বসু বলরাম-মন্দিরে, গিরিশ-মন্দিরে ও দেবেন্দ্র-ভবনে ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ
প্রথম পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণের বলরামের গৃহে আগমন ও তাঁহার সহিত নরেন্দ্র, গিরিশ, বলরাম, চুনিলাল, লাটু, মাস্টার, নারায়ণ প্রভৃতি ভক্তের কথোপকথন ও আনন্দ
ফাল্গুন কৃষ্ণা দশমী তিথি, পূর্বাষাঢ়ানক্ষত্র, ২৯শে ফাল্গুন, বুধবার — ইংরেজী ১১ই মার্চ, ১৮৮৫। আজ আন্দাজ বেলা দশটার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর হইতে আসিয়া ভক্তগৃহে বসু বলরাম-মন্দিরে শ্রীশ্রীজগন্নাথের প্রসাদ পাইয়াছেন। সঙ্গে লাটু প্রভৃতি ভক্ত।
ধন্য বলরাম! তোমারই আলয় আজ ঠাকুরের প্রধান কর্মক্ষেত্র হইয়াছে। কত নূতন নূতন ভক্তকে আকর্ষণ করিয়া প্রেমডোরে বাঁধিলেন, ভক্তসঙ্গে কত নাচিলেন। গাইলেন। যেন শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীবাসমন্দিরে প্রেমের হাট বসাচ্ছেন!
দক্ষিণেশ্বরের কালীবাটীতে বসে বসে কাঁদেন, নিজের অন্তরঙ্গ দেখিবেন বলে ব্যাকুল! রাত্রে ঘুম নাই। মাকে বলেন, “মা, ওর বড় ভক্তি, ওকে টেনে নাও; মা, একে এখানে এনে দাও; যদি সে না আসতে পারে, তাহলে মা আমায় সেখানে লয়ে যাও, আমি দেখে আসি।” তাই বলরামের বাড়ি ছুটে ছুটে আসেন। লোকের কাছে কেবল বলেন, “বলরামের ৺জগন্নাথের সেবা আছে, খুব শুদ্ধ অন্ন।” যখন আসেন অমনি নিমন্ত্রণ করিতে বলরামকে পাঠান। বলেন, “যাও — নরেন্দ্রকে, ভবনাথকে, রাখালকে নিমন্ত্রণ করে এসো। এদের খাওয়ালে নারায়ণকে খাওয়ানো হয়। এরা সামান্য নয়, এরা ঈশ্বরাংশে জন্মেছে, এদের খাওয়ালে তোমার খুব ভাল হবে।”
বলরামের আলয়েই শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষের সঙ্গে প্রথম বসে আলাপ। এইখানেই রথের সময় কীর্তনানন্দ। এইখানেই কতবার “প্রেমের দরবারে আনন্দের মেলা” হইয়াছে।
[“পশ্যতি তব পন্থানম্” — ছোট নরেন ]
মাস্টার নিকটে একটি বিদ্যালয়ে পড়ান। শুনিয়াছেন আজ দশটার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের বাটীতে আসিবেন। মাঝে অধ্যাপনার কিঞ্চিত অবসর পাইয়া বেলা দুই প্রহরের সময় ওইখানে আসিয়া উপস্থিত। আসিয়া দর্শন ও প্রণাম করিলেন। ঠাকুর আহারান্তে বৈঠকখানায় একটু বিশ্রাম করিতেছেন। মাঝে মাঝে থলি থেকে কিছু মসলা বা কাবাবচিনি খাচ্ছেন; অলপবয়স্ক ভক্তেরা চারিদিকে ঘেরিয়া বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে) — তুমি যে এখন এলে? স্কুল নাই?
মাস্টার — স্কুল থেকে আসছি — এখন সেখানে বিশেষ কাজ নাই।
ভক্ত — না, মহাশয়! উনি স্কুল পালিয়ে এসেছেন! (সকলের হাস্য)।
মাস্টার (স্বগতঃ) — হায়! কে যেন টেনে আনলে!
ঠাকুর যেন একটু চিন্তিত হইলেন। পরে মাস্টারকে কাছে বসাইয়া কত কথা কহিতে লাগিলেন। আর বলিলেন, “আমার গামছাটা নিংড়ে দাও তো গা, আর জামাটা শুকোতে দাও, আর পাটা একটু কামড়াচ্ছে, একটু হাত বুলিয়ে দিতে পার?” মাস্টার সেবা করিতে জানেন না, তাই ঠাকুর সেবা করিতে শিখাইতেছেন। মাস্টার শশব্যস্ত হইয়া একে একে ওই কাজগুলি করিতেছেন। তিনি পায়ে হাত বুলাইতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কথাচ্ছলে কত উপদেশ দিতে লাগিলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও ঐশ্বর্যত্যাগের পরাকাষ্ঠা — ঠিক সন্ন্যাসী ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — হ্যাঁগা, এটা আমার কদিন ধরে হচ্ছে, কেন বল দেখি? ধাতুর কোন জিনিসে হাত দেবার জো নাই। একবার একটা বাটিতে হাত দিছিলুম, — তা হাতে শিঙ্গিমাছের কাঁটা ফোটা মতো হল। ঝন্ঝন্ কন্কন্ করতে লাগল। গাড়ু না ছুঁলে নয়, তাই মনে করলুম, গামছাখানা ঢাকা দিয়ে দেখি, তুলতে পারি কিনা; যাই হাত দিয়েছি, অমনি হাতটা ঝন্ঝন্ কন্কন্ করতে লাগল, খুব বেদনা। শেষে মাকে প্রাথ্রনা করলুম, ‘মা আর অমন কর্ম করব না, মা এবার মাপ করো।’
“হ্যাঁগা, ছোট নরেন যাওয়া আসা কচ্ছে, বাড়িতে কিছু বলবে? খুব শুদ্ধ, মেয়ে সঙ্গ কখনও হয় নাই।”
মাস্টার — আর খোলটা বড়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, আবার বলে যে, ঈশ্বরীয় কথা একবার শুনলে আমার মনে থাকে। বলে, ছেলেবেলায় আমি কাঁদতুম — ঈশ্বর দেখা দিচ্ছেন না বলে।
মাস্টারের সঙ্গে ছোট নরেন সম্বন্ধে এইরূপ অনেক কথা হইল। এমন সময় উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিলেন, “মাস্টার নহাশয়! আপনি স্কুলে যাবেন না?”
শ্রীরামকৃষ্ণ — কটা বেজেছে?
একজন ভক্ত — একটা বাজতে দশ মিনিট।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — তুমি এস, তোমার দেরি হচ্ছে। একে কাজ ফেলে এসেছো। (লাটুর প্রতি) — রাখাল কোথায়?
লাটু — চলে গেছে; — বাড়ি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার সঙ্গে দেখা না করে?