1 of 2

৪২. অর্কর প্রণাম করা শেষ হলে

 বিয়াল্লিশ

অর্কর প্রণাম করা শেষ হলে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘আর একটা রিকশার কি দরকার?’ প্রশ্নটা অনিমেষের মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে নয়।

অনিমেষ বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম স্টেশনে যাব।’

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বারান্দা থেকে বলে উঠলেন, ‘না, না, খোঁড়া মানুষ, রিকশায় ওঠাওঠি করে অদ্দূর যেতে হবে না।’

মাধবীলতা এবার অনিমেষের দিকে তাকাল। এই সময় ছোটমা বললেন, ‘গেলে কিন্তু ভাল হত। ওরা এখানকার পথ-ঘাট চেনে না ভাল করে। অনি তো রিকশায় এর আগেও উঠেছে।’

মাধবীলতা অর্ককে বলল, ‘তুই এগিয়ে যা। আর একটা রিকশা ডাক।’

অর্কর যে ব্যবস্থাটা মনঃপূত হল না তা বোঝা গেল, ‘কিন্তু খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে মা। যদি ট্রেন না পাও—।’

মাধবীলতা আস্তে করে বলল, ‘ঠিক আছে।’

গায়ে একটা জামা গলিয়ে অনিমেষ গেট ছাড়িয়ে রিকশার কাছে এসে বলল, ‘আমায় একটু ধরো তো ভাই।’

রিকশাঅলা ক্রাচ দুটো টেনে নিচ্ছিল, মাধবীলতা পিছন থেকে বলল, ‘ওভাবে নয়, তুমি ওর পেছনটা ধর।’

রিকশায় বসে অনিমেষ বলল, ‘এই ওঠার ব্যাপারটা যদি পারতাম তাহলে কোন অসুবিধে থাকত না আমার।’

মাধবীলতা বারান্দার দিকে মুখ করে বলল, ‘এলাম’।

দুটো গলা প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারণ করল, ‘এসো।’

মাধবীলতা আর দাঁড়াল না। এবং অনিমেষকে খানিকটা অবাক করে এগিয়ে গেল অর্ককে অনুসরণ করে। রিকশায় অনিমেষ একা বসে, পায়ের তলায় ওদের জিনিসপত্র। অনিমেষ লক্ষ্য করল আজ মাধবীলতার মাথায় সেই অর্থে ঘোমটা নেই। আঁচলটা খোঁপার ওপর কোনক্রমে রয়ে গেছে মাত্র। অনিমেষের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মাধবীলতাকে ডাকে। তার পাশে পর্যাপ্ত জায়গা আছে অতএব হেঁটে যাওয়ার কোন মানে হয় না। কিন্তু সেই মুহুর্তেই অর্ক দূর থেকে চেঁচাল, ‘মা, রিকশা পেয়ে গেছি!’

অতএব দুটো রিকশা পর পর ছুটল স্টেশনে। কিছুটা অভিমান, কিছুটা অপমান বোধ আবার কিছুটা ক্রোধ অনিমেষকে পীড়িত করছিল। তার মনে হচ্ছিল মাধবীলতাকে একা পেলে সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে হয় তো নরম করতে পারত কিন্তু অর্কর জন্যেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কাল রাত্রের পর থেকে ছেলেটা এমন ব্যবহার করছে যা অন্য সময় হলে সহ্য করত না অনিমেষ। আর এখন, নিজেকে এমন অসহায় লাগছে যে—। অনিমেষ মাথা নাড়ল। না, এখন কোন ঝগড়াঝাঁটির সময় নয়। যা স্বাভাবিক তাকে সহজভাবে মেনে নেওয়াই ভাল।

মালপত্র প্লাটফর্মে নামিয়ে অর্ক টিকিট কাটতে গেল। বেশ ভিড় প্লাটফর্মে। অফিসযাত্রীরা উপচে পড়ছে। জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি ডেইলি প্যাসেঞ্জারি চালু হয়েছে খুব। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ বলে ফেলল, ‘তুমি এমন নিষ্ঠুর হয়ো না।’

মাধবীলতা অন্যমনস্ক হয়ে মানুষ দেখছিল। এবার চমকে মুখ ফেরাতেই অনিমেষ ওর চোখ দেখতে পেল। মাধবীলতা কিছু বলতে গেল কিন্তু হঠাৎ ওর ঠোঁট কেঁপে উঠল আর দুই চোখের কোণে চোরা জল বাসা বাঁধল। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল ওই জল মুছিয়ে দেয়। কতদিন, কতদিন মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেনি। কতদিন আকণ্ঠ চুম্বন করেনি! ওই শরীরে মুখ ডুবিয়ে নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ অনুভব করেনি। আর এখন, এই স্টেশনে দাঁড়িয়ে এই সব ইচ্ছেগুলো একসঙ্গে অনিমেষের মনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠিক এখনই একটি বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারিত হল পাশ থেকে, ‘অনিমেষ না?’

অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে দেখল।

‘কি রে শালা চিনতে পারছিস না? কবে এসেছিস গুরু? আই বাপ, তোর পায়ে কি হল? ওহো, বুঝেছি।’

চেহারাটা একটুও বদলায়নি। অথচ প্রায় বাইশ বছর পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। সেই কোঁকড়া চুলের কায়দা, ভেঙেচুরে দাঁড়ানো আর ঠোঁটে বদমায়েসী হাসি ঝুলিয়ে মন্টু হাসছে। জলপাইগুড়ি শহরে অনিমেষের স্কুল জীবনে যে কজন বন্ধু ছিল মন্টু তার অন্যতম। যাবতীয় জ্ঞানবৃক্ষের ফল সে খেয়েছিল এর মারফৎ। অনিমেষের ওকে দেখে অবশ্যই খুশি হওয়া উচিত ছিল কিন্তু এই সময়টায় সে কাউকেই সহ্য করতে পারছিল না। তবু হাসতে হল, ‘কেমন আছিস?’

‘ফাইন!’ মন্টু চেঁচিয়ে উঠল, ‘এটা কি জেলে হয়েছে?’ আঙ্গুল নেড়ে অনিমেষের পা দেখাল মন্টু।

‘ফালতু। কোন মানে হয় না। তোকে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল নকশাল হতে? কি লাভ হল বল? যাক, কবে এসেছিস?’

‘কিছুদিন হল।’

‘বাঃ, এসে একবার দেখাও করিসনি! আমার বউকে মাইরি তোর সেই গল্পটা করতাম। বিরাম করের বউটা তোকে—।’ হো হো করে হেসে উঠল মন্টু। অনিমেষ দেখল এই বয়সেও মন্টুর মধ্যে তরল ভাবটা অটুট থেকে গিয়েছে। ওকে চাপা দেওয়ার জন্যে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘স্টেশনে কেন? কোথাও যাচ্ছিস নাকি?’

মন্টু খুব কায়দা করে দাঁড়াল। এই বয়সে সেটা খুব বেমানান দেখাচ্ছে। পনের ষোল বছরে দেবানন্দকে যে নকল করত সে চল্লিশ পেরিয়েও তা ধরে রেখেছে। হয়তো অভ্যেস হয়ে গিয়েছে, যা করছে নিজের অজান্তেই করছে। তবে মোটা হয়ে গেলেও ভুঁড়ি হয়নি বলে বাঁচোয়া। মন্টু একটা হাত পেটের ওপর রাখল, ‘এই ধান্দায় রোজ স্টেশনে আসতে হয়। তোদের মত রাজনীতি করলে আর দেখতে হতো না। রোজ সকালের ট্রেন ধরে এন জে পি যাই আবার সন্ধ্যের ট্রেনে ফিরে আসি। আজকে শালা লেট করছে খুব।’ একটু বিরক্ত চোখে মন্টু হলদিবাড়ির দিকে তাকাল।

‘তুই কোথায় কাজ করছিস? কোন ডিপার্টমেন্টে?’

‘রেলে। ইণ্ডিয়ান রেইলওয়ে। তুই কোথায় যাচ্ছিস?’

‘আমি যাচ্ছি না।’

এই সময় অর্ক একটু বিব্রত ভঙ্গীতে এসে দাঁড়াল, ‘মা, রিজার্ভেশন ছাড়া এরা টিকিট ইস্যু করে না। আমি এন জে পি পর্যন্ত টিকিট করেছি। অনেকে বলছে এই ট্রেনে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরা যাবে না।’

মন্টু মাথা নাড়ল, ‘কে বলেছে ভাই? গুজবে কান দিও না। বোধ হয় একদিন মাত্র ও-রকম ঘটনা ঘটেছিল। এরা কে রে অনিমেষ?’

মাধবীলতা ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। লোকটাকে তার বিন্দুমাত্র পছন্দ হয়নি। যে বয়সে যা মানায় তা না হলে বড় দৃষ্টিকটু দেখায়। এখন প্রশ্নটা শুনে সে অনিমেষকে দেখল। অনিমেষ বলল, ‘বউ আর ছেলে।’

‘তাই নাকি?’ মন্টু উৎফুল্ল হল, ‘নমস্কার, নমস্কার। আমার নাম মন্টু, অনিমেষের সঙ্গে পড়তাম। কোথায় চললেন?’

মাধবীলতা যতটা সম্ভব সহজ ভঙ্গীতে বলল, ‘কলকাতায়।’

‘টিকিটের কথা শুনছিলাম, রিজার্ভেশন নেই?’

মাধবীলতা মাথা নাড়ল। মন্টু হাত নাড়ল, ‘কোই ফিকির নেহি। যখন পরিচয় হয়ে গেল তখন ও দায়িত্ব আমার। কাঞ্চনজঙ্ঘায় আপনাদের বসিয়ে তবে আমি ছুটি নেব। কিন্তু হ্যাঁরে, তোর এত বড় ছেলে কি করে হল? বিয়ে করেছিস কবে?’

অনিমেষ অস্বস্তিটা এড়াবার জন্যে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কেন, তুই তো বউ-এর কথা বলছিস, ছেলে মেয়ে নেই?’

‘সেটাই তো ভাবছি। আমার মেয়ের বয়স দশ। তোমার বয়স কত হে, কুড়ি?’ প্রশ্নটা সরাসরি অর্ককে।

হঠাৎ অর্কর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে মন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বয়স জেনে আপনার কি হবে?’ প্রশ্নটা কানে যাওয়া মাত্র অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল। মাধবীলতাও মুখ তুলে ছেলেকে দেখল। মন্টু কিন্তু মোটেই অপ্রস্তুত হয়ন, ‘খুব পার্সোনালিটি আছে তোর ছেলের, ভাল ভাল। যাক, ট্রেনটা এসে গিয়েছে।’

দূরে শব্দ হচ্ছিল বটে কিন্তু তার আগে আকাশের গায়ে কালো ধোঁওয়া সবার চোখে পড়ল। প্লাটফর্মে হুড়মুড় করে মানুষজন ছোটাছুটি করছে। মন্টু মাধবীলতাকে বলল, ‘ব্যস্ত হবার দরকার নেই। জেনারেল কম্পার্টমেন্টে আপনারা উঠতে পারবেন না। সবাই উঠুক তার পর আমরা গার্ডের গাড়িতে উঠব।’

অনিমেষ বলল, ‘গার্ডের গাড়িতে উঠতে দেবে?’

মন্টু কাঁধ নাচাল, ‘ডোন্ট ফরগেট, আমি রেলের লোক।’

ট্রেনটা প্লাটফর্মে দাঁড়ানো মাত্র ঝড় বয়ে গেল। ছুটোছুটি ধাক্কাধাক্কির শেষে গোটা প্লাটফর্মটা ট্রেনের গায়ে ঝুলে পড়ল। মন্টুর নির্দেশে ওরা গার্ডের কামরার কাছে চলে এল। সেখানেও কিছু লোক উঠেছে কিন্তু তবু স্বস্তিকর।

মন্টু গার্ডের সঙ্গে কথা বলে অর্ককে ইঙ্গিত করল জিনিসপত্র তুলতে। সেগুলো নিয়ে অর্ক ওপরে উঠলে অনিমেষ চাপা গলায় মাধবীলতাকে বলল, ‘চিঠি দিলে উত্তর দেবে তো?’

মাধবীলতা আবার তাকাল। তার পর বলল, ‘কি দরকার!’

অনিমেষ প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে জবাব দিল, ‘দরকার আছে, আমি তোমাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছি না। ছোটখাটো ত্রুটিকে এত বড় করে দেখো না। আমরা পরস্পরকে ছাড়া অসহায় হয়ে পড়ব। আমি এখানে রইলাম। তুমি যদি না পার তাহলে ডেকো। আর পিসীমা যদ্দিন বেঁচে আছেন তদ্দিন আমাকে না পার ওঁকে চিঠি লিখো। অন্তত এঁরা জানুক আমাদের সম্পর্ক অটুট।’

‘তোমার কথাবার্তা পরস্পর বিরোধী হয়ে যাচ্ছে।’

সেটা অনিমেষ নিজেও বুঝছিল। কিন্তু এই দ্রুত গলে যাওয়া সময়টায় সে যে করেই হোক মাধবীলতাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিল। এই সময় অর্ক ডাকল, ‘মা, তাড়াতাড়ি উঠে এস, গাড়ি ছাড়ছে।’

মাধবীলতা মুখ তুলল, ‘চলি, সাবধানে থেকো।’

‘তুমি কিছুই বললে না!’

‘কি বলব!’

এই সময় ঠং ঠং শব্দ উঠল। ঘণ্টা বাজছে ট্রেন ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে।

‘তুমি এইভাবে চলে যাবে?’

‘আমাকে তো যেতেই হবে। যাওয়াটা এর চাইতে আর কিভাবে সহজ হত!’

মাধবীলতা ধীরে ধীরে ওপরে উঠতেই ঝরঝরে ট্রেনটা ছেড়ে দিল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল মন্টু, ‘তুই চিন্তা করিস না, ওদের আমি কাঞ্চনজঙ্ঘায় বসিয়ে দেব।’

অনিমেষ উন্মুখ হয়ে কম্পার্টমেন্টের দরজার দিকে তাকাল। না, মাধবীলতাকে আর দেখা গেল না, এমন কি অর্কও জানলায় এল না। দু’তিন পা এগিয়েও সে ওদের দেখতে পাচ্ছিল না। ট্রেনটা গতি বাড়িয়ে প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। সামনের আকাশটা ধোঁওয়ায় কালো। হঠাৎ অনিমেষের বুকের ভেতর থেকে আর একটা দৃশ্য উঠে এল। তখন সন্ধ্যেবেলা। সে ট্রেনের দরজায়। সরিৎশেখর চলন্ত ট্রেনের পাশাপাশি লাঠি দুলিয়ে হাঁটছেন। ধীরে ধীরে গভীর অন্ধকার তাঁকে গ্রাস করে নিল। অনেক দূরে একটি আলোকিত স্টেশনকে রেখে সে অন্ধকারে ডুবে গেল।

আজ অনেক অনেকদিন বাদে প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে এসে অনিমেষ কেঁদে ফেলল। এই প্রথম, নিজেকে প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল।

মন্টুর কল্যাণে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে চমৎকার জায়গা পেয়ে গেল ওরা। আসাম থেকে আসা একটা ট্রেন দেরি করায় কাঞ্চনজঙ্ঘা সময়ে ছাড়েনি। বিশেষ ঋতু ছাড়া এই ট্রেনে তেমন ভিড় হয় না। কিন্তু ওভারব্রিজ পেরিয়ে টিকিট কিনে আনা, রিজার্ভেশন পাওয়ার জন্যে যা ঝামেলা তা মন্টুই করে দিয়ে জানলার পাশে ওদের জায়গা করে দিয়ে বলল, ‘এবার আমি চলি।’

মাধবীলতা বলল, ‘আপনি অনেক করলেন!’

‘আরে এ সব তো নস্যি। আপনি জানেন না অনিমেষ আর আমি ছেলেবেলায় কি-রকম বন্ধু ছিলাম। এখন তো আপনি জলপাইগুড়ির বউ হয়েছেন, নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।’

লোকটার চেহারা এবং ব্যবহারের চাপল্যের সঙ্গে আসল লোকটাকে ঠিক মেলানো যায় না। মাধবীলতা নিঃশ্বাস ফেলল, অনিমেষের মুখে মন্টু সম্পর্কিত অনেক ঘটনা সে শুনেছে। বেপরোয়া দুঃসাহসী ছেলে। কিন্তু এখন সে এমন ভঙ্গী করে ছিল যেন মন্টু মামটা প্রথম শুনছে। একমাত্র মানুষই পারে নিজের দুটো চেহারাকে আলাদা রাখতে।

রোদ মাথায় নিয়ে ট্রেনটা ছাড়ল। অর্ক জানলার পাশে। ছেলে যে সকাল থেকেই অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না সেটা লক্ষ্য করেছিল মাধবীলতা। তার নিজেরও কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না। সে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিল। কি হল, এই জীবনটায় কিছুই হল না। কেন এত কষ্ট করা, কেন নিজেকে নিংড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা? কোন মানে হয় না। এ দেশে মেয়েদের উচিত যা স্বাভাবিক সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া। এখানে ব্যতিক্রম হওয়ার চেষ্টা মানে পরিণামে নিঃসঙ্গতা, বুকভরা নিঃস্বতা। মাধবীলতার সমস্ত শরীরে কাঁপুনি এল। যেন একটা ঢেউ এসে তাকে শূন্যে তুলে দূরে ছুঁড়ে দিচ্ছে এবং পরক্ষণেই আর একটা ঢেউ সেখান থেকে তুলে আরও দূরে ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর সে ঠিক একটা জড়পদার্থের মত সেই ঢেউ-এর কাছে আত্মসমর্পণ করে চলেছে। নিজের শরীরের কিংবা মনের এই অস্থিরতার বিরুদ্ধে সে জোর করে শক্ত হতে চাইল। পরিণতি নেতিবাচক হলেই কাজটা ভুল হয়ে যাবে? না, কোন ভুল করেনি সে। সারা জীবনে যা করেছে নিজে জেনে শুনে করেছে। একটা জীবন আর কত বড়? যাকে সে ভালবেসেছিল তাকে তো দশ বছর নিবিড় করে পেয়েছে। তাই বা ক’জন পায়? এটাই তার জয় নয়? গত রাত্রে তো সে নিজে মরেও যেতে পারত!

ঢেউটা যেন সামান্য জোর হারালো কিন্তু মাধবীলতা বুঝতে পারছিল এটা স্তোকমাত্র। তার শরীর ভারী হয়ে আসছিল এবং মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। কাল রাত্রে সে কি খুব সামান্য কারণে পাগল হয়ে গিয়েছিল? যেটাকে তখন অপমান বলে মনে হয়েছিল সেটা কি সত্যি অপমান? এতটা ক্রোধ প্রকাশ না করলেও কি চলতো? অনিমেষ তাকে কোনরকম কটু কথা শোনায়নি। বারংবার আত্মসমর্পণ করার চেষ্টা করেছে। দৃশ্যটা মনে পড়া মাত্র ওর শরীরে জ্বলুনি ফিরে এল। একটা পুরুষ মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েও যদি আত্মসমর্পণ করে তাহলে—। বরং তখন যদি অনিমেষ বলতো সে ঠিক কাজ করেছে, যা করেছে ভাল মনে করে করেছে এবং মাধবীলতাকে তাই মেনে নিতে হবে তাহলে হয়তো সে নিজে আত্মসমর্পণ করত। সে কি মনে মনে চাইছিল না অনিমেষ সত্যিকারের পুরুষ মানুষ হয়ে উঠুক? যাক, যা হবার তা হয়েছে। এখন সে কি করবে? কলকাতায় সে আর অর্ক। তার সারা দিন রাত কাটাবে কি করে? মাধবীলতা হেসে ফেলল নিজের মনে যদিও তার কোন ছায়া ঠোঁটে পড়ল না। অনিমেষ থাকতে তার কিভাবে দিন কাটতো? সারা বছরে কদিন ভালবাসার কথা বলতো তারা? কদিন সুন্দর জিনিস দেখতে বের হতো দু’জনে? মাধবীলতা মাথা নাড়ল। একটা মেয়ের জন্ম শুধু একটি পুরুষের কাছে নতজানু হবার জন্যে এ কখনই হতে পারে না। এখন সে যা স্বাভাবিক তাই করবে। একমাত্র অর্ক ছাড়া কারো কাছে দায়বদ্ধ নয় সে। মাধবীলতার চোখের কোল ভিজছিল। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংযত করল। এতসব ভাবনা চিন্তা তাকে অনেকটা ঢেউ-এর বিরুদ্ধে হেঁটে আসতে সাহায্য করলেও হঠাৎ আর একটা চোরা স্রোত আচমকা পায়ের তলার বালি সরাল। এতদিনের সব পরিশ্রম এবং মন সে নিজের হাতেই নিঃশেষ করে এল? এক ঝটকায় মাধবীলতা সোজা হয়ে বসল। না, সে ঠিক করেছে। অনিমেষ ছাড়া তার জীবনে অন্য কোন পুরুষের অস্তিত্ব নেই, তাই বলে সে অনিমেষের ক্রীতদাস হয়ে থাকতে পারে না।

‘খানা চাহিয়ে?’

প্রশ্নটা শুনে অর্ক মুখ ফেরাল। মাধবীলতা তখন চোখ খুলেছে। কিন্তু খুব শক্ত এবং কিঞ্চিত ফোলা লাগছে মুখ। অর্ক লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি খাবার?’

‘ফিস চিকেন আউর আণ্ডা রাইস।’

‘কত দাম?’

লোকটা উত্তর দেবার আগে মাধবীলতা বলল, ‘একটা মাছভাত আর, তোমরা নিরামিষ দাও না?’

লোকটা মাথা নাড়ল, ‘হাঁ, ভেজ মিলেগা।’

‘তাহলে আমাকে নিরামিষ দিও।’

একটা কাগজে অডার লিখে নিয়ে লোকটা চলে যেতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি নিরামিষ খাচ্ছ কেন?’

মাধবীলতা মাথাটা আবার হেলিয়ে দিল, ‘ট্রেনে মাছ মাংস খেতে ভাল লাগে না।’

অর্ক মুখ ফিরিয়ে নিল। মায়ের কাছে কত টাকা আছে তা তার জানা নেই। স্টেশনে অনেককে পুরি তরকারি খেতে দেখেছে সে, তাই খেয়ে নিলে হত। মাছ-ভাতের দাম কত কে জানে! সে বাইরে তাকাল। প্রখর রোদের মধ্যে মাঠ ঘাট জঙ্গল পিছনে ছুটে ছুটে যাচ্ছে। আকাশে একটুকরো সাদা মেঘ পর্যন্ত নেই। এ-রকম ঝলসানো রোদে তাকিয়ে সুখ নেই। ওদের ঠিক উল্টো দিকে একটি মহিলা শিশুকোলে বসে ছিলেন। তার পাশে বেশ বয়স্ক পুরুষ। বাচ্চাটা নিঃশব্দে পড়ে রয়েছে। এরা কি মা বাবা আর ছেলে? লোকটাকে বউটার স্বামী বলে মনে হয় না কিন্তু কথাবার্তায় অন্যকিছু কল্পনা করা যায় না। সে ট্রেনের অন্য যাত্রীদের দিকে তাকাল। এই ট্রেনে শোওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। মাঝখান দিয়ে প্যাসেজ রয়েছে এ কামরা ও কামরায় যাওয়ার। তাই যাত্রীদের হাঁটাচলার বিরাম নেই। অর্ক আবার মায়ের দিকে তাকাল। পাথরের মত মুখ, চোখ বন্ধ এবং কি ভীষণ সাদা দেখাচ্ছে। এই চেহারায় সে কোনদিন মাকে দ্যাখেনি। মা নিরামিষ খেতে চাইল। কেন? মা কি নিজেকে বিধবা ভাবছে? শব্দটা মনে আসতেই সে ঠোঁট কামড়াল। তোমার বাবার নাম কি? না, আর সে অনিমেষ মিত্র বলতে পারবে না। এই পৃথিবীতে তার কোন আইনসম্মত বাবা নেই। চমৎকার! এতদিন ধরে যাকে সে বাবা বলে ভেবেছিল এবং জেনেছিল আজ বলা হল তিনি তার জন্মদাতা মাত্র, বাবা নন। আর এ ব্যাপারে তার কিছু করার নেই। যদি বলা হত তিনি তার জন্মদাতাও নন তাহলেও তার করার কিছু ছিল না। কিন্তু মায়ের অস্তিত্ব তো অস্বীকার করা যাবে না। এইটেই পরম সত্যি। তার জন্মাবার পর কয়েক বছর মা দু’দিক আগলে ছিল। এই কয় বছর একজন বাবার ভূমিকা নিয়ে ছিলেন এখন আর নেই। অন্তত আইনের চোখে নেই। শুধু আইনের চোখে, তার নিজের কাছে? আজ যদি সে ঝুমকির সঙ্গে বাস করে এবং সন্তান হয় তাহলে তাদের সবাই মেনে নেবে?

আবার ক্ষরণ শুরু হল অর্কর। এই সময় সামনের বউটা নাকিসুরে কিছু বলে উঠতেই লোকটা চাপা গলায় ধমকালো, ‘চোপ! কথা বলবে না একদম।’

অর্ক লোকটার দিকে তাকাল। রোগা পটকা শরীর কিন্তু তেজ খুব। বাচ্চাটা যদি ওর হয় তাহলে সে জানল না তার মাকে ধমক খেতে হচ্ছে। সে হঠাৎ মাধবীলতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘তোমার মন খুব খারাপ, না?’

মাধবীলতা যেন সামান্য চমকালো। তার পর চোখ না খুলে বলল, ‘কই, না তো।’

‘তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।’

‘কাল রাত্রে ঘুম হয়নি তাই হয়তো।’

‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’

মাধবীলতা সামান্য সময় নিল, ‘বল।’

‘তোমরা বিয়ে করোনি কেন?’

মাধবীলতার চিবুক বুকের ওপর নেমে আসছিল কিন্তু সে কোনক্রমে সোজা হল, ‘সে অনেক কথা, তুই ঠিক বুঝবি না।’

‘তুমি আমাকে ছেলেমানুষ ভেবো না।’

এবার মাধবীলতা অর্কর দিকে তাকাল। এবং অত্যন্ত দ্রুত সে মন ঠিক করে নিল। না, আর লুকোছাপা করে কোন লাভ নেই। অর্ক সত্যিই বড় হয়ে গিয়েছে। বাকি জীবনটা যদি একসঙ্গে থাকতে হয় তাহলে আর ওর সঙ্গে আড়াল রাখার কোন মানে হয় না। সে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলল, ‘তখন ওর রাজনীতি আমাদের বিয়ে করার সময় দেয়নি। যখন সময় হল তখন তুই এসে গেছিস। মা হওয়ার পর, তোকে নিয়ে অত কষ্ট করার পর নতুন করে বিয়ে করতে চাইনি আমি।’

‘কেন?’

‘আমি ভেবেছিলাম দু’জন মানুষের মনের বন্ধন বিয়ের চেয়ে বড়।’

‘সেটা কি ভুল?’

‘জানি না।’

‘কিন্তু তোমরা বিবাহিত হলে আমি জানতাম উনি আমার বাবা। এখন তুমি বলছ বলে আমি জানছি। তাই না?’

‘কি বলতে চাইছিস তুই?’ মাধবীলতার গলার স্বরে ধার এল।

‘কাল রাত্রে তোমরা আমাকে বাস্টার্ড বলেছিলে!’

মাধবীলতা চট করে অর্কর হাত ধরল, ‘খোকা!’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘না মা, তার জন্যে আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। মোক্ষবুড়ি দুনিয়াসুদ্ধ লোককে বেজন্মা বলে গালাগাল দিত। তাতে কার কি এসে যায়। তবে কি জানো, এক পুরুষের ভুলের দায় পরের পুরুষের ওপর চেপে বসে। বাস্টার্ড মানে তো বেজন্মা?’

মাধবীলতা দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। ও বুঝতে পারছিল এ ছেলে ভীষণ পাল্টে গিয়েছে। এমন ভঙ্গীতে এত ভারী কথা তার চেনা অর্ক কখনও বলত না। কিন্তু সে প্রাণপণে চাইছিল পরিস্থিতির সামাল দিতে। এখনই যদি অর্ককে না ফেরানো যায় তাহলে পরে আর কিছুই করার থাকবে না। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তুই আমার ছেলে।’

অর্ক দেখল সামনের লোকটা মাধবীলতার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু তারা যে গলায় কথা বলছে তাতে ওর কানে নিশ্চয়ই পৌঁছাচ্ছে না। ট্রেনের চাকার শব্দ অনেকটা আড়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, কিন্তু আমার বাবা-।’

মাধবীলতা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘বেজন্মা মানে যাদের কোন শেকড় নেই, কারো কাছে কোন দায় নেই। কোনরকম ন্যায় নীতি বা মূল্যবোধ ছাড়া মানুষকে বেজন্মা বলে। তারা খুব ভীষণ, তুই কি তাই?’

অর্ক চমকে উঠে মাধবীলতার দিকে তাকাল। যাদের বাবা মায়ের ঠিক নেই তাদের তো কারো কাছে দায় থাকে না। বাপ মায়ের স্নেহ যে পায়নি তার মনে কারো প্রতি টান আসার কথা নয়। শেকড়হীন হয়ে সে বেঁচে থাকে। নীতিবোধ কিংবা মূল্যবোধ তার কাছে ফালতু। মা যে সংজ্ঞা বলল সেই সংজ্ঞার সত্যতা তার কাছে স্পষ্ট হল।

আর তখনই গাদা গাদা মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। খুরকি কিলা, কোয়া বিলু থেকে শুরু করে শ্মশানের সেই মাস্তানটা। কিংবা ন্যাড়া। কারো কোন দায় নেই কারো কাছে। শুধু এরা? নুকু ঘোষ কিংবা বিলাস সোম? তাদের কি দায় আছে সমাজের কাছে? কোন নীতিবোধে তারা বিশ্বাস করে? কিলা খুরকি যেমন নিজের লাভটুকু গোছাবার জন্যে খুর চালায় পেটো ছোঁড়ে ওরাও তেমন নিজের পজিশন রাখার ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়। এমন কি সতীশদা, সতীশদাও যখন প্রতিবাদ করে ধমক খায় তখন মুখ বুজে সহ্য করে। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনের মানুষগুলো আজ সমস্ত কলকাতায় ছড়িয়ে গেছে। এই জলপাইগুড়ি শহরটাও তার ছোঁওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি। নুকু ঘোষ, সতীশদা আর বিলাস সোমরা তাদের ব্যবহার করছে স্বার্থ নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে সেই ছেলেটার মুখ ভাসল যে ট্রামে ঊর্মিমালাকে বেইজ্জত করতে চেয়েছিল। অর্ক মাথা নাড়ল, ‘ঠিক বলেছ মা, ঠিক।’ তার পর মুখ তুলে কামরার লোকগুলোকে দেখল। ওর নিজের বয়সী ছেলেগুলোর চুল, পোশাক, চাহনি যেন সব একরকম। মায়ের সংজ্ঞায় বাস্টার্ডরা যেমন হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *