1 of 2

৪২. রাত দশটা

রাত দশটা।

তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। নাইমুল অতিতবাড়ি স্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার

প্রবলবেগে বৃষ্টির পানি নেমে আসছে। নাইমুল এই পানিতে গোসল সারছে। বৃষ্টির পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। নাইমুলের শরীর কাঁপছে কিন্তু গোসল শেষ না করে উঠতে ইচ্ছা করছে না।

তালেব সাহেব একটা শুকনা গামছা এবং ধোয়া লুঙি নিয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করছেন। তালেব সাহেবের পাশে তার বড়মেয়ে চাপা। চাঁপা নাইনে পড়ে। চাঁপার হাতে একটা হারিকেন। চাঁপার মা আমেনা বেগমও কিছুক্ষণ স্নানের দৃশ্য দেখেছেন। এখন তিনি গেছেন রান্নার আয়োজনে। ঘরে কিছুই নেই। অতি দ্রুত কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। ডিমের তরকারি, বেগুনভাজি, মাষকলাইয়ের ডাল। খোয়াড়ে মুরগি আছে। মুরগির মাংস করতে পারলে ভালো হতো। সন্ধ্যার পর মুরগি জবেহ করা নিষেধ বলেই মুরগি জবেহ করা যাচ্ছে না।

যে মানুষটা গোসল করছে, সে কোনো সাধারণ মানুষ না। সে মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করেছে–স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এরকম খবর পাওয়া গেলেও তালেব সাহেবের পরিবার এই প্রথম চোখের সামনে মুক্তিযোদ্ধা দেখছে। কী সুন্দর চেহারা! দেখেই মনে হয় বড় ঘরের সন্তান। পথে পথে ঘুরছে।

তালেব সাহেব বললেন, আপনার সাবান লাগবে? ঘরে সাবান আছে।

নাইমুল বলল, সাবান লাগবে না।

বৃষ্টির পানি ঠাণ্ডা না?

বেশ ঠাণ্ডা।

তাহলে বেশিক্ষণ থাকবেন না। উঠে পড়েন।

নাইমুল বলল, আরেকটু থাকি।

তালেব সাহেব বললেন, আপনার জন্যে একটু চা করতে বলব? ঘরে চায়ের ব্যবস্থা আছে। গুড়ের চা। রান্না হতে সামান্য বিলম্ব হবে। গোসল সেরে চা খান। ভালো লাগবে।

চা দিতে বলুন।

চাঁপা দৌড়ে তার মাকে চায়ের কথা বলতে গেল। সে একটা মুহুর্তের জন্যেও মানুষটাকে চোখের আড়াল করতে চাচ্ছে না। তাদের বাড়িতে একজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্ৰ হাতে উঠে এসেছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মানুষটার প্রতিটা কথা সে খুব মন দিয়ে শুনতে চায়।

তালেব মাস্টার বললেন, কিছু মনে করবেন না, আপনার দলের আর লোকজন কোথায়?

আমার দলে আর লোক নেই। আমি একাই একটা দল করেছি। দলের নাম বললে আপনি হয়তো চিনবেন। আমার দলের নাম হাছুইন্যার দল। ইংরেজিতে হাছুইন্যা গ্রুপ।

তালেব মাস্টার চমকে মেয়ের দিকে তাকালেন। হাছুইন্যার দলের অসীম সাহসী কর্মকাণ্ডের খবর এই অঞ্চলের সবাই জানে। এই মানুষটা হাছুইন্যা?

নাইমুল বলল, নামটা ভালো হয়েছে না? হাছুন অর্থ ঝাড়ু। হাঙ্গুইন্যার দল ঝাড়ু মেরে দেশ থেকে মিলিটারি তাড়াবে।

চাঁপা হেসে ফেলল। মানুষটার কথা তার এত মজা লাগছে! সে চট করে হাসি থামিয়েও ফেলল। হাছুইন্যার দলের হাছুইন্যা অবাক হয়ে এখন তাকে দেখছে। তার খুব লজ্জা লাগছে। সে চা আনতে রান্নাঘরে চলে গেল। গোসল যে করছে এই মানুষটাই বিখ্যাত হাছুইন্যা–এই খবর মাকে দিতে হবে।

চাপার হাসি শুনে কিছুক্ষণের জন্যে নাইমুল বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল মরিয়ম হাসছে। হারিকেন হাতে মেয়েটির সঙ্গে মরিয়মের কোনো মিল নেই। কিন্তু দুজনের হাসিব শব্দ এত কাছাকাছি!

আমেনা বেগম রান্না প্ৰায় সেরে ফেলেছেন। মাষকলাইয়ের ডালটা শুধু বাকি। ডাল সিদ্ধ হতে সময় লাগছে। স্বামী এবং কন্যার মতো তারও ইচ্ছা! করছে অদ্ভুত মানুষটার আশেপাশে থাকতে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। রান্নাঘর ছেড়ে যাওয়া যাবে না। ডাল ধরে যাবে। আয়োজন সামান্য, এর মধ্যে একটা যদি নষ্ট হয় বেচারা খাবে কীভাবে? এরা বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, আরাম করে একবেলা হয়তো খেতেই পারে না।

নাইমুল আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। তার এবং মাস্টার সাহেবের হাতে সিগারেট। মাস্টার সাহেব সিগারেট খান না। আজ একটা বিশেষ রাত, এই রাত বারবার ঘুরেফিরে আসবে না। রাতটা স্মরণীয় করে রাখার জন্যেই একটা সিগারেট খাওয়া দরকার।

তালেব মাস্টার বললেন, চা খেতে খেতে গল্প করেন। আপনার কথা শুনি।

নাইমুল বলল, কী গল্প করব?

যুদ্ধের গল্প করেন। কীভাবে যুদ্ধ করেন এইসব।

যুদ্ধের গল্প করতে ভালো লাগে না। অন্য গল্প করি?

চাঁপা খুবই আগ্রহ নিয়ে বলল, জি জি করেন!

নাইমুল মজার কোনো গল্প মনে করার চেষ্টা করছে। গল্প মনে পড়ছে না। মজার কোনো গল্প শুনে যদি মেয়েটা হেসে দিত, তাহলে মরিয়মের হাসি আরেকবার শোনা যেত। নাইমুল চাঁপার দিকে তাকিয়ে গল্প শুরু করল।

শোন চাঁপা, একবার এক জীববিজ্ঞানী সুন্দর একটা গবেষণা করলেন। তিনি করলেন কী, বড় একটা অ্যাকুরিয়ামে দুধরনের মাছ রাখলেন। এক ধরনের মাছ বড় বড়, আরেক ধরনের মাছ ছোট। ছোট মাছগুলি বড় মাছের খাদ্য। তিনি করলেন কী, অ্যাকুরিয়ামের মাঝামাঝি কাচের একটা পার্টিশন দিয়ে দিলেন। এখন কী হলো শোন–বড় মাছগুলি ছোট মাছ দেখে খাবার জন্যে হা করে ছুটে আসে। এসেই এক সময় কাচের দেয়ালে ধাক্কা খায়। ছোট মাছ তারা আর খেতে পারে না। দিনের পর দিন এরকম চলল। তারপর তারা একসময় বুঝলকোনো এক বিচিত্র কারণে ছোট মাছগুলিকে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তারা ছোট মাছ খাবার চেষ্টা বন্ধ করে দিল। আর তখনই বিজ্ঞানী ভদ্রলোক কাচের পার্টিশন তুলে দিলেন। দুধরনের মাছই একসঙ্গে মিশে গেল। কিন্তু বড় মাছগুলি ছোট মাছ খায় না। মুখের সামনে দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তারা খাচ্ছে না। খাবার চেষ্টাও করছে না।

চাঁপা বলল, ও আল্লা! সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। অ্যাকুরিয়াম থেকে কাচের পার্টিশন উঠে গেছে কিন্তু সেই পার্টিশন চলে গেছে বড় মাছগুলির মাথায়।

চাঁপা বলল, মাছের মাথায় কাচের পার্টিশন যাবে কীভাবে?

নাইমুলের কাছে অদ্ভুত লাগছে কারণ মরিয়মও চাঁপার মতোই একই প্রশ্ন করেছিল–কাচের পার্টিশন মাছের মাথায় যাবে কীভাবে? মেয়েটা শুধু যে মরিয়মের মতো হাসছে তা না, তার চিন্তা-ভাবনাও মরিয়মের মতো।

আমেনা বেগম দরজার ওপাশ থেকে বললেন, খাওয়া কি এখন দিব? নাইমুল বলল, দিন। খুবই ক্ষুধার্তা। তালেব মাস্টার বললেন, আপনি খাওয়াদাওয়া করে আরামে ঘুমান। বিছানা করে দিতেছি। আপনার ভয়ের কিছু নাই। আমি ঘুমাব না। সারারাত জেগে থাকব। পাহারায় থাকব। চাঁপা বলল, আমিও জেগে থাকিব।

নাইমুল বলল, কারো জেগে থাকতে হবে না। আমি আরামেই ঘুমোব। আমার ভয়-ডর একেবারেই নাই।

নাইমুল খেতে বসেছে। তালেব মাস্টারের পরিবার তাকে ঘিরে আছে। আমেনা বেগমের মন খারাপ লাগছে–ছেলেটা কী আগ্রহ করেই না খাচ্ছে! একটু ভালো আয়োজন যদি করা যেত! নাইমুল তালেব মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, চন্দ্রপুর এখান থেকে কত দূর?

তালেব মাস্টার বললেন, দূর আছে। আপনি চন্দ্রপুর যাবেন? চন্দ্রপুর কার কাছে যাবেন?

নাইমুল জবাব দিল না। চন্দ্রপুর কার কাছে সে যাবে–এই তথ্য প্রকাশ করার কিছু না।

ভাত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমেনা বেগমের বুক ধড়ফড় করছে। ভাতে টান পড়বে না তো?

 

চন্দ্রপুরের পীর সাহেবকে তার খাদেম এবং ভক্তরা ডাকে সুরমা বাবা। তিনি চোখে সুরমা ছাড়া সারা গায়ে কোনো কাপড় পরেন না বলেই এই নাম। তিনি দিনরাত অন্ধকার একটা ঘরে থাকেন। ঘরের একটা মাত্র দরজা। সেই দরজা চটের ভারি পর্দায় ঢাকা থাকে। সেই ঘরে খাদেম ছাড়া অন্য কারো প্ৰবেশ নিষেধ। ভক্তরা বিশেষ চাপাচাপি করলে দর্শন দেন। ভক্তদের তখন ঘরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়। সুরমা বাবার সঙ্গে দেখা করার আগে ভক্তদেরও চোখে সুরমা দিতে হয়। সুরমাদানি নিয়ে খাদেম দরজার পাশে বসে থাকেন; হাদিয়ার বিনিময়ে খাদেম চোখে সুরমা দিয়ে দেন।

আজ চন্দ্ৰপুরের পীর সাহেবের হুজরাখানা জমজমাট। প্রথমত, আজি বৃহস্পতিবার। সারারাত জিগির হবে। জিগির শেষ হবে ফজর ওয়াক্তে, তখন সিন্নি দেয়া হবে। সিন্নি হলো গরু, খাসি, মুরগি এবং চাল-ডালের খিচুড়ি জাতীয় খাদ্য। সুরমা বাবার দোয়ায় এই খাদ্য অতি সুস্বাদু হয়। একবার যে খেয়ে যায়, বাকি জীবন তার এই সিনির কথা মনে থাকে।

জিগির ছাড়াও আজ আরেকটি বড় ঘটনা আছে। পীর সাহেবের দাওয়াতে ধর্মপাশা থেকে মিলিটারির মেজর সাহেব আসছেন। তিনি যেহেতু সন্ধ্যার পর থাকবেন না, কাজেই আজ সিন্নি সকাল সকাল রান্না হচ্ছে। মেজর সাহেবকে ইজ্জত করার জন্যে আজ সিন্নি দেয়া হবে আছর ওয়াক্তে। সিন্নি দেয়ার আগে পাকিস্তানের জন্যে দোয়া করা হবে। এই দোয়ায় শামিল হবার জন্যে পীর সাহেব তার ভক্তদের ডেকেছেন। ভক্তদের মধ্যে অনেকেই এসেছে।

মেজর সাহেবকে ইজ্জত করার জন্যে সুরমা বাবা আজ ঘিয়া রঙের একটা চাদর লুঙির মতো কোমরে পেঁচিয়ে রেখেছেন। একবার নিজে এসে রান্নার খোঁজও নিয়ে গেলেন। সচরাচর এই কাজ তিনি করেন না।

সুরমা বাবার হুজরাখানার সামনে নাইমুল বসে আছে। তার গায়ে চাদর। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। সে সুরমা বাবার সঙ্গে একান্তে দেখা করতে চায়। আজ যে ব্যস্ততা তাতে দেখা করা অসম্ভব, তবে সুরমা বাবার এক খাদেমের হাতে দুপ্যাকেট ক্যাপস্টেন সিগারেট এবং দশটা টাকা দেয়ায় খাদেম আশ্বাস দিয়েছে দেখা করিয়ে দেবে। নাইমুল ধৈৰ্য নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে খাদেমকে বলেছে, সুরমা বাবার জন্যে সে কিছু নজরানা নিয়ে এসেছে। বাবার সঙ্গে দেখা হবার পর সে খাদেমকেও খুশি করে দেবে।

এই গরমেও নাইমুলের গায়ে কালো রঙের প্রায় কম্বল জাতীয় চান্দর। তার চোখ লাল। সে মাঝে-মাঝে কাশছে। চোখ লালের কারণ তার চোখ উঠেছে। এই চোখ উঠার নাম জয় বাংলা রোগ। সবারই হচ্ছে। এই রোগ এক সপ্তাহের বেশি থাকে না। নাইমুলের বেলায় রোগ মনে হয় স্থায়ী হয়ে গেছে। আজ নিয়ে বারদিন হলো রোগ সারছে না। এমন কোনো কষ্ট নাই, শুধু রোদের দিকে তাকানো যায় না। চোখ কটকট করে।

সকাল থেকে নাইমুলের কিছু খাওয়া হয় নি। এখন দুপুর। সিনির গন্ধে পেটের ভেতর পাক দিচ্ছে। গন্ধেই বোঝা যাচ্ছে এই সিন্নি আসলেই খেতে ভালো হবে।

সুরমা বাবার হুজরাখানায় নাইমুলের ডাক পড়েছে। খাদেম বলল, আপনার সমস্যার কথা বাবাকে অতি অল্প কথায় বলবেন। লম্বা ইতিহাস বলার প্রয়োজন নাই। বাবা সবই বুঝেন। এখন আসেন, চোখে সুরমা দিয়ে দেই। সুরমার নজরানা এক টাকা।

নাইমুল বলল, সুরমা না দিলে হয় না? আমার চোখের অসুখ।

খাদেম বিরক্ত গলায় বলল, সুরমা চোখে না দিলে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। না। মেজর সাহেব যে আসতেছেন, উনারও চোখে সুরমা দিতে হবে। টিক্কা খান দেখা করতে আসলে তার জন্যেও একই ব্যবস্থা।

দেন, চোখে সুরমা দেন। ব্যথা দিবেন না।

 

সুরমা বাবা গা থেকে চাদর খুলে ফেলেছেন। ঘরের ভেতরটা গরম। গরমে তিনি ঘামিছেন। চাদর দিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে গায়ের ঘাম মুছছেন। বাবার সামনে জলচৌকি। জলচৌকিতে পিতলের গ্রাসে পানি। একপাশে হাতপাখা। তিনি হাতপাখা দিয়ে অতি দ্রুত নিজেকে কিছুক্ষণ বাতাস করেই এক চুমুক পানি খান। নাইমুল কাউকে কখনো এত দ্রুত বাতাস করতে দেখে নি। সুরমা বাবা নাইমুলের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, কী চাস? তুই চাস কী?

নাইমুল বিনয়ে নিচু হয়ে বলল, আপনার জন্যে কিছু নজরানা এনেছি। নিজের হাতে দিতে চাই।

জিনিসপত্র না টেকা?

টাকা।

পরিমাণ কত?

পরিমাণ ভালো।

সুরমা বাবার মুখের বিরক্তি দূর হলো। তিনি প্রায় হাসিমুখে বললেন, আমার কাছে টেকার পরিমাণ কোনো বিষয় না। আমার কাছে এক টেকার যে মূল্য, হাজার টেকার একই মূল্য। সব টেকা-পয়সা গরিব দুঃখীর কাজে ব্যবহার হয়। এইটাও একটা ইবাদত। এই ইবাদতের নাম হাকুল ইবাদ। নজরানার টেকা জলচৌকির নিচের দানবাক্সে রাখা। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে চলে যা। মেজর সাব আসতেছেন।

হুজুর কি মেজর সাহেবকে দাওয়াত দিয়েছেন?

অবশ্যই দাওয়াত দিয়েছি। দাওয়াত ছাড়া তারা আসবেন?

হুজুর যদি কিছু মনে না করেন, যদি বেয়াদবি না নেন–একটা প্রশ্ন করব?

কী প্রশ্ন?

শুনেছি মিলিটারিরা অনেক মানুষ মেরেছে, মেয়েদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। তাদেরই দাওয়াত করেছেন–ব্যাপারটা কেমন না?

সুরমা বাবা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কেমন মানে? বিধমীর সাথে যুদ্ধের নিয়ম তুমি জানো? বিধমীর মালা হলো গনিমতের মাল। সেই মাল নেওয়ার হুকুম আছে। বিধমীদের মেয়েছেলেও মালের মধ্যে পড়ে।

যুদ্ধ তো বিধমীর সঙ্গে হচ্ছে না। এই দেশের মানুষের সঙ্গে হচ্ছে।

তুমি চাওটা কী পরিষ্কার করে বলো তো? তুমি কে?

আমার আসল নাম নাইমুল। আসল নামে আপনি আমাকে চিনবেন না। যে নামে আপনি আমারে চিনবেন সেই নাম হলো–হাছুইন্যা। এখন চিনেছেন?

সুরমা বাবার মুখ যে ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তা এই প্রায়ান্ধকার ঘরেও বোঝা গেল। নাইমুল গায়ের কালো চাদর খুলে ফেলল। স্টেনগান এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নাইমুল বলল, শুনেন সুরমা বাবা–চিৎকার চোঁচামেচি কিছুই করবেন। না। যেভাবে বসে আছেন, বসে থাকেন। আমি এসেছি মেজরটাকে মারার জন্যে। আমার সঙ্গে আরো চারজন আছে। এরা বাইরে আছে। আপনি হাছুইন্যা গ্রুপের নাম শুনেছেন?

জি বাবা শুনেছি।

আমার দলটার নাম হাছুইন্যার দল।

ইয়া গাফুরুর রহিম। এইটা কী বলেন!

ভয় লাগে?

জি লাগে।

নেংটা বসে থাকবেন না, কাপড় গায়ে দেন।

সুরমা বাবা অতি দ্রুত চাদর গায়ে প্যাচালেন। নাইমুলও চাদর গায়ে দিল। ভয় যতটুকু দেখানোর দেখানো হয়েছে। সুরমা বাবা কঁপা কাপা গলায় বললেন, বাবাজি, আমাকে কিছু করবেন না তো?

নাইমুল বলল, আপনি যদি মেজরটাকে মারার জন্যে আমাকে সাহায্য করেন, তাহলে আপনাকে কিছু করব না। আর যদি সাহায্য না করেন–আপনাকে মেরে ফেলব। আমি আপনার সঙ্গেই থাকব। মেজর আপনার সঙ্গে কথা বলতে যখন আসবে, তখন গুলি করব।

বাবাজি এইসব কী বলেন?

ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি এত বড় পীর! মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে বেহেশতে চলে যাবেন। সত্তরটা হুর আপনার গা টিপা টিপি করবে।

বাবাজি, ভুল-ত্রুটি কিছু হয়ে থাকলে ক্ষমা দেন।

হাছুইন্যা গ্রুপের কাজ-কারবার তো জানেন। ক্ষমা এক বস্তু এদের মধ্যে নাই। বিদায় নিয়েছে। দেশ যেদিন স্বাধীন হবে, সেদিন হয়তো ফিরে আসবে।

চটের পর্দা ফাঁক করে একজন খাদেম উঁকি দিল। নাইমুলের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, এই তুমি আসো। বাবার সামনে বেশিক্ষণ থাকার নিয়ম নাश्।

নাইমুল বলল, আরেকটু দেরি হবে। বাবার সঙ্গে আসল কথাই এখনো হয় নাই। সুরমা বাবা, আপনি আপনার খাদেমকে বলেন, আমার দেরি হবে।

সুরমা বাবা যন্ত্রের মতো বললেন, উনার দেরি হবে। তুমি এখন যাও।

খাদেম পর্দা নামিয়ে চলে গেল। ঘর আবারও অন্ধকার হয়ে গেল। নাইমুল বলল, সুরমা বাবা, মেয়েভক্তরা আপনার কাছে আসে না?

আসে। তাদের সামনেও নেংটিা হয়ে বসে থাকেন? বাবাজি, আমার শরীরে গরম বেশি, এই জন্যে গায়ে কাপড় রাখতে পারি না। বাবাজি গো, এইবার আমারে মাফ দেন। মাফ দিলে আমি জয় বাংলার লোক হবো।

নাইমুল সিগারেট ধরাল। সুরমা বাবার দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন। সিগারেট খান।

সুরমা বাবা সিগারেট নিলেন। দেয়াশলাই দিয়ে সিগারেট ধরাতে তার অনেক সময় লাগল। তার হাত কাঁপছে।

লোকে বলে আপনার জীন সাধনা আছে। সত্যি নাকি?

জি বাবা সত্যি।

কয়েকটা পোষা জীনও নাকি আছে। কয়টা আছে?

তিনজন আছে। চারজন ছিল। একজনের মৃত্যু হয়েছে। এখন আছে তিনজন।

তাদের ডাকেন, তারা আপনাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করুক। যার কন্ট্রোলে তিনটা জীন আছে, সে যদি এত ভয় পায় তাহলে কীভাবে হবে? আপনি কি পিসাব করে দিয়েছেন?

জি-না। পিসাব করি মাই। তবে বাবাজি আমারে টাট্রিঘরে যেতে হবে। পিসাব চেপেছে।

পিসাব এখানেই করেন। আপনাকে টাট্টিঘরে যেতে দিব না।

ছড়ছড় শব্দ হচ্ছে। সুরমা বাবা সত্যি সত্যি পিসাব করছেন।

আছরের সময় খবর পাওয়া গেল মেজর সাহেব। আসবেন না। তবার রুক পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। তবারারুক নেয়ার জন্যে ধর্মপাশা থানার একজন সেপাই নৌকা নিয়ে এসেছে।

নাইমুল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, কাজ তো হলো না, এখন তাহলে উঠি?

সুন্নামা বাবা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললেন, জি আচ্ছা বাবাজি। জি আচ্ছা।

নাইমুল সহজ গলায় বলল, আপনি কাপড় খুলে আবার নেংটা হয়ে যান। আপনি নেংটা বাবা। আপনাকে নেংটা অবস্থায় মারি।

সুরমা বাবা এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন তিনি নাইমুল কী বলছে বুঝতে পারছেন না। নাইমুল বলল, দেরি করছেন কেন? কাপড় খুলেন।

খুব কাছ থেকে নাইমুল স্টেনগান দিয়ে গুলি করল। সে সামান্যতম বিকারও বোধ করল না। তার একটাই সমস্যা হলো–ক্ষিধে নষ্ট হলো।

 

ধর্মপাশা থানা থেকে হাছুইন্যা গ্রুপের নাইমুলকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দেবার জন্যে এক হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। পুরস্কার ঘোষণা করলেন শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট। তিনি রাতে থাকেন থানায়। বাড়িতে থাকা নিরাপদ বোধ করেন না। পুরস্কার ঘোষণার দুদিনের মাথায় শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট দুপুরে বাজারে চায়ের দোকানের সামনে মারা গেলেন। নাইমুলের হাতেই মারা গেলেন। গুলি করার আগে নাইমুল জিজ্ঞেস করল, প্রেসিডেন্ট সাহেব, ভালো আছেন? আমাকে চিনেছেন তো, আমি হাছুইন্যা।

প্রেসিডেন্ট সাহেব জর্দা দিয়ে পান খাচ্ছিলেন। তার মুখ থেকে জর্দার রস গড়িয়ে পড়ল। নাইমুল বলল, থানায় কতগুলি মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছে एका?

প্রেসিডেন্ট সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, থানায় কোনো মেয়ে আটক নাই।

নাইমুল বলল, সত্যি কথা বলেন। আমি কিন্তু চাদরের নিচে ষ্টেনগান তাক করে আছি।

প্রেসিডেন্ট সাহেব বললেন, কয়টা মেয়ে আছে আমি সঠিক জানি না।

আপনার নিজের মেয়ে তো নাই। না-কি আছে?

আপনি কী বলতেছেন বুঝতে পারতেছি না।

গুলি খাওয়ার পরে বুঝবেন। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়–বুলেট শরীরে ঢোকামাত্র মাথা পরিষ্কার হয়ে যায়। বুলেট হলো মাথা পরিষ্কারের ট্যাবলেট।

প্রেসিডেন্ট সাহেব কথাবাতাঁর এই পর্যায়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তাকে সেই অবস্থাতেই গুলি করা হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *