একাদশ পরিচ্ছেদ
অন্তরঙ্গসঙ্গে বসু বলরাম-মন্দিরে
বেলা তিনটা অনেকক্ষণ বাজিয়াছে। চৈত্র মাস, প্রচণ্ড রৌদ্র। শ্রীরামকৃষ্ণ দুই-একটি ভক্তসঙ্গে বলরামের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।
আজ ৬ই এপ্রিল (সোমবার), ১৮৮৫, ২৫শে চৈত্র, ১২৯১, কৃষ্ণা সপ্তমী। ঠাকুর কলিকাতায় ভক্তমন্দিরে আসিয়াছেন। সাঙ্গোপাঙ্গদিগকে দেখিবেন ও নিমু গোস্বামীর গলিতে দেবেন্দ্রের বাড়িতে যাইবেন।
[সত্যকথা ও শ্রীরামকৃষ্ণ — ছোট নরেন, বাবুরাম, পূর্ণ ]
ঠাকুর ঈশ্বরপ্রেমে দিবানিশি মাতোয়ারা হইয়া আছেন। অনুক্ষণ ভাবাবিষ্ট বা সমাধিস্থ। বহির্জগতে মন আদৌ নাই। কেবল অন্তরঙ্গেরা যতদিন না আপনাদের জানিতে পারেন, ততদিন তাহাদের জন্য ব্যাকুল, — বাপ-মা যেমন অক্ষম ছেলেদের জন্য ব্যাকুল, আর ভাবেন কেমন করে এরা মানুষ হবে। অথবা পাখি যেমন শাবকদের লালন-পালন করিবার জন্য ব্যাকুল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — বলে ফেলেছি, তিনটের সময় যাব, তাই আসছি। কিন্তু ভারী ধুপ।
মাস্টার — আজ্ঞে হাঁ, আপনার বড় কষ্ট হয়েছে।
ভক্তেরা ঠাকুরকে হাওয়া করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ছোট নরেনের জন্য আর বাবুরামের জন্য এলাম। পূর্ণকে কেন আনলে না?
মাস্টার — সভায় আসতে চায় না, তার ভয় হয়, আপনি পাঁচজনের সাক্ষাতে সুখ্যাতি করেন, পাছে বাড়িতে জানতে পারে।
[পণ্ডিতদের ও সাধুদের শিক্ষা ভিন্ন – সাধুসঙ্গ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, তা বটে। যদি বলে ফেলি তো আর বলব না। আচ্ছা, পূর্ণকে তুমি ধর্মশিক্ষা দিচ্ছ, এ তো বেশ।
মাস্টার — তা ছাড়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বইয়েতে Selection-H ওই কথাই[1] আছে, ঈশ্বরকে দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসবে। এ-কথা শেখালে কর্তারা যদি রাগ করেন তো কি করা যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ওদের বইয়েতে অনেক কথা আছে বটে, কিন্তু যারা বই লিখেছে, তারা ধারণা করতে পারে না। সাধুসঙ্গ হলে তবে ধারণা হয়। ঠিক ঠিক ত্যাগী সাধু যদি উপদেশ দেয়, তবেই লোকে সে কথা শুনে। শুধু পণ্ডিত যদি বই লিখে বা মুখে উপদেশ দেয়, সে কথা তত ধারণা হয় না। যার কাছে গুড়ের নাগরি আছে, সে যদি রোগীকে বলে, গুড় খেয়ো না, রোগী তার কথা তত শুনে না।
“আচ্ছা, পূর্ণের অবস্থা কিরকম দেখছো? ভাব-টাব কি হয়?”
মাস্টার — কই ভাবের অবস্থা বাহিরে সেরকম দেখতে পাই না। একদিন আপনার সেই কথাটি তাকে বলেছিলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি কথাটি?
মাস্টার — সেই যে আপনি বলেছিলেন! — সামান্য আধার হলে ভাব সম্বরণ করতে পারে না। বড় আধার হলে ভিতরে খুব ভাব হয় কিন্তু বাহিরে প্রকাশ থাকে না। যেমন বলেছিলেন, সায়ের দীঘিতে হাতি নামলে টের পাওয়া যায় না, কিন্তু ডোবাতে নামলে তোলপাড় হয়ে যায়, আর পাড়ের উপর জল উপছে পড়ে!
শ্রীরামকৃষ্ণ — বাহিরে ভাব তার তো হবে না। তার আকর আলাদা! আর আর সব লক্ষণ ভাল। কি বলো?
মাস্টার — চোখ দুটি বেশ উজ্জ্বল — যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — চোখ দুটো শুধু উজ্জ্বল হলে হয় না। তবে ঈশ্বরীয় চোখ আলাদা। আচ্ছা, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে, তারপর (ঠাকুরের সহিত দেখার পর) কিরকম হয়েছে?
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ, কথা হয়েছিল। সে চার-পাঁচদিন ধরে বলছে, ঈশ্বর চিন্তা করতে গেলে, আর তাঁর নাম করতে গেলে চোখ দিয়ে জল, রোমাঞ্চ এই সব হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে আর কি!
ঠাকুর ও মাস্টার চুপ করিয়া আছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মাস্টার কথা কহিতেছেন। বলিতেছেন, সে দাঁড়িয়ে আছে —
শ্রীরামকৃষ্ণ — কে?
মাস্টার — পূর্ণ, — তার বাড়ির দরজার কাছে বোধ হয় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কেউ গেলে দৌড়ে আসবে, এসে আমাদের নমস্কার করে যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আহা! আহা!
ঠাকুর তাকিয়ায় হেলান দিয়া বিশ্রাম করিতেছেন। মাস্টারের সঙ্গে একটি দ্বাদশবর্ষীয় বালক আসিয়াছে, মাস্টারের স্কুলে পড়ে, নাম ক্ষীরোদ।
মাস্টার বলিতেছেন, এই ছেলেটি বেশ! ঈশ্বরের কথায় খুব আনন্দ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — চোখ দুটি যেন হরিণের মতো।
ছেলেটি ঠাকুরের পায়ে হাত দিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিল ও অতি ভক্তিভাবে ঠাকুরের পদসেবা করিতে লাগিল। ঠাকুর ভক্তদের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে) রাখাল বাড়িতে আছে। তারও শরীর ভাল নয়, ফোঁড়া হয়েছে। একটি ছেলে বুঝি তার হবে শুনলাম।
পল্টু ও বিনোদ সম্মুখে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (পল্টুর প্রতি সহাস্যে) — তুই তোর বাবাকে কি বললি? (মাস্টারের প্রতি) — ওর বাবাকে ও নাকি জবাব করেছে, এখানে আসবার কথায়। (পল্টুর প্রতি) — তুই কি বললি?
পল্টু — বললুম, হাঁ আমি তাঁর কাছে যাই, এ কি অন্যায়? (ঠাকুর ও মাস্টারের হাস্য) যদি দরকার হয় আরো বেশি বলব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, মাস্টারের প্রতি) — না, কিগো অতদূর!
মাস্টার — আজ্ঞা না, অতদূর ভাল নয়! (ঠাকুরের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিনোদের প্রতি) — তুই কেমন আছিস? সেখানে গেলি না?
বিনোদ — আজ্ঞা, যাচ্ছিলাম — আবার ভয়ে গেলাম না! একটু অসুখ করেছে, শরীর ভাল নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — চ না সেইখানে, বেশ হাওয়া, সেরে যাবি।
ছোট নরেন আসিয়াছেন। ঠাকুর মুখ ধুইতে যাইতেছেন। ছোট নরেন গামছা লইয়া ঠাকুরকে জল দিতে গেলেন। মাস্টারও সঙ্গে সঙ্গে আছেন।
ছোট নরেন পশ্চিমের বরান্দার উত্তর কোণে ঠাকুরের পা ধুইয়া দিতেছেন, কাছে মাস্টার দাঁড়াইয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ভারী ধুপ।
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি কেমন করে ওইটুকুর ভিতর থাকো? উপরের ঘরে গরম হয়ে না?
মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ! খুব গরম হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাতে পরিবারের মাথার অসুখ, ঠাণ্ডায় রাখবে।
মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ। বলে দিয়েছি, নিচের ঘরে শুতে।
ঠাকুর বৈঠকখানা ঘরে আবার আসিয়া বসিয়াছেন ও মাস্টারকে বলিতেছেন, তুমি এ রবিবারেও যাও নাই কেন?
মাস্টার — আজ্ঞা, বাড়িতে তো আর কেউ নাই। তাতে আবার (পরিবারের মাথার) ব্যারাম। কেউ দেখবার নাই।
ঠাকুর গাড়ি করিয়া নিমু গোস্বামীর গলিতে দেবেন্দ্রের বাড়িতে যাইতেছেন। সঙ্গে ছোট নরেন, মাস্টার, আরও দুই-একটি ভক্ত। পূর্ণর কথা কহিতেছেন। পূর্ণর জন্য ব্যাকুল হইয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — খুব আধার! তা না হলে ওর জন্য জপ করিয়ে নিলে! ও তো এ-সব কথা জানে না।
মাস্টার ও ভক্তেরা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন যে, ঠাকুর পূর্ণর জন্য বীজমন্ত্র জপ করিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আজ তাকে আনলেই হত। আনলে না কেন?
ছোট নরেনের হাসি দেখিয়া ঠাকুর ও ভক্তেরা সকলে হাসিতেছেন। ঠাকুর আনন্দে তাঁহাকে দেখাইয়া মাস্টারকে বলিতেছেন — দ্যাখো দ্যাখো, ন্যাকা ন্যাকা হাসে। যেন কিছু যানে না। কিন্তু মনের ভিতর কিছুই নাই, — তিনটেই মনে নাই — জমীন, জরু, রূপেয়া। কামিনী-কাঞ্চন মন থেকে একেবারে না গেলে ভগবানলাভ হয় না।
ঠাকুর দেবেন্দ্রের বাড়িতে যাইতেছেন। দক্ষিণেশ্বরে দেবেন্দ্রকে একদিন বলিতেছিলেন, একদিন মনে করেছি, তোমার বাড়িতে যাব। দেবেন্দ্র বলিয়াছিলেন, আমিও তাই বলবার জন্য আজ এসেছি, এই রবিবারে যেতে হবে। ঠাকুর বলিলেন, কিন্তু তোমার আয় কম, বেশি লোক বলো না। আর গাড়ি ভাড়া বড় বেশি! দেবেন্দ্র হাসিয়া বলিয়াছিলেন, তা আয় কম হলেই বা, ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ (ধার করে ঘৃত খাবে, ঘি খাওয়া চাই)। ঠাকুর এই কথা শুনিয়া হাসিতে লাগিলেন, হাসি আর থামে না।
কিয়ৎ পরে বাড়িতে পৌঁছিয়া বলিতেছেন, দেবেন্দ্র আমার জন্য খাবার কিছু করো না, অমনি সামান্য, — শরীর তত ভাল নয়।
—————————–
১ “”With all thy Soul love God above.
And as thyself thy neighbour love.”