1 of 2

৪৫. পুরনো গোয়ালঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকে

পুরনো গোয়ালঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকে। তৃষা ইদানীং কয়েকটা খুব ভাল জাতের গোরু কিনেছে। পাকা লম্বা ব্যারাক বাড়ির মতো নতুন গোয়ালঘর তুলেছে। সূক্ষ্ম জালের পাল্লা বসিয়ে জানলা-দরজা দিয়ে মশা ঢোকার পথ বন্ধ করা হয়েছে। গোরু দেখাশোনা করার জন্য আরও দুটো লোক এসেছে।

সজল কাউকে কিছু না বলে এক ছুটির দিনে সকালে পুরনো গোয়ালঘরটায় গিয়ে ঢুকল। সঙ্গে বেজি, হাতে লাঠি।

মাটির ভিটিতে এর মধ্যেই হরেকরকম গর্ত তৈরি হয়েছে, জঞ্জাল জমেছে। বাইরে থেকে লতানে গাছ এসে উকিঝুকি মারছে জানলা-দরজা দিয়ে। বিশ্রী একটা ভ্যাপসা গন্ধ আর পোকামাকড়ের ঘিনঘিনে আওয়াজ। সজল সিলিং-এর কাঠের বিমগুলো দেখছিল। বেশ মজবুত।

বেজিটা তড়াক করে একটা লাফ দেওয়ায় সজল চকিতে চোখ নামায়। একটা গর্তের মুখে সরু একটা মুখ উঁকি দিয়েই ড়ুব দিল। সাপ। সজল জানে, এ ঘরে সাপ থাকবেই। বেজিটা এখনও বাচ্চা, বোধহয় সাপের সঙ্গে লড়তে শেখেনি। সজল তাই উদ্যত বেজিটাকে হাতে তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে ছেড়ে দরজা বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে। তার লাঠির ডগায় একটা লোহার ফলা পরানো আছে। নিঃশব্দে সে গর্তটার কাছে গিয়ে উঁকি দিল ভিতরে। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যায় না, সে ভুসভুসে মাটির মধ্যে ফলাটা চালিয়ে গর্তের মুখটা বড় করতে থাকে।

গর্তটা তেমন গভীর ছিল না। মুখটা বড় হতেই সে ভিতরে চিকরিমিকিরি দেখতে পেল। গোখরো। মাথা তুলছে না ভয়ে। ওরাও তো মরণ টের পায়।

সজল দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে খুব সাবধানে গর্তের মধ্যে ফলাটা চালিয়ে দিল বার কয়েক। ভিতরে তর্জন-গর্জন চলল কিছুক্ষণ। তারপর নিথরতা। সাপটাকে গর্ত থেকে তুলল না সজল। ওপর থেকে মাটি চাপা দিয়ে বন্ধ করে দিল।

নিজেই একটা ঝাঁটা এনে ঘরটা যতদূর সম্ভব সাফ করল। একটা মস্ত বস্তায় বালি ভরে তৈরি রেখেছিল সে। খ্যাপা নিতাই আর সে ধরাধরি করে এনে সেটাকে সিলিং-এ দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিল।

কাজ শেষ হলে নিতাই কপালের ঘাম মুছে বলে, কাণ্ড বাপু তোমার। গায়ের জোর করে হবেটা কি শুনি? জোর হল মন্তরের। এই দেখো না, আমার যে বোগা জিবজিবে শবীর, তবু সাতখানা গাঁয়ের লোক আমায় দেখলে পথ ছেড়ে দেয়। মন্তরের জোর বাড়াও, সব বশ হয়ে যাবে।

সজল ঝুলন্ত বস্তাটায় ঘুরে ঘুরে ঘুসি মারছিল। কর্কশ বস্তা আর বালিতে আঙুলের চামড়ার নুনছাল উঠে গেল। জ্বালা করছে। সে ধমক দিল, কেটে পড়ো তো নিতাইদা! আর, খবরদার মাকে বাতে যেয়ো না।

সজলখোকা, এই তো সেদিনও এটুকু ছিলে।

বলে একটু অবাক হয়ে নিতাই সজলকে আজ ভাল করে দেখে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, হবে না! কার ছেলে দেখতে হবে তো!

কথাটার মানে সজল জানে। একসময়ে সে নিজেকে জেঠামণির ছেলে বলে ভাবতে ভালবাসত। অজিকাল বাসে না! তার বাবা শ্রীনাথ যেমনই হোক, সে আজকাল বাবার পক্ষে। তাই বস্তা ছেড়ে কোমরে হাত দিয়ে সে রক্তচোখে তাকাল নিতাইয়ের দিকে।

নিতাই চোখ দেখেই ধরে ফেলে, মার আসছে। সজলখোকা ছোট বয়সে তাকে বড় কম মারেনি। কিন্তু সে ছিল ছোট হাতের মিঠে মার। কিন্তু ইদানীং সে বাচ্চাটা বেশ বুনো আর শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে। এখন এর হাতের মার খেলে হাড়ে গিয়ে লাগবে।

নিতাই চট করে সুর পালটে বলল, শ্রীনাথবাবুর কথাই বলছিলাম খোকাবাবু। তোমার বাবা। ভারী তেজি লোক। তুমি তারই ছেলে তো।

বেরোও তো এখন।

এই যাচ্ছি।-বলে নিতাই চোখের পলকে সবে পড়ে। দুনিয়াটা কেমনধারা হয়ে যাচ্ছে। কাউকে বিশ্বাস নেই। সেদিনকার খোকাটা কেমন মাতবরের মতো চোখ রাঙায়। ছোট কলকে দিয়ে যে সরিৎবাবুকে একসময়ে বশে রেখেছিল সেও এখন মোড়লমশাই। শুধু নিতাই বদলাল না, যে নিতাই সেই নিতাই-ই রয়ে গেল।

অবশ্য নিতাই আর বেশিদিন পুরনো নিতাই থাকবে না। ক’দিন আগে হিজলির শিষ্যবাড়ি থেকে একটা শোল মাছের বাচ্চা আর কিছু ডালের বড়ি গামছায় বেঁধে ফিরছিল নিতাই। হিজলির জেলেরা বোকাসোকা লোক। দুঘর তার কাছে মন্ত্র নিয়েছে হালে। এই এখন শিষ্যবাড়ি থেকে কিছু আদায় উশুল করতে পেবে মনে ভারী ফুর্তি ছিল। গুনগুন করছিল আপনমনে। পশ্চিমের জলার ধারের নির্জন রাস্তায় সাঁঝটি হল যেই অমনি নিতাই তারস্বরে কালী নাম করতে লাগল। কিন্তু তবু মেছে। পেতনিটা এলোচুল ফুঁপিয়ে জলা থেকে উঠে এসে পথ আটকে দাঁড়াল।

নিতাইয়ের হয়ে গিয়েছিল সেদিনই। ধাত ছাড়ে আর কী! হঠাৎ মনে পড়ল, এ জলার ধারেই বাঁশবনের আড়ালে কুঠে সামন্ত থাকত না! ব্যাটা মরেছে। চারটি ছেলেপুলে নিয়ে তার বউ এখন বিধবা। তা সেই বিধবাটাই নয় তো!

আন্দাজটা লেগেছিল ঠিকই। চোখ খুলে দেখল, সামন্তর সেই বিধবাই বটে। কালো হাকুচ, রোগা, বড় দাত, চোখ কোটরে। একেবারে মরি-মরি ছিরি।

তবু সেই বুঝকো সাঁঝে জলা থেকে আঁশটে গন্ধের একটা কু-বাতাস এসে বাঁশবানে মড়মড় শব্দ যখন তুলল, আর যখন রাঙা-ভাঙা একটা চাদও উঁকি দিল দিগন্তে, তখন আর বুক বশ মানল না। ভারী একটা কষ্ট ঘুলিয়ে উঠল বুকের মধ্যে। সামন্তর বেধবা বউটা! আহা!

কী খবর গো!

সামন্তর বিধবা স্ত্রী নিতাইকে বিলক্ষণ চেনে। রতনপুরের নামকরা চাটুজ্জেবাড়ির পোষা তান্ত্রিক। তাই সে জড়োসড়ো হয়ে বলল, কোনও গতিকে আছি বাবা।

তার আঁচলে বাঁধা কিছু গেঁড়িগুগলিই হবে। সামন্ত একসময়ে চমৎকার ঘরামির কাজ করত। কুষ্ঠ হয়ে বসে যায়। সেই থেকে অবস্থা পড়তির দিকে। সংসারটার কী অবস্থা তা আন্দাজ করতে অসুবিধে নেই। এদের মন্তর দেওয়া বৃথা। কিছুই আদায় উশুল হবে না। তবু নিতাইয়ের সেদিন ভারী কষ্টই হচ্ছিল। গরিবের জন্য গরিব না ভাবলে চলে?

সে বলেই ফেলল, চলো তোমার ঘরটা দেখে যাই। সামন্ত আমার বন্ধুলোক ছিল।

ঘর!–বলে বউটা হাঁ করে রইল, ঘর বলতে কি আর কিছু আছে বাবা! কোনওরকমে থাকা। যাবে তো এসো।

বাঁশবনের পিছনে সামন্তর ভিটেয় পা দিয়ে নিতাইয়ের চোখে জল এল। এমন গরিবও আছে! ঘর বলতে শুধু কয়েকটা মাটির দেয়াল খাড়া রয়েছে। চালে টিন বা খড় নেই, সে জায়গায় পুরনো চট, বাসি ক্যালেন্ডারের কাগজ, ক্যানেস্তারা এইসব দিয়ে জোড়াপট্টি লাগানো। বিছানা নেই, বাসন নেই, কাপড়চোপড় নেই। কীভাবে যে আছে! সামন্তর বউয়ের ট্যানাটা বোধহয় গায়ে গায়ে ভিজে গায়ে গায়েই শুকোয় রোজ। তাই চামসে তাঁশটে পেট-গোলানো গন্ধ ছাড়ছে গা থেকে। বড় মেয়েটা যুবতীই হবে। বুকে ন্যাকড়ার ঢাকনা, কোমর থেকে আর একটা আব্রু ঝুলছে। শরীরটা ঢ্যাঙা, কঙ্কালসার। বাকি কুঁচো কাচাগুলো উদোম ন্যাংটো।

সামন্তর বেধবা কান্নাকাটি করল না। বলল, এখনও ভিক্ষে শুরু করিনি বাবা। চাটুজ্জে-মাকে বলে ঘরের একটা কাজ দাও তো বাঁচি।

শোল মাছটা বেধবার হাতে দিয়ে নিতাই বলল, এটা সেদ্ধ করে আজ চালিয়ে দাও। আমি গিয়ে বউদিমণিকে বলবখন। হয়ে যাবে হিল্লে। বড় মেয়ে কতয় পড়ল?

বিয়ের যুগ্যি। নেবে?

ভেবে দেখি।

ভাবাভাবির অবশ্য কিছু নেই। এই বয়সে হাড়হাভাতে ছাড়া আর কে মেয়ে দেবে? তবু দর বাড়াতে একটু সময় নিয়ে রাখল। প্রথম দিন তো! বিয়ের কথা পাড়লেই হয়তো মেয়ের গায়ে এক কুড়ি কি দুকুড়ি দামের লেবেল বসে যাবে। দিনকাল ভাল না।

তৃষা বউদিকে পরদিন সব বলল নিতাই। বউদি শুনেটুনে বলল, চোর নয় তো?

না, সামন্ত লোক ভাল ছিল। কুষ্ঠরোগী ছিল বলে পরিবারটা কোথাও ঘরের কাজ পায় না।

তৃষা বউদি খুব চোখা নজরে নিতাইকে দেখে নিয়ে বলল, বড় মেয়ে-টেয়ে আছে?

নিতাই লজ্জায় মুখ নামিয়ে বলল, আছে একটা।

বউদিমণি আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি বটে, কিন্তু ওইটুকুতেই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তার চোখকে ফঁকি দেওয়া নিতাইয়ের বাপেরও সাধ্যি নয়।

সামন্তর বউ অবশ্য ধানকলে কাজ পেল। আগুরি শতখানেক টাকাও বউদি দিয়ে দিল ঘর মেরামতির জন্য। সামন্তর ঘরামি বন্ধুরা মজুরি না নিয়ে ছেয়ে দিল ঘর। এখন খেয়ে-পরে আছে। সামন্তর বড় মেয়ের শাড়ি জুটেছে, শরীরটাও ফিরছে আস্তে আস্তে। বিকেলের দিকটায় প্রায়ই গিয়ে ওদের উঠোনে থানা গাড়ে নিতাই।

মুশকিল হল, বিয়ে করে বউ তুলবে কোথায়! সে ভালমতোই জানে, এ বাড়িতে বউ নিয়ে নিতাইকে বাস করতে দেবে না বউদি। তার ওপর খোরাকির কথাও ফেলনা নয়। একা পেট চলে যায়, কিন্তু বউ হলে তার অনেক বায়নাক্কা। তাই খুব হিসেব নিকেশ করছে নিতাই। বিয়ের জন্য প্রাণটাও আঁকুপাঁকু করে। পুতুলরানি গিয়ে অবধি জীবনটা শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে গেছে।

নিতাই যাওয়ার পর অনেকক্ষণ বালির বস্তায় ঘুসি চালাল সজল। মুঠির চামড়া লাল, কবজি ছিড়ে পড়ছে ব্যথায়, সারা গায়ে জবজবে ঘাম।

দিন চারেকের মধ্যে গোয়ালঘরে দুটো বাচ্চা সমেত আরও দুটো গোখরো মারল সজল। দেখেশুনে নিতাই বলল, বাস্তুসাপ। মারলে তো, এখন দেখো কী না কী হয়! দোষের কাজ হয়ে গেল, একটা পুজো লাগালে হয়।

সজল বলল, ধ্যাত!

কিন্তু ব্যাপারটা ভাল লাগল না নিতাইয়ের। বাস্তুসাপ বলে কথা। সে গিয়ে বউদিমণিকে গোপনে জানাল, পুরনো গোয়ালঘরে তিনটে বাস্তুসাপ মেরে দিয়েছে সজলখোকা। কাজটা ভাল হয়নি। একটা পুজোটুজো লাগালে ভাল হয়।

তৃষা চোখ বড় করে বলে, সজল মেরেছে?

আজ্ঞে। বারণ শোনে না।

একটু ভাবল তুষা। সজল সাপ মেরেছে! ঘটনাটার মধ্যে একটু সাবালকত্বের আভাস আছে না?

সজলকে নিয়ে বরাবরই একটা ভাবনা ছিল তৃষার। সেটা আর-একটু বাড়ল। তা বলে ছেলেকে কিছু বলল না সে। গোপনে গিয়ে একদিন গোয়ালঘরে ঝুলন্ত বালির বস্তাটা দেখে এল। ফাঁসির মড়ার মতো ঝুলে আছে। অনেকক্ষণ ব্যাপারটা গুনগুন করল তার মনের মধ্যে।

সকালে বিকেলে দুইজন প্রাইভেট টিউটর সজলকে পড়ান। তবু আজকাল সজল প্রায়ই রাতের দিকে শ্রীনাথের কাছে পড়া বুঝতে আসে।

ব্যাপারটা যে শ্রীনাথের খুব ভাল লাগে তা নয়। কিন্তু সে খুব একটা বারণও করে না। শুধু যেদিন নেশাটা বেশি হয় সেদিন ফিরিয়ে দেয় ছেলেকে। কিংবা ফেরাতেও হয় না, দরজার বাইরে থেকেই বাবার অবস্থাটা দেখে সজল নিজেই ফিরে যায়।

যেদিন শ্রীনাথ ভাল থাকে, তেমন নেশা করে না, সেদিনই বই খাতা নিয়ে এসে সজল বসে যায়।

শ্রীনাথ যে খুব ভাল পড়াতে পারে তা নয়। চর্চা না থাকায় কত কী ভুলে গেছে। ভগ্নাংশ বা দশমিকের অঙ্কই পারে না। ভুগোলে কোন দেশের কী রাজধানী তা মনেই পড়ে না। ইতিহাস যেন আবছা এক নদীর মতো লাগে, হুমায়ুন আকবরের বাবা? না আকবর হুমায়ুনের?

অবশ্য এসবেও কিছু যায় আসে না। কিছুক্ষণ পড়া-পড়া খেলা সেরে নিয়ে সজল গল্প বলার জন্য শ্রীনাথকে নানারকম উসকানি দিতে থাকে। তাতে কাজও হয়।

সারাদিন কারও সঙ্গেই তো কথা বলার নেই শ্রীনাথের। শ্রোতা পেয়ে সে মনের আগল খুলে দেয়। বানানো গল্প নয়, ভূত প্রেত দত্যি দানোব গল্প নয়, শ্রীনাথ স্মৃতির ভাণ্ডার উজাড় করে দিতে থাকে সজলের কাছে। সজল হাঁ করে শোনে।

রাত বাড়ে। চারদিক নিঃঝুম হয়ে যায়। এক-একদিন ভিতরবাড়ি থেকে বৃন্দা বা অন্য কেউ এসে ডেকে নিয়ে যায় সজলকে। কোনওদিন সজলকে নিজেই ফেরত পাঠায় শ্রীনাথ।

একদিন শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করল, রোজ আমার কাছে আসিস কেন রে?

সজল লাজুক মুখে বলে, তুমি খুব ভাল পড়াও যে!

শ্রীনাথ ছেলের দুষ্টুমি ধরতে পেরে বলে, আমি আর কী পড়াব? তুই তো আসিস গল্প শুনতে।

বড় মায়া হল শ্রীনাথের। ছেলেটা তো জানেও না যে, সে ওর বাবা নয়। কিন্তু তাতে তো ওর কোনও দোষ নেই। শ্রীনাথ ওর কাছে কোনওদিন ভুলটা ভাঙবে না। সজলকে তার ভালই লাগে। হয়তো ছেলের মতোই ভালও বাসছে আজকাল।

শ্রীনাথ বা সজল টের পায় না, কিন্তু মাঝে মাঝে ভাবন-ঘরের জানালা বা দরজার পাশটিতে ছায়ামূর্তির মতো এসে কিছুক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তৃষা। সজল যে তাকে তেমন পছন্দ করে না তা তৃষা বরাবর জানে। তার জন্য কোনও মাথাব্যথাও নেই তার। কিন্তু ইদানীং শ্রীনাথের ওপর সজলের টান দেখে তার মনে নানা সন্দেহ উঁকি দেয়। শ্রীনাথকে বিশ্বাস নেই। ছেলেকে হাত করে তৃষাকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করছে হয়তো।

করছেই। এতদিন বাইরের লোকের কাছে কুৎসা গেয়ে বেড়িয়েছে। তাতে কাজ হয়নি দেখে এখন নতুন করে কোনও ফন্দি আঁটছে নিশ্চয়ই।

দিন সাতেক বাদে একদিন নিশুত রাতে কুকুরের চিৎকারে ঘুম ভাঙল তৃষার। উঠোনে খুব চেঁচাচ্ছে কুকুরটা। তৃষার ভয়ডর বলে কিছু নেই। মেঝেয় বৃন্দা পড়ে ঘুমোচ্ছে। তাকে ঠেলে তুলে দিয়ে তৃষা টর্চ হাতে দরজা খুলল।

পাল্লা দুটো ভাল করে খোলবার আগেই অন্ধকার উঠোনে একটা নীলচে লাল আগুনের ঝলকানি, আর সেই সঙ্গে বুক কাঁপানো দুড়ুম শব্দ। বাতাসের ধাক্কা আগুনের হলকা আর সেই সঙ্গে বালির মতো গুঁড়ো গুঁড়ো কী যেন এসে সপাটে ধাক্কা মারল তৃষাকে। আচমকা এসব ঘটে যাওয়ায় হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল তৃষা! কিন্তু সেই অবস্থাতেই দু’জোড়া পায়ের দৌড়োনোর শব্দ তার কান এড়াল না।

দরজা খুলে তৃষা টর্চ জ্বেলে দেখে বারান্দার সিঁড়ির কাছে শানের ওপর অনেকখানি জায়গা জুড়ে সাদাটে দাগ। সিমেন্টে চিড় ধরেছে। একটা বোমার খোল পড়ে আছে উঠোনে। বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী।

শব্দে মারমার করে বাড়ির লোকজন উঠে এল। সরিৎ, ছেলেমেয়ে, চাকর-বাকর। বোমার শব্দে ইস্পাত কেঁউ কেউ করে পালিয়ে গিয়েছিল। লোকজন দেখে সেও এল আবার ঘেউ ঘেউ করতে করতে।

সরিৎ নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে বন্দুকটা নিয়ে এল। বলল, কোনদিকে গেল বলো তত মেজদি!

তৃষা টর্চ জ্বেলে সদর ফটকের দিকটায় আলো ফেলে বলল, তাড়া করে লাভ নেই।

তাদের দেখেছ?

না। তবে দু’জন ছিল। পায়ের শব্দ পেয়েছি।

কারা হতে পারে?

কী করে বলব? মংলার হাতে চিঠি দিয়ে একবার থানায় পাঠা।

খোকনকে সজাগ থাকতে বলে হঠিয়ে দিল তৃষা। তারপর টর্চ হাতে নিঃশব্দে চলল ভাবন-ঘরের দিকে।

গ্রীষ্মকাল বলে কয়েকটা জানালা খুলে রেখে শোয় শ্রীনাথ। আজও শুয়েছে। আগে অন্ধকার ঘরে শ্রীনাথের ঘুমন্ত শরীরটা তীক্ষ্ণ চোখে দেখে। ঘুমোচ্ছে! বোমার আওয়াজটা এতদূর এসে পৌঁছোয়নি নাকি?

সন্দেহ। তৃষা টর্চ জ্বেলে নাইলনের মশারির ভিতরে শ্রীনাথের ঘুমন্ত মুখটাকে বুঝবার চেষ্টা করে। ঘুমোচ্ছে তো? না কি মটকা মেরে পড়ে আছে। টর্চের আলোটা খানিকক্ষণ মুখের ওপর নাড়াচাড়া করেও দেখল, শ্রীনাথ জাগে কি না। জাগল না।

তৃষা ডাকল, শুনছ! ওঠো তো! বাড়িতে কারা এইমাত্র বোমা মেরে গেল।

অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর শ্রীনাথ উঠল।

কী হয়েছে?

দরজা খোলো, বলছি।

বিরক্ত শ্রীনাথ উঠে দরজা খোলে, এত রাতে! ডাকাত পড়েছে নাকি?

এখনও পড়েনি। তবে যে-কোনওদিন পড়বে।

কী হয়েছে তা হলে?

দুটো লোক এসে আমার শোওয়ার ঘরে বোমা মেরে গেল একটু আগে। শব্দ পাওনি?

বোমা!—বলে হাঁ করে চেয়ে থাকে শ্রীনাথ। বোমা মারে বটে লোকে, কিন্তু তৃষার শোওয়ার ঘরে বোমা মারার কী আছে তা সে ঘুমন্ত মাথায় সঠিক বুঝতে পারে না।

কারা জানো?–তৃষা জিজ্ঞেস কবে।

 

আমি কী করে জানব? বোমা কারও গায়ে লেগেছে?

না। মনে হচ্ছে আমাকেই মারতে এসেছিল। কিন্তু তাড়াহুড়োয় ঠিক মতো ছুড়তে পারেনি। বারান্দায় পড়ে ফেটে গেছে।

সর্বনাশ! —বলে সত্যিকারের সাদা হয়ে যায় শ্রীনাথ। তার মাথাটা ঘুম ছাড়িয়ে সম্পূর্ণ জেগে ওঠে। কাল রাতে একটু বেশি টেনে ফেলেছিল সে। জেগে শরীরের একটা প্রবল কষ্ট টের পায়! বলে, তোমাকে মারতে এসেছিল।

খুব তীক্ষ্ণ চোখে শ্রীনাথকে লক্ষ করে তৃষা। হয়তো অভিনয়। সে ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারে না। বলে, আমাকে ছাড়া আর কাকে? আমার তো শত্রুর অভাব নেই। কিন্তু এতটা আগে কখনও হয়নি। তুমি কিছু জানো না?

আমি জানব! আমি কী জানব?

তুমি তো রামলাখনের আড্ডায় যাও, বটতলায় মিটিং করো, ওসব জায়গায় যাৰা যায় তারাই হয়তো এই কাণ্ডটার পিছনে আছে।

তৃষা কী বলতে চাইছে তা সঠিক ধরতে পারল না শ্রীনাথ। তাই রেগেও গেল না। তোম্বা ঘাবড়ে যাওয়া মুখে মাথা নেড়ে বলল, না, আমি কিছু শুনিনি। কেউ তোমাকে মারতে চায় বলে জানি না।

এখন তো জানলে!

জানলাম। কিন্তু কী করা উচিত বুঝতে পারছি না।

তৃষা সামান্য হেসে বলল, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। কোনওদিন কিছু কি করেছ আমাদের জন্য? আজও তোমাকে ছাড়াই চলবে।

শ্রীনাথ এ কথাটাও গায়ে মাখল না। চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ, তারপর একটা বিড়ি ধরাল। চোখেমুখে ভীষণ উদ্বেগ আর ভয় ফুটে রয়েছে তার।

তৃষা উঠে বাইরে গিয়ে চারদিকে টর্চটা ঘুরিয়ে দেখল। নিতাই একটা মশাল জ্বেলে জঙ্গলে-জঙ্গলে খুঁজছে। আরও কয়েকটা টর্চ জ্বলে উঠছে এখানে-সেখানে।

তৃষা উঁচু গলায় ডাকল, সরিৎ!

কী বলছ?—ফটকের ধার থেকে জবাব এল।

ছেলেমেয়েগুলোকে শুয়ে পড়তে বল। বৃন্দাকে বলিস ওদের ঘরে শুতে। নইলে ভয় পাবে।

যাচ্ছি।

বন্দুকটা রেখে আয়।–বলে তৃষা আবার ভাবন-ঘরে ঢুকে শ্রীনাথের মুখোমুখি হয়।

শ্রীনাথ আর-একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে, পুলিসে যাওয়া উচিত।

লোক গেছে। ছেলে দুটো কাল-পরশুই ধরা পড়বে।

পড়লেই ভাল। কিন্তু আজকাল পুলিস অত রেসপনসিবল নয়।

তৃষা খুব খর দৃষ্টিতে শ্রীনাথের মুখের দিকে চেয়ে বলল, পুলিস পারুক বা না-পারুক ছেলে দুটো ধরা পড়বেই। মরা বা জ্যান্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *