনেকটা ফেরত পায়। সেই থেকে এখানটায় মাছের বরকত বেশি। পোড়াদহের মেলায় ফকিরের ঘাটের শিঙিমাগুরের খুব কদর।

আজও আবিতনের বাপের জাল ভরে মাছ উঠলো, তার বড়ো খলুইটা ভরে গেলে সে জাল তুলে দেয় ভিকু পাগলার হাতে। ভিকুও মাছ ভরা জাল টেনে তুলছে, এমন সময় কে চেপে ধরলো তার ডান হাতের কবজি। ভিকু ওই অবস্থাতেই বলে, আসসালামু আলায়কুম। কেয়া ভাই হাত পাকড়াতা কাহে? হাত ছাড়িয়ে।

তার হাত চেপে ধরেছে আলি মামুদ, যমুনার মাঝিদের সর্দার গোছের মানুষ। ভিকুর সালামের জবাব না দিয়ে, উর্দু ভাষায় করা তার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে শান্ত গলায়। হুকুম দেয়, জাল লিয়া বাড়িত যাও।

ততোক্ষণে ফকিরের ঘাটে ও ঘাটের ওপারে জমতে শুরু করেছে যমুনার মাঝিরা। আলি মামুদ খামাখা গোলমাল করার লোক নয়, বরং অতো বড়ো কালো কুচকুচে শরীর থেকে বার করে মিষ্টি বুলি, বুড়ার বেটা, আবিতনের বাপের দিকে সে তাকায়, তোমরাও মাঝি, হামরাও মাঝি। মোসলমান মাঝি দ্যাশোত আর আছে কি-না সন্দ। হামরা নিজেরা নিজেরা খালি খালি হুজ্জত করি কিসক ভিকুর হাত ছেড়ে সে বলে, কালাম মিয়া সরকারের কাছ থ্যাকা ল্যাখাপড়া করা ট্যাকা দিয়া বিল ইজারা লিছে। উগলান কাগজপত্র দেখা তাক খাজনা দিয়া হামরা আজ আসিছি বিলের মাছ ধরবার। আজকার দিন এই বিলের মাছ ধরমু হামরা যমুনার মাঝিরা। তুমি এক খলুই মাছ ধরিছো, এটি থুয়া তোমার জাল লিয়া বাড়িত যাও। আবিতনের বাপের হতাশ মুখ দেখে সে আরেকটু বলে, হামাগোরে মাছ ধরা শেষ হলে তোমাক কিছু মাছ হামি লিজে থ্যাকা দিমু।

রাগে ও দুঃখে হোক কিংবা পরে মাছ পাবার আশ্বাসেই হোক, আবিতনের বাপ। জাল ও খলুই রেখে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। কিন্তু তার খলুইটা হাতে নেয় ভিকু এবং আলি মামুদকে বলে, ইগলান ফালতু বাত কেয়া বলতা? তোম যমুনা আর গঙ্গা কাহেকা মাঝি না জেলে না নিকারি কেয়া হ্যায় তো হামারা বাল ছিড়েগা? গিরিরডাঙার মাঝিরা পোড়াদহ মেলামে মাছ বেচেগা নেহি?

রীতিমতোন খাজনা দিয়ে একদিনের জন্যে জমা নিয়ে মাছ ধরতে আসা যমুনার বনেদি মাঝিসর্দারের পক্ষে এতোটা সহ্য করা সম্ভব নয়, শোভনও নয়। আলি মামুদ কারো গায়ে হাত তোলার মানুষ নয়। সে পেছনে আড়চোখে একবার তাকায়, অমনি তার বেঁটে খাটো এক সঙ্গীর হাতের প্রবল এক ধাক্কায় ভিকু পড়ে যায় একেবারে নিচে। তার মুখ থেকে পেট পর্যন্ত ড়ুবে যায় পানিতে, তবে কোমর থেকে বাকিটা থাকে ডাঙার ওপরেই। উত্তর পাড়ার নুলা শামসুদ্দিন ভিকুর শরীরের প্রথম আদ্দেকটা তুলতে নেমে পড়ে পানিতে। তবে তার বাঁ হাতটা নুলো বলে শুধু ডান হাতে কিছু করতে পারে না। তবে ততোক্ষণ ভিকু তার শরীরের ডাঙার অংশটিও টেনে নিয়েছে পানিতে এবং একটুখানি সাঁতার দিয়ে পুরো শরীরটাই সে তুলে ফেলে ডাঙার ওপর, কিন্তু পানিতে তার টুপিটা ভেসে গেছে, তার ধুতির হালও এমন হয়েছে যে ওটা পরার উদ্দেশ্যই এখন ব্যর্থ। ধুতিটা কোনোমতে জড়িয়ে পরে ভিকু বারবার তার মাথায় হাত দিতে থাকে, . সেটা কি টুপির শোকে, না চুলের পানি ঝেড়ে ফেলতে তা তারও জানা নাই।

আবিতনের বাপ হনহন করে ছোটে কালাম মাঝির বাড়ির দিকে। হাঁটে গজর আর গজর করে, তাদের গ্রামে এসে, তাদেরই বাপদাদাপরদাদার বিলে মাছ ধরে ভিন ঠেনের মানুষ, আবার তাদের মারধোর করে,-এ কেমন কথা? তাদের নেতা কালাম মাঝি কি এর একটা বিহিত করবে না?

কিন্তু কালাম মাঝির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো বুধা, সে জানায়, মামু গেছে তমিজের বাপের গোর জেয়ারত করবার।

আবিতনের বাপের পিছে পিছে এসেছে ভিকু পাগলা। সে অবাক হয়, তমিজের বাপের গোর? উও তো কেয়া বলতা চোরাবালিমে–! মামা তার সেখানেই গেছে। বলতে বলতে বুধাও তাদের সাথ ধরে।

আবিতনের বাপ সেদিকে ছুটলে ভিকু পাগলাও যেতে যেতে একটা হাঁক ছাড়ে তমিজের বাড়ির সামনে এসে। কুলসুম ভেতর থেকে জানায়, কিছুক্ষণ আগে তমিজ গেছে পাকুড়তলায়। জাল নিয়েই গেছে।

চোরাবালির তিনদিকে ঘেরা খাটো দেওয়ালের এক কোণে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে জিয়ারতের দোয়া পড়ছে কুদ্স মৌলবি, তার পাশে মোনাজাতের হাত তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালাম মাঝি। তার দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার দাড়িতে। দাড়ি এখনো তার তেমন বাড়ে নি। তবে দাড়ি হচ্ছে বেশ চাপ বেঁধে। মাথায় পরিষ্কার কিস্তি টুপি। কয়েক গজ দূরে ইটখোলার ইটের সারির পাশে হাঁটতে হাঁটতে একটা বেড় জাল ফেলার জুতসই জায়গা জরিপ করছে যমুনার আরেক সর্দার মাঝি, আলি মামুদের ভাই শাকের মামুদ। তার আশে পাশে বেশ কয়েকজন মাঝি। মস্ত বড়ো জালটা ধরে রয়েছে অন্তত তিনজন লোক।

বুধা সবাইকে ছাড়িয়ে চলে যায় আরেকটু উত্তরে, সেখানে মস্ত একটা তৌড়া জাল উড়িয়ে দিচ্ছে তমিজ। ৰিলের ঠাণ্ডা সর-পড়া পানিতে ছপাস আওয়াজ করে জালটা পড়তেই কালাম মাঝি হাত মোনাজাতে রেখেই এদিকে তাকায়। বুধা গিয়ে ধরে ফেলে তমিজের হাত, চাচা, তমিজ চাচা, আকজার দিনটা বাদ দে। মামু যমুনার মাঝিগোরে কাছ থ্যাকা মেলা ট্যাকা লিয়া আজকার জন্যে বিল জমা দিছে। তুই আজ আর মাছ ধরিস না চাচা। আজ থাক।

জাল ওঠাও। জাল ওঠাও। শাকের মামুদের এই কড়া হুকুমে তমিজ ফিরেও তাকায় না। কিন্তু জিয়ারত ছেড়ে কিংবা জিয়ারত সেরে ছুটে আসে কালাম মাঝি। তমিজের পাশে দাঁড়িয়ে সে বলে, তুই পাগলা হলু? তোর বাপের মাজার জিয়ারত করা তার দোয়া লিয়া আজ কাম শুরু করনু। তোর বাপের অছিলাত হামরা মাঝিরা বিল ফেরত পানু। হামি বিল পত্তন নিলাম। আজ যমুনার মাঝিরা মাছ ধরবি, ওরা হামাক খাজনাও দিছে। তুই জাল ওঠা।

বুধা তমিজের কানের কাছে মুখ নিয়ে সাবধান করে দেয়, যমুনার মাঝিরা সব মারকুটা মানুষ। আবার তহসেন ভাই কয়া রাখিছে আমতলির দারোগাক। খবর পালেই

পুলিস আসবি মটোরেত চড়া। তুই ওঠ বাপু।

কিন্তু ততক্ষণ তমিজের হাতে শক্ত টান পড়েছে। জালে ঢুকছে মস্ত কোনো মাছ। বেশ বড়ো মাছ। তমিজ ফিসফিস করে বলে, বুধা, বাপজান বাঘাড় ধরিছিলো না? তুইও তো সাথে আছিলু? মনে হয় ওই বাঘাড়টা!

বুধার গা শিরশির করে উঠলে সে চুপ করে। তমিজ বোঝে ডাঙায় দাড়িয়ে এই মাছ তোলা অসম্ভব। সরসর করে সে নেমে পড়ে ঠাণ্ডা পানিতে। ডাঙার তুলনায় পানি কম ঠাণ্ডা আর উরুতে গত রাত্রির ফুলজানের উরুর তাপ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার মনোযোগ এখন জালের দড়ি টানার দিকে। বড়ো মাছের আভাস পেয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে নেমে পড়েছে ভিকু পাগলা, নুলা শামসুদ্দিন আর শামসুদ্দিনের ভাগ্নে মংলু। সবাই মিলে তারা জাল টেনেও হাপসে হাপসে যাচ্ছে, মাগো! কী মাছু না জানি আজ ধরা পড়লো গো!

শাকের মামুদ এবার সরাসরি ফয়সালা করতে চায় কালাম মাঝির সঙ্গে, কালাম মিয়া, বিলের ব্যামাক ঘাটোত তোমাগোরে মাঝিপাড়ার মানুষ জাল লিয়া আসিছে। ইগলান কী? তুমি হামাগোরে পয়সা ঘুরা দাও। মাছ ধরবার আসা এংকা হুজ্জত করবার পারমু না আমরা। পয়সা ঘুরা দাও। হামরা যাই। তবে ফিরে যাবার কোনো লক্ষণ তাদের নাই। বরং যমুনার মাঝিদের হাতে জাল ও পলো ছাড়াও যেসব অস্তর দেখা। যাচ্ছে সেগুলো দিয়ে শুধু মাছই মারা যায় না। কালাম মাঝি সবই খেয়াল করে এবং চি স্কার করে বলে, শালা হামাগোরে মাঝিপাড়ার মানুষ ইগলান কী করিচ্ছে? শালারা তো মরবি গো! শাকের মামুদ বলে, না গো, পয়সা ঘুরা দাও। আগে শরাফত মিয়াক খাজনা দিয়া হামরা বছর বছর মাছ ধরিছি, কেউ ক্যাচাল করে নাই। তোমাক খাজনা দিয়া অ্যাসা মুসিবতে পড়লাম।

কালাম মাঝি ফের চেঁচায়, এ তমিজ, উঠা আয়। তোরা শালারা ঠিক থাকিস মণ্ডলের কোন খালে!

ভিকু পাগলা ও মংলুর দুই ও দুই চার হাত, নুলা শামসুদ্দিনের এক হাত এবং তমিজের দুই হাত,–এই সাত হাত এবং তমিজের সর্ব অঙ্গের জোরে মাছটা তখন হাঁসফাঁস করছে, শালাকে বেরুতে দেওয়া হবে না। ভিকু বলে, বহুত বড়া রুই হোগা। তমিজ আস্তে করে জানায়, না। বাঘাড়। কথা কয়ো না। তার কথা কেঁপে কেঁপে ওঠে, বাপটা কি চোরাবালির ভেতর দিয়ে পানিতে ঢুকে মাছ ধরে দিলো নাকি?

কালাম মাঝির আর সহ্য হয় না, এই কুত্তার বাচ্চা। তোর বাপ মণ্ডলের কোন খায়া ঠিক হছিলো। এখন কোন দেওয়া লাগে তোক। মনে হচ্ছে, তমিজের বাপের। দোয়া পাবার পর তার প্রতি ভক্তি রাখার দরকার কালাম মাঝির ফুরিয়ে গেছে। এর পরেও তমিজ জাল নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কালাম মাঝি ছাড়ে তার মোক্ষম অস্তর, এই শালা হারামজাদা। কাল তুই কুদ্স মৌলবিক ওয়াদা দিছিল না। কাল শালা ঘেগি মাগীটাক লিকা করলু। এখনি মণ্ডলকে খবর দেই তো হুরমতুল্লাক ভিটাছাড়া করবি। ঐ মাগীক লিয়া তুই তখন উঠবু কুটি? হামার কাছে তোর ভিটাঘর বন্ধক আছে না? আজই ঘর ছাড়া করমু তোক। তারপর সে ডাকে কুদুস মৌলবিকে। কুদুস মৌলবি মিনমিন করে বলে, একটা মাছ তুল্যা তমিজ বাড়িত যা।

কালাম মাঝি কষে ধমক লাগায় মৌলবিকে, আরে মুনসির বেটা, চুপ করো। পয়সা খাও হামার, আর কথা কও উল্টাপাল্টা, না? যাও জুম্মাঘরত যাও। নামাজ পড়ান, লাগবি না?

জুম্মাঘর থেকে তার পদচ্যুতির সম্ভাবনায় কুদুস মৌলবি দমে যায়, যতোটা পারে চিৎকার করে সে বলে, তমিজ, তুই না কাল ওয়াদা করলু, কালাম মিয়া যা কয় তাই শুনবু। আজ আবার–।

তার কথা শেষ না হতেই একটা বর্শা এসে পড়ে মংলুর পিঠে, ঘাড়ের নিচে বর্শাটা লেগেই সেটার গতি শিথিল হয়ে এসেছিলো বলে বর্শা পড়ে যায় পানিতে। তমিজ আর ভিকু পাগলা এর পরেও জাল না ছাড়লে আরেকটি বর্শা বিধে গেল তমিজের কনুইতে। শিথিল হাতের ভেতর দিয়ে জালের দড়ি খুলে যায়। মুনসির পান্টিই কি বর্শা হয়ে বিধলো তার কনুইতে? তা মুনসি হোক আর যেই হোক তমিজ তাকে ছাড়ছে না। এখন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো পানিতেই কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকটি ভয়ে কাঁপছে। বোগাপটকা, বয়স পঞ্চাশের কম নয়। দেখেই বোঝা যায়, এ শালার জাল নাই, নৌকা নাই; পরের মাছ-ধরা নৌকায় শালা জন খাটে। বর্শাটাও তেমন জোরে মারতে শেখে নি, এর কাছে বর্শা যা, পান্টিও তাই। তমিজ নিজের বাঁ হাতের কনুই থেকে বর্শা উপড়ে নিয়ে বড়ো একটা নিশ্বাস টেনে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো লোকটার মুখ বরাবর। লোকটা লাফ দিয়ে ওঠায় বর্শাটা বেঁধে তার গলার নিচে। সঙ্গে সঙ্গে সে পড়ে যায় বিলের পানিতেই, অনেকটা জায়গা জুড়ে পানি দেখতে দেখতে লাল হয়ে ওঠে এবং তমিজের জালের বড়া মাছটাও জাল ছিড়ে বেরুবার সময় তার বহুকালের ল্যাজ, পেট, পিঠ ও মাথা ঝাকালে পানিতে ঢেউ ওঠে এবং রক্তাক্ত পানির ঝাপটায় মনে হয় বিলে বুঝি আগুন লেগেছে।

গলায় বর্শা বেঁধা মানুষটাকে ডাঙায় উঠিয়ে ফেলে যমুনার মাঝিরা। তাকে ঘিরে যমুনার মাঝিদের ভিড় দেখে শাকের মামুদ তাদের উঠিয়ে দেয়, এটি তামশা দেখবার আসিছে, না? যাও যাও বেড় জালটা খাটাও। শিমুলতলা এখনো খালিই পড়া আছে। যাও সোগলি যাও।

এদিকে তমিজের বর্শায় আহত মানুষটা বেহুঁশ হয়ে রইলো, তাকে শোয়াননা হয়েছে চোরাবালির বেঁটে দেওয়াল ঘেঁষে। কালাম মাঝি লোক পাঠিয়েছে করিম ডাক্তারকে ডাকতে। কিন্তু আলি মামুদ বলে, আগেই ডাক্তার কিসক? পুলিস জখম দেখবি না? জখম না দেখলে মামলা শক্ত হয় ক্যাংকা কর‍্যা?

আরে আমতলির দারোগা তো আমার বেটার কথাত উঠবি, তার কথাত বসবি। কালাম মাঝির এই আত্মবিশ্বাসে আলি মামুদ কিংবা শাকের মামুদ টলে না, দারোগা, তাই দারোগাই। দারোগা নিজের বাপেকও ছাড়ে নাকি?

এদিকে তমিজের দিকে তেড়ে এসেছিলো যমুনার মাঝিদের মেলা ছোঁড়া। মংলু, ভিকু পাগলা, আবিতনের বাপের নেতৃত্বে মাঝিপাড়ার ছোঁড়ারা তাদের ঠেকায়, তবে তমিজের পিঠে বাঁশের একটা চোট লেগেছে বেশ ভালো ভাবে। কিন্তু যমুনার নেতৃস্থানীয় মাঝিরা এখন গোলমাল সহ্য করছে না, আগে মাছ ধরো। বেলা তো ড়ুবাই গেছে, বাতি জ্বালাও, মাছ ধরো।

কালাম মাঝি তাদের আশ্বাস দেয়, তহসেন তো আর এটি আসবার পারে না। অর হুকুম পায়া আমতলির দারোগা ফোর্স লিয়া খাড়া হয়া আছে গোলাবাড়ি হাটেত। এখনি আসিচ্ছে।

না। এখন থাক। আলি মামুদ বাধা দেয়, হামাগোরে মাছ ধরা হোক। মাছ ধরা পোড়াদহ পাঠাঁই আগে। পুলিস আসলে শালারা আদ্দেক মাছ লিয়া যাবি।

তমিজের ওপর কালাম মাঝি এতোটাই রেগে গেছে যে পারে তো এখনি গলায় পা দিয়ে তাকে শেষ করে ফেলে। কিন্তু তার জন্যে তার উদ্বেগও অন্তত চার আনা। একবার ইচ্ছা করে, কোমরে দড়ি বেঁধে তৌড়া জালের মতো তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় চোরাবালির ঠিক মাঝখানটায়। কুত্তার বাচ্চা বালুর মধ্যে মরুক দম বন্ধ হয়ে। আবার সঙ্গে সঙ্গে ভয়। হয়, ছোঁড়াটাকে যদি পুলিস একবার ধরে তো জেলের ঘানি টানবে সারাটা জীবন। এদিকে মাঝিপাড়ার মানুষ সব জোট বাঁধতে শুরু করেছে উত্তর পাড়ায়। সবাই যদি এদিকে আসে তো শালার মাঝির জাত, কোনো বিশ্বাস নাই, কালাম মাঝির টিনের নতুন আটচালায় আগুন ধরিয়ে দেবে। কালাম এখন কী করে?

পাকুড়তলা থেকে উঠে তমিজ ভিকু পাগলা আর মংলুর পিঠে হাত দিয়ে রওয়ানা হয়েছিলো উত্তরপাড়ার দিকে। কালাম তাকে ধরে আড়ালে নেয়। ভিকু পাগলাকেও ডাকে। গলা নামিয়ে বলে, তমিজ, যে নেমকহারামিটা তুই করলু তোর ফাঁসি হলেও হামি আটকাবার পারমু না রে।

উগলান পরে দেখা যাবি। মংলু বলে, দেখি আবিতনের বাপের ঘরত হামরা আগে বস্যা বুঝি।

আবিতনের বাপের ঘরে তমিজ একবার গেলে শালারা জোট বেঁধে এসে হাজির হবে। কালাম বলে, তমিজ তুই ভাগ। পুলিস আসলে ইগলান বুঝাবুঝি কিছু শুনবি না।

 

পুলিসের কথায় ভিকু পাগলা একটু ঘাবড়ায়, পুলিসকো হামরা সাচ কথা বলেঙে।

এদিকে রাত হয়ে যাচ্ছে। তমিজকে একরকম জোর করেই বুধা আর কালাম মাঝি তোলে নিজের ঘরে। অন্যদের বলে, তোমরা উত্তরপাড়াত যাও।

কিছুক্ষণ পর তমিজের শরীরে মাথায় ছাই রঙের একটা আলোয়ান জড়িয়ে বুধা তার পিঠে হাত ঠেকিয়ে গোলাবাড়ির পথ ধরে। ভিকু পাগলা তখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে কালাম মাঝির বাড়ির বাইরের উঠানে। বুধা তার দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে।

ভোর হওয়ার আগেই আমতলির দারোগা চলে আসে দুইজন কনস্টেবল নিয়ে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যমুনার মাঝিরা নৌকা বোক্সাই মাছ নিয়ে রওয়ানা হয় পোড়াদহ মাঠের দিকে। জখম মাঝিটা রয়ে গেলো কালামের ঘরে, আর পুলিসকে সামলাতে রইলো আলি মামুদ।

সেদিন পোড়াদহ মেলা। গ্রামের ঘরে ঘরে নাইওর। গ্রামের প্রত্যেকটি প্রাণী মেলায় যাবার জন্যে তৈরি হতে ঘুম থেকে উঠেছে ভোর হওয়ার অনেক আগে। সুতরাং কাউকে জাগিয়ে তোলার কষ্ট পুলিসকে আর করতে হয় নি। ফুল ইউনিফর্মে হাফপ্যান্টের তলায় মাঘের হাওয়া ঢোকায় নিম্নাঙ্গ তাদের শীতে কুঁকড়ে কুঁকড়ে যায়। সেটা পুষিয়ে নিতে ঊর্ধ্বাঙ্গের অন্তর্গত মুখে তারা অবিরাম গালাগালি করে। দারোগাকে ধরলে তিনজন পুলিসের তিন দ্বিগুণে ছয়টা পা চলতে থাকে সারা গ্রাম জুড়ে। পা পিছু দুজন করে মোট বারোজনকে তারা ধরে। তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে সবাইকে বসিয়ে রাখে কালাম মাঝির বাড়ির বাইরে। তহসেন সকালে এসেছে সাদা পোশাকে, বৌ ছেলেমেয়ে রেখে সে চলে যাবে বেলা সাড়ে দশটার মধ্যেই। বাপের কাছে সে বারবার আফসোস করে, এক নম্বর। আসামীই তো ধরা পড়লো না। কী মুশকিল। তমিজকে খুঁজতে পুলিস কোনো জায়গা। আর বাকি রাখে না। এমন কি তহসেনের কথায় তার নিজের বাড়ির ঘরে ঘরেও তমিজকে খোঁজা হয় তন্ন তন্ন করে। তহসেন তার দিকে বারবার আড়চোখে তাকালে কালাম মাঝি মুখ কাচুমাচু করে বলে, এ শালা মণ্ডলের কাম। হামার সাথে দুষমুনি করা মণ্ডলই বুঝি তমিজকে কোটে সরায়া দিলো। মণ্ডলবাড়ি একবার দেখবা নাকি?

তহসেন বলে, পাগল হলেন নাকি? শরাফত মণ্ডলের সঙ্গে বাপের বিবাদ করাটা তহসেন সায় দিতে পারে নি কখনোই। কাদেরের ক্ষমতা এখন মেলা। তার বড়োভায়ের ছেলেটা এবার ম্যাট্রিক দেবে, ছাত্র নাকি খুব ভালো। তার ছোটো বোনটা ভি এম গালর্স স্কুলে তহসেনের মেয়ের সঙ্গে পড়ে, সেটাও পরীক্ষায় ওপরদিকেই থাকে। আজিজ টাউনে বাড়ি কিনেছে হিন্দু পাড়ায়, কী সুন্দর বাড়ি। এইসব লোকের সঙ্গে তার বাপের গোলামাল। আর খাতির যতো সব ছোটলোকের সঙ্গে। গোমরা মুখ করে তহসেন বলে, আমি যাই। দুইটার দিকে ফোর্সের সঙ্গে যেতে হবে কাহালু, তেভাগার শয়তানগুলো আজ বিকালে ময়েজ সরকারের বাড়ির গোলা লুট করতে পারে। যাই। আমতলির দারোগার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সে বলে, গোলাবড়িটা একবার দেখতে পারেন। তবে একটা রাত পুরো পেয়েছে, বেটা কি আর বসে আছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *