দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অপরাহ্নে ভক্তসঙ্গে — অবতারবাদ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
স্কুলের ছুটির পর মাস্টার আসিয়া দেখিতেছেন — ঠাকুর বলরামের বৈঠকখানায় ভক্তের মজলিস করিয়া বসিয়া আছেন। ঠাকুরের মুখে মধুর হাসি, সেই হাসি ভক্তদের মুখে প্রতিবিম্বিত হইতেছে। মাস্টারকে ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া ও তিনি প্রণাম করিলে, ঠাকুর তাহাকে তাঁহার কাছে আসিয়া বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষ, সুরেশ মিত্র, বলরাম, লাটু, চুনিলাল ইত্যাদি ভক্ত উপস্থিত আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — তুমি একবার নরেন্দ্রের সঙ্গে বিচার করে দেখো, সে কি বলে।
গিরিশ (সহাস্যে) — নরেন্দ্র বলে, ঈশ্বর অনন্ত। যা কিছু আমরা দেখি, শুনি, — জিনিসটি, কি ব্যক্তিটি — সব তাঁর অংশ, এ পর্যন্ত আমাদের বলবার জো নাই। Infinity (অনন্ত আকাশ) — তার আবার অংশ কি? অংশ হয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বর অনন্ত হউন আর যত বড় হউন, তিনি ইচ্ছা করলে তাঁর ভিতরের সার বস্তু মানুষের ভিতর দিয়ে আসতে পারে ও আসে। তিনি অবতার হয়ে থাকেন, এটি উপমা দিয়ে বুঝান যায় না। অনুভব হওয়া চাই। প্রত্যক্ষ হওয়া চাই। উপমার দ্বারা কতকটা আভাস পাওয়া যায়। গরুর মধ্যে শিংটা যদি ছোঁয়, গরুকেই ছোঁয়া হল; পাটা বা লেজটা ছুঁলেও গরুটাকে ছোঁয়া হল। কিন্তু আমাদের পক্ষে গরুর ভিতেরের সার পদার্থ হচ্ছে দুধ। সেই দুধ বাঁট দিয়ে আসে।
“সেইরূপ প্রেমভক্ত শিখাইবার জন্য ঈশ্বর মানুষদেহ ধারণ করে সময়ে সময়ে অবতির্ণ হন।”
গিরিশ — নরেন্দ্র বলে, তাঁর কি সব ধারণা করা যায়। তিনি অনন্ত।
[PERCEPTION OF THE INFINITE][1]
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — ঈশ্বরের সব ধারণা কে করতে পারে? তা তাঁর বড় ভাবটাও পারে না, আবার ছোট ভাবটাও পারে না। আর সব ধারণা করা কি দরকার? তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে পারলেই হল। তাঁর অবতারকে দেখলেই তাঁকে দেখা হল। যদি কেউ গঙ্গার কাছে গিয়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করে, সে বলে — গঙ্গা দর্শন-স্পর্শন করে এলুম। সব গঙ্গাটা হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত, হাত দিয়ে ছুঁতে হয় না। (হাস্য)
“তোমার পাটা যদি ছুঁই, তোমায় ছোঁয়াই হল। (হাস্য)
“যদি সাগরের কাছে গিয়ে একটু জল স্পর্শ কর, তাহলে সাগর স্পর্শ করাই হল। অগ্নিতত্ত্ব সব জায়গায় আছে, তবে কাঠে বেশি।”
গিরিশ (হাসিতে হাসিতে) — যেখানে আগুন পাব, সেইখানেই আমার দরকার।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — অগ্নিতত্ত্ব কাঠে বেশি। ঈশ্বরতত্ত্ব খোঁজ, মানুষে খুঁজবে। মানুষে তিনি বেশি প্রকাশ হন। যে মানুষে দেখবে উর্জিতা ভক্তি — প্রেমভক্তি উথলে পড়ছে — ঈশ্বরের জন্য পাগল — তাঁর প্রেমে মাতোয়ারা — সেই মানুষে নিশ্চিত জেনো, তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন।
(মাস্টার দৃষ্টে) — “তিনি তো আছেনই, তবে তাঁর শক্তি কোথাও বেশি প্রকাশ, কোথাও কম প্রকাশ। অবতারের ভিতর তাঁর শক্তি বেশি প্রকাশ; সেই শক্তি কখন কখন পূর্ণভাবে থাকে। শক্তিরই অবতার।”
গিরিশ — নরেন্দ্র বলে, তিনি অবাঙ্মনসোগোচরম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না; এ-মনের গোচর নয় বটে — কিন্তু শুদ্ধমনের গোচর। এ বুদ্ধির গোচর নয় — কিন্তু শুদ্ধবুদ্ধির গোচর। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি গেলেই, শুদ্ধমন আর শুদ্ধবুদ্ধি হয়। তখন শুদ্ধমন শুদ্ধবুদ্ধি এক। শুদ্ধমনের গোচর। ঋষি-মুনিরা কি তাঁকে দেখেন নাই? তাঁরা চৈতন্যের দ্বারা চৈতন্যের সাক্ষাৎকার করেছিলেন।
গিরিশ (সহাস্যে) — নরেন্দ্র আমার কাছে তর্কে হেরেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না; আমায় বলেছে, গিরিশ ঘোষের মানুষে অবতার বলে অত বিশ্বাস; এখন আমি আর কি বলব! অমন বিশ্বাসের উপর কিছু বলতে নাই।’
গিরিশ (সহাস্যে) — মহাশয়! আমরা সব হলহল করে কথা কচ্ছি, কিন্তু মাস্টার ঠোঁট চেপে বসে আছে। কি ভাবে? মহাশয়! কি বলেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — “মুখহলসা, ভেতরবুঁদে, কানতুলসে, দীঘল ঘোমটা নারী, পানা পুকুরের সীতল জল বড় মন্দকারী। (সকলের হাস্য) (সহাস্যে) — কিন্তু ইনি তা নন — ইনি ‘গম্ভীরাত্মা’ (সকলের হাস্য)
গিরিশ — মহাশয়! শ্লোকটি কি বললেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — এই ক’টি লোকের কাছে সাবধান হবে: প্রথম, মুখহলসা — হলহল করে কথা কয়; তারপর ভেতরবুঁদে — মনের ভিতর ডুবুরি নামালেও অন্ত পাবে না; তারপর কানতুলসে — কানে তুলসী দেয়, ভক্তি জানাবার জন্য; দীঘল ঘোমটা নারী — লম্বা ঘোমটা, লোকে মনে করে ভারী সতী, তা নয়; আর পানাপুকুরের জল — নাইলে সান্নিপাতিক হয়। (হাস্য)
চুনিলাল — এঁর (মাস্টারের) নামে কথা উঠেছে। ছোট নরেন, বাবুরাম ওঁর পোড়ো; নারায়ণ, পল্টু, তেজচন্দ্র — এরা সব ওঁর পোড়ো। কথা উঠেছে যে, উনি তাদের এইখানে এনেছেন, আর তাদের পড়াশুনা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এঁর নামে দোষ দিচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাদের কথা কে বিশ্বাস করবে?
এই সকল কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় নারাণ আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিল। নারাণ গৌরবর্ণ, ১৭/১৮ বছর বয়স, স্কুলে পড়ে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে বড় ভালবাসেন। তাকে দেখবার জন্য, তাকে খাওয়াবার জন্য ব্যাকুল। তার জন্য দক্ষিণেশ্বরে বসে বসে কাঁদেন। নারাণকে তিনি সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখেন।
গিরিশ (নারায়ণ দৃষ্টে) — কে খবর দিলে? মাস্টারই দেখছি সব সারলে। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — রোসো! চুপচাপ করে থাকো! এর (মাস্টারের) নামে একে বদনাম উঠেছে।
[অন্নচিন্তা চমৎকারা — ব্রাহ্মণের প্রতিগ্রহ করার ফল ]
আবার নরেন্দ্রের কথা পড়িল।
একজন ভক্ত — এখন তত আসেন না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা,
কালিদাস হয় বুদ্ধিহারা।’ (সকলের হাস্য)
বলরাম — শিব গুহর বাড়ির ছেলে অন্নদা গুহর কাছে খুব আনাগোনা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, একজন আফিসোয়ালার বাসায় নরেন্দ্র, অন্নদা এরা সব যায়। সেখানে তারা ব্রাহ্মসমাজ করে।
একজন ভক্ত — তাঁর (অফিসওয়ালার) নাম তারাপদ।
বলরাম (হাসিতে হাসিতে) — বামুনরা বলে, অন্নদা গুহ লোকটার বড় অহংকার।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বামুনদের ও-সব কথা শুনো না। তাদের তো জানো, না দিলেই খারাপ লোক, দিলেই ভাল! (সকলের হাস্য) অন্নদাকে আমি জানি ভালো লোক।
————————
১ Compare discussion about the order of perception of the Infinite and of the Finite in Max-Muller’s Hibbert Lectures and Gifford Lectures.