বাল গঙ্গাধর তিলকের মামলা চালাবার জন্য কলকাতায় যথেষ্ট চাঁদা তোলা হয়েছিল, ব্যারিস্টারও পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু কোনও লাভ হল না। ইংরেজ সরকার কঠোর দৃষ্টান্ত স্থাপনে বদ্ধ পরিকর। নিজস্ব পত্র-পত্রিকায় কিছু স্বাধীন মতামত প্রকাশ করা ছাড়া ইংরেজ-হত্যাকারীদের সঙ্গে তিলকের কোনও যোগসূত্র প্রমাণিত না হলেও তাঁর আঠারো মাসের কারাদণ্ড হয়েছে। তার পরেই ভারতীয়দের মতামত সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাশ হয়ে গেল সিডিশান আইন।
কংগ্রেসের অধিবেশনে ইংরেজ শাসনের পরোক্ষ সমালোচনা ও কিছু কিছু অধিকার আদায়ের জন্য বক্তৃতাবাজি এতদিন শাসকমহল খানিকটা কৌতুকের চোখে দেখত, এই আইন এবার সেইসব বক্তাদের প্রতি খানিকটা চোখ রাঙানি দিল। কিছু কিছু পত্র-পত্রিকায় মাঝে মাঝে যে উগ্র সুর দেখা দিচ্ছিল, তাও নরম হয়ে গেল।
চাপেকর ভ্রাতৃদ্বয়ের পক্ষেও বেশিদিন আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব হল না। প্রত্যেকের মাথার দাম বিশ হাজার টাকা। এ দেশে বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই। দামোদর আর বালকৃষ্ণ একটা কীর্তনের দলে ভিড়ে গিয়ে খোল করতাল বাজিয়ে গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়াত। বেশ কিছুদিন তাদের কেউ সন্দেহ করেনি। একদিন দু’জন চর পুলিশ ডেকে এনে সেখানে ওদের ধরিয়ে দিল হাতেনাতে। খুব সংক্ষিপ্ত বিচারে দুজনেরই ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল।
ওদের ছোট ভাই বাসুদেওকে পুলিশ প্রথম সন্দেহ করেনি। তাকে রোজ হাজিরা দিতে হত থানায়। বাসুদেও’র মাত্র সতেরো বছর বয়েস, হত্যাকাণ্ডের দিন সেও যে সঙ্গে ছিল পুলিশ তা টের পেয়ে গেছে। তবু তাকে আশ্বাস দেওয়া হল, সে রাজসাক্ষী হলে ক্ষমা পেয়ে যাবে।
সহোদর দুই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে বাসুদেও? বরং সে দাদাদের সঙ্গে মিলিত হতে চায়। এক সন্ধেবেলা সে মহাদেও রানাডেকে সঙ্গে নিয়ে চলে এল সেই বিশ্বাসঘাতকদের বাড়ির সামনে। অমাবস্যার রাত, টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছে, চতুর্দিক অন্ধকার, পথে মানুষজন নেই। বিশ্বাসঘাতকরা দুই দ্রাবিড় ভাই, তারা ভয়ে রাত্রিবেলা বাড়ির বাইরে বেরোয় না। ভেতরদিকের ঘরে লণ্ঠন জ্বেলে তারা তাস খেলছিল। বাসুদেও পুলিশের মতন গলা করে তাদের নাম ধরে ডেকে বলল, থানা থেকে আসছি। তোমাদের পুরস্কারের টাকা এনেছি। সেই দুই ভাই আনন্দে লাফাতে লাফাতে বাইরে আসতেই বাসুদেও খুব কাছ থেকে গুলি চালাল তাদের বুকে। প্রত্যেকবার গুলি চালাবার সময় সে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল, নে ইনাম, নে ইমাম!
রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ দেখে ওদের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবার পর সে আর পালাবারও চেষ্টা করল না। বিচারের সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বাসুদেও বলল, হ্যাঁ, দুজন বিশ্বাসঘাতককে মেরেছি, আমাকে দু’বার ফাঁসি দিতে হবে কিন্তু।
চাপেকররা তিন ভাই এবং মহাদেব রানাডের ফাঁসি হবে পর পর। ওদের যেখানে রাখা হয়েছে, সেই ইয়েরাওডা কারাগারেই অন্য একটি সেলে বন্দি আছেন তিলক। সমস্ত ঘটনাই তাঁর কানে এসেছে, কিন্তু ওদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান না।
প্রথম ফাঁসি হল বড় ভাই দামোদরের। ভোরবেলা ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে সে প্রহরীদের অনুরোধ করে একবার প্রণাম করতে গেল তিলককে। তিলক একখণ্ড ভগবদগীতা তুলে দিলেন তার হাতে, দামোদর সেই বই বুকে চেপে ধরল। তার মুখমণ্ডলে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই, তার দৃঢ় বিশ্বাস শীঘ্রই তার পুনর্জন্ম হবে, সে আবার ফিরে আসবে এই দেশের মাটিতে।
তিন চাপেকর ভাই ও মহাদেব রানাডের ফাঁসির সংবাদ শুধু ছাপা হল কাগজে, কিন্তু তাদের সাহস ও বীরত্বের কাহিনী প্রচারিত হতে দেওয়া হল না। ওদের কয়েকজন বন্ধু ও সন্দেহজনক আরও কয়েক ব্যক্তির কারাদণ্ড হল দুই থেকে পাঁচ বছরের বিভিন্ন মেয়াদে। দণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় একজনের নাম বি সিং। সে যে আসলে ভরত সিংহ, তা কলকাতায় তার পরিচিতদের মধ্যেও জানতে পারল না কেউ।
সাহেব-হত্যার এই চাঞ্চল্যকর কাহিনী ও একই পরিবারের তিন নির্ভীক ভ্রাতার ফাঁসির দড়িতে আত্মদানের ঘটনার প্রতিক্রিয়া কলকাতায় হল দু রকম। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা প্রাজ্ঞ, প্রবীণ ব্যক্তিরা কেউই সমর্থন করলেন না, তাঁদের কাছে এটা মূর্খামি বা গোঁয়ারতুমি ছাড়া আর কিছুই নয়। ওদের জন্যই তো সিডিশান বিল পাশ হল, এখন আর ইংরেজদের কোনও কাজের প্রতিবাদও জানানো যাবে না। বাংলার ছোটলাট স্যার আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল বিল এনে যে দেশীয় কাউন্সিলারদের ক্ষমতা কমিয়ে দিলেন, তার বিরুদ্ধে কিছু লেখালেখি করা গেল? এই ম্যাকেঞ্জি যখন তখন বাঙালিদের গাল পাড়েন।
কিন্তু অল্পবয়েসী যুবা ও কলেজের ছাত্রদের মধ্যে বিস্ময়ের ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেল। এই মারাঠা ছেলেগুলি ইংরেজ সরকারকে একটা জোর ধাক্কা দিয়েছে, বাঙালিরা পারবে না? অনেক ইংরেজ এ দেশের মানুষদের কুকুর, বাঁদর, কাপুরুষ বলে, এবার ওদের যোগ্য জবাব দেওয়া হয়েছে। ওরা পিস্তল পেল কোথায়? প্রত্যেকের টিপ নির্ভুল, তবে কি এর আগে কিছুদিন চাঁদমারি অভ্যেস করেছে? এখানে সে সুযোগ পাবার উপায় আছে?
দামোদরের ফাঁসির দিন সরলা সারাদিন উপবাস করে রইল। সারাদিন সে কথাও বলল না কারুর সঙ্গে! এত বড় একটা কাণ্ড ঘটল, অথচ তার একটা প্রতিবাদ সভা হল না কলকাতায়? সে কয়েকজন কংগ্রেসী নেতার সঙ্গে আলোচনাও করেছিল, তাঁরা পাত্তাই দেননি। বিকেলবেলা এসে উপস্থিত হল প্রভাত। এই ছেলেটি ইদানীং গল্পটল্প লিখছে, রবিমামাকে প্রায়ই নানা বিষয়ে চিঠিপত্র লেখে, মাঝেমাঝে রবিমামার কাছে বায়না ধরে, আপনি প্লট দিন, তাই নিয়ে আমি গল্প লিখব।
প্রভাত ‘ভারতী’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক, সরলার কাছে ইদানীং প্রায়ই আসে। নিছক সাহিত্য আলোচনা ছাড়াও সরলার প্রতি তার ঘনিষ্ঠতা অন্যদিকে এগোচ্ছে। সরলা তা টের পায়, সে বিশেষ প্রশ্রয় দেয় না, আবার একেবারে বিমুখও করে না। পুরুষরা যখন স্তুতির বন্যা ছুটিয়ে দেয়, তখন সে তা বেশ উপভোগ করে। তার আগেকার কয়েকজন প্রেমিক ধৈর্য হারিয়ে সরে পড়েছে। দেখা যাক, এই প্রভাত মুখুজ্যে কতদিন টেকে!
মা কিংবা দিদি এখন সময় দিতে পারে না, ‘ভারতী’ পত্রিকা এখন সরলাকেই চালাতে হয়। কিন্তু লেখকদের কাছ থেকে রচনা সংগ্রহের ঝক্কি ঝামেলা সে ঠিক সামলাতে পারছে না। প্রভাতের মতন লেখকরা নিজেদের লেখা দেবার ব্যাপারে খুব উৎসাহী, কিন্তু পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে কিছু দায়িত্ব নিতে বললে এড়িয়ে যায়। সরলা তাই রবিমামাকে সম্পাদক হবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে কিছুদিন ধরে। রবিমামা চাইলে অনেকেই ঠিক সময়ে লেখা দেবে। তার চেয়েও বড় কথা পত্রিকা প্রতি মাসে ঠিক সময়ে বেরুতে পারবে, কিছু লেখা না পাওয়া গেলেও কোনও পাতা খালি থাকবে না, সব্যসাচী লেখক রবীন্দ্র নিজেই দুহাতে গল্প কবিতা-প্রবন্ধ-ধারাবাহিক উপন্যাস লিখে অনেকগুলি পৃষ্ঠা ভরিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু রবিমামা সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে সম্মত হচ্ছেন না। তাঁকে বোঝানো হয়েছে যে ছাপাখানার কাজ, কাগজের দাম, গ্রাহকদের কাছে পত্রিকা পাঠানো ইত্যাদি ব্যাপার নিয়ে তাঁকে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে হবে না, সরলাই সে সব দিক সামলাবে, রবিমামা শুধু সম্পাদকীয় কাজটুকু করে দেবেন। এ পত্রিকার জন্য টাকাপয়সার কোনও সমস্যা নেই, লাভ-লোকসান নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। জানকীনাথ সব খরচ দিয়ে দেন।
একজন দাসী এসে প্রভাতের আগমনবার্তা জানালে সরলা বিশেষ কোনও সাজগোজ করল না। শুধু চুল আঁচড়ে নিয়ে আটপৌরে শাড়ি পরেই নেমে এল বসবার ঘরে। প্রভাত প্যান্ট-কোট পরা, একটি চুরুট ধরিয়ে বসেছিল সোফায়, সরলাকে দেখে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল।
সরলা উদাসীন মুখ করে বসল তার মুখোমুখি একটা সোফায়। বেশ কয়েক মিনিট কোনও কথাই বলল না।
গলা খাঁকারি দিয়ে প্রভাত জিজ্ঞেস করল, মিস ঘোষাল, আপনার কি শরীর খারাপ?
সরলা মুখ তুলে বলল, আপনাকে বলেছি না, আমাকে মিস ঘোষাল বলবেন না। আমার একটা নাম আছে, আমার নিজস্ব একটা পরিচয়ও আছে। ইংরিজি সম্বোধন আমার পছন্দ হয় না।
প্রভাত বিব্রতভাবে বলল, ও হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার ভুল হয়ে যায়। আপনার এত সুন্দর নাম। সরলাদেবী, আপনি শুনলে খুশি হবেন, ‘ভারতী’র জন্য আমি একটা গল্প নিয়ে এসেছি। অন্য একটি পত্রিকার সম্পাদক খুব ঝুলোঝুলি করছিল, কিন্তু আপনার পত্রিকায় ছাড়া অন্য কোথাও আমার লেখা দিতে ইচ্ছে করে না। লেখাটি আপনাকে পড়ে শোনাতে পারি কি?
সরলা এবারেও খুশির ভাব দেখাল না। নিস্পৃহভাবে বলল, আপনি বুঝি শোনেননি, রবিমামা শেষপর্যন্ত সম্পাদক হতে রাজি হয়েছেন। এখন থেকে তাঁর কাছেই গল্প দেবেন, প্রভাতবাবু।
প্রভাত সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, রাজি হয়েছেন? রাজি হয়েছেন? অত্যন্ত সুখের কথা। রবিবাবু সম্পাদক হলে সে কাগজের মর্যাদা অনেক বেড়ে যাবে। রবিবাবুর তুল্য এখন আর কে আছে? তবে, দেবী সরলা, গল্প আমি রবিবাবুর কাছে জমা দিলেও আগে আপনাকে একবার শুনিয়ে যাব। আপনার মতামতের মূল্য আমার কাছে অনেকখানি। আজ যেটা এনেছি, সেটা কি শুরু করব?
প্রভাতের ছোট ছোট গল্পগুলি বেশ আকর্ষণীয়। সরলার ভাগই লাগে। তবে সেগুলি শুধুই গল্প। তাতে দেশাত্মবোধের উদ্দীপনার কোনও ভাব নেই। সরলা আজ গল্প শোনার আগ্রহ বোধ করল না।
সে দেওয়ালের ভারতের মানচিত্রের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, প্রভাতবাবু, আমাদের ভারতমাতার কী হবে?
প্রভাত চমকে উঠে বলল, ভারতমাতা? কেন, তার কী হয়েছে?
সরলা তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল, পূণার চাপেকর ভাইদের যে ইংরেজ সরকার ফাঁসির দড়িতে ঝোলাচ্ছে, আপনি শোনেননি?
প্রভাতকুমার চুপসে গেল! এসব ব্যাপারে তার কোনও আগ্রহ নেই। সদ্য লেখা গল্পটি মনের মধ্যে এখনও টগবগ করছে, সেটি কারুকে না শোনাতে পারলে সে স্বস্তি পাবে না। সে বেশ আশা করে এসেছিল, আজকের এই মেঘ মেদুর সন্ধ্যায় সরলার সঙ্গে নিরিবিলিতে বসে গ্যাসের আলোয় তার গল্পটি পাঠ করবে আর মাঝেমাঝে চোখ তুলে দেখবে সরলার সুন্দর মুখের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু আজ এখানকার আবহাওয়া প্রতিকূল। যা বোঝা যাচ্ছে, এখন আর সরলাকে গল্প শোনাবার সম্ভাবনা নেই।
একজন পরিচারক এসে চায়ের পট ও কেক পেস্ট্রি নিয়ে এলেও প্রভাত শুধু এক কাপ চায়ে দু চুমুক দিয়ে উঠে পড়ল।
কয়েকদিন পরে সরলা তার অনুগত যুবকবৃন্দকে নিয়ে একটা ছোট সভা ডাকল তাদের বাড়ির মাঠের এক কোণে। এর মধ্যে সে বোম্বাই থেকে কিছু পত্র-পত্রিকা আনিয়েছে, চাপেকর ভাইদের সম্পর্কে যতদূর সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেই কাহিনী শুনিয়ে সে এই ছেলেদের মনে প্রেরণা জাগাতে চায়।
প্রথমে দামোদরের আত্মার শান্তি প্রার্থনা করে নীরবতা পালন করা হল দু মিনিট। তারপর সরলা সবিস্তারে সব বলতে শুরু করল।
তার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই একটি যুবক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দিদি, আপনি আমাদের তলোয়ার-লাঠিখেলা শেখবার ব্যবস্থা করেছেন। এ শিখে কী হবে? এ তো যেন শখের ব্যাপার। উৎসব করে আমরা লোকজনদের ডেকে সেই খেলা দেখিয়েই খুশি থাকব? মহারাষ্ট্রের ছেলের হাতে পিস্তল তুলে নিয়েছে। ইংরেজদের সঙ্গে যুঝতে গেলে ওদের সমান সমান অস্ত্র দিয়েই লড়াই করতে হবে। আপনি আমাদের পিস্তল জোগাড় করে দিন।
সরলা একটুক্ষণ নতনেত্রে নীরব হয়ে রইল। তারপর মুখ তুলে বলল, তা হলে তোমরা মনে করছ, লড়াই করার সময় এসে গেছে? এই মনে হওয়াটাই বড় কথা। তোমরা পুরুষ ছেলে, তোমরা এই অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করতে পারো না? আমাকেই সব জোগাড় করতে হবে?
তিলককে সাহায্য করার জন্য রবি অনেকটা দায়িত্ব নিয়েছিলেন, বেশ কয়েক জায়গায় ঘুরে ঘুরে চাঁদা সংগ্রহ করেছেন। তিলক-মামলা তিনি অনুসরণ করেছেন আগাগোড়া। তিলকের তিনি সমর্থক, কিন্তু চাপেকরদের এই খুনোখুনি তিনি একেবারেই পছন্দ করেননি। সন্ত্রাসবাদ তাঁর মতে ভ্রান্ত পথ। দেশের সব মানুষকে আগে দেশ কাকে বলে তা চেনাতে হবে।
তবু চারজন তরুণ, তারা চোর-ডাকাত নয়, দাঙ্গাকারী নয়, সাধারণ খুনে-বদমাশ নয়, সচ্চরিত্র, তারা নিজের জাতির সম্মান রক্ষার্ধে অবলীলায় ফাঁসির দড়ি গলায় দিল, এ কি উপেক্ষা করা যায়? রবির হৃদয় বেদনা ভারাক্রান্ত হয়ে রইল।
এরই মধ্যে আবার রথীর উপনয়নের ব্যবস্থা হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছে তার এই পৌত্রের উপনয়ন হোক বিশুদ্ধ আর্যমতে, শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। অনেক লোকজন সমেত রথীকে আগেই শান্তিনিকেতন পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভারতবর্ষীয় আর্যসমাজের সঙ্গে আদি ব্রাহ্মসমাজের একটা যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বলে, রথীর পৈতে উপলক্ষে কয়েকজন বিশিষ্ট আর্যসমাজীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাঙালি ব্রাহ্মণদের তুলনায় এদের ব্রাহ্মণত্বের গৌরব বেশি।
পৈতে ধারণ বা পরিত্যাগের প্রশ্নটিই ছিল ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। এখন অন্য দুটি ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে উপনয়ন অনুষ্ঠানই হয় না। হিন্দু ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্রাহ্মরা এক নতুন ধর্মের কথা বলেছেন, সেখানে জাতিভেদের কোনও স্থান থাকার কথা নয়। আদি ব্রাহ্মসমাজ এখনও পুরনো অনেক প্রথাই আঁকড়ে ধরে আছে। শুধু মূর্তিপূজা ছাড়া হিন্দুত্বের আচার-আচরণ থেকে তাদের আর বিশেষ প্রভেদ নেই। রবি ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব মনে মনে স্বীকার করেন না। বিসর্জন নাটকে তাঁর স্পষ্ট সহানুভূতি গোবিন্দমাণিক্যের প্রতি, তাঁর মুখ দিয়ে ক্ষমতালোভী, দর্পিত ব্রাহ্মণ রঘুপতি সম্পর্কে বলিয়েছেন :
এ সংসারে বিনয় কোথায়? মহাদেবী,
যারা করে বিচরণ তব পদতলে
তারাও শেখেনি হায় কত ক্ষুদ্র তারা!
হরণ করিয়া লয়ে তোমার মহিমা
আপনার দেহে বহে, এত অহংকার!
তবু পিতার নির্দেশ এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক হিসেবে সে সমাজের নীতি তিনি লঙ্ঘন করতে পারেন না। দেবেন্দ্রনাথ উদার হস্তে টাকা বরাদ্দ করেছেন, মহা ধুমধামের সঙ্গে হল সেই উপনয়ন। কিশোর রথীর মস্তক মুণ্ডন করিয়ে পরিয়ে দেওয়া হল গেরুয়া বসন, দুই কানে সোনার কুণ্ডল। পুরোহিতরা সমস্বরে মন্ত্রপাঠ করতে লাগল, বেদীতে বসে রবি বেদগান গাইলেন। তারপর রথী একটা বেলগাছের ডালের দণ্ড ও ভিক্ষাপাত্র নিয়ে সকলের কাছে গিয়ে মঞ্জু কণ্ঠে বলতে বলল, ভবান ভিক্ষাং দেহি।
যেন প্রাচীন ভারতের এক আশ্রমের দৃশ্য।
নতুন ব্রহ্মচারীটিকে এরপর তিনদিন বাকসংযম করে নিরালা কক্ষে কাটাতে হয়, এইসময় কোনও অব্রাহ্মণের মুখ দর্শনও নিষিদ্ধ। ভিক্ষালব্ধ চাল-ডাল-আলু-বেগুন ফুটিয়ে খাওয়া ছাড়া আর কিছু খেতেও নেই। সারাদিন বেদপাঠ ও গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করে আত্মস্থ হতে হবে।
অন্যান্য অতিথিদের জন্য অবশ্য খাওয়াদাওয়ার অঢেল ব্যবস্থা। এপ্রিল মাসের শান্তিনিকেতনে বেশ গরম, দুপুরের বাতাসে যেন আগুনের হলকা ছোটে, তবু এক একদিন কালবৈশাখি ঝড় ওঠে, দিগন্তবিস্তারী সেই ঝড়ের রূপ কলকাতায় বসে তো দেখা যায় না। প্রকৃতির সেই তাণ্ডবের মধ্যেও ফুটে ওঠে এক মাদক সৌন্দর্য, অন্য সবাই দরজা-জানলা বন্ধ করে সেই সময় ঘরে বসে থাকলেও রবি বেরিয়ে আসেন বাইরে, দিনের বেলাতেও কালো হয়ে আসে আকাশ, মড়মড় করে গাছের ডাল ভেঙে উড়ে যায় শূন্য দিয়ে, রবি তখন প্রকৃতির অঙ্গ হয়ে যান।
এক একটা ঝড়ের পর তাপ কমে যায় বেশ কয়েকদিন, তা ছাড়াও রবি গ্রীষ্মের দাহতে কষ্ট পান না। সব কটি ঋতুই তাঁর ভাল লাগে। তিনি ঠিক করলেন, এখন কিছুদিন শান্তিনিকেতনেই কাটিয়ে যাবেন। অন্তত তাঁর জন্মদিন পর্যন্ত।
কিন্তু তা হল না, কলকাতা থেকে এল দুঃসংবাদ।
কলকাতায় এবার ছড়িয়েছে প্লেগ। মহারাষ্ট্র-গুজরাতে প্লেগের তাণ্ডব চলেছে অনেক দিন। এখানেও খুচরো-খাচরা সংবাদ পাওয়া যাচ্ছিল ইতিমধ্যে। এবারে তা সত্যিই সংক্রামক হয়ে পড়ল। পিতৃদেব আছেন পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে, জোড়াসাঁকোয় কার কী অবস্থা কে জানে, সকলের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন রবি। শান্তিনিকেতনে তাঁর লেখার হাত বেশ খুলেছিল, সব পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরতে হল কলকাতায়। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের রেখে এলেন ওখানে।
হাওড়ার সেতু পার হতে হতে তিনি দেখলেন এক বিচিত্র চলচ্ছবি। দলে দলে মানুষ উদভ্রান্ত, ভয়ার্ত মুখে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। দেখতে দেখতে রবির মনে পড়ল রোমিও-জুলিয়েট নাটকের একটি অংশ। অভিশপ্ত প্রেমিক-প্রেমিকা রোমিও-জুলিয়েটকে সাহায্য করছিলেন যে পাদ্রি লরেন্স, তিনি পলাতক রোমিও’র কাছে জুলিয়েটের সংবাদ দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সে চিঠি রোমিও’র কাছে পৌঁছল না, কারণ ইতিমধ্যে প্লেগ শুরু হয়ে গেছে ইটালির কয়েকটি শহরে, পত্রবাহক যে বাড়িতে ছিল, সেই বাড়িতেই একজন লোক প্লেগাক্রান্ত হওয়ায় সন্ত্রস্ত নগরবাসীরা সে বাড়ির দরজা জানলা সব বাইরে থেকে আটকে দিয়ে কারুকেই বেরুতে দিল না।
Where
the infections Pestilence did reign,
Sealed the door, and
would not let us froth;
সেই মধ্যযুগ থেকে অবস্থা প্রায় বিশেষ কিছুই বদলায়নি। এক একটা ভাড়াটে ছ্যাকরা গাড়িতে আট-দশজন লোক ঝুলছে, পাল্কিগুলো সব ভর্তি। অনেক লোক গাড়ি না পেয়ে হনহন করে ছুটছে নিজেদের মোট মাথায় নিয়ে, ভদ্রঘরের মহিলারা পর্যন্ত ত্রাসে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে।
হাওড়ার দিকে যাচ্ছে অবাঙালিরা, আর শিয়ালদার দিকে প্রাণপণে ছুটছে পূর্ববঙ্গের মানুষ। ছ আনা-আট আনার ভাড়ার গাড়ি এখন দু টাকা-আট টাকা হাঁকছে। শহর জুড়ে বিশৃঙ্খলা। যে সব মানুষের কলকাতা ছেড়ে আর কোথাও আশ্রয় নেই, যাদের কোনও ‘দেশের বাড়ি’ নেই, তাদের ভীত চকিত অবস্থা।
রবির ভয় হতে লাগল। এতটাই অবস্থা খারাপ নাকি? অনেক সময় রোগের চেয়েও আতঙ্ক বেশি ছড়ায়। রোগে যত না মানুষ মরে, তার চেয়ে বেশি মরে ভয়ে কিংবা বিনা চিকিৎসায়।
প্রথমে বাড়িতে না গিয়ে রবি সোজা গেলেন পার্ক স্ট্রিটে, সেখানে পিতাকে সুস্থ দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তারপর বালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে মেজবউঠান ও ইন্দিরার খবর নিলেন, সে বাড়িতে তখন এমন আড্ডা ও গানবাজনা চলছে যেন মনে হয় কেউ প্লেগের কোনও খবরই জানে না। পিয়ানো বাজাচ্ছে ইন্দিরা, তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে দুই ভাই, যোগেশ আর প্রমথ। ইন্দিরা আর প্রমথর মধ্যে বেশ একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, কিন্তু ইদানীং তার দাদা যোগেশেরই যেন ইন্দিরার প্রতি আকর্ষণ বেশি মনে হয়।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিজের সংসারের কেউ নেই, তবু রবি সেখানেই ফিরে গেলেন। জ্ঞানদানন্দিনী থাকতে বলেছিলেন, কিন্তু এই প্রথম রবি সেখানে থাকার জন্য উৎসাহ বোধ করলেন না। যুবকেরা ইন্দিরাকে ঘিরে আছে, এখন রবিকার সঙ্গে বিশেষ কথা বলার ফুরসত পাবে না সে। সেও তো রবিকাকে থেকে যাবার জন্য পেড়াপিড়ি করল না তেমন। রবি বুঝতে পেরেছেন, এবার ইন্দিরাকে দূরে সরে যেতেই হবে। জ্ঞানদানন্দিনী মেয়ের বিয়ের জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
প্লেগ রোগের উপদ্রব অশিক্ষিত, গরিবদের বস্তি এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকে প্রধানত। মধ্যবিত্ত ও ধনীরা ত্রস্তব্যস্ত হয়ে পড়ে আগে থেকেই নানারকম প্রতিষেধকের ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু গরিবরা যে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিও জানে না। মৃত্যু তাদের কাছে নিয়তি। গরিবরা এই রোগে আক্রান্ত হলে ভদ্রলোকরা ও সরকার যে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, তার কারণ গরিবদের প্রতি দরদ নয়। ওই সব বস্তি থেকে রোগের জীবাণু যাতে পাকা বাড়ি ও ইমারতের বাসিন্দাদের মধ্যে না ছড়ায়, সেই চিন্তা।
দামোদর চাপেকরদের পুণায় ফাঁসি হলেও তাদের আত্মা যেন ঘুরে বেড়াতে লাগল কলকাতায়। তার প্রমাণ পাওয়া গেল কয়েকদিন পর।
বাংলার সরকার প্লেগের বিস্তার ঠেকাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বস্তিগুলোতে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করল। রোগ হয়েছে কি হয়নি, যার তিন দিন আগে জ্বর হয়েছিল এমন লোককেও জোর করে টেনে নিয়ে যায় হাসপাতালে। উপার্জনশীল পুরুষদের সরিয়ে নিলে তার পরিবারের সবাই যে অনশনের সম্মুখীন হয়, তা নিয়ে কে মাথা ঘামায়? দরিদ্র ব্যক্তিদের কাছে অনশনের চেয়ে বেশি ভয়াবহ আর কোনও রোগ হতে পারে না। কিন্তু পুলিশ এসে অত্যাচার করলে তারা শুধু কাঁদতে জানে, প্রতিবাদ জানাবার সাহস তাদের নেই। অত্যাচারীর পা জড়িয়ে ধরে তারা দয়া চাইতে গিয়ে পদাঘাত পায়।
একদিন বেলেঘাটায় এক বস্তিতে পুলিশবাহিনী যখন লাঠি দিয়ে ঘর বাড়ি ভাঙছে, সেই সময় সেখানে উপস্থিত হল একদল যুবক। সদ্য গৃহহীন যারা মাটিতে আছড়ে পড়ে কান্নাকাটি করছিল তাদের রূঢ়ভাবে সরিয়ে দিয়ে সেই যুবকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বড় বড় ইটের টুকরো ছুঁড়তে লাগল পুলিশের দিকে।
পুলিশরা হকচকিয়ে গেল প্রথমটায়, কয়েকজনের মাথা ফাটল, কয়েকজন মাটিতে পড়ে গেল। কোথাও এরকম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। ওদিক থেকে ইটবর্ষণ হচ্ছে বৃষ্টিধারার মতন। তারপর পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসতেই যুবকরা অন্তর্হিত হয়ে গেল চোখের নিমেষে। একটু বাদেই তারা ফিরে এল। এবার সঙ্গে বড় বড় পাথরের টুকরোও নিয়ে এসেছে। অতর্কিতে অনেক কাছে এসে পড়ে মারতে লাগল পুলিশদের।
এবারে পুলিশ সার্জেন্টের হুকুমে চালানো হল কয়েক রাউন্ড গুলি। হুটোপাটি-ছোটাছুটির মধ্যে গুলিবর্ষণ ও ইট ছোঁড়ার ফলে আহত হয়ে পড়ে গেল দু’জন যুবক, অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধরাধরি করে নিয়ে গেল আড়ালে। হঠাৎ ফিরে এল এক তরুণ, হাতে তার একটা বড় ঢেলা, ইংরেজ পুলিশ সার্জেন্টটি পিস্তল তোলার আগেই সে ঢেলাটি ছুঁড়ে সার্জেন্টের কপাল ফুটো করে দিল। তার অকুতোভয় মুখ দেখে মনে হল, তার কাছে পিস্তল থাকলে সে গুলি চালাতে দ্বিধা করত না, বোমা থাকলে তাই ছুঁড়ে মারত।
পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ করে সরে পড়ল সেই ছেলেরা, ধরা দিল না কেউ। শুধু তাই নয়, পরে শোনা গেল এই একই দিনে, প্রায় একই সময়ে খিদিরপুরে, বাগবাজারে, মানিকতলায় কোথা থেকে যুবকের দল এসে পুলিশকে আক্রমণ করে গেছে। মানিকতলায় একজন ইংরেজ পুলিশের গায়ে তলোয়ারের কোপ পড়েছে। বউবাজারে, পুলিশ নয়, একদল ইওরোপীয়র সঙ্গে হঠাৎ এসে মারপিট করে গেছে একদল দিশি ছেলে।
এরা কারা? শহরের লোকজন কিছু বুঝতেই পারল না, কংগ্রেসের নেতারাও দিশাহারা। পুলিশের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, কংগ্রেসের এরকম নীতি নেই, বরং কংগ্রেস এর ঘোর বিরোধী। কংগ্রেস ছাড়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কে নেবে? কলকাতা শহরে কোনও সঙ্গবদ্ধ দলও নেই, তবে এরা কোথা থেকে এল? হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে একদল যুবক পথে নেমে পড়েছে?
পরদিন পুলিশবাহিনী প্রতিশোধ নিতে পথে যে-কোনও এক দঙ্গল যুবক দেখলেই লাঠি পেটা করতে লাগল, দাঙ্গা বাধার উপক্রম হল। সৌভাগ্যের বিষয়, তা বেশি দূর গড়াল না। সরকার মহারাষ্ট্রের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না বাংলায়। পুলিশবাহিনী ও স্থানীয় ইওরোপীয়দের সংযত হতে বলা হল, প্লেগ নিরোধের নামে অত্যাচার বন্ধ করে প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে প্রচার করা হতে লাগল। বৃষ্টি শুরু হবার পর প্লেগের প্রকোপও কমে গেল অনেক।
এর মধ্যেই মৃণালিনী পুত্র-কন্যাদের নিয়ে শান্তিনিকেতন থেকে চলে এসেছেন জোড়াসাঁকো। একদিন বেলা এগারোটায় রবি যখন ‘ভারতী’ পত্রিকার জন্য লেখাপত্র সাজাতে বসেছেন, অকস্মাৎ মৃণালিনী সে ঘরে প্রবেশ করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, তুমি আমার একটা কথা শুনবে?
রবি মুখ তুলে তাকালেন। মৃণালিনীর চুল খোলা, আঁচল খসে পড়েছে, দু চক্ষে টলটল করছে কান্না। মুখমণ্ডলে ঝড়ের পূর্বাভাস।
মৃণালিনী বললেন, তোমার অনেক কাজ আমি জানি। সব সময় বাস্ত। তুমি এখানে যাও, সেখানে যাও, পৃথিবীর আর সবার জন্য তোমার সময় আছে, আমি কি তোমার স্ত্রী হয়ে দুটো কথা বলারও সময় পাব না?
স্ত্রীর মেজাজ শান্ত করার চেষ্টায় রবি হেসে বললেন, কেন সময় পাবে না? তোমার জন্য আমি সব কাজ সরিয়ে রাখতে পারি। ওই কুরসিটাতে বসো, তারপর বলল।
বসলেন না মৃণালিনী, রাজ্যের অভিমান ভরা কণ্ঠে বললেন, তোমাদের এ বাড়িতে আমি আর থাকব না। একদিনও থাকব না।
রবি জিজ্ঞেস করলেন, কেন, এ বাড়ি কী করে তোমার অযোগ্য হল? মৃণালিনী বললেন, এ তোমাদের বড় মানুষের বাড়ি। এখানে আমাকে মানায় না। আমি গেঁয়ো মেয়ে। এতদিন হয়ে গেল, তবু অনেকেই এখানে আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলে। আড়ালে আবডালে ফিসফিস করে, আমি শুনতে পাই, আমি নাকি ঘর সাজাতে জানি না, সর্বক্ষণ রান্নাঘরে থাকলেই আমাকে মানা, অর্থাৎ আমি শুধু রাঁধুনি… একমাত্র বলু ছাড়া আর কেউ নিজে থেকে আমায় ডেকে একটাও ভাল কথা বলে না, এখানে আমি কেন থাকব?
রবি ধীরস্বরে বললেন, ভাই ছুটি, তুমি কাঁদছ, তা আমারও বুকে বাজছে। তুমি স্থির হয়ে একটু বসো, সব কথা শুনি। এত বড় পরিবারে নানারকম মানুষ থাকবেই।
মৃণালিনী বললেন, আমি আর কিছু শুনতে চাই না। আর এক দণ্ডও আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। তুমি আজই ব্যবস্থা করো।
রবি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সংসারে এক একটা তীক্ষ্ণ সমস্যার করাঘাত যে অকস্মাৎ কখন কোন দিক দিয়ে আসে তার ঠিক নেই। একটা নতুন গানের সুর তাঁর মাথার মধ্যে গুনগুন করছিল, তা কোথায় মিলিয়ে গেল। জীবন শুধু কাব্য আর সঙ্গীতে মগ্ন থাকতে পারে না। কবিকেও প্রায়ই তুচ্ছ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়।
তিনি একটুও ধৈর্য না হারিয়ে বললেন, তোমরা শান্তিনিকেতন থেকে হন্তদন্ত হয়ে চলে এলে কেন? ওখানে এখন বর্ষা নেমেছে, ভুবনডাঙার সারা আকাশ জুড়ে মেঘ জমে থাকে, খোয়াইতে ছুটে যায় কত শত কলকল ধারা, এই সময় কেয়া ফুল ফোটে, ওখানে তোমাদের মন টিকল না?
মৃণালিনী বললেন, আমি শান্তিনিকেতনে ছেলেমেয়েদের নিয়ে পড়ে থাকব, আর তুমি থাকবে এখানে? বৃষ্টি বাদলা দেখতে দু’একদিনই ভাল লাগে, দিনের পর দিন কারুর ভাল লাগে না। তুমি আমাদের দূরে সরিয়ে রাখতে চাও?
রবি বললেন, তেমন কথা আমি কখনও ভাবি না। তবু আমাকে তো কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করতেই হয়। মাঝে মাঝে যাব তোমাদের কাছে।
মৃণালিনী বললেন, ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে না? শান্তিনিকেতনে ধারে কাছে কোন ইস্কুল আছে? রথী, বেলীরা কত বড় হল, তুমি ওদের কোনও ইস্কুলে দিলে না। রথী শুধু সংস্কৃত আওড়ায়, তাতেই চলবে? ওর বয়েসী ছেলেরা ইংরিজি শেখে। তুমি কত বড় বিদ্বান, কত কিছু জানো, তোমার ইচ্ছে হয় না ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসে তাদের সে সব শেখাতে? ছেলেমেয়েরা বাবার সঙ্গ পায় কতটুকু!
রবি এবারে কিছুটা ব্যাকুলভাবে বললেন, আমি ওদের সঙ্গে থাকতেই তো ভালবাসি। ওদের মুখের হাসি, ওদের প্রত্যেকটি কথা আমার বুক জুড়িয়ে দেয়।
মৃণালিনী বললেন, তুমি ওদের ভালবাস, মাঝে মাঝে ওদের কোলে নিয়ে আদর করো। বাস, ওইটুকুতেই কর্তব্য শেষ! ওদের বুঝি ইচ্ছে করে না, বাবাকে ঘিরে পড়তে বসবে। বাবা ওদের গান শেখাবেন। শোনো, এ বাড়ির পরিবেশে ছেলেমেয়েরাও মানুষ হবে না। তুমি অন্য কোথাও বাড়ি ভাড়া নাও। মেজবউঠান যদি বরাবর পৃথক বাড়িতে থাকতে পারেন…।
রবি একটুক্ষণ নীরব রইলেন। মৃণালিনীর কথার মধ্যে অপমানবোধ ও বেদনা মিশে আছে। এ বাড়ির কেউ নিশ্চয়ই তাঁকে বেশ আঘাত দিয়েছে। কিন্তু এবাড়ি ছেড়ে যাবেন কোথায়? অন্য দুই দাদা প্রায়ই শখ করে দক্ষিণ শহরে বাড়ি ভাড়া করে থেকেছেন। রবির তেমন টাকার জোর নেই। বলেন্দ্রর সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে অনেক টাকা লগ্নি হয়ে গেছে। বাজারে ধার মেটাতে আবার অন্যের কাছ থেকে ধার করতে হয়েছে, তার আবার সুদ আছে। পুরীতে একটা বাড়ি কেনার ইচ্ছে আছে শস্তায় মাত্র তিন হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, সে টাকাও জোগাড় করতে হবে।
হঠাৎ একটা সমাধান তাঁর মনে এল। সপরিবারে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি গিয়ে থাকা যায়। অতি প্রশস্ত, সুন্দর বাসস্থান আছে। শিলাইদহ তাঁর নিজেরও খুব পছন্দ। শান্তিনিকেতনে বাৎসরিক উৎসব ছাড়া অন্য সময় কোনও কাজ থাকে না, শিলাইদহে আস্তানা গেড়ে আশেপাশের জমিদারি পরিদর্শনের কাজও হবে। সেখানে অবসরও অঢেল, সেই সময়ে তিনি ছেলেমেয়েদের পড়াবেন। ইস্কুল-পাঠশালার পড়াশুনোর ওপর তাঁর ভক্তি নেই, ওদের ইংরাজি শেখাবার জন্য সাহেব মাস্টার রাখা যেতে পারে। মাঝে মাঝে দু’চারদিনের জন্য কলকাতায় ঘুরে গেলেই চলবে।
আরও একটা সুবিধে এই যে তাঁর শিলাইদহে অবস্থান জমিদারির কাজ হিসেবেই গণ্য হবে এবং সংসারের খরচাপত্রও পাওয়া যাবে সেরেস্তা থেকে।
রবি উঠে এসে মৃণালিনীর কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুমি আর চিন্তা কোরো না, কটা দিন সময় দাও। তোমাদের আমি খুব ভাল জায়গায় রাখব, আমিও থাকব তোমাদের সঙ্গে।
মৃণালিনী শশব্যস্তভাবে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, এক্ষুনি এখানে কেউ এসে পড়বে। লোকজনদের তো আর আক্কেল নেই!
শিলাইদহে পুরনো কুঠিবাড়িটি নদীগর্ভে চলে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সেটি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলে একটি নতুন বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। স্ত্রী-পুত্রকন্যাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার আগে কিছু কিছু ব্যবস্থা করা দরকার। এরমধ্যে রবিকে একবার ঢাকায় যেতে হল কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে। সেখান থেকে তিনি বেশ নিরাশ হয়েই ফিরলেন। ভূমিকম্প সত্ত্বেও নাটোরের অধিবেশন বেশ জমজমাট হয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় সব কিছুই কেমন যেন নিষ্প্রাণ। এবারে প্রতিনিধির সংখ্যা অনেক কম, স্থানীয় জমিদারও অনেকেই আসেননি। বিশালভাবে অভ্যর্থনার আয়োজন হয়েছিল, তার অনেক কিছুই কাজে লাগেনি, বহু অর্থ নষ্ট হয়েছে। মহারাষ্ট্রের ঘটনা এখানেও ছায়া ফেলেছে। যাঁরা আসব বলেও এলেন না, তাঁরা সব ভয় পেয়ে গেছেন? সরকারের ধর-পাকড় ও দমননীতি দেখেই অনেকের হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেছে।
ঢাকা থেকে শিলাইদহে ফিরে বাড়িটিকে ঝাড়পোঁছ করিয়ে, সব ব্যবস্থাপত্র সেরে রবি মৃণালিনীদের আনবার জন্য রওনা হলেন কলকাতার দিকে। বজরায় নাগর নদী-পথে আত্রাই স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। সন্ধের পর একটু একটু ঝড় উঠল, বজরা বেশ দুলছে, কিন্তু রবি আজ আর ঝড় দেখছেন না,দাঁড়ি-মাঝিদের কথাবার্তাতেও মন নেই। তাঁর মনে পড়ছে অন্য কথা।
ঢাকায় বিশিষ্ট কংগ্রেস প্রতিনিধিদের একটি স্টিমার পার্টিতে আপ্যায়িত করা হয়েছিল, অঢেল খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল, ভাগ্যকুলের রাজাদের বাড়ির একটি ছেলে গানও শোনাচ্ছিল। সেই গানবাজনার মাঝখানেই একটি যুবক উত্তেজিত ভাবে বলতে শুরু করল, কংগ্রেস মানে কি শুধু বক্তিমে, খানা-পিনা আর আড্ডা? এতে দেশের কী কাজ হবে বলতে পারেন? এসব কী হচ্ছে? কেন আমরা আমরা এখানে ফুর্তি করছি। সারা দেশে, গ্লেগ, দুর্ভিক্ষ, সাহেবদের অত্যাচার, তবু আমরা হাত গুটিয়ে থাকব?
হঠাৎ সে রবির দিকে ফিরে বলেছিল, কবি, আপনি কিছু বলুন, আপনি আমাদের পথ দেখান। আপনার ‘ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ’ বলে একটা কবিতা পড়ছি :
যে
তোমারে দূরে রাখি নিত্য ঘৃণা করে,
হে মোর স্বদেশ,
মোরা তারি পিছে ফিরি সম্মানের তরে
পরি তারি বেশ…
সব কটা অধিবেশনের বক্তৃতায় তো সেই ভিক্ষেরই সুর! দেখুন না, এখানেও অনেকে ইংরেজের অনুকরণে সুট-টাই পরে আছে এই গরমেও। ‘যে তোমারে তুচ্ছ করে, সে আমারে মাতঃ, কী দিবে সম্মান?’ দেশ জননী কাঁদছে, এরা কি তা শুনতে পায় না? আপনি বলুন?
যুবকটি এমনই উচ্চকণ্ঠে ক্ষোভ জানাচ্ছিল যে অনেকেই ফিরে তাকিয়েছে তার দিকে। রবি এসব তর্ক-বিতর্কে অংশ নিতে চান না। তাঁর মতামত তিনি শুধু লেখায় প্রকাশ করতে পারেন। তবু ছেলেটির পেড়াপিড়িতে তিনি মৃদুকণ্ঠে বলেছিলেন, দেশবাসীকে সচেতন করাই এখন প্রধান কাজ। বিদেশি প্রভুরা আমাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেবে না, আমাদের আত্মশক্তিতে উঠে দাঁড়াতে হবে, সব অধিকার আদায় করে নিতে হবে।
যুবকটি বলেছিল, আত্মশক্তি মানে কী? দেশের মানুষ এমনি এমনি জাগে না। তাদের আঘাত দিয়ে জাগাতে হয়। এ-দেশের কোটি কোটি মানুষকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সচেতন করতে আরও একটা শতাব্দী কেটে যাবে। ততদিন আমরা সহ্য করব?
রবি বলেছিলেন, অন্য আর কী পথ আছে? আগে দেশকে মা বলে চিনতে হবে, সেই মায়ের ডাক সন্তানদের কানে পৌঁছবেই।
ছেলেটি অস্থির ভাবে বলল, মারাঠা ছেলেরা ইংরেজদের ওপর আঘাত দিয়ে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। আমরা পারি না? ইংরেজ দু’চারজনকে ফাঁসি দিতে পারে, কিন্তু যারা হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়েছে তারা আমাদের কাছে প্রকৃত বীরের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে। এখন এইভাবে দেশের কাজে আত্মদানের জন্য আমাদের তৈরি হওয়া দরকার। শুধু বক্তৃতায় কিছু হবে না।
রবি অসন্মতিতে মাথা নেড়েছিলেন। তখন কয়েকজন কর্মকর্তা ছেলেটির কাছে এসে রূঢ়ভাবে বললেন, গানের মাঝখানে তুমি হট্টগোল করছ কেন? তোমার যা বলার তা কালকের ওপেন মিটিং-এ বলবে।
তাঁরা ঠেলতে ঠেলতে যুবকটিকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। অপমানিত হয়ে প্রতিবাদে সে তখনই একটা চলন্ত নৌকো ডেকে নেমে গেল স্টিমার থেকে। ওইভাবে ছেলেটিকে সরিয়ে দেওয়া রবির পছন্দ হয়নি। তিনি বেদনা বোধ করেছিলেন।
সেই ঘটনা ভাবতে ভাবতে রবির কলমে কবিতা ভর করল। এই ভাবেও ছেলেটিকে উত্তর দেওয়া যায়—
বারেক
তোমার দুয়ারে দাঁড়ায়ে
ফুকারিয়া
ডাকো জননী
প্রান্তরে তব সন্ধ্যা নামিছে
আধারে ঘিরিছে ধরণী।
ডাকো ‘চলে আয়, তোরা কোলে আয়’
ডাকো সকরুণ আপন ভাষায়
সে বাণী হৃদয়ে করুণা জাগায়
বেজে
উঠে শিরা ধমনী,
হেলায় খেলায় যে আছে যেথায়
সচকিয়া
উঠে অমনি…