উচ্চবিত্ত মিসেসদের জীবনযাপন
আমি মধ্যবিত্ত সংসারে মানুষ। উচ্চবিত্তের জীবনযাপন খুব কম দেখেছি। সেদিন আমার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য কি না জানি না এক উচ্চবিত্তের বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। বাড়ি গুলশান। ভদ্রলোক এককালে মন্ত্রী ছিলেন, এখন বাণিজ্য করছেন; ভদ্রমহিলা একটি কোম্পানির পরিচালক জাতীয় কিছু। ওঁরা আমাকে প্রথম যে ঘরে নিয়ে বসলেন, ওটি মদ খাবার ঘর। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল আমি কি খাব অর্থাৎ কোন নামের মদটি আমার পছন্দ। আমি কোমল পানীয়ের কথা বলতে সম্ভবত ওঁরা আমাকে অতিথি হিসেবে খুব উঁচুদরের ভাবলেন না।
এক-এক করে অভ্যাগত আসছেন। আমরা বড় একটি হলঘরে বসলাম। যেহেতু মানুষ আমার প্রিয় এবং প্রধান বিষয়—আমি ওঁদের বাক্য এবং আচরণের প্রতি মনোযোগী হলাম। আর খুব অবাক হয়ে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, বাড়ির ভদ্রমহিলা—বয়স পঞ্চাশের কাছে আমি জানি, যদিও তার শরীর এবং সৌন্দর্য সেই বয়সকে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে এনে দাঁড় করিয়েছে—তিনি আঁটসাঁট পরা শাড়িটি বারবারই বুকের ওপর থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন, বিশেষ করে যখন পুরুষ অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন। আমি এই আচরণের কোন অনুবাদ জানি না। কেন এই বিত্তবান ভদ্রমহিলার হাত অত্যন্ত সজাগ থাকে যেন শাড়ির আঁচল এসে তার পীনোন্নত পয়োধর আড়াল না করে? অতিথিরা পরপরের সঙ্গে ইংরেজিতে চেঁচিয়ে উঠছেন, চোখ নাক বন্ধ করে, কাঁধ শ্রাগ করে তাঁদের আবেগ প্রকাশ করছেন, এক দম্পতি আরেক দম্পতির গালে চুমু খাচ্ছেন অর্থাৎ এর স্ত্রী ওঁর স্বামীকে অথবা এর স্বামী ওঁর স্ত্রীকে। আমি ক্রমেই বিস্মিত হচ্ছিলাম এবং খুব স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম এই দম্পতিদের বিচিত্র জলসায় আমি এক একটি মানুষ বড় বেশি দৃষ্টিকটু ঠেকছি। আমার হাতে কোমল পানীয়ের গ্লাস, আমি ওঁদের দেখছি, এবং অল্প অল্প চুমুক দিচ্ছি গ্লাসে। আমার জন্য সে এক আশ্চর্য সন্ধ্যা বটে।
আমার সঙ্গে অতিথিরা যখন নিজ দায়িত্বে পরিচিত হতে চাইলেন সকলেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি মিসেস?’ ওঁরা যেমন নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে যে আমি মিসেস আলম, আমি মিসেস মহিউদ্দিন, আমি মিসেস সাদেক—তেমন মিসেস জাতীয় কোনও পরিচয় না দিয়ে আমি বললাম, আমার নাম নাসরিন । ওঁরা কিছুটা বিস্মিত হলেন এবং কিছুটা মৰ্মাহতও বোধ হয়।
ফারুক, আমানুল্লাহ, সফিউদ্দিনের বিত্তের ওপর ভেসে বেড়ানো এই দ্বিপদী জীবগুলো গা ভর্তি প্রদর্শন করার জন্য শাড়ি এবং শাড়ির আঁচলকে গা থেকে প্রায় ফেলে দিতে পারলেই যেন ওঁরা বাঁচেন ।
কেন এই বিকৃতি? কেন ‘মিসেস’ শব্দের কালিতে নিজের নামকে ওঁরা মুছে ফেলেন? আর অ্যাকাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে অঢেল বিত্ত মিশিয়ে এমন এক উদ্ভট সংস্কৃতি তৈরি করেন যা ঠিক বাঙালির নয়, আবার ইংরেজেরও নয়। বাংলা বলতে গেলে আমি লক্ষ্য করেছি ওঁদের জিহ্বা আচমকা ভারি হয়ে যায় এবং স্বরধ্বনির সঙ্গে মোটেও সহযোগিতা করে না। ওঁরা কেউ নিজের নামে পরিচিত নন। ওঁরা স্বামীর সঙ্গী হিসেবে দেশে অবস্থান করেন এবং বিদেশ ভ্রমণ করেন। ওঁরা নিজ নিজ ঘরের পার্টিতে একটি পৃথক সংস্কৃতি লালন করেন, ওঁরা হাই হ্যালো বলে এর ওঁর গায়ে গড়িয়ে পড়েন। ওঁরা শরীরকে সবচেয়ে বড় সম্পদ বলে মনে করেন বলে শরীরকেও রঙে ও রেখায় এমন প্রকট উপস্থিত করেন যেন সকলে শরীরের তারিফ করেন। ওঁরা অনর্গল ঐর ওঁর প্রতি অশ্লীল বাক্য নিক্ষেপ করে অন্তরঙ্গতা প্রকাশ করেন।
একসময় আমার চোখও ক্লান্ত হয়, আমার শ্রবণযন্ত্রও বিরক্ত হয়। আমি হঠাৎ ঘর ভর্তি ওই অসুস্থ মানুষগুলোকে চমকে দিয়ে বলি আমি যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি বলে কারও কোনও উদ্বেগ নেই। কারণ আমার গা ভর্তি অলংকার নেই, বাংলায় কথা বলতে আমার জিহা আড়ষ্ট হয় না, আমার গায়ে আঁটসাঁট পোশাক নেই, আমি কোনও মিসেস নামে পরিচিত নই, আমার গল্পে আজ ইউরোপ কাল আমেরিকার গন্ধ নেই। আমি চলে আসতে বাধ্য হই কারণ এই মেয়েরা যাঁরা নিজেদের খুব আধুনিক বলে দাবি করেন, স্বামীর ইন্ডাস্ট্রিগুলোর কাগজপত্রে পরিচালক হিসেবে যাঁরা বহাল আছেন, যারা অন্য পুরুষকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়াকেই নারী স্বাধীনতা বলেই ভাবেন হয়ত—ওঁদের গা থেকে ভুর ভুর করে টাকার গন্ধ বেরিয়ে ঘরকে এত ঠেসে ধরেছিল যে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
এই নির্বোধ মেয়েরা কঠিন পানীয়ের গ্লাস হাতে নিয়ে শরীর দুলিয়ে বিত্ত এবং বৈভবের গল্প বলেন। লোকে ওঁদের শিক্ষিত এবং সন্ত্রান্ত বলে জানে। আর আমি ওই অন্ধকারে পড়ে থাকা অশিক্ষিত মেয়েদের বিকৃত সভ্যতার গালে দুটো চড় কষাতে চাই। জানি ওঁরা সভ্যতার শিকার, ওঁরা পুরুষ তৈরি সমাজের নিয়মে আক্রান্ত নিরীহ প্রাণী মাত্র।
মিসেস নামের আড়ালে আমি নাজমা, শাহানা, ডালিয়া, চিত্রা, নিপা, শিখা, ফেরদৌসী, নুপুর, কুসুম নামের মানুষগুলোকে অন্তরে অনুভব করি। ওঁরা কি ইচ্ছে করলেই পারেন না নিজ নামে পরিচিত হতে, ওঁরা কি হীরে সোনার কাছে নিজেকে বিক্রি না করে, নিজেকে এমন ফাঁপা এবং অন্তঃসারশূন্য আনন্দদায়িনী শরীর না করে একবার মানুষ করতে পারেন না, পূর্ণাঙ্গ এবং সম্পূর্ণ মানুষ—যে মানুষ এক দাঁড়াতে পারে, একা এক ব্যক্তি সুস্থ মেরুদণ্ড নিয়ে এমন যে ইবসেনের মত বলা যায়–The strongest man in the world is the man who stands most alone.
একটি দরিদ্র দেশে বিত্ত নিয়ে যে ব্যভিচার চলে গুটিকয় সংসারে, তা দেখবার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে। গুলশান থেকে ফিরে আসবার পথে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের কথা ভাবি, এবং কিলবিল করে হেসে ওঠা ওই পঙ্গু নারীদের কথা ভেবে গায়ে কঁকিয়ে ওঠে তীব্র শোক। এই দুর্ভাগা দেশ এবং দেশের দুর্ভাগা নারীর জন্য শোকে ও সন্তাপে আমার মাথা নুয়ে আসে।