চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ঠাকুর কীর্তনানন্দে
কীর্তনিয়া দলবলের সহিত উপস্থিত। ঘরের মাঝখানে বসিয়া আছে। ঠাকুরের ইঙ্গিত হইলেই কীর্তন আরম্ভ হয়। ঠাকুর অনুমতি দিলেন।
রাম (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আপনি বলুন এরা কি গাইবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি কি বলব? — (একটু চিন্তা করিয়া) আচ্ছা, অনুরাগ।
কীর্তনিয়া পূর্বরাগ গাইতেছেন:
আরে মোর গোরা দ্বিজমণি।
রাধা রাধা বলি কান্দে, লোটায় ধরণী।।
রাধানাম জপে গোরা পরম যতনে।
সুরধুনী ধারা বহে অরুণ নয়নে।।
ক্ষণে ক্ষণে গোরা অক্ষগ ভূমে গড়ি যায়।
রাধানাম বলি ক্ষণে ক্ষণে মুরছায়।।
পুলকে পুরল তনু গদ গদ বোল।
বাসু কহে গোরা কেন এত উতরোল।।
কীর্তন চলিতে লাগিল। যমুনাতটে প্রথম কৃষ্ণদর্শন অবধি শ্রীমতীর অবস্থা সখীগণ বলিতেছেন:
ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার, তিলে তিলে আইসে যায়।
মন উচাটন নিঃশ্বাস সঘন, কদম্ব কাননে চায়।।
(রাই এমন কেনে বা হৈল)।
গুরু দুরু জন, ভয় নাহি মন, কোথা বা কি দেব পাইল।।
সদাই চঞ্চল, বসন অঞ্চল, সম্বরণ নাহি করে।
বসি বসি থাকি, উঠয়ে চমকি, ভূষণ খসিয়া পড়ে।।
বয়সে কিশোরী রাজার কুমারী, তাহে কুলবধূ বালা।
কিবা অভিলাষে, আছয়ে লালসে, না বুঝি তাহার ছলা।।
তাহার চরিতে, হেন বুঝি চিতে, হাত বাড়াইল চান্দে।
চণ্ডীদাস কয়, করি অনুনয়, ঠেকেছে কালিয়া ফান্দে।।
কীর্তন চলিতে লাগিল — শ্রীমতীকে সখীগণ বলিতেছেন:
কহ কহ সুবদনী রাধে! কি তোর হইল বিরোধে।।
কেন তোরে আনমন দেখি। কাহে নখে ক্ষিতি তলে লিখি।।
হেমকান্তি ঝামর হৈল। রাঙ্গাবাস খসিয়া পড়িল।।
আঁখিযুগ অরুণ হইল। মুখপদ্ম শুকাইয়া গেল।।
এমন হইল কি লাগিয়া। না কহিলে ফাটি যায় হিয়া।।
এত শুনি কহে ধনি রাই। শ্রীযদুনন্দন মুখ চাই।।
কীর্তনিয়া আবার গাইল — শ্রীমতী বংশীধ্বনি শুনিয়া পাগলের ন্যায় হইয়াছেন। সখীগণের প্রতি শ্রীমতীর উক্তি:
কদম্বের বনে, থাকে কোন্ জনে, কেমন শবদ্ আসি।
এক আচম্বিতে, শ্রবণের পথে, মরমে রহল পশি।।
সান্ধায়ে মরমে, ঘুচায়া ধরমে, করিল পাগলি পারা।
চিত স্থির নহে, শোয়াস বারহে, নয়নে বহয়ে ধারা।।
কি জানি কেমন, সেই কোন জন, এমন শবদ্ করে।
না দেখি তাহারে, হৃদয় বিদরে, রহিতে না পারি ঘরে।।
পরাণ না ধরে, কন কন করে, রহে দরশন আশে।
যবহুঁ দেখিবে, পরাণ পাইবে, কহয়ে উদ্ধব দাসে।।
গান চলিতে লাগিল। শ্রীমতীর কৃষ্ণদর্শন জন্য প্রাণ ব্যাকুল হইয়াছে। শ্রীমতী বলিতেছেন:
পহিলে শুনিনু, অপরূপ ধ্বনি, কদম্ব কানন হৈতে।
তারপর দিনে, ভাটের বর্ণনে, শুনি চমকিত চিতে।।
আর একদিন, মোর প্রাণ-সখী কহিলে যাহার নাম,
(আহা সকল মাধুর্যময় কৃষ্ণ নাম)।
গুণিগণ গানে, শুনিনু শ্রবণে, তাহার এ গুণগ্রাম।।
সহজে অবলা, তাহে কুলবালা, গুরুজন জ্বালা ঘরে।
সে হেন নাগরে, আরতি বাঢ়য়ে, কেমনে পরাণ ধরে।
ভাবিয়া চিন্তিয়া, মনে দঢ়াইনু, পরাণ বহিবার নয়।
কহত উপায় কৈছে মিলয়ে, দাস উদ্ধবে কয়।।
“আহা সকল মাধুর্যময় কৃষ্ণনাম!” এই কথা শুনিয়া ঠাকুর আর বসিতে পারিলেন না। একেবারে বাহ্যশূন্য, দণ্ডায়মান। সমাধিস্থ! ডানদিকে ছোট নরেন দাঁড়াইয়া। একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া মধুর কণ্ঠে “কৃষ্ণ” “কৃষ্ণ” এই কথা সাশ্রুনয়নে বলিতেছেন। ক্রমে পুনর্বার আসন গ্রহণ করিলেন।
কীর্তনিয়া আবার গাইতেছেন। বিশাখা দৌড়িয়া গিয়া একখানি চিত্রপট আনিয়া শ্রীমতীর সম্মুখে ধরিলেন। চিত্রপটে সেই ভুবনরঞ্জনরূপ। শ্রীমতী পটদর্শনে বলিলেন, এই পটে যাঁকে দেখছি, তাঁকে যমুনাতটে দেখা অবধি আমার এই দশা হয়েছে।
কীর্তন — শ্রীমতির উক্তি —
যে দেখেছি যমুনাতটে। সেই দেখি এই চিত্রপটে।।
যার নাম কহিল বিশাখা। সেই এই পটে আছে লেখা।।
যাহার মুরলী ধ্বনি। সেই বটে এই রসিকমণি।।
আধমুখে যার গুণ গাঁথা। দূতীমুখে শুনি যার কথা।।
এই মোর হইয়াছে প্রাণ। ইহা বিনে কেহ নহে আন।।
এত কহি মূরছি পড়য়ে। সখীগণ ধরিয়া তোলয়ে।।
পুনঃ কহে পাইয়া চেতনে। কি দেখিনু দেখায় সে জনে।।
সখীগণ করয়ে আশ্বাস। ভণে ঘনশ্যাম দাস।।
ঠাকুর আবার উঠিলেন, নরেন্দ্রাদি সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া উচ্চ সংকীর্তন করিতেছেন:
(১) — যাদের হরি বলতে নয়ন ঝরে তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
(যারা আপনি কেঁদে জগৎ কাঁদায়) (যারা মার খেয়ে প্রেম যাচে)
(যারা ব্রজের কানাই বলাই) (যারা ব্রজের মাখন চোর)
(যারা জাতির বিচার নাহি করে) (যারা আপামরে কোল দেয়)
(যারা আপনি মেতে জগৎ মাতায়) (যারা হরি হয়ে হরি বলে)।
(যারা জগাই মাধাই উদ্ধারিল) (যারা আপন পর নাহি বাচে)।
জীব তরাতে তারা দুভাই এসেছে রে। (নিতাই গৌর)
(২) — নদে টলমল টলমল করে, গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে।
ঠাকুর আবার সমাধিস্থ!
ভাব উপষম হইলে আবার আসন গ্রহণ করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — কোন্ দিকে সুমুখ ফিরে বসেছিলাম, এখন মনে নাই।