1 of 2

৪৭. ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা

অধ্যায় : ৪৭ ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা

ধারা-১১১১

ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার সংজ্ঞা প্রতিরক্ষা বলিতে ব্যক্তির নিজের অথবা অপরের দেহ, জীবন, মাল ও ইজ্জতের উপর আক্রমণের মোকাবিলায় যুক্তিসংগত শক্তি প্রয়োগকে বুঝায়।

বিশ্লেষণ

মানবদহে, তাহার জীবন, তাহার মাল ও ইজ্জত-আক্রর বিরুদ্ধে অবৈধ আক্রমণ প্রতিহত করাকে আইনের পরিভাষায় “দাফউস সাইল”(LL. Las)অর্থাৎ ‘আক্রমণকারীকে প্রতিহতকরণ’, যে ব্যক্তি অবৈধ আক্রমণ করে তাহাকে “সাইল” (Lal) অর্থাৎ আক্রমণকারী এবং যে ব্যক্তি আক্রান্ত হয় তাহাকে মাসূল আলায়হ্ (Cla J.) অর্থাৎ ‘আক্রান্ত ব্যক্তি বলে। আক্রমণ প্রতিহত করা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্র বাণী :

فمن اعتدى عليكم فاتوا عليه بمثل ما اعتدى عليكم.

“সুতরাং যে কেহ তোমাদের উপর আক্রমণ করিল তাহার উপর তোমরাও অনুরূপ আক্রমণ কর” (সূরা বাকারা : ১৯৪)।

ইসলামী শরীআতে জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর বিরুদ্ধে অবৈধ আক্রমণ প্রতিহত করা আক্রান্ত ব্যক্তির শুধু অধিকারই নয়, বরং কর্তব্য এবং ক্ষেত্রভেদে বাধ্যতামূলক কর্তব্য। ইজ্জত-আব্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রতিহত করা ফকীহগণের ঐক্যমত অনুযায়ী বাধ্যতামূলক কর্তব্য। ইমাম আবু হানীফা (র)-এর প্রসিদ্ধ মত এবং ইমাম মালেক ও শাফিঈ (র)-এর অগ্রগণ্য মত অনুসারে মানবদেহের উপর আক্রমণ প্রতিহত করাও বাধ্যতামূলক কর্তব্য।

৫৭২

ইমাম আহমাদ (র)-এর মতে মানবদেহের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রতিহত করা বাধ্যতামূলক কর্তব্য নহে, তবে বৈধ। এই মতের সমর্থনে ইমাম মালেক ও শাফিঈ (র)-এর একটি পরোক্ষ মতও আছে। কিছু সংখ্যক হাম্বলী ফকীহ অরাজকতা বিদ্যমান থাকাকালে আক্রমণ প্রতিহত করাকে বৈধ এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাধ্যতামূলক বলিয়াছেন। কিছু সংখ্যক মালিকী ও শাফিঈ ফকীহ্ও এই মত পোষণ করেন।

ফকীগণের অধিকাংশের মতে মালের উপর আক্রমণ প্রতিহত করা বৈধ, বাধ্যতামূলক কর্তব্য নহে। মালিক চাহিলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারে আবার নাও করিতে পারে। মানব জীবন ও তাহার ইজ্জত-আব্রু এবং মালের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রতিহত করার বিষয়ে উক্তরূপ পার্থক্যের কারণ এই যে, কোন ব্যক্তির জন্য অপর ব্যক্তিকে তাহার জীবন সংহার, দৈহিক ক্ষতিসাধন ও ইজ্জত লুণ্ঠনের অধিকার বা অনুমতি প্রদান বৈধ নহে এবং অনুমতি প্রদান করা হইলেও অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্যও উহার উপর হস্তক্ষেপ করা বৈধ নহে। অপরদিকে মালের মালিক ইচ্ছা করিলে অবৈধ দখলদারের পক্ষে তাহার মালিকানা স্বত্ব ত্যাগ করিতে পারে এবং এই অবস্থায় উক্ত মালের ভোগ-ব্যবহার দখলদারের জন্য বৈধ হইয়া যায়।

ধারা-১১১২

মানবদেহের উপর আক্রমণ মানবদেহের উপর আক্রমণ যদি –

(১) এমন প্রকৃতির হয় যে, উহার দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি নিহত হওয়ার আশংকা করে;

(২) এমন আশংকা সৃষ্টি করে যে, আক্রান্ত ব্যক্তি উপলব্ধি করিতে থাকে যে, সে মারাত্মক আঘাত পাইবে;

(৩) যেনার উদ্দেশ্যে হইয়া থাকে; (৪) মানুষ অপহরণের উদ্দেশ্যে হইয়া থাকে; তাহা হইলে সেই ক্ষেত্রে আক্রমণকারীকে হত্যা করা বৈধ।

বিশ্লেষণ

উপরোক্ত ক্ষেত্রসমূহে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্য কোন পন্থায় আক্রমণ প্রতিহত করিতে সক্ষম না হইলে আক্রমণকারীকে হত্যা করিতে পারিবে। মহানবী (সা)

৫৭৩

বলেন?

قاتل دون نفسك .

“তোমরা আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ কর”। ইজ্জত-আব্রুর উপর আক্রমণ প্রতিহত করা এমন একটি বাধ্যতামূলক কর্তব্য যে বিষয়ে ফকীহগণ সম্পূর্ণ একমত। যেমন কোন নারী যদি কোন পাষণ্ডের আক্রমণের শিকার হয়, তবে সেই অবস্থায় নিজের জান-মাল ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য সে আক্রমণকারীকে হত্যা করিলে ইহার জন্য সে দোষী হইবে না।

উমার (রা)-র খিলাফতকালে এক পাষণ্ড এক মহিলার উপর অপরাধমূলক আক্রমণ করিলে উক্ত মহিলা তাহাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করে। উমার (রা) ফয়সালা দান করেন যে, নিহত ব্যক্তির কোন দিয়াত নাই।৬

মানুষ অপহরণকারীকে ভিন্নতর কোন পন্থায় পরাস্ত করা সম্ভব না হইলে তাহাকেও হত্যা করা বৈধ। কারণ এই বিষয়টিও জীবনের নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট। জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তার পরিধির মধ্যে অপর ব্যক্তির জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুও অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ অন্য ব্যক্তির বা তাহার মাল ও ইজ্জত আক্রান্ত হওয়ার সময়ে ও স্থানে উপস্থিত ব্যক্তি তাহার উপর আক্রমণ প্রতিহত করিতে সাহায্য করিবে। এই বিষয়ে মহানবী (সা) বলেন :

ان المؤمنين يتعاونون على الفتن .

“ঈমানদারগণ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে পরস্পরকে সাহায্য করে।”

أنصر أخاك ظالما أو مظلوما .

“তোমার ভ্রাতাকে সাহায্য কর সে যালেম অথবা মজলুম যাহাই হউক”।৮ অনন্তর আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত বাণীও এখানে প্রযোজ্য?

تعاونوا على البر والتقوى ولا تعاونوا على الاثم والعدوان .

১৩

“তোমরা সঙ্কর্মে ও তাকওয়ায় পরস্পরের সহযোগিতা করিবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে পরস্পরের সাহায্য করিবে না” (সূরা মাইদা : ২)।

উপরোক্ত আয়াতের ভিত্তিতে বলা যায়, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করা একটি সৎকর্ম এবং তাহাকে সাহায্য না করা একটি অন্যায়কর্ম, প্রকারান্তরে অন্যায়কারীকে সাহায্য করার নামান্তর।

৫৭৪

ধারা-১১১৩ প্রতিরক্ষায় কৃত কোন কর্ম অপরাধ নহে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণকালে কৃত কোন কিছুই অপরাধ হিসাবে গণ্য নহে।

বিশ্লেষণ

আত্মরক্ষাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। অবৈধ আক্রমণ প্রতিহত করিতে গিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি তাহার উপস্থিত বিবেচনা ও প্রয়োজনমতে যাহা কিছু করে তাহা অপরাধ হিসাবে গণ্য নহে। ইয়ালা ইবন উমাইয়্যা (রা) বলেন, আমার এক কর্মচারী জনৈক ব্যক্তির সহিত বিবাদে লিপ্ত হইয়া একজন অপরজনের হাতের আঙ্গুল দাত দিয়া কামড়াইরা ধরে। যাহার আঙ্গুল কামড়াইয়া ধরা হয় সে সজোরে তাহার আঙ্গুল টান দিলে অপর ব্যক্তির সামনের পাটির দুইটি দাঁত উপড়াইয়া যায়। সে মহানবী (স)-এর নিকট বিচারপ্রার্থী হইলে তিনি তাহার মোকদ্দমা খারিজ করিয়া দেন এবং বলেন, তোমার মুখের মধ্যে তাহার হাত ঢুকাইয়া রাখিবে আর তুমি তাহা উটের মত চিবাইতে থাকিবে না কি!”

ধারা-১১১৪

অনধিকার প্রবেশ কাহারো বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং বাড়ির বাসিন্দাগণের বাধাদান সত্ত্বেও অনুপ্রবেশকারী বিরত না হইলে তাহারা প্রয়োজনীয় শক্তি দ্বারা তাহাকে প্রতিহত করিতে পারিবে।

বিশ্লেষণ

অপরের অন্দর বাড়িতে কাহারও প্রবেশের প্রয়োজন হইলে বাড়ির বাসিন্দাগণের অনুমতি সাপেক্ষে প্রবেশ করিতে হইবে। এই সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে?

ايها الذين أموا لأنوا بيوتا غير بيوتكم حتى تستانسوا وسلموا على أهلها ط ذلكم خيركم لعلكم ترون . فان لم تجوا فيها أحدا فلا تنها حتى يؤذن لكم ج وإن قيل لكم ارجعوا قازجوا ممو أزكى لكم ط والله بما تعملون علي”

৫৭৫

“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অপর কাহারও গৃহে গৃহবাসীদের অনুমতি না লইয়া এবং তাহাদেরকে সালাম না করিয়া প্রবেশ করিও না। ইহাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যাহাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। যদি তোমরা গৃহে কাহাকেও না পাও তবে উহাতে প্রবেশ করিও না যতক্ষণ না তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয়। যদি তোমাদেরকে বলা হয়, ফিরিয়া যাও’, তবে তোমরা ফিরিয়া যাইবে। ইহাই তোমাদের জন্য উত্তম এবং তোমরা যাহা কর সেই সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত” (সূরা নূর ও ২৭-২৮)।

উপরোক্ত আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, অপরের ঘরে প্রবেশ করিতে হইলে অনুমতি লইতে হইবে। ঘরে কেহ না থাকিলে অথবা বাসিন্দাগণ অনুমতি না দিলে জোরপূর্বক প্রবেশ করা যাইবে না, বরং ফিরিয়া যাইতে হইবে। অতএব কোন ব্যক্তি অপরের গৃহে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ করিলে গৃহবাসীগণ প্রয়োজনীয় শক্তি দ্বারা অনুপ্রবেশকারীকে প্রতিহত করিবে, এমনকি প্রয়োজন হইলে সশস্ত্র প্রতিরোধও করা যাইবে। ইহাতে অনুপ্রবেশকারী আহত বা নিহত হইলে গৃহবাসীগণ দায়ী হইবে না।

ধারা-১১১৫ চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশ চুরি, দস্যুতা বা অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ বা প্রবেশের উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে।

বিশ্লেষণ

চুরি ও দস্যুতা হদ্দের আওতাভুক্ত অপরাধ। চুরির অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হস্তকর্তন এবং দস্যুতার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অতএব চোর বা দস্যুর অপরাধমূলক প্রবেশে বাধাদান করিতে গিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি অপরাধীকে হত্যা করিলে ইহার জন্য সে দায়ী হইবে না। এমনকি চোর বা দস্যু তাহার মাল লইয়া পলায়নকালে তাহাদেরকে হত্যা ব্যতীত উক্ত মাল উদ্ধার করা সম্ভব না হইলে হত্যাকাণ্ডও ঘটানো বৈধ। মহানবী (সা) বলেন :

من أريد ماله بغير حق فقاتل فقت فهو شهيد .

“কাহারও মাল অন্যায়ভাবে ছিনাইয়া লওয়া হইলে এবং সে তাহা প্রতিহত করিতে গিয়া নিহত হইলে শহীদ গণ্য হইবে।”১০

৫৭৬

হিদায়া গ্রন্থে বলা হইয়াছে যে, রাত্রিবেলা কোন ব্যক্তির গৃহে চোর প্রবেশ করিয়া তাহার মাল বাহির করিয়া লইয়া গেলে এই অবস্থায় চোরের পিছু ধাওয়া করিয়া তাহাকে হত্যা করা বৈধ হইয়া যায়। তবে চোর বা ডাকাত মাল ফেলিয়া পলায়ন করিলে তাহার পিছু ধাওয়া করিয়া তাহাকে হত্যা করা বৈধ নহে, তবে গ্রেপ্তার করিয়া আইনানুগ কর্তৃপক্ষের নিকট সোপর্দ করিতে হইবে।

ধারা-১১১৬

অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কোন ব্যক্তি আইনসম্মতভাবে সম্পত্তি ভোগদখল করা অবস্থায় অপর কেহ উহা জবরদখলের উদ্যোগ গ্রহণ করিলে বা জবরদখল করিলে উহার বিরুদ্ধে ভোগদখলকারী যুক্তিসংগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।

বিশ্লেষণ

সম্পত্তি প্রতিরক্ষার অধিকার তখনই জন্মে যখন উহার বিরুদ্ধে কোন নির্দিষ্ট অপরাধ সংঘটিত হয় বা সংঘটনের অপচেষ্টা চলে। কোন অবস্থায় এবং কোন ক্ষেত্রে প্রয়োজনাতিরিক্ত হিংস্রতা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত নহে। উদারহণস্বরূপ জবরদখলকারী অস্ত্রবিহীনভাবে অন্যের সম্পত্তিতে অবস্থান গ্রহণ করিয়াছে। এই অবস্থায় তাহাকে মারাত্মক অস্ত্র দ্বারা আঘাত করা যাইবে না। জবরদখলকারী তাহার জবরদখল ত্যাগ করার সংগে সংগে প্রতিরক্ষার অধিকার শেষ হইয়া যায়। এই অবস্থায় তাহার পিছু ধাওয়া করিয়া তাহাকে আহত বা নিহত করা অপরাধ হিসাবে গণ্য হইবে।

ধারা-১১১৭ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের শর্তাবলী (ক) কোন ব্যক্তি আক্রান্ত হইবার বা আক্রমণের আশংকা করিলে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে, যদি –

(১) আক্রমণকারী আক্রান্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে, কর্মটি করিতেছে তাহা আইনত আক্রমণকর্ম হয়;

(২) আক্রমণকারীর কর্মটি আইনত শাস্তিযোগ্য কর্ম হয় এবং সে আইনের আওতায় আনয়নযোগ্য হয়;

৫৭৭

(৩) আক্রমণ ভিন্ন কোন সহজলভ্য পন্থায় প্রতিহত করা সম্ভব না হয়।

(খ) আক্রমণ প্রতিহত করিতে যতখানি আঘাত হানা প্রয়োজন, আক্রান্ত ব্যক্তি ততখানি আঘাত হানিতে পারিবেন

তবে শর্ত থাকে যে, এই শক্তি প্রয়োগ পরিমাপযোগ্য নহে।

বিশ্লেষণ

আক্রমণকারীকে প্রতিহত করার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে কতিপয় বিধিনিষেধ মানিয়া চলিতে হয়। প্রথমত, আক্রমণকারীর কর্মটি আইনের দৃষ্টিতে আক্রমণের পর্যায়ভুক্ত হইতে হইবে, অন্যথায় প্রতি-আক্রমণ বৈধ হইবে না। যেমন পিতা কর্তৃক পুত্রকে অথবা শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রকে সামান্য প্রহার আক্রমণ হিসাবে গণ্য নহে। কিন্তু কোন ব্যক্তির অস্ত্রসহ অপর ব্যক্তির উপর ঝাপাইয়া পড়া অবশ্যই আক্রমণ হিসাবে গণ্য হইবে।

আক্রমণকারী অপর ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে কর্মটি করিতেছে তাহা আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধকর্ম হইতে হইবে এবং আক্রমণকারীকেও এমন পর্যায়ের ব্যক্তি হইতে হইবে যাহাকে আইনের আওতায় শাস্তি প্রদান করা সম্ভব। ইমাম আবু হানীফা (র) ও তাহার সহচরবৃন্দের মতে আক্রমণকারীর কর্মটি শাস্তিযোগ্য অপরাধকর্মের অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরী। তাহা হইলেই আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বৈধ হইবে। ইমাম মালেক, শাফিঈ ও আহমাদ (র)-এর মতে আক্রমণকারীর কর্মটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ কর্মের অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরী নহে, অবৈধ কর্ম হওয়াই যথেষ্ট। অনুরূপভাবে আক্রমণকারী ব্যক্তিকেও আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য হইতে হইবে, ইহা ইমাম আবু হানীফা (র)-এর অভিমত। অপর তিন ইমাম ও ইমাম আবু ইউসুফ (র)-এর মতে আক্রমণকারীর মধ্যে উক্তরূপ শর্ত বিদ্যমান থাকা জরুরী নহে। অতএব শেষোক্ত ব্যক্তিগণ গৃহপালিত পশুর হিংস্র কর্মকেও আক্রমণ হিসাবে গণ্য করেন। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফার মতে উহা আক্রমণ নহে।

যে কর্ম আরম্ভ হয় নাই তাহার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার অধিকার সৃষ্টি হয় না। তবে যুক্তিসংগত কারণ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় প্রবল ধারণার ভিত্তিতে আক্রান্ত হওয়া আসন্ন হইলেও আক্রমণকারীকে প্রতিহত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাইতে পারে।

আক্রমণকারীর আক্রমণ সহজতর পন্থায় প্রতিহত করা সম্ভব হইলে প্রতি-আক্রমণের পরিবর্তে তাহাই অবলম্বন করা বাধ্যতামূলক। যেমন আক্রান্ত

৫৭৮

ব্যক্তি হাঁক-ডাক ছাড়িয়া অথবা সাহায্যের জন্য লোকজনকে ডাকিয়া আক্রমণকারীকে প্রতিহত করিতে পারিলে তাহাকে মারধর করা, আহত করা বা হত্যা করা বৈধ নহে, তাহা করিলে সে অপরাধী সাব্যস্ত হইবে।১২ সে যদি পুলিশ ডাকিয়া অথবা অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করিয়া নিজেকে বিপদমুক্ত করিতে পারে তাহা হইলে কঠোরতর পন্থা গ্রহণ তাহার জন্য বৈধ নহে।১৩ অতএব ভিন্নতর বা সহজতর পন্থায় সম্ভব না হইলে সেই অবস্থায়ই কেবল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে।

আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যতখানি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী ততখানিই গ্রহণ করা যাইবে। সীমাতিরিক্ত আঘাত করা প্রতিরক্ষার আওতায় পড়ে

। আলাউদ্দীন আল-কাসানী (র) বলেন, হত্যা করা ব্যতীত আক্রমণকারীকে প্রতিহত করা সম্ভব না হইলে তাহাকে প্রতি-আক্রমণ করিয়া হত্যা করা যাইবে। আক্রমণকারী বিপক্ষের প্রতি সশস্ত্র আক্রমণ করিলেই তাহাকে হত্যা করা বিপক্ষের জন্য বৈধ হইয়া যায়।১৪

ধারা-১১১৮

ঠাট্টাচ্ছলে অস্ত্রধারণ করিলে কোন ব্যক্তি খেলা বা ঠাট্টাচ্ছলে অপর ব্যক্তির সামনে স্বীয় অস্ত্র উন্মুক্ত করিলে উহার দ্বারা প্রতিরক্ষা অধিকার সৃষ্টি হয় না। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এইরূপ হয় যে, বাহ্যত খেলা বা ঠাট্টাচ্ছলে অস্ত্র উন্মুক্ত করা হইলেও বাস্তবে আক্রমণই উদ্দেশ্য, তাহা হইলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে।

বিশ্লেষণ

এই অবস্থায় অস্ত্রধারীকে হত্যা করা ব্যতীত প্রতিহত করা সম্ভব না হইলে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য তাহাকে হত্যা করা বৈধ।

ধারা-১১১৯

আক্রমণের প্রকৃতি ও মাত্রা আক্রমণ কঠোর অথবা সাধারণ যে প্রকৃতিরই হউক উহার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে।

৫৭৯

বিশ্লেষণ

আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগের সময় পরিস্থিতির একেবারে নির্ভুল পরিমাপ করিয়া আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব নহে। আক্রমণের পরিসরের কোন সীমা নির্ধারিত নাই যে, নির্দিষ্ট মাত্রায় আক্রমণ হইলেই কেবল আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে, উহার কম হইলে গ্রহণ করা যাইবে না। অতএব আক্রমণ সাধারণ বা মারাত্মক যে প্রকৃতিরই হউক, আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দ্বিধায় উহার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে। অবশ্য সে আক্রমণের ভয়াবহতার মাত্রা অনুযায়ী আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে, উহার অতিরিক্ত নহে।১৫

ধারা-১১২০

যেই ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা অধিকার নাই কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে কর্মটি সম্পাদন আইনত বাধ্যতামূলক অথবা সরকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যাহা করিবার অনুমতি প্রদান করা হইয়াছে, সেই কর্ম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ সম্পাদন করিলে তাহা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসাবে গণ্য হইবে না, যদিও ইহা অন্য পক্ষের নিকট আক্রমণ বলিয়া প্রতিপন্ন হয়।

. বিশ্লেষণ

আক্রমণ বা আইন লংঘন বিদ্যমান থাকার অর্থ এই যে, আক্রান্ত ব্যক্তির উপর যে কর্মটি সংঘটিত হইতে যাইতেছে সেই কর্মটি আক্রমণ বা আইন লংঘনের পর্যায়ভুক্ত হইতে হইবে, অন্যথায় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বৈধ নহে। অতএব আইন যে কর্মটি সম্পাদন বাধ্যতামূলক করিয়াছে বা যাহা করিবার অনুমতি বা নির্দেশ প্রদান করিয়াছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের সেই কর্মটি আইন লংঘন বা আক্রমণ হিসাবে গণ্য নহে। যেমন সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তথ্য অনুসন্ধান করা, তাহাকে গ্রেপ্তার বা বন্দী করা আইন লংঘন বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আক্রমণ নহে। অনুরূপভাবে অপরাধীর বিরুদ্ধে বিচার বিভাগের দণ্ড কার্যকর করাও আক্রমণ হিসাবে গণ্য নহে, বরং তাহা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্তব্য পালন হিসাবে গণ্য।১৬

৫৮০

ধারা-১১২১

নাবালেগ ও পাগলের আক্রমণ কোন ব্যক্তি নাবালেগ বা পাগল দ্বারা আক্রান্ত হইলে তাহার প্রতিরক্ষা অধিকার বহাল থাকিবে।

বিশ্লেষণ

ইমাম আবু হানীফা ও মুহাম্মাদ (র)-এর মতে কোন ব্যক্তি নাবালেগ বা পাগলের দ্বারা আক্রান্ত হইলে প্রয়োজনবােধে সে সংশ্লিষ্ট আক্রমণকারীকে হত্যাও করিতে পারিবে, কিন্তু সে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবে, যদিও তাহার উক্ত কর্ম হদ্দ-এর আওতায় আসে না। ১৭ কিন্তু ইমাম মালেক, শাফিঈ, আহমাদ ও আবু ইউসুফ (র)-এর মতে আক্রান্ত ব্যক্তির উপর কোনরূপ ক্ষতিপূরণ ধার্য হইবে

। কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি স্বীয় জান-মালের হেফাজতের জন্যই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছে।১৮

উপরোক্ত দুই বিপরীত অভিমতের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য এই যে, হানাফীগণের মতে আক্রমণ কর্মটি শাস্তিযোগ্য অপরাধকর্ম হইতে হইবে এবং একই সংগে যাহার দ্বারা কর্মটি সংঘটিত হইবে তাহাকে আইনের আওতায় আনয়ন সম্ভবপর হইতে হইবে। এক্ষেত্রে আক্রমণ কর্মটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ (যদিও নাবালেগ, পাগল ও পশুর ক্ষেত্রে অপরাদ নহে) হইলেও আক্রমণকারী (নাবালেগ ও পাগল) আইনের আওতাভুক্ত নহে। তাই এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি যাহা করে তাহা “প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নহে, বরং “জরুরী প্রয়োজনে গৃহীত পদক্ষেপ মাত্র। অতএব সে আক্রমণকারীর অংগহানি বা প্রাণনাশ করিলে ইহার জন্য তাহাকে দিয়াত বা ক্ষতিপূরণ প্রদান করিতে হইবে। অপরদিকে ইমাম মালেক, শাফিঈ ও আহমাদ (র)-এর মতে এক্ষেত্রে আক্রমণকর্মটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ কর্ম হওয়া জরুরী নহে, আইন বিরুদ্ধ কর্ম হওয়াই যথেষ্ট এবং আক্রমণকারীরও আইনের আওতায় আনয়নযোগ্য হওয়াও জরুরী নহে। তাই নাবালেগ ও পাগলের আক্রমণের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপ “প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসাবেই গণ্য, “জরুরী পদক্ষেপ নহে এবং এই ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির কর্ম অপরাধ হিসাবে গণ্য নহে এবং ইহার জন্য সে ক্ষতিপূরণ দিতেও বাধ্য নহে।১৯

ধারা-১১২২

পশুর আক্রমণ কোন ব্যক্তি পশু কর্তৃক আক্রান্ত হইলে তাহার প্রতিরক্ষার অধিকার বহাল থাকিবে।

বিশ্লেষণ

নাবালেগ ও পাগলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধান ও নীতিমালা বাকশক্তিহীন পশুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং এই ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের ব্যাপারেও ফকীহগণের মধ্যে একইরূপ মতভেদ বিদ্যমান। হানাফী ফকীহগণের মতে কোন ব্যক্তির প্রতি পশুর হিংস্রকর্ম প্রতিহত করা “প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নহে, বরং “জরুরী প্রয়োজনে গৃহীত পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য এবং মালিকী, শাফিঈ ও হাম্বলী ফকীহগণের মতে এই ক্ষেত্রেও গৃহীত পদক্ষেপটি “প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য। অতএব প্রথমোক্ত মত অনুযায়ী পশু নিহত বা আহত হইলে ক্ষতিপূরণ বাধ্যকর হইবে এবং শেষোক্ত মত অনুযায়ী বাধ্যতামূলক নহে। ২০

ধারা-১১২৩

প্রতিরোধের প্রারম্ভ ও সমাপ্তিকাল যুক্তিসংগত কারণ বিদ্যমান থাকিলে প্রবল ধারণার ভিত্তিতে আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের সূচনা হইতে পারে এবং আক্রমণ প্রতিহত হওয়ার সংগে সংগে প্রতিরক্ষার অধিকার শেষ হইয়া

যায়।

বিশ্লেষণ

আক্রমণের উদ্যোগ ও ভীতি দৃষ্ট হইলেই ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার আরম্ভ হয় এবং আতংক, ভীতি বা আক্রমণ প্রতিহত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত অধিকার বহাল থাকে। যেমন আক্রমণকারী বাধাগ্রস্ত হইয়া পলায়ন করিল অথবা সে এমনভাবে আহত হইল যে, তাহার পুনরায় আক্রমণ করার শক্তি রহিত হইয়া গিয়াছে, এই অবস্থায় তাহার পশ্চাদ্বাবন করা বা তাহাকে আরও আঘাত করা আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য বৈধ নহে।২১

ধারা-১১২৪

আক্রমণের খাহেশ আক্রমণকারী কেবল আক্রমণের আকাঙ্খা ব্যক্ত করিলেই প্রতিরক্ষার অধিকার সৃষ্টি হয় না।

৫৮২

বিশ্লেষণ

কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে আক্রমণ করার খাহেশ ব্যক্ত করিলেই কেবল উহাতে শেষোক্ত ব্যক্তির প্রতিরক্ষার অধিকার জন্মায় না, বরং ইহার জন্য তৎক্ষণাৎ আক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশংকা বিদ্যমান থাকা জরুরী। অতএব যে ব্যক্তি আক্রমণ করার শুধু আকাঙ্খ ব্যক্তি করিয়াছে, কিন্তু তাহার আক্রমণ করার সামর্থ্য নাই, তাহাকে মারধর করা, আহত করা বা হত্যা করা বৈধ নহে।২২

ধারা-১১২৫

আক্রমণকারীর প্রতি-আক্রমণ আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা প্রতিহত হইয়া আক্রমণকারী পুনরায় যে আক্রমণ করে তাহা তাহার জন্য প্রতিরক্ষা হিসাবে গণ্য হইবে না।

বিশ্লেষণ

আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিরক্ষার জবাব দেয়ার অধিকার আক্রমণকারীর নাই। আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা বাধাগ্রস্ত হইয়া সে এই দাবি করিতে পারিবে না যে, সে যাহা করিতেছে তাহা নিজের প্রতিরক্ষার জন্য করিতেছে। এই অবস্থায় তাহাকে হত্যা বা আহত করিলে আক্রান্ত ব্যক্তি দায়ী হইবে না। এই বিষয়ে হযরত আলী (রা)-র একটি সিদ্ধান্ত প্রণিধানযোগ্য। এক নারী বাসর রাত্রে তাহার প্রেমিক প্রবরকে তাহার শয়নকক্ষে লুকাইয়া রাখে। তাহার স্বামী শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলে উক্ত প্রেমিক তাহাকে আক্রমণ করে। স্বামী উক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করার পর স্ত্রী তাহাকে আক্রমণ করিয়া হত্যা করে। হযরত আলী (রা) স্বামী হত্যার অপরাধে স্ত্রীর মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন, তাহার আক্রমণকে নিজের বা অপরের আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করেন নাই। ২৩

ধারা-১১২৬

আক্রান্ত ব্যক্তির ভুলকর্ম আক্রমণকারীকে প্রতিহত করাকালে আক্রান্ত ব্যক্তি ভুল বা অসাবধানতা বশত ভিন্ন ব্যক্তিকে আহত বা হত্যা করিলে ক্ষতির প্রকৃতি অনুযায়ী দিয়াত ক্ষতিপূরণ প্রদান বাধ্যকর হইবে।

বিশ্লেষণ

প্রতিরক্ষার মূলনীতি এই যে, “প্রতিরক্ষাকল্পে কৃত কর্ম বৈধ এবং শাস্তিযোগ্য নহে”।২৪ অর্থাৎ আক্রমণকারীকে প্রতিরক্ষার সময় যে আঘাত হানা প্রয়োজন, আক্রান্ত ব্যক্তি তাহা হানিতে পারে। কিন্তু তাই বলিয়া সে নিরপরাধ ব্যক্তিকে আঘাত হানিতে পারে না। তবে প্রতিরক্ষাকালে ভুলবশত বা অসাবধানতাবশত তাহার আঘাত নিরপরাধ ব্যক্তির দেহেও লাগিয়া যাইতে পারে। যেমন একদল লোক হঠাৎ করিয়া তাহাকে আক্রমণ করিল। এই অবস্থায় তাহাদের সকলকে এককভাবে প্রতিহত করিতে গিয়া কাছেই অবস্থানরত কোন ব্যক্তির উপর গিয়া তাহার আঘাত পতিত হইতে পারে। এই ক্ষেত্রে সে ভুলবশত অপরাধ করিয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে এবং ক্ষতির মাত্রা অনুযায়ী সে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে দিয়াত ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবে।২৫

ধারা-১১২৭

অপরের ঘরে উঁকি মারিলে কোন ব্যক্তি দেয়ালের ছিদ্র বা দরজা-জানালার ফাঁক দিয়া অপরের ঘরে উঁকিঝুঁকি মারিলে এবং বারণ করা সত্ত্বেও সে বিরত না হইলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে, কিন্তু তাহার চক্ষুর ক্ষতিসাধন করা যাইবে না।

বিশ্লেষণ

দেয়াল বা বেড়ার ছিদ্র দিয়া অথবা দরজা-জানালার ফাঁক দিয়া অপরের ঘরের। অভ্যন্তরে উঁকিঝুঁকি মারা অন্যায় বা অপরাধকর্ম হইলেও ইহাতে ঘরের বাসিন্দাদের এমন প্রতিরক্ষার অধিকার জন্মায় না যে, তাহারা উক্ত কর্মে লিপ্ত ব্যক্তির দৈহিক ক্ষতি বা চক্ষু উৎপাটন করিতে পারে। তবে তাহারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারে। যেমন তাহাকে বারণ করা, দরজা-জানালায় পর্দা টাঙ্গানো, অপ্রয়োজনীয় ছিদ্র বন্ধ করিয়া দেওয়া ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে অপরাধীর চক্ষু উৎপাটন বা দৈহিক ক্ষতি সাধন করা হইলে ইহার জন্য দায়ী হইতে হইবে। ইহাই হানাফী মাযহাবের গৃহীত মত। এই বিষয় সংক্রান্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন :

لو أن إمرة اطلع عليك بغير اذن فحذفته بحصاة قفقات عينه

لم يكن علي جناح .

৫৮৪

“কোন ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে তোমার ঘরের অভ্যন্তরে উঁকিঝুঁকি মারিলে এবং তুমি কংকর নিক্ষেপ করিয়া তাহার চক্ষু নষ্ট করিয়া দিলে তোমার কোন অপরাধ হইবে না।” ২৬

عن سهل بن سعد أن رجلا اطلع في جحر من باب البي وكان الرسول الله لا يحك راسه بدري في يده فقال رسول الله

لو علمت أنك تنظر لعنت به في عينك انما جعل الإتيان

من أجل البصر .

“সাহল ইবন সাদ (রা) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী (সা)-এর ঘরের দরজার ছিদ্র দিয়া উঁকিঝুঁকি মারে। তিনি তখন তাহার হস্তস্থিত লোহার চিরুনী দ্বারা নিজের মাথার চুল এলোমেলো করিতেছিলেন। তিনি বলেন : আমি যদি জানতাম যে, তুমি তাকাইতেছিলে তাহা হইলে তোমার চোখে ইহা দ্বারা আঘাত করিতাম। চোখের কারণেই (বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে) অনুমতি প্রার্থনার নির্দেশ প্রদান করা হইয়াছে।”২৭

উপরোক্ত হাদীসদ্বয়ের ব্যাখ্যায় হানাফী বিশেষজ্ঞ আলেমগণ বলেন যে, বিনা অনুমতিতে অপরের ঘরের অভ্যন্তরভাগে উকিঝুঁকি মারার বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করার জন্যই কংকর বা বর্শা নিক্ষেপের কথা বলা হইয়াছে।২৮ কারণ কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির গোপন অঙ্গের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে ইহাতে তাহার চক্ষু উৎপাটন বৈধ নহে। তাই ঘরের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারার অপরাধে চক্ষু উৎপাটন বৈধ হইতে পারে না। মালিকী মাযহাবের ফকীহগণ বলেন যে, সতর্ক করা এবং প্রতিহত করার জন্যই বর্শা নিক্ষেপের কথা বলা হইয়াছে, আহত করা বা চক্ষু নষ্ট করিয়া দেওয়ার জন্য নহে। ২৯

ইমাম শাফিঈ, আহমাদ এবং অনুল্লেখযোগ্য সংখ্যক হানাফী ফকীহর মতে এই অবস্থায় সহজতর পন্থায় বাধাদানে অপরাধী বিরত না হইলে তাহার চক্ষু বিনষ্ট করিয়া দেওয়া বৈধ। এই মতের অনুসারীগণ পূর্বোক্ত হাদীস নিজেদের মতের সমর্থনে গ্রহণ করিয়াছেন। হাম্বলী ও শাফিঈ মাযহাবের ফকীহগণ এই বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। এক্ষেত্রে হানাফী ও মালিকী মাযহাবের মতই অধিক যুক্তিসংগত প্রতীয়মান হয়।

ধারা-১১২৮

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আক্রান্ত ব্যক্তি প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে তাহার বাড়ির দরজায় অথবা প্রাচীরের চতুর্দিকে ফাঁদ পাতিতে, জাল বিছাইতে এবং কাঁটা ছড়াইয়া রাখিতে পারিবে।

বিশ্লেষণ

ইমাম আবু হানীফা, শাফিঈ ও আহমাদ (র)-এর মতে ফাঁদ পাতিয়া, জাল বিস্তার করিয়া, কাঁটা ছড়াইয়া বা অনুরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়া আক্রমণকারীকে প্রতিহত করা যাইতে পারে। এজন্য বাড়ির মালিককে কোনরূপ কৈফিয়তের সম্মুখীন হইতে হইবে না।৩১

ধারা-১১২৯

আক্রান্ত ব্যক্তির পলায়ন। আক্রমণকারীর হামলা হইতে পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা করা সম্ভব হইলে আক্রান্ত ব্যক্তি তাহাই করিবে।

বিশ্লেষণ

আক্রান্ত ব্যক্তির “পলায়ন” আত্মরক্ষার উপায় হিসাবে গণ্য হইবে কিনা এই বিষয়ে ফকীহগণের মতভেদ আছে। যাহারা পলায়নকে প্রতিরক্ষার একটি উপায় হিসাবে গণ্য করেন তাহাদের মতে সুযোগ থাকিলে আক্রান্ত ব্যক্তির পলায়ন করা বাধ্যতামূলক। কারণ পলায়ন প্রতিরক্ষার একটি উত্তম উপায় এবং প্রতিরক্ষার জন্য সহজতর ও সম্ভাব্য উপায় অবলম্বন করাই আক্রান্ত ব্যক্তির কর্তব্য।৩২ কিন্তু যাহার “পলায়ন”-কে প্রতিরক্ষার উপায় হিসাবে স্বীকার করেন না তাহাদের মতে আক্রান্ত ব্যক্তির পলায়ন করা বাধ্যতামূলক নয়। প্রতিহত করা অথবা পলায়ন ব্যতীত অন্য কোন উপায় না থাকিলে আক্রান্ত ব্যক্তি আক্রমণকারীকে মোকাবিলা করিবে।৩ কিছু সংখ্যক ফকীহ পলায়নকে সংগত ও অসংগত এই দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া বলিয়াছেন যে, সংগত পলায়ন বাধ্যতামূলক এবং অসংগত (আপত্তিজনক) পলায়ন বাধ্যকর নয়। ও কিন্তু উহার দ্বারা প্রয়োজন পূর্ণ না হইলে বাধ্যকর নয়। যেমন তাহার মাল এবং পরিবার-পরিজনের ইজ্জতের প্রতিরক্ষার প্রয়োজন হইলে সেই ক্ষেত্রে “পলায়ন” প্রতিরক্ষার উপায়ও নয় এবং বাধ্যতামূলকও নয়।

ধারা-১১৩০

প্রতিরক্ষায় সীমালংঘন আক্রমণকারীকে প্রতিহত করার জন্য যতখানি আঘাত হানা প্রয়োজন ছিল উহার অতিরিক্ত আঘাত হানা অথবা আক্রমণকারী প্রতিহত হওয়ার

পরও আঘাত হানা অপরাধ হিসাবে গণ্য হইবে।

বিশ্লেষণ

প্রতিরক্ষার জন্য যতখানি ক্ষতি করা প্রয়োজন কোন অবস্থায়ই তাহার অধিক ক্ষতি পর্যন্ত প্রতিরক্ষার অধিকার বিস্তৃত নহে। যেমন আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁক-ডাক শুনিয়া আক্রমণকারী পলায়ন করিলে সেই অবস্থায় তাহার পিছু ধাওয়া করিয়া তাহাকে আহত করা যাইবে না। আহত করা হইলে ইহার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে দায়ী হইতে হইবে। অনুরূপভাবে আক্রমণকারী আহত হইয়া পলায়ন করিলে তাহার পিছু ধাওয়া করিয়া পুনরায় তাহাকে আহত করা হইলে শেষোক্ত আঘাতের জন্য দায়ী হইতে হইবে। অনুরূপভাবে আক্রমণকারী আহত হওয়ার ফলে অকেজো হইয়া পড়িলে সেই অবস্থায় তাহাকে হত্যা করা অপরাধ হিসাবে গণ্য হইবে। মোটকথা আক্রমণকারী প্রতিহত হওয়ার পর তাহার বিরুদ্ধে যে কোন অপ্রয়োজনীয় আঘাত অপরাধ হিসাবে গণ্য হইবে।৬

তথ্য নির্দেশিকা ১. হাশিয়া ইবন আবিদীন, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৮১; তুহফাতুল মুহতাজ, ৪ খণ্ড, পৃ. ১২৪; মাওয়াহিবুল

জালীখণ্ড, ৬ খণ্ড, পৃ. ৩২৩; আয-যায়লাঙ্গ ও হাশিয়া আশ-শিবলী, ৬ খণ্ড, পৃ. ১১০। ২. আল-মুগনী, ১০ খণ্ড, পৃ. ৩৫০-১। ৩. আল-ইকনা, ৪ খণ্ড, পৃ. ২৯০। ৪. হাশিয়াতুর রামলী, ৪খণ্ড, পৃ. ১৬৮; আসনাল মাতালিব, ৪ খণ্ড, পৃ. ১৬৮। ৫. আত-তাশরীউল জানাইল ইসলামী, ১ খণ্ড, ধারা ২৩৩। ৬. আত-তাশরীউল জানাইল ইসলামী, ১ খণ্ড, পৃ. ১৯৭ (ইং অনু.)। ৭. আবু দাউদ, ইমারা, বাব ৩৬, নং ৩০৭০।

৫৮৭

৮. বুখারী, মাজালিম, বাব ৪; ইকরাহ, বাব ৭; মুসলিম, বির, হাদীস নং ৬৩; তিরমিযী, ফিতান,

বাব ৬৭; দারিমী, রিকাক, বাব ৪০; আহমাদ, ৩খণ্ড, পৃ. ৯৯। ৯. বুখারী, দিয়াত, বাব ১৮, নং ৬৮৯২ (ইবনে উমার কর্তৃক বর্ণিত); মুসলিম, কাসামা, হাদীস

নং ৪৩৬৬ (১৮); আবু দাউদ, দিয়াত, বাব ২২, নং ৪৫৮৪-৫; তিরমিযী, দিয়াত, বাব ১৯, নং ১৪১৬; ইবন মাজা, দিয়াত, বাব ২০, নং ২৬৫৬; নাসাঈ, কাসামা, বাব ১৮, নং ৪৭৬২

(ইমরান ইবন হুসাইন)। ১০. অনুরূপ হাদীস দ্র. মুসনাদ আমাদ, ২খণ্ড, পৃ. ২০৬ নং ৬৯২২; বুখারী। মাজালিম, বাব ৩৩,

নং ২৪৮০; মুসলিম, আয়মান, হাদীস ২২৬; তিরমিযী, দিয়াত, বাব ২১; নাসাঈ, তাহরীম,

বাব ২২, ২৩; ইবন মাজা, হুদূদ, বাব ২১। ১১. হিদায়া, ৪ খণ্ড, পৃ. ৫৫২; শারহু ফাতহিল কাদীর, ৯ খণ্ড, পৃ. ১৬৭। ১২. হাশিয়া ইবন আবিদীন, ৫ খণ্ড, পৃ. ৪৮২; আসনাল মাতালিব, ৪ খণ্ড, পৃ. ১৬৭। ১৩. কিতাবুল উম্ম, ৬ খণ্ড, পৃ. ২৭; আসনাল মাতালিব, ৪ খণ্ড, পৃ. ১৬৭। ১৪. বাদাইউস সানাই, ৭ খণ্ড, পৃ. ৯৩। ১৫. আত-তাশরীউল জানাই, ১ খণ্ড, পৃ. ৪৭৯। ১৬. আত-তাশরীউল জানাই, ১ খণ্ড, পৃ. ৪৭৯, ধারা নং ৩৩৫। ১৭. আত-তাশরীউল জানাই, ১ খণ্ড, পৃ. ৪৭৬ (আল-বাহরুর রাইক, ৮ খণ্ড, পৃ. ৩০২)। ১৮. মাওয়াহিবুল জালীখণ্ড, ৬ খণ্ড, পৃ. ৩২৩; তাবসিরাতুল হুঙ্কাম, ২ খণ্ড, পৃ. ৩০৩; কিতাবুল

উম্ম, ৬ খণ্ড, পৃ. ১৭২; আল-মুহায্যাব, ২ খণ্ড, পৃ. ২৪৩; আল-ইকনা, ৪খণ্ড, পৃ. ২৮৯। ১৯. আত-তাশরীউল জানাঈ, ১খণ্ড, পৃ. ৪৮০। ২০. আত-তাশরীউল জানাঈ, ১ম খণ্ড। ২১. আত-তাশরীউল জানাঈ, ১ খণ্ড, পৃ. ৪৮১। ২২. আত-তাশরীউল জানাঈ, ১খণ্ড, পৃ. ৪৮২। ২৩. আত-তাশরীউল জানাঈ, ১ খণ্ড, পৃ. ৪৮০। ২৪. গ্রন্থ, ১ম খ। ২৫. আত-তাশরীউল জানাঈ, ১ খণ্ড, পৃ. ৪৮৭। ২৬. আবু দাউদ, বাব ১২৭; তিরমিযী, ইসতিযান, বাব ১৭; নাসাঈ, কাসামা, বাব ৪৭। ২৭. তিরমিযী, আবওয়াবুল ইসতিযান, বাব ১৭; বুখারী ও মুসলিম-সহ অন্যান্য গ্রন্থও দ্র.। ২৮. হাশিয়া ইবন আবিদীন, ৫ খণ্ড, পৃ. ৪৮৫। ২৯. মাওয়াহিবুল জালীখণ্ড, ৬ খণ্ড, পৃ. ৩২২-৩। ৩০. আল-মুগনী, ১০ খণ্ড, পৃ. ২৫৫; আল-মুহায্যাব, ২ খণ্ড, পৃ. ২৪২। ৩১. হাশিয়া ইবন আবিদীন, ৫ খণ্ড, পৃ. ২২৪; তুহফাতুল মুহতাজ, ৪ খণ্ড, পৃ. ৫০; আল-মুগনী,

৯খণ্ড, পৃ. ৫৭১।

৫৮৭৮

৩২. আল-মুগনী, ১০ খণ্ড, পৃ. ৫৩৫। ৩৩. আল-মুগনী, ১০ খণ্ড, পৃ. ৩৫৩; কিতাবুল উন্ম, ৬ খণ্ড, পৃ. ২৮। ৩৪. তুহফাতুল মুহতাজ, ৪ খণ্ড, পৃ. ১২৬। ৩৫. তুহফাতুল মুহতাজ, ৪ খণ্ড, পৃ. ১২৬; আসনাল মাতালিব, ৪ খণ্ড, পৃ. ১৬০। ৩৬, আত-তাশরীউল জানাঈ, ১ খণ্ড,ধারা ৩৩৬।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *