1 of 3

৪২. রেমি যে মারা যাচ্ছে

॥ ৪২ ॥

রেমি যে মারা যাচ্ছে সে বিষয়ে বোধহয় কোনো সন্দেহই নেই। ধ্রুবর সমস্ত শরীরটা ভয়ে ঠাণ্ডা মেরে আসছিল।

একটু দূরে একা এবং আলাদা হয়ে জয়ন্ত নারসিং হোমের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটার প্রতি একসময়ে যে রাগ আর বিদ্বেষ ছিল ধ্রুবর এখন তা নেই। এখন সে কারো ওপরেই তেমন রাগ করতে পারে না। দিন দিন সে কি অবোধ হয়ে যাচ্ছে? ক্যালাস? হারিয়ে যাচ্ছে আত্মমর্যাদাজ্ঞান?

নিজের সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। শোক নয়, বিরহ নয়, রেমির আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে তার বড় ভয় করছে। রেমি বেঁচে থাকলে কি ভাল? সে ঠিক করতে পারছে না।

সে গিয়ে জয়ন্তর পাশে দাঁড়ায়। জয়ন্ত সিগারেট খাচ্ছে, প্রকাশ্যেই। ধ্রুব যতদূর জানে, জয়ন্ত সিগারেট খায় না। এখন খাচ্ছে সম্ভবত ভিতরকার উদ্বেগ উৎকণ্ঠাকে সামাল দেওয়ার জন্যই। একবার ধ্রুবর দিকে একটু তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। ঘৃণায়? ভয়ে? কে জানে! কিন্তু ওই তাকানোটা বুলেটের মতো বিঁধল ধ্রুবর শরীরে।

ধ্রুব খুব বোকার মতো প্রশ্ন করল, রেমির কোনো খবর আছে।

খুব খারাপ।

কতটা খারাপ?

যতটা খারাপ হওয়া যায়।

একেবারেই হোপলেস?

ডাক্তাররা সেরকম বলে না। কিন্তু আমি জানি।

ধ্রুব তার লম্বা চুলে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল, অপারেশন তো এখনো হয়নি। হলে যদি বেঁচে যায়!

দিদির বেঁচে থাকা কি আপনি চান?

খুব একথায় রাগ করল না। মাথাটা বড় গোলমেলে। বলল, বাঃ, চাইব না, কী বলছ!

দিদি চায় না।

কি চায় না?

দিদি বেঁচে থাকতে চায় না।

বাজে কথা। বেঁচে থাকতে চাইবে না কেন?

আমি জানি। আপনিও চান না।

ধ্রুব এবার একটু গরম হল। বলল, জয়, এটা ঠিক তর্ক করার সময় নয়।

জয়ন্ত বিষাদ-মলিন একটু হেসে বলে, আপনার মুখ থেকে এখনো ভকভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। আপনি খুব দুশ্চিন্তা করছেন বলে মনে হচ্ছে না।

ধ্রুব তেমন স্মার্টনেস বোধ করছে না। একথায় মিইয়ে গিয়ে বলল, বিকেলে একটু খেয়েছিলাম। জাস্ট টু সেলিব্রেট। তখন রেমির অবস্থা খারাপ ছিল না।

জয়ন্ত ঠাণ্ডা অথচ বিষাক্ত একরকম গলায় বলল, আপনি কি এ খবর রাখেন যে, দিদির লেবার পেন উঠেছিল তিন দিন আগে? মেমব্রেন ধারস্ট করায় সমস্ত ফ্লুইড বেরিয়ে যায় তিনদিন আগেই। ট্র্যাক শুকিয়ে যাওয়ায় ডাক্তার ফরসেপ দিয়ে টেনে বাচ্চাটাকে বের করেছে। দিদির শরীরে কীরকম ইনজুরি হয়েছে আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, বাচ্চাটাকে জন্ম দেওয়ার পর থেকেই দিদি বেঁচে থাকার লড়াইটা আর লড়ছে না। ডেলিভারির পর দিদি ডাক্তারকে বলেছিল, আমার যা হয় হোক, বাচ্চাটাকে আপনারা বাঁচিয়ে রাখবেন। বাচ্চাটার বেঁচে থাকা ভীষণ দরকার।

না, আমি অত সব জানি না।

সেইরকম বিষাক্ত হেসেই জয়ন্ত বলে, তা জানার কথাও আপনার নয়। আপনি কোনোদিনই দিদির জন্য পরোয়া করেননি। আমরা শুনেছি, কিছুকাল আগে আপনি দিদির একটা অ্যাবোরশনও করিয়েছিলেন, যেটার কোনো দরকার ছিল না। এইসব করে আপনি দিদির শরীর নষ্ট করেছেন, মন ভেঙে দিয়েছেন। অথচ সে খবরটা আপনার জানা ছিল না।

বিরক্ত ধ্রুব বলল, এসব কথা বলার অনেক সময় পাবে জয়। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। কিন্তু এখন—

এখনটা তো তখনকারই পরিণতি। আমার দিদি বিয়ের পরই মরে গিয়েছিল কিংবা তখন থেকেই তার মৃত্যু শুরু হয়েছিল। আজ শুধু শী উইল বি টারমিনেটেড। তার বেশী কিছু নয়। ভাবছেন কেন? খুব বেশী উতলা বোধ করলে আরো কয়েক পেগ চাপিয়ে নেবেন। খুব নরমাল হয়ে যাবেন তাহলে।

ধ্রুব টের পাচ্ছে তার ভিতরে একটা আগুন নিবে গেছে। কিছুতেই সে উত্তপ্ত হতে পারছে না। হাজির জবাবের জন্য তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল, সে ঠোঁটকাটাও বটে কিন্তু কিছুতেই মুখে কথা আসছে না। কিন্তু কী নিবে গেল? কিসের আগুন? এমন সেঁতিয়ে আছে কেন ভিতরটা?

একথা ঠিক যে, সে দায়িত্বশীল স্বামী নয়, বাপের সুযোগ্য পুত্র নয়, তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে জামাই হিসেবে পেয়ে খুব গৌরবান্বিত বোধ করে না। এ সবই ঠিক কথা। কিন্তু ধ্রুবও তো দুনিয়ার মানুষকে একটা কিছু বোঝাতে চাইছে। তারও তো একটা বার্তা আছে দুনিয়াভর গাড়লদের প্রতি। গিদধড়রা সেটা বুঝতে চাইছে না কেন?

ধ্রুব হঠাৎ টান টান সোজা হয়ে ভিতরকার নিবন্ত আগুনে কিছু রাগের বাতাস লাগিয়ে জয়ন্তকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা আমার কাছে কী একসপেকট করেছিলে?

সেটা জেনে আপনার কী হবে? আপনার ভিতর সেটা নেই।

আমার মধ্যে অনেক কিছুই নেই। কিন্তু তোমরা কোনটা চেয়েছিলে সেটা একটু জেনে রাখি।

যেটা নেই সেটার কথা বলে লাভ কী? যেটা আছে সেটার কথা বরং বলুন।

সেটা কী?

আপনারা এত অহংকারী কেন?

আমি অহংকারী? কে বলল?

বলার দরকার হয় না। আপনাদের চালচলনে সেটা অত্যন্ত প্রকট।

বাজে কথা।

আপনার বাবা একটু আগে বলেছেন, নিজেদের লোক ছাড়া আর কারো রক্ত দিদিকে দেওয়া চলবে না। কেন আমি জিজ্ঞেস করিনি। উনি মনে করেন তাতে ওঁদের বংশের রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হবে।

ধ্রুব একটু ফাঁকা আওয়াজ করে হাসল, ওঃ, বাবার কথা ছেড়ে দাও।

আপনার পক্ষে কথাটা বলা সোজা, কিন্তু আমার পক্ষে ব্যাপারটা হজম করা শক্ত। আমি দিদির ভাই হয়েও তাকে রক্ত দিতে পারব না জাস্ট একটা প্রিমিটিভ ক্ল্যানিশ হুলিগানের সেটা পছন্দ নয় বলে। এটা অহংকার নয়?

ধ্রুব চোখ গোল করে সপ্রশংস চোখে জয়ন্তর দিকে চেয়ে বলল, বাঃ, দিব্যি বলেছো তো! এ কথাগুলো এতকাল আমার মাথায় আসেনি কেন সেটাই ভাবছি। কী কী বললে যেন! প্রিমিটিভ, ক্ল্যানিশ হুলিগান? না? বাঃ!

কথাগুলো আমি আপনাদের পুরো পরিবারের সামনেই বলতে পারি, এমন কি আপনার বাবার মুখের ওপরেও।

আমি জানি, ইউ আর এ কারেজিয়াস বয়। বুদ্ধিমানও।

আমি কিন্তু ইয়ার্কি করছি না।

আমিও করছি না। কিন্তু একটু একটু ঝগড়া হয়ে যাচ্ছে।

হলে হচ্ছে।

কিন্তু ভাল হচ্ছে না জয়। তোমার দিদির এই অবস্থায় আমরা ঝগড়া করতে পারি কি?

দিদির এই অবস্থা বলেই আমি চুপ করে থাকতে পারছি না।

এক্ষুনি একটা শো-ডাউন চাও?

যদি বলি চাই?

তাহলে তোমার কাজটা সহজ করে দিতে পারি।

কী ভাবে?

তোমার কাছে কোনো অস্ত্রশস্ত্র আছে? পেনসিলকাটা ছুরি হলেও চলবে।

নেই।

ঠিক আছে। ওই যে সামনে একটা মস্ত অ্যাপার্টমেন্ট হাউস তৈরি হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছো?

পাচ্ছি। তাতে কি?

চলো দুজনে ওখানে যাই।

তারপর?

ওখানে আমি তোমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকব আর তুমি একটা পাথর বা আস্ত ইঁট যা পাবে খুঁজে নিয়ে আমার মাথায় মারো। কোনো সাক্ষী থাকবে না।

হঠাৎ আপনি এত উদার হয়ে গেলেন যে!

আমি আজকাল শুধু একটা কথাই ভাবি, যুদ্ধ নয়, শান্তি।

মাতাল অবস্থায় না হলে প্রস্তাবটা ভেবে দেখতাম। কিন্তু আপনি তো নরমাল নন।

সুতরাং আবার ঝগড়া?

ঝগড়া করতে চাইছি না। আপনি আপনার পরিবারের কাছে যান। আমাকে একটু একা থাকতে দিন।

আমিও একা। ওরা আমার তেমন কেউ নয়।

পেটরোল পামপের দিক থেকে একজন অতি সুপুরুষ যুবা এগিয়ে এল। তাকে কলকাতার অর্ধেক লোক চেনে। রাজা ব্যানারজি। দুর্দান্ত রবীন্দ্রসংগীত গায়ক। তাছাড়া কয়েকটা ফিলমেও নেমেছে।

কখন এলে ধ্রুবদা?

এই তো। কি খবর রে?

রাজার মুখে গভীর বিষাদ ও শোক থমকে আছে। ছাইরঙা প্যান্ট, দুধসাদা হাওয়াই শার্ট ছাড়া গায়ে কিছু নেই। এই পোশাক এবং শোকের ছাপ সত্ত্বেও তাকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিল। খুব স্বাভাবিক কারণেই তাকে জড়িয়ে রেমির নামে একটা রটনা শুরু হয়েছিল। তা বলে রাজার ওপর কোনো রাগ বা অভিমান নেই ধ্রুবব। জীবনের খেলায় নিয়মকানুন অন্যরকম। কত ফাউল, কত সেমসাইড হয়, রেফারি চোখ বুজে থাকে।

রাজা তাদের কাছাকাছি এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল, যেন কী করবে তা ভেবে স্থির করতে পারছিল না। ধ্রুবর প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না।

রাজার দিকে সাপের চোখের মতো একজোড়া কুটিল ও হিংস্র চোখ চেয়ে ছিল। সে চোখ জয়ন্তর। কিন্তু রাজা ওকে লক্ষ্য করল না।

অনেকক্ষণ বাদে রাজা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, কী হবে? অ্যাঁ!

কাকে জিজ্ঞেস করল তা ঠিক বোঝা গেল না। বোধহয় কাউকেই নয়। তার বুকের ভিতর থেকে প্রশ্নটা শ্বাসবায়ুর সঙ্গে বেরিয়ে এসে বিপুল পৃথিবীর আরো নানা শব্দের সঙ্গে মিশে গেল।

লবিতে তখন প্রাক্তন মন্ত্রীকে ঘিরে অনেক লোক। কৃষ্ণকান্ত একটা বড়ি খেয়েছেন। বুকে একটা ব্যথা হচ্ছেই।

কে যেন আবার একবার মোলায়েম গলায় বলল, আপনি চলে যান না। গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমরা তো রয়েছি।

কৃষ্ণকান্ত গর্জে উঠলেন না। তবে সেই অবিমৃষ্যকারীর দিকে চেয়ে বললেন, তুমি কি জানো যে, আমি দ্বিতীয়বার মাতৃহারা হতে চলেছি? এ সময়ে কোনো ছেলে বাড়ি ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারে? বিশ্রাম জিনিসটা কি শুধু শরীরের ব্যাপার? মন যেখানে চঞ্চল অস্থির সেখানে শরীরের কি কোনো বিশ্রাম আছে?

অবিমৃষ্যকারীটি গা-ঢাকা দিল।

প্রতি দশ পনেরো মিনিট অন্তর ও টি থেকে কেউ না কেউ এসে খবর দিয়ে যাচ্ছে।

খুব আশাপ্রদ খবর নয়। রক্তচাপ ক্ষীণ, স্রাব সাংঘাতিক, চেতনা প্রায় নেই। তবে আশা তো ছাড়া যায় না।

সাত আটজন ইতিমধ্যেই রক্ত দিতে তৈরি হয়েছে। কৃষ্ণকান্ত বলেছেন তিনিও দেবেন। ডাক্তার বলেছে অত রক্তের দরকার নেই। গ্রুপ মিলিয়ে তিনজনের কাছ থেকে রক্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আপাতত যথেষ্ট।

ও টি-র দরজা কিছুক্ষণের জন্য আঁট করে বন্ধ করা হবে। সারজেন তৈরি, অজ্ঞান করার বিশেষজ্ঞ তৈরি, নার্সরা তৈরি।

কৃষ্ণকান্ত হাহাকারের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ওই হনুমানটা আসেনি? সেটা কই?

জগা বলল, এসেছে। বাইরে আছে।

এখানে ডেকে আন। আমি ওকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব।

জগা একটু দ্বিধা করল। কাবাবুর কথার অমান্য চলে না। তবু সে একটু অপেক্ষা করে কৃষ্ণকান্তর কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল।

কৃষ্ণকান্ত বিবশ হয়ে শুধু সামনের দিকে চেয়ে রইলেন।

না, এরা কেউ চায় না তো তাকে।

চাইলে সে এই পৃথিবীতে থেকে যেতে পারত আরো বহুদিন। ওই যে রক্তমাংসের ছোট্ট একটা পুঁটুলি পড়ল তার পেট থেকে-পড়েই প্রাণ পেয়ে জানান দিল, পৃথিবীতে এসেছে এক দামাল শিশু, ওকে বড় করত রেমি। বুকের ওম দিয়ে, চুমু দিয়ে, চোখের দৃষ্টিতে বার বার লেহন করে, দশ হাতে ঘিরে ধরে বড় করে তুলত আস্তে আস্তে। নিজের সবটুকু আয়ু কি শেষ হয়ে গেল ওকে পৃথিবীতে আনতে?

না তা নয়। তার বাচ্চাটাকে যেন অপয়া না ভাবে কেউ। বড় নিস্পাপ, কুসুমকোমল ও জানে না তো পৃথিবীর পাপ-পুণ্য ভালমন্দের কথা। ও ওর মাকে মারেনি। যারা মেরেছে তারা মুখোশ এঁটে চিরকাল বহাল থাকবে পৃথিবীতে।

না, কেউ চায়নি রেমি বেঁচে থাক। রেমির এই মুহূর্তে চেঁচিয়ে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছে, ওগো তোমরা শোনো। ডাক্তার বলি নয়, ওষুধ নয়, অপারেশন নয়, রক্ত নয়, শুধু কেউ একটু চাইলেই আমি বেঁচে থাকতে পারতাম। শুধু মনপ্রাণ দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে যদি কেউ চাইত, রেমি বেঁচে থাক।

না, ভুল হচ্ছে রেমির। একথা তো ঠিক নয় যে, কেউই তার বেঁচে থাকা চায়নি। চেয়েছিল কেউ কেউ। তবে তাদের চাওয়ার ভাব ছিল অন্য রকম। রেমি চেয়েছিল একজন, মাত্র একজন তাকে চাক।

হায়, সে না চাইলে রেমি বেঁচে থাকে কী করে?

রেমির চোখ থেকে মাঝে মাঝে আলো মুছে যাচ্ছে। আবার অন্ধকার কেটে ফুটে উঠছে থোপা থোপা আলো। মৃত্যু কী রকম গো? খুব অন্ধকার! না কি আলোয় আলো!

রাজা এসেছিল না এক দুপুরে! ধ্রুবর কী সব খবর নিয়ে!

তারপর তারা বেরোলো ধুবকে খুঁজতে।

ধ্রুবর জন্য কোনো দুশ্চিন্তা বোধ করছিল না রেমি। তবু রাজার সঙ্গে যে বেরোলো তার কারণ বেশ কয়েকদিন সে ঘর থেকে আদপেই বেরোয় নি।

কৃষ্ণকান্ত দিল্লি থেকে জরুরি ডাক পেয়ে চলে গেছেন। কাজেই কাউকে কিছু না জানালেও চলে। তবু লতুর জন্য একটা চিরকুট রেখে গেল। লতু কোথায় গেছে, কখন ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই। মেয়েটা বাড়িতে খুব কম সময়ই থাকে। যদি ফেরে এর মধ্যে তবে চিরকুট পাবে। বাড়ি আগলানোর কোনো লোক রইল না। তার অবশ্য দরকারও নেই। বনমালী আছে, জগার ছেলে আছে, তারা বুক দিয়ে আগলে রাখবে বাড়ি। এরা মাইনে করা কাজের লোক বটে কিন্তু আত্মীয়ের বেশী। দেখে মনে হয়, কৃষ্ণকান্ত কিছু লোককে স্থায়ীভাবে সম্মোহিত করে রেখেছেন। কৃষ্ণকান্ত এই কাজটা খুব ভালই পারেন। তাঁর সম্মোহন যে কত সাঙ্ঘাতিক তা কি রেমিও হাড়ে হাড়ে টের পায় না! আর এই সম্মোহনের জাল কেটে বেরিয়ে যাওয়ারই কি প্রাণপাত চেষ্টা করছে না দুর্বল ধ্রুব?

রাজা হনহন করে ট্রামরাস্তার দিকে হাঁটছে দেখে রেমি বলল, কোথায় এলোপাথারি হাঁটছ? ট্যাকসি ধরো না! ওই তো ট্যাকসি।

আরে দূর। বড়লোকি ব্যাপারে আমি নেই।

বেশ তো ছেলে তুমি! বড়লোকি ব্যাপার আবার কী! আমি বাপু ঢ্যাকর ঢ্যাকর করে ট্রামে বাসে যেতে পারব না।

বউদি, খুব কিন্তু রেলা হয়েছে তোমার!

ওমা! সে আবার কী!

ক’দিন আগেও মিডলক্লাস ছিলে। বিয়ের পর আপার ক্লাস মেনটালিটি এসে গেছে। অত ট্যাকসি ট্যাকসি কর কেন? কলকাতার বাস-ট্রামে মানুষই যায়, গরু ভেড়া নয়। চলো।

আহা, এখন অত ঝামেলা ভাল লাগে। তোমার দাদার খবর এনেছো, এসময়ে টাইম ওয়েস্ট করতে আছে?

কে বলল খবর এনেছি?

তুমিই তো বললে!

পাকা খবর নয়। উড়ো খবর।

তাই না হয় হল। ট্যাকসি ধরো তো, ভাড়া আমি দেবো।

রাজা মাথা নেড়ে বলল, মেয়েরা ভাড়া দেয় নাকি? আমি রোজগার কিছু কম করি ভেবেছো? ভাড়া দেওয়ার ভয়ে বুঝি ট্যাকসি করছি না! তুমি একটা যাচ্ছেতাই।

আচ্ছা বাবা, ভাড়া তুমিই দিও। কিন্তু পায়ে পড়ি, ট্যাকসি নাও। না হয় চলো বাড়ি ফিরে গিয়ে গাড়িটা নিয়ে আসি।

দরকার নেই। ট্যাকসি নিচ্ছি। নাহলে তো কৃপণ ভাববে।

ভাবতাম। বাঁচালে।

ট্যাকসিতে উঠে রাজা কিছুক্ষণ কথা বলেনি। তারপর হঠাৎ বলল, ধ্রুবদার ব্যাপারে তুমি খুব ফ্রাস্ট্রেটেড জানি। কিন্তু এতটা নির্বিকার হয়ে গেছ তা জানতাম না।

নির্বিকার! কই, না তো! এই তো তোমার সঙ্গে তাকে খুঁজতে যাচ্ছি।।

কিন্তু প্রথমে যেতে চাওনি। আমি জোর করায় যাচ্ছো।

তা খানিকটা বটে। আসলে আমি ওকে তোমার চেয়ে বেশী চিনি কিনা।

রাজা একটু চুপ করে থেকে বলল, কতটা চেনো তা জানি। কিন্তু ধ্রুবদা আমাদের সকলের চেয়ে অনেক বেশী ব্রিলিয়ান্ট। লেখাপড়ায় ভাল ছিল সেটা কোনো ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু মানুষ হিসেবেও ধ্রুবদা নামবার ওয়ান। কেন এরকম হল বলো তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *