1 of 2

৪০. সূর্য চলে যাবার পর

সূর্য চলে যাবার পর বাদলের চোখের সামনে একটা সাময়িক শূন্যতা তৈরি হয়। অতি অল্প বয়স থেকেই সূর্য তার হিরো, সূর্যর হাবভাব চালচলন সব কিছুতেই সে মুগ্ধ–অন্ধ ভাবে অনুকরণ করারও চেষ্টা করেছে। সূর্যর অনুপস্থিতিতে সূর্যর কোনও বিকল্প সে খুঁজে পেল না। অথচ বয়ঃসন্ধিকালের অস্থিরতায় সে একজন কারোকে অবলম্বন করতে চায়। সে রকম কোনও শিক্ষক নেই, সে রকম কোনও আত্মীয় নেই। এই শুন্যতার কথা বাদল বুঝতে পারে না–সে এর-ওর কাছে গিয়ে জীবনের একটা প্রতিভাস পাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।

তার মামাবাড়িতে অনেক মানুষ। দীর্ঘজীবীদের বংশ, তার দাদামশাইয়ের মা পর্যন্ত এখনও বেঁচে আছেন, একানব্বই বছর বয়স। এখন অনেক মানুষজন আছে যাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্র খুঁজতে হলে কাগজ কলম নিয়ে বসতে হয়। এক থেকে একানব্বই বছর বয়সি প্রায় চল্লিশ জন মানুষ এবাড়িতে মিলে মিশে আছে। কখনও কখনও বাদলের সেজোমাসির এক বছরের ছেলে দুলালকে বসিয়ে দেওয়া হয় দাদামশাইয়ের মায়ের কোলে। একানব্বই বছরের পুরনো একটি হাত সেই নতুন শিশুকে আদর করে।

বাদলের দাদামশাই বেশ প্রতাপশালী পুরুষ। যদিও চেহারাটি ছোটখাটো–তবু তাকে দেখলেই সবাই সম্ভ্রমে চুপ করে যায়। তিয়াত্তর বছর বয়স, মাথার সব চুল সাদা, কিন্তু শরীরে কোনও রোগ নেই। তাঁর বৈষয়িক বুদ্ধি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, সামান্য অবস্থা থেকে বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন–ওদিকে আবার সংস্কৃত কাব্য ও রস শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান আছে যথেষ্ট। সাহেবদের পছন্দ করেন, মেমসাহেবদের ঘৃণা করেন। তার এক ছেলেকে ডাক্তারি পড়তে বিলেতে পাঠিয়ে ছিলেন, সে মেম বিয়ে করে আর ফেরেনি।

দাদামশাইয়ের স্বভাব অনেকটা প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠীর নেতার মতন। নিজ পরিবার বা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার জন্য তিনি প্রাণপাত করতে প্রস্তুত, নিজের জাত-গোত্রের কেউ বিপদে পড়ে সাহায্য চাইতে এলে তিনি তাদের প্রতি উদার ও দয়ালু, তাঁর অনেকগুলি নাতিনাতনির মধ্যে যে-কোনও একজনের সামান্য সর্দি জ্বর হলেও তিনি উতলা হয়ে পড়েন কিন্তু বাইরের কোনও লোক সম্পর্কে তার কোনও দুর্বলতা নেই। নিজের গোষ্ঠীর বাইরে বাদবাকি মানুষ শুধু শোষণ বা অবহেলা করার জন্য। বাড়িতে ভিখিরি এলে তিনি দারোয়ান দিয়ে তাড়িয়ে দেন কিন্তু তার বাবার বাৎসরিক কাজের দিন একশো জনের পাতা পেড়ে দরিদ্রনারায়ণের সেবা করেন। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য যে-কোনও জাতের লোলাকের প্রতি তার একটা আন্তরিক ঘৃণা আছে, কথাবার্তাতেও সেটা প্রকাশিত হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও আবার শ্রেণিভেদ আছে–তিনি নিজে রাঢ়ী শ্রেণির বলে অপর ব্রাহ্মণরা তার কাছে উপহাসের পাত্র।

অন্ধ সংস্কারের মধ্যেও এমন একটা জোর আছে, যা চোখ ধাঁধায়। নিকৃষ্ট শ্রেণির প্রচারকদেরও যেমন ভক্তের অভাব হয় না। বাদল ক্রমে ক্রমে তার এই দাদামশাইয়ের ভক্ত হয়ে উঠছিল। মনে মনে সে দাদামশাইকে পুজো করতে লাগল। বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও বাদল? আমি দাদামশাইয়ের মতন রাগী তোক হব।

যে বাড়িতে অনেক মানুষ, সে বাড়িতে কিন্তু আসলে অনেকেই কিছুটা নিঃসঙ্গ অনেকেই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে থাকে। বাদলও ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ছিল। বাবার সঙ্গে আজকাল তার প্রায় দেখাই হয় না। চিররঞ্জন শ্বশুরবাড়ির আশ্রয়ে থেকে এরই মধ্যে বিরক্ত হয়ে পড়েছেন এবং একটা কিছু কাজের সন্ধানে ঘোরাঘুরি করছেন ইদানীং। এই গ্রামে কিংবা কাছাকাছি কোনও জায়গায় তাঁর পক্ষে চাকরি করা সম্ভব নয়–অত বড় শ্বশুরের জামাই হয়ে সাধারণ চাকরি করলে তার নিন্দে হয়ে যাবে। তা ছাড়া পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হয়ে গেছে–এখন তাকে যেচে চাকরি দেবেই বা কে? যুদ্ধ কত দিন চলবে তার ঠিক নেই–ততদিন কি তাকে ঘরজামাই হয়ে থাকতে হবে? চিররঞ্জন নিজের দেশের বাড়িঘরের খোঁজ করতে চলে গেলেন।

বাদল তার মাকেও বেশি সময় কাছে পায় না। হিমানী এই বাড়ির কর্মস্রোতের মধ্যে মিশে গেছেন। তার ইচ্ছে, তার মেয়ে সান্ত্বনার বিয়েটা এখানে থাকতে থাকতেই দিয়ে যাবেন। নিজের স্বামীর ওপর ভরসা নেই হিমানীরবাবার আশ্রয়ে থেকে মেয়ের বিয়ে চুকিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া যায়। পনেরো বছর হলেও সান্ত্বনাকে বেশ বড়সড় দেখায়।

মামাতো-মাসতুতো ভাই-বোনের সংখ্যা অনেক হলেও বাদলের সমবয়সি ঠিক কেউ নেই। বড়রা তাকে দূরে সরিয়ে রাখে, ছোটদের দলে গিয়ে সর্দারি করতেও তার ভালো লাগে না। সেই জন্যই সে তার দাদামশাইয়ের ন্যাওটা হয়ে পড়ল।

পূর্ববঙ্গের একটি নিস্তরঙ্গ গ্রাম। যুদ্ধের কোনও ঝাঁপটা এখানে এসে পৌঁছোয় না, বিশাল ভারতবর্ষের সঙ্গে এর যোগাযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। গান্ধী সুভাষ-নেহরু এগুলো নিছক কয়েকটি নাম মাত্র মাঝে মাঝে অবশ্য পাকিস্তান তৈরির দাবির কথা শোনা যাচ্ছে কানাঘুষোয়-বাদলের দাদামশাইয়ের মতন মানুষরা সেসব তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেন। ঠাকুরদালানে বসে হেসে ওঠেন উঁচু গলায়। সাধারণ মানুষ শুধু ভাবে–এবছর ভালো ফসল হবে, কি হবে না। সেই স্বপ্নের সুদিন কি কোনও দিন আসবে–যে-দিন সোনার ফসলে মাঠ ভরে যাবে, শোধ হয়ে যাবে সমস্ত ঋণ, জমিদারবাবুর সামনে হেসে কথা বলা যাবে?

বাদল ভোরবেলা দাদামশাইয়ের ডাকে জপতপ করতে বসে। প্রতিদিন উপনিষদের দুটি করে শ্লোক মুখস্থ করে দাদামশাইয়ের কাছে পরীক্ষা দেয়। তারপর দাদামশাই যখন বার বাড়িতে প্রজাদের সঙ্গে কথা বলতে যান, তখন বাদল ইংরেজি-অঙ্ক নিয়ে বসে। ইস্কুলের দিনের কথা আলাদা, কিন্তু প্রতি ছুটির দিনে সে দুপুরবেলা দাদামশাইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে বসে। এটা একটা দুর্লভ সৌভাগ্য। কারণ, দাদামশাইয়ের খেতে বসা মানে এক মস্ত ঘটনা। সারা বাড়িতে একটা চাঞ্চল্য পড়ে যায়–কেউ আসন পাতে, কেউ জল গড়িয়ে দেয়, কেউ পাখা হাতে নিয়ে দাঁড়ায় এবং ঠাকুর-চাকর নয়, খাবার পরিবেশন করে বাড়ির মেয়েরা–যার কোনও কাজ নেই তাকেও কাজের ভান করতে হয়। কার্পেটের আসনে সিধে হয়ে বসে থাকেন দাদামশাই–কোনও দিন কোনও রকম রান্নার প্রশংসা করেননি, কোনও দিন কোনও পদ দ্বিতীয় বার চাননি–কিন্তু একটা কিছু অপছন্দ হলেই থালা সুদ্ধ ঠেলে দিয়ে উঠে যান। তার মস্ত বড় থালা ঘিরে অন্তত দশটি বাটি সাজানো। ঠিক রাজা মহারাজা নয়–আদিবাসী দলনেতার মতনই তার ভঙ্গি। তিনি গম্ভীর, এ-সবই তার প্রাপ্য ও স্বাভাবিক ঘটনা।

তাঁর আহার গ্রহণের ব্যাপারেও বিশেষত্ব আছে। বড় বড় মাছের টুকরো থেকে তিনি খানিকটা মুখে দিয়েই বাটিটা ফেলে রাখেন। অতি সরু ও সৌরভময় চালের ভাত দেওয়া হলেও তিনি খান মাত্র দু’ চামচ ভাত। তিনি আসলে স্বল্পাহারী, কিন্তু বহু রকম পদ সাজিয়ে তাকে দেওয়াই রেওয়াজ। তাঁর বন্ধু পীতাম্বর এক দিন তাঁর সঙ্গে খেতে বসে এই ব্যাপার দেখে প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি তো কিছুই খাও না হে, তবে গয়নাগাঁটির মতন এত বাটি সাজিয়ে বসো কেন? দাদামশাই তখন উত্তর দেননি, খাওয়ার সময় তিনি কথা বলেন না। পরে তিনি পীতাম্বরকে বলেছিলেন, আমাকে দিতে হয় বলেই বাড়িতে এত পদ রান্না হয় বাড়ির অন্য অন্য লোকরা খেয়ে বাঁচে। আমাকে না দিতে হলে, এরা রান্নার ব্যাপারটা সংক্ষেপে সেরে ফেলত। মেয়েদের যত বেশিক্ষণ পারবে ততক্ষণ রান্নাঘরে রাখবার চেষ্টা করবে–না হলেই তো ওরা ঝগড়াঝাটি নিয়ে মেতে উঠবে।

বাদল দাদামশাইয়ের সঙ্গে খেতে বসে একটি বিশেষ আকর্ষণে। দাদামশাইকে প্রতিদিন দুটি আস্ত গলদা চিংড়িমাছ ভাজা করে দেওয়া হয়। এক একটা মাছ বাদলের এক হাত মাপের সমান। দাদামশাই একটি মাছ থেকে সামান্য একরত্তি মুখে দিয়ে বাকি মাছটা তুলে দেন বাদলের থালায়। অন্য জায়গায় খেতে বসলে এত বড় একটা চিংড়িমাছ বাদলকে একা কক্ষনও দেওয়া হত না। চিংড়ির মাথায় ঘি খেতে যা ভালোবাসে বাদল। লাল রঙের গরম গরম ঘি! বাদল আজকাল লোভী হচ্ছে।

সকালবেলা যেমন প্রজাদের সঙ্গে দরবারে বসেন দাদামশাই, বিকেলে সেই রকম বসেন বাড়ির লোকের সঙ্গে। খুঁটিনাটি ভাবে প্রত্যেকের খবরাখবর নেন। কারওর কিছু আর্জি থাকলে শোনেন, প্রয়োজন বুঝলে টাকাপয়সার বরাদ্দ করেন। তিনি কথা বলেন। আস্তে আস্তে, অথচ তবু যে কেন সবাই তার সামনে এসে ভয়ে কাপে সেটাই বুঝতে পারে না বাদল! ইস, তাকে যদি সবাই এ রকম ভয় করত!

সন্ধ্যার পর দাদামশাই বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। তার পেছনে পেছনে বর্শা হাতে বাড়ির একজন পাইক যায়। এই ব্যবস্থাটাও তার নিজেরই করা। তিনি সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ান, কখনও পাশের গ্রামে চলে যান। প্রতিদিন অন্তত দশ মাইল পথ হাঁটা তার বরাদ্দ। তিনি রাত্রে ছাড়া হাঁটতে ভালোবাসেন না, অন্ধকারে হ্যারিকেন নেন না, হাতে একটি টর্চ থাকে, তাও জ্বালেন কদাচিৎ। ভ্রমণ শেষে এক এক দিন তিনি যান তার বন্ধু পীতাম্বরের বাড়ি, সেখানে গানবাজনা হয়। পীতাম্বর কীর্তন গায়ক–প্রত্যেক সন্ধ্যাবেলাতেই সাঙ্গোপাঙ্গ খোল করতাল নিয়ে বসেন–দাদামশাই কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে আবার নিঃশব্দে উঠে আসেন।

এক এক দিন দাদামশাই চলে যান মাঠ পেরিয়ে নদীর ধারে। উঁচু বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ নদীর দৃশ্য দেখেন–বিশেষত জ্যোৎস্না রাতে। নদীর জলে চকচক করে জ্যোৎস্না–মাঝে মাঝে ঢেউ এসে জিভ বাড়িয়ে বাঁধের মাটি ভেঙে নেয়, ঝুপঝাঁপ শব্দ হয়–আর কোনও শব্দ নেই। আকাশে ইতস্তত তারা, সেই রকমই নদীর অন্ধকারে বহু দূরে দূরে ছড়ানো আলোর বিন্দু। মনে হয় চরাচরময় অদ্ভুত শান্তি।

দাদামশাই অনেকক্ষণ নদীর দিকে চোখ রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই মানুষটি ঘোর সংসারী ও বিষয়ী, অথচ এঁর সৌন্দর্যবোধ আছে। এঁর রক্তের কোনও ঐতিহ্য নেই, অথচ ধরে আছেন একটি ঐতিহ্যময় শাস্ত্র, ইনি ঘোরতর সংস্কারাচ্ছন্ন অথচ দয়ালু–বাদল তাই এঁর কোনও থই পায় না।

একদিন দাদামশাই নিজেই বাদলকে তার ভ্রমণের সঙ্গী করে নিতে চাইলেন। এ রকম আর কখনও ঘটেনি। সন্ধ্যাবেলার একাকীত্ব তার বহু দিনের অভ্যাস–সঙ্গে যে পাইক যায়, সে ছায়ামাত্র! কিন্তু বাদলকে যে সঙ্গে নিলেন–তার একটা কারণ আছে। দাদামশাই বাড়িতে কারওর সঙ্গেই বিশেষ কথা বলেন না। রাশভারী হয়ে থাকতে থাকতে সেটাই তাঁর মুখোশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দাদামশাই এখন যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়েছেন–প্রত্যেক বৃদ্ধেরই অনেক কিছু কথা বলার জন্য বুকের মধ্যে একটা আকুলিবিকুলি থাকে। অন্যের কাছে হঠাৎ স্বভাব বদলানো যায় না যদিও, তবে একটি বালকের কাছে মুখ খুলতে বাধা নেই।

প্রথম প্রথম ভ্রমণপথে দাদামশাই বাদলকে নানা রকম নীতিশিক্ষা দিতেন। আদর্শ ব্রাহ্মণ সন্তানের জীবন কী রকম হওয়া উচিত সে বিষয়ে তার নির্দিষ্ট ছক আছে। আকাশের প্রতিটি তারা এবং মাটির প্রতিটি মানুষকে চিনতে হবে। পশু-পক্ষীর স্বভাবও বুঝতে হবে–সেখানেও শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু। ভগবান বিষ্ণু যে মৎস, কূর্ম, বরাহ, নৃসিহং প্রভৃতি পশুর আকৃতিতেও অবতীর্ণ হয়েছিলেন, এসবের তাৎপর্য কী? বেদ অতল জলে তলিয়ে গিয়েছিল, মৎস্যরূপী বিষ্ণু তাকে উদ্ধার করেন। তেমনই যে-সাধনার গভীর অতলে থাকে বিশুদ্ধ জ্ঞান–

বাদল জিজ্ঞেস করল, দাদামশাই, বিশুদ্ধ জ্ঞান কী?

দাদামশাই গভীর স্নেহে তাকালেন তার নাতির দিকে। বালকের রিনরিনে কণ্ঠস্বরে বিশুদ্ধ জ্ঞান শব্দ দুটিই কত সুন্দর শোনায়। মনে হয় যেন তৈত্তিরীয় উপনিষদের বরুণ ও ভৃগুর প্রশ্নোত্তরের মতন নতুন এক অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। দাদামশাই তার ঠান্ডা হাতখানা বাদলের কাঁধে রাখলেন। এতদিন তার মনে মনে একটু দুঃখ ছিল যে তাঁর মেয়ে হিমানীকে তিনি ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারেননি। জামাইটি একটি অপদার্থ। কিন্তু এই নাতিটি মানুষ হলে বংশের মুখরক্ষা করবে।

বাদলকে নিয়ে এসে তিনি দাঁড়ান নদীর পাড়ে। বাদল দৌড়ে জলের কাছে নেমে যেতে চায়–তিনি তাকে নিবৃত্ত করেন না। তার নিজেরও ইচ্ছে করে শৈশবে ফিরে যেতে, কিন্তু ঢালু পাড় দিয়ে নামার সাধ্য তার নেই। আধ মাইলটাক দূরে নদীর পারেই চিতা–এখান থেকে দেখা যায় চিতার আগুন। যেন অন্ধকারকেই দহন করছে সেই আগুনের শিখা।

একদিন দাদামশাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে বাদলের একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। ঘটনাটা ঘটার সময় বাদল শুধু অবাক হয়েছিল, কিন্তু বেশ কয়েক বছর বাদে সে বুঝতে পেরেছিল, তার দাদামশাই আসলে একজন মনোরোগী। ওই ব্যক্তিত্ব ও গাম্ভীর্য, ওই রকম কঠোর সংসারীপনা ও দয়া, কুসংস্কার ও শাস্ত্রজ্ঞানের অহংকার–এর আড়ালে লুকিয়ে আছে একজন অসুস্থ মানুষ। পরবর্তী জীবনে বাদল দেখেছে বাইরে থেকে : যাকে যা মনে হয়, তার আড়ালেও আর একজন মানুষ থাকে। সকলেরই থাকে। একা একজন মানুষ কেউ নয়, প্রত্যেকেই দু’জন বা বহুজন মানুষ। সেই আড়ালের মানুষটিকে সহজে দেখা যায় না। এটা কোনও কবিত্বের কথা নয়। খুব যুক্তিবাদী মানুষের মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ একটা যুক্তিহীন স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে। তখন চমকে উঠতে হয়। এই যুক্তিহীনতারও একটা সীমা আছে–প্রত্যেক মানুষের আলাদা–সেই সীমা অতিক্রম না-করা পর্যন্ত সংসারে টিকে থাকার কোনও অসুবিধে নেই। কারও কারওর ভেতরের এই চমকপ্রদ সত্তাটি শুধু বিশেষ একজনের চোখেই ধরা পড়ে। বাদল প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সেই আলাদা মানুষকে খুঁজে বার করার নেশায় মেতে উঠেছিল একসময়। উত্তরকালে যখন সে একটি নারীকে বলেছিল, আমি তোমাকে চাই–একটি ফঁকা ঘরের দেওয়ালে হেলান-দেওয়া নারীকে সে বলেছিল চোখের দিকে চেয়ে–তখন সে এই কথা বলতে পেরেছিল, কারণ সে সেই নারীর ভেতরের আলাদা স্বরূপটিকে চিনতে পেরেছে।

কলকাতা ছেড়ে এসে এই নিভৃত গ্রামে বাদলের অনেক রকম শিক্ষার সুযোগ আসে। সে নানা রকম স্তর পেরিয়ে পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পান্নালাল নামের বকাটে ছেলে কিংবা তার গুরুগম্ভীর দাদামশাইদু’জনে দু’রকম ভাবে বাদলের শিক্ষাকার্যেই সাহায্য করেছে।

সে-দিন নদীর পারে দাঁড়িয়ে দাদামশাই বাদলকে আকাশের তারা চেনাচ্ছিলেন। কালপুরুষ, সপ্তর্ষি, সন্ধ্যাতারা ইত্যাদি বাদল আগে থেকেই চেনে–কিন্তু দাদামশাই তাকে দেখাচ্ছিলেন রোহিণী, অরুন্ধতি প্রভৃতি।

ঘাটে এসে কয়েকটা নৌকো ভিড়েছে। ইলিশ মাছের ডিঙি। রুপোলি মাছগুলোর শরীর চকচক করছে কুপির আলোয়। কোনও প্রয়োজন নেই, তবু বাদল বলল, দাদামশাই, মাছ কিনবে? কী টাটকা মাছ!

দাদামশাই নিজে কোনও দিন কোনও কিছু কেনাকাটা করেন না। এইসব লোকের সঙ্গে কথা বলাই তার ধাতে নেই। তবু নাতির আবদার ফেলতে পারলেন না আজ। খানিকটা প্রশ্রয়ের সুরেই বললেন, কেন, মাছ কী হবে?

বাড়ি গিয়ে ভাজা খাব টাটকা টাটকা!

দাদামশাই গলা চড়িয়ে জেলেদের উদ্দেশে বললেন, এই, দে তো রে বড় দেখে এক জোড়া মাছ।

জেলেরা দাদামশাইকে চিনতে পারেনি। জালে আজ খুব বড় বড় মাছ পড়েছে, সেই জয়ের আনন্দ, গায়ে এখনও পরিশ্রমের ঘাম শুকোয়নি, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাতেই মত্ত। প্রথম বার তারা কথা শুনলই না। দ্বিতীয় বার বলার পর একজন তরল গলায় বলল, নেন কত্তা, টাকা টাকা জোড়া!

দাদামশাই কঠোর ভাবে বললেন, কত?

টাকা টাকা জোড়ার কম হবে না আইজ!

দামের জন্য নয়, কণ্ঠস্বরের এ তারল্যেই দাদামশাই রেগে আগুন হয়ে গেলেন। নক্ষত্র-বিলাস ছেড়ে হয়ে উঠলেন সামন্ততান্ত্রিক। সে-দিন পাহারাদার পাইক হিসেবে। এসেছিল কেষ্ট ঢালী। দাদামশাই কেষ্টকে বললেন, এক জোড়া মাছ নিয়ে আয়। বলিস, কাল সকালে যেন আমার কাছে দাম আনতে যায়।

কেষ্ট দাদামশাইয়ের ইঙ্গিত বুঝে তরতর করে নেমে গিয়ে সোজা সেই উত্তরদাতা জেলেটির গালে সপাটে এক চড় কষায়।

মাছ হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে কেষ্ট পেছন পেছন আসছে, সামনে দাদামশাই আর বাদল পাশাপাশি। কেউ কোনও কথা বলছে না। তার আবদারের জন্যই জেলেটি মার খেল– এ জন্য বাদলের মনে কোনও রকম গ্লানি নেই তার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ঠিকই। মানানসই। তার চেনা ছোট পৃথিবীতে দাদামশাইয়ের মুখের ওপর কথা বলার অধিকার কারওর নেই। সে শুধু এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করছিল।

হঠাৎ দাদামশাই থমকে দাঁড়ালেন। বাদলের হাত চেপে ধরলেন শক্ত করে। একটু চেঁচিয়ে বললেন, যা যা, সরে যা! আবার এসেছিস?

বাদল সামনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। দু ধারে জমির মাঝখান দিয়ে আলপথ ধরে এতক্ষণ তারা হেঁটে আসছিল। এই পথে এলে রাস্তা সংক্ষেপ হয়। এবার জমি ছেড়ে তাদের উঠতে হবে একটা বাগানে, ডান ধারে একটা ছোট পুকুর, তার পাশে বাঁশঝাড়। বেশ জ্যোৎস্না রয়েছে, দেখা যায় সবকিছুই।

দাদামশাই হাতের ছড়িটা তুলে ধমকের সুরে বললেন, যা যা, পথ ছাড়!

বাদল জিজ্ঞেস করল, কে দাদামশাই?

বিটি মাছের লোভে এসেছে। তুই চোখ বুজে থাক তো দাদুভাই।

আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

চোখ বুজে থাক। এই পেতনিটা একের নম্বরের শয়তানি।

কেষ্ট একটু পিছিয়ে পড়েছিল, সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিছু কন নাকি বড়কত্তা?

দাদামশাই লাঠি তুলে এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, বিটি, তোর এত সাহস! আমি এখানে রয়েছি–

কেষ্ট হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বাদলের হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, কানা ওলা। বড়কত্তারে কানা ওলায় ধরেছে।

কানা ওলা কী?

পেতনিটা মাছ খাইতে আসে। এখন ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া মারবে আমাগো।

আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

চোখ বুইজা থাকো!

কেষ্ট অতিশয় বলশালী পুরুষ। তার শরীর ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে বাদল আর ভয় পায় না। কেষ্ট কিন্তু ভয় পেয়েছে, সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কত্তা পিছনে চলেন, পিছনে চলেন।

বাদল বিস্ফারিত চোখে দেখল তার দাদামশাই টর্চ জ্বেলে বাঁশ ঝাড়ের ওপর লাঠির ঘা মেরে বললেন, হারামজাদি, মাছ খাওয়ার নোলা! আমার সামনে আসিস, তোর এত সাহস!

বাদল উত্তেজনায় কাঁপছে! সে দেখতে চায়। সে আজ নিজের চোখে পেতনি দেখবে। সে জানে তার দাদামশাইয়ের কাছে ভূত-পেতনি সব হেরে যায়। এ-সম্পর্কে। সে অসংখ্য গল্প শুনেছে! অন্ধকার রাত্রে ঘুরে বেড়ানোর জন্য দাদামশাই বহু বার ভূত-পেতনির সামনে পড়েছেন। কোনও দিন তিনি একটুও বিচলিত হননি, লাঠি উঁচিয়ে ধরেছেন। দাদামশাইয়ের দিকে প্রেতযযানিরা যেন বেশি রকম আকৃষ্ট হয়–গাঁয়ের অন্য মানুষের তুলনায় তারা দাদামশাইয়ের সামনেই আসে বার বার। সাধারণ ভূত-পেতনি তো আছেই–জলাভূমির ধারে দাদামশাই আলেয়ার পাল্লায় পড়েছেন–চৌধুরীচকে একদিন একটা বেলগাছের ডাল নিচু হয়ে নেমে এসেছিল দাদামশাইয়ের সামনে–সেই গাছে ব্ৰহ্মদৈত্যের বাস–কোনও বার দাদামশাইয়ের গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি।

এই মাছখেকো পেতনিটাও নাকি দাদামশাইকে অনেক বার বিরক্ত করেছে। বাদল আজ তাকে দেখবে।

কিন্তু দাদামশাই দেখলেন, কেষ্ট ঢালী দেখল, বাদল দেখতে পেল না। সে শুধু দেখল, টর্চের আলো ফেলে দাদামশাই একটা বাঁশের ঝোঁপ পেটাচ্ছেন–সেখানে আর কিছু নেই। দাদামশাই প্রচণ্ড ঝকে গালাগালি দিচ্ছেন, কেষ্টও একসময় বর্শা নিয়ে তেড়ে গেল সেই শূন্যতার দিকে।

তারপর বেশ কিছু দিন ধরে চলেছিল এই গল্প। সবাই বিশ্বাস করেছে। কিছু দেখতে পায়নি বলে মনে মনে নিরাশ হয়েছিল বাদল–কিন্তু সকলকে বলেছে যে সে-ও দেখেছে। এরপর অনেক বছর ধরে বাদল এই ঘটনার কথা ভেবেছে। শেষে একদিন উপলব্ধি হয়েছে যে ওখানে সত্যিই কিছু ছিল না। তার দাদামশাই পাগল ছাড়া কিছু নয়। প্রজাদের ওপর অত্যাচার করেন, বাড়ির লোকদের পদানত করে রেখে তিনি চোখের সামনে ভূত দেখেন। অলৌকিক জগতকেও শাসন করার মানসে তিনি বাঁশ ঝাড়ের ওপর লাঠিপেটা করেন শুধু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *