৪০
ভিনোদের বাংলো থেকে বেরিয়েই অজাইব সিং বলল, কাঁহা সাহাব?
কাঁহা?
এই প্রশ্নটা পৃথুকে চিরদিনই বিব্রত করে। যাওয়ার জায়গা তো তার কোথাওই নেই।
ক্লাবে যাবে?
ছুটির দিন। তার উপরে সামনেই ক্লাবের ইলেকশান। একদল ওয়েল-অফফ মানুষ রঙচঙে জামা পরে কী দারুণ মনোযোগের সঙ্গে কী দারুনতম অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি ছোট ছোট চড়াই-সুখের আলোচনায় এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত সেখানে।
ফিস-ফিস, ফুস-ফুস।
মিঃ সেনের বাড়ি যাবে কি? তাসের আড্ডা বসেছে সেখানে এখন জোর।
নাঃ।
মিঃ গাঙ্গুলী?
মোসাহেবরা ভিড় করে আছে আর উনি কিং ক্যানিউটের মতো লনের গোলাপবাগানের সামনে চেয়ারে বসে সামনের টেবলে দুটি গোদা-গোদা পা তুলে দিয়ে রাজা-উজির মারছেন। ব্যাংককে তাঁর মোষসদৃশ দাদ-ঘষঘষ নিম্নাঙ্গ এবং থলথলে থাই; থাই-মেয়েদের দিয়ে কেমন মালিশ করিয়ে এলেন তারই রসালো গল্প অথবা হংকংয়ে কেমন গ্রান্ড সেরিমনির সঙ্গে চিঁচিঁ-বাঁদরের ঘিলু খেলেন নীট ভি, এস, ও, পি ব্রান্ডি সহযোগে, সবচেয়ে দামি রেস্তোরাঁতে, তার গল্প। এই মানুষগুলোর প্রতি অনুকম্পা ছাড়া অন্য কিছু নেই পৃথুর। ক্রোধ হয় চামচেগুলোর উপর। এই মোসাহেবরাই কালচার্ড এবং আনকালচার্ড বাঙালিদেরও ঘুণপোকার মতোই কুরে খেয়ে যাচ্ছে অনুক্ষণ।
অজাইব সিং আবার শুধোল পথের মোড়ে এসে; কাঁহা সাহাব?
ঠিক সেই সময়েই পৃথুর বুকের মধ্যে কে যেন আমূল ছুরি বসিয়ে দিল একটা। আত্মবিস্মৃত; অকৃতজ্ঞ পৃথুর।
কুর্চি।
তার কুর্চি যে হারিয়ে গেছে!
কুর্চি-ই-ই-ই…ই…ই…
ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল পৃথুর। কুর্চির চিঠিটি পাবার পর থেকে তাকে খুঁজে বের করার কোনওই চেষ্টা করেনি সে। কান্নাটাকে গিলে ফেলল। প্রায় অসম্ভব হলেও গিলল। ভদ্রলোক, শিক্ষিত লোক কাঁদে না, ড্রাইভারের সামনে তো নয়ই। মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ তাকে তার মূল স্বাভাবিকতা এবং মূল বাসভূমি প্রকৃতি থেকে বহু দূরেই নিয়ে এসেছে। ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে। ‘শো অফ ইমোশান’ প্রাকৃতজনেরই লক্ষণ।
ছিঃ।
রায়না চলো।
পৃথু বলল।
ভাঁটু বাবুকো ঘর?
একটু অবাকই হল পৃথু।
অজাইব সিং লোকটা একটু বেশি বুদ্ধিমান। মালিকের চেয়ে তার কর্মচারি বেশি বুদ্ধি ধরলে, মালিককে খুবই সাবধানে থাকতে হয় এমবারাসমেন্টের হাত থেকে বাঁচতে এবং এই সাবধানতার কারণে একটা বাড়তি টেনসনেরও সৃষ্টি হয়।
বলল, হাঁ।
মগর উনোনে তো হ্যাঁয় নেহী রায়নামে।
গ্যয়া কঁহা?
যেন, জানে না; এমন ভাব করল পৃথু।
জেল হো গ্যয়া না উনকো। মান্দলামে হ্যায়। মরদনা ফটকমে। উনকা বিবি…
বলেই, চুপ করে গেল চালাক অজাইব সিং। ওর বুকের মধ্যে ওর প্রিয় গানটা নীরবে বেজে উঠল : “হায়! ঝুমকা গীড়ারে। ব্যারিলিকা বাজার মে ঝুমকা গীড়ারে। হাম দোনোকা ঘাবড়ার মে, ঝুমকা গীড়ারে। ঝুমকা, ঝুমকা, ঝুমকা গীড়ারে…
পৃথু বলল, কুর্চি মেমসাব? উনোনে কাঁহা হ্যায়? পাত্তা হ্যায়?
মুঝে মালুম নেহি হ্যায়। মগর শুনে যে, যো রায়না ছোড়কর চলী গ্যয়ী।
মালুম কৈসে হুয়া? ঔর গ্যয়ী কাঁহা?
অজাইব সিং গাড়ি ঘুরিয়ে মান্দলার দিকের পথে চলল। স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে সোজা পথের দিকে চেয়ে বলল, আমার এক পিসতুতো শালাও ওই চোরাচালানের দলে ছিল। তার হয়েছে দশ বছর।
একটু চুপ করে থেকে অজাইব সিং বলল, ভাঁটুবাবু কিন্তু মানুষ সুবিধের নয়। আগে যে চাকরি করতেন সেখান থেকেও চুরির দায়ে চাকরি গেছিল। সকলেই জানে। কুর্চি মেমসাব য্যায়সী আওরাতকি জিন্দগীই বরবাদ হো চুকি।
হুঁ!
লজ্জিত গলায় বলল পৃথু। আর কীই বা বলতে পারে? ভাঁটু যে মানুষ গোলমেলে, গুলবাজ, এবং ধূর্তচূড়ামণি তা বুঝত ও। কিন্তু প্রেমিকার স্বামী অথবা কুকুরের আবার ভালমন্দ কী? তাদের অ্যাকসেপ্ট করে নিতেই হয়।
কুর্চি মেমসাহেব আছেন কোথায়? কোন জায়গায়? কার বাড়িতে?
ম্যায় ক্যায়সে কঁহু সাহাব? মগর আপ হুকম করনেসে পাত্তা লগানে শকতা।
কৈসে? অজাইব সিং?
যাঁহা যাঁহা ঢুঁড়না পড়েগা সবহি জাগেমে যাউঙ্গা। ছোড়েগা থোড়ি!
শেকোগে অজাইব সিং?
পৃথুর গলাটা যেন ভয়ার্ত শোনাল নিজেরই কানে।
অজাইব সিং অবাক চোখে তাকাল তার সাহাবের চোখে। এমন কাকুতিভরা, দ্বিধাগ্রস্ত গলায় তার সাহেব কখনও কথা বলেনি। আর এমন অসহায়ের চোখে কখনও তাকায়ওনি তার জবরদস্ত কিন্তু ভোলেভালা সাহাব তার চোখে কোনওদিন।
ঘুরে বসে, গোঁফে হাত ছুঁইয়ে অজাইব সিং বলল, জরুর শেকেগা। হুজৌর কা মেহেরবানিসে। মগর এক আর্জি হ্যায় হুজৌর।
ক্যা?
চারগো টি এ বিল পড়া হুয়া হ্যায় বহত দিনোঁসে। উও খিটমিটিয়া অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাবনে পাস করতাহি নেহী। হামসে ভী কমিশন মাঙ্গ রহে হেঁ। ম্যায় বোলিন, ডাণ্ডা দেগা, কমিশন-উমিশন হামসে নেহী মিলনা। হাম ঘোষ সাহিবকা ডেরাইবার বা!
কৌন বাবু?
পাণ্ডে বাবু হুজৌর। ঔর কোন? ইতনা পইসা পিট লিয়া কা কঁহু! কোই ভী পেমেন্ট দেহাতি নেহী বেগর পইসা। মোঁগাও মে তো মোকান ভী বানা লিহিস। ই কোম্পানি হুজৌর সব চোর ঔর ডাক্কুসে ভর চুকে হ্যায়। নতিজা ভারী খরাব নিকলেগা।
পৃথু মনে মনে বলল, সমস্ত দেশেরই এখন এই অবস্থা। হাটচান্দ্রা শেল্যাক কোম্পানি ব্যতিক্রম হবে কি রে?
ওসব কথার উত্তর না দিয়ে ওকে একটি কুড়ি টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমারা খানেপীনেকা লিয়ে রাখখো। আর আমাকে ভুচুর গ্যারাজেই নামিয়ে দিয়ে যাও। তারপর রায়না থেকে খোঁজ আরম্ভ কর। মান্দলা, টিকেরিয়া, বালাঘাট—যেখানে যেতে চাও যাও কিন্তু আমার খোঁজটা এনে দেবে। যদি দেখা পাও, তাহলে কুর্চিদিদির কাছ থেকে দু’লাইনের চিঠিও আনবে একটা। বলবে, খুবই চিন্তায় আছি আমরা সকলেই! আর কী উপকার করা যেতে পারে, যে-কোনও উপকার; সে সম্বন্ধেও ভাল করে খোঁজ নিয়ে এসো। তুমহারা দিমাগমে অকল হ্যায় অজাইব সিং। ইয়ে কাম হামারা ঠিকঠাক করকেই আনা। সমঝা?
জী হুজৌর। সমঝা। ম্যায় আপকি কাম করকে তবহি লওটুঙ্গা। ম্যায় নেহী লউটুঙ্গা তো মেরী ডেড বডি লওটেগা পাত্তা লে কর।
এই হিন্দি সিনেমাগুলোই খেলো সবাইকে। কথায় কথায় ডায়ালগ ঝাড়ে প্রত্যেকেই। ভাবল, পৃথু।
বিরক্ত গলায় বলল, ফজুল বাতেঁ বন্ধ করো। আভভি জলদি চলো গারাজ।
পৃথু ভাবছিল, কাল সকালে অফিসে গিয়েই পাণ্ডেকে বলে অজাইব সিংয়ের টি এ বিলগুলো পাশ করে দিতে বলবে। আজকাল সংসারে একটি ছোট্ট উপকার চাইলেও কারও কাছে, সে যতটুকু পারে বদলে নিয়ে নেয়। চেয়েই হোক, কি কেড়েই হোক। অজাইব সিংও ব্যতিক্রম নয়।
দূর থেকে ভুচুর গ্যারাজের সামনে একটু জটলামত জমেছে মনে হল। অনেক সময়ই হয়। কোনও কাস্টমার বিল পেমেন্ট করা নিয়ে ঝামেলা করে, কখনও মেকানিক আর মিস্ত্রিরা গোল হয়ে আড্ডা মারে। কখনও মারামারিও হয় নিজেদের মধ্যে। আপসে মেটে, কখনও-বা মাথাও ফাটে। যাইই হোক, অজাইব সিংকে আটকে না রেখে, ছেড়ে দিল পৃথু।
পৃথুকে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসতে দেখেই হুদা এগিয়ে এল। বলল, মালুম হোতা খতরা বন গ্যয়ে দাদা।
খতরা? কওন চিজকা? ভুচু কোথায়?
বেরিয়েছে। আসবে এক্ষুণি।
একটা বারো তেরো বছরের গাব্দাগোব্দা ছেলে ঘন সবুজ রঙা চেক-চেক লুঙ্গি আর লালরঙা গরম কাপড়ের একটা পাঞ্জাবি পরে দুহাতে দুচোখ ঢেকে কাঁদছিল।
কে এ?
মৌলভী গিয়াসুদ্দিনের ছেলে।
ছেলেটির নধরকান্তি চেহারার দিকে তাকিয়ে পৃথুর মনে হল, স্বাভাবিক! রোজই তেলওয়ালা মোরগা খেলে চেহারা এরকমই হওয়ার কথা।
হয়েছে কী?
কাল শেষ বিকেলে মৌলভী মোরগা মারতে গেছিল নই নদীয়ার জঙ্গলে। কিন্তু এখনও ফিরে আসেনি।
রাতেই খবর দিল না কেন?
ওরা ভেবেছিল, নইনদীয়ার দিকে নাজিমুদ্দিনের ভাণ্ডার। সেখানে ছোট একটি মাদ্রাসাও আছে। হয়তো, রাতটা সেখানেই কাটিয়ে আসছে। নাজিমুদ্দিন হজ করতে গেছিল। ভেবেছিল হজ-এর গল্প শুনছে হয়তো রাতভর হাজির কাছে। বেলা হয়ে যাবার পরই ওদের ভয় ঢুকেছে। কী যে হল, কে জানে?
পুলিশে কি খবর দিয়েছে?
না। দেয়নি এখনও।
হুদাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল পৃথু। বলল, ভুচু, গেছেটা কোথায়?
জেনারেটরের ব্যাটারীটা চার্জে গেছে। তারই জন্যে বাজারে গেছে। এসে গেল বলে। আমরা রোজই যাচ্ছি, কিন্তু সুরতহারাম গিদাই আমাদের পাত্তাই দিচ্ছে না। এদিকে জেনারেটরের জন্যে বড়া তকলিফ। তাই দাদা নিজেই গেছে সাইকেলে।
এখন পুলিশে খবর দিও না। ভুচু এলে, ভুচুকে বোলো যেন ও-ও চলে আসে। জীপটা বার করে দাও তো আমাকে। তেল আছে তো? আমি এগোচ্ছি।
ভুচুকে বোলো নইনদীয়ার দিকে যেতে, বলেই, চলে গেল ধুলো উড়িয়ে।
কাছারির পাশ দিয়ে যে বাইপাসটা আছে, তা দিয়ে টিকিয়া উড়ান চালিয়ে যাচ্ছিল ভুচু। এমন সময় দেখে ক্লাবের রাস্তার মোড়ে হান্নানের দোকানের সামনেই গাছের গায়ে সাইকেলে ঠেস দিয়ে রেখে কাবাব আর রোটি খাচ্ছে ভুচু।
জীপটাকে দেখেই ও তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে উঠল। কিন্তু দোকানের দিকে আর গেল না পৃথু। এখন ওখানে সকালের খাওয়ার জন্যে খুব ভিড় থাকে। নানারকম লোক।
স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে গাছতলায় রাখল জীপটাকে। ভুচু সাইকেল সম্বন্ধে হান্নানকে কী যেন বলে দৌড়ে এল, রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে। কাছে এসে বলল, ব্যাপার কী? সাত সকালে?
বলছি। সাইকেলটা এখানে রেখো না। লোকে আমাকে দেখেছে। আমি এগোচ্ছি। শামীমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পান খাব। তুমি সাইকেলেই এসো তাড়াতাড়ি। পথেই বলব যা বলার।
সাইকেলটা শামীমের দোকানেই রেখে দিলে হবে।
হয়েছেটা কী তা তো বলবে?
মৌলভী কাল মোরগা মারতে গেছিল নইনদীয়ার জঙ্গলে। এখনও পর্যন্ত ফেরেনি। তাড়াতাড়ি এসো। আমি চললাম।
পৃথু জীপ চালিয়ে এগিয়ে গেল।
ভুচু ফিরে গেল হান্নানের দোকানে। কী মনে করে, বারোটা রুটি আর কিছুটা মগজের কারিও নিয়ে নিল চটপট সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে ঝুলিয়ে। তারপর এগোল শামীমের দোকানের দিকে।
শামীম বলল, সালাম আলেকুম। চায়ে মাঙ্গাউ?
পান মাঙ্গাউ? আবার বলল, শামীম।
আমিই আনাচ্ছি। সঙ্গে লাগবে।
তুমি কি খুবই ব্যস্ত শামীম?
ভুচু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
শামীম একচোখের ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা না খুলেই বোকার মতো তাকাল পৃথুর দিকে। পৃথুর মুখটা বোধহয় আবছা অথবা অতিকায় দেখাল ওর চোখে ওই কাঁচেরই জন্যে। চট করে কাঁচটা খুলে পৃথুর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল, ক্যা হুয়া? পিরথুদাদা? শামীমকেও যে আবার কখনও তার দলের মানুষদের প্রয়োজন হতে পারে এ-কথা শামীম বোধহয় ভুলেই গেছিল।
ধারে কাছে কেউ নেই দেখে, পৃথু বলল, মৌলভী কাল বিকেলে মোরগা মারতে গেছিল, আর ফেরেনি। নইনদীয়ার জঙ্গলে।
মৌলভী…? ইয়া আল্লা!
হতভম্ব হয়ে বলল, শামীম। তারপর নিজের মনে বিড় বিড় করে কী সব বলল অস্ফুটে। আমরা যাচ্ছি। পৃথু বলল, চাপা গলায়।
আমরা মানে?
ভুচু আসছে।
আমিও যাব।
কী হতে পারে? বাঘ? সাপ? ডাকু?
কী করে বলব? আমরা যাচ্ছি। তুমি ভেবে দেখো। যেতেই হবে এমন মানে নেই। ঠুঠাকে নিতাম, সময় নেই এখন।
পিরথুদাদা! ভাববার কিছুই নেই। যদি কোনও খতরাই বনে গিয়ে থাকে? যারা আমার মেয়ের জান বাঁচাল তাঁদের বিপদে পাশে না দাঁড়ালে খুদাহ আমাকে দোজখ-এও জায়গা দেবেন না। আসছি আমি। এক সেকেন্ড।
বলেই, ও ভিতরে চলে গেল। ওর মেজ ছেলে সামসুদ্দিনকে দোকানে বসতে বলল। দোকান থেকেই গলা তুলে চেঁচিয়ে। সামসুদ্দিন বাপকো-বেটা হয়েছে। হিরো; আরেকজন। সে একটা জিনের ফ্লেয়ার পরে, হাতে ফিলমফেয়ার ম্যাগাজিন নিয়ে অনিচ্ছাসহকারে দোকানে এসে বসল। ব্যাজার মুখে। ভাবখানা; বম্বেতে গেলে অমিতাভ বচ্চনই হতে পারত, এখানে এই গর্তে বসে ঘড়ি সারাই করবার জন্যে এই দুনিয়াতে সে পয়দা হয়নি।
ভুচু এসে গেল। পানও। শামীমের সেজছেলেকে পাঠিয়েছিল।
ভুচু আর শামীম দুজনেই সামনে বসল।
ভুচু বলল, চলো।
শামীম বলল, এক সেকেন্ড। বন্দুকটা নেওয়া হল না।
ঠিক আছে। ভুচু বলল। নিয়ে নাও।
গিরিশদার বাড়ির রাস্তায় মাইলখানেক গিয়েই একটা ঝাঁকড়া অশত্থ গাছের নীচে পথটা আসতেই বাঁয়ে একটা সরু কাঁচা রাস্তা বেরিয়ে গেছে। বয়েল গাড়ি, জীপ অথবা মোটর সাইকেল এবং সাইকেলের পক্ষেই তা উপযুক্ত। কার যাবে না। এই পথটা অন্ধ। একটা শূন্য টাঁড়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে অনেক দূরে। সেখানে আগে নইনদীয়া বলে মস্ত একটা গ্রামও ছিল। পানকাদের। বসন্তর প্রকোপে আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে সে গ্রাম ছেড়ে লোকে এদিকে ওদিকে চলে গেছিল। তাই এই পথে ক্বচিৎ কোনও পিকনিক করা পার্টি ছাড়া সদুদ্দেশ্যে কারও যাবার কথা নয়।
পৃথু জীপটা দাঁড় করাল। বলল, দ্যাখো তো ভুচু অন্য জীপের চাকার দাগ পাও কি না পথের ধুলোয়?
ভুচু ও শামীম দুজনেই নেমে ভাল করে দেখল। জীপের চাকার দাগ নেই তবে মোটর সাইকেলের যাওয়া-আসার দাগ আছে নিয়মিত। সাইকেলেরও।
পৃথু বলল, চিন্তার কথা।
তিনজনেই সাবধান হয়ে গেল। কিন্তু বেশি দূর যেতে হল না। মাইলখানেক মতো আঁকাবাঁকা, দুধারে জঙ্গলঘেরা পথে এগোতেই শামীম আঁতকে উঠে বলল, ইয়া আল্লা!
ব্রেক করে দাঁড় করাল জীপটাকে পৃথু। ডানদিকে চেয়ে দেখল একটি শিমুল গাছের ডাল থেকে মৌলভী গিয়াসুদ্দিন ঝুলে আছে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার লাল কালো চেক চেক লুঙ্গিটা পাকিয়ে তার গলাতে গিঁট দিয়ে ডালের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে কারা যেন। মৃতদেহটা ফুলে উঠেছে। মনে হচ্ছে যেন একটা অতিকায় লাল কালো বনমোরগ। একদল শকুন ছেয়ে আছে গাছটাকে। মাঝে মাঝেই মৃতদেহের কাছে পা রাখার জায়গা না পেয়ে উড়ে উড়ে এসে এক এক কামড় মাংস খুবলে নিচ্ছে। যেখানে একসময় চোখ দুটি ছিল সেখানে বীভৎস দুটি ক্ষত। তরল রক্ত গড়িয়ে গেছে মুখ বেয়ে সারা শরীরে। কালো রেখায় শুকিয়ে গেছে।
পৃথু তাড়াতাড়ি জীপ ঘুরিয়ে নিয়ে আবার অশত্থ গাছটার নীচে ফিরে এল। শামীম আর ভুচুকে বলল ফিরে গিয়ে মৌলভীর বাড়িতে খবর দিতে। ভোপালের সঙ্গেও ফোনে কথা বলতে বলল।
ভুচু সব শুনল।
জীপের স্টিয়ারিং-এ বসতে বসতে ভুচু বলল, তুমি?
আমি একা গিয়ে দেখে আসব একটু।
ঠিক আছে। বলল ভুচু। কিন্তু পৃথুদা খুব সাবধান। তোমাকে একা ছেড়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?
পৃথু বলল, বিলকুল ঠিক হবে। সময় নষ্ট কোরো না।
শামীমের বয়স যেন আরও দশ বছর বেড়ে গেল। বিড় বিড় করে আবার বলল, ইয়া আল্লা! খুদাহতাল্লা।
জীপটা চলে গেল। পৃথুও জঙ্গলের গভীরে ঢুকে গেল পথ ছেড়ে। ডানদিকে নয়; বাঁদিকে। তারপর পিস্তলটি হাতে ধরে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে এগোতে লাগল, আহত বাঘকে যেভাবে শিকারের সময় অনুসরণ করত, প্রায় সেইভাবেই।
জঙ্গল এদিকে বেশ গভীর। শালই বেশি। তবে বেল, আমলকি, চিলবিল, ঢওঠা, ঢোঁঠর ইত্যাদিও অনেকই আছে। পিটিস, কেলউন্দা, করৌঞ্জ, পিলাবিবি ইত্যাদির ঝোপ-ঝাড়ও কম নেই। ময়ূর, বনমুরগি, তিতির, বটের খরগোশ আর চিতার আইডিয়াল কান্ট্রি। মিনিট পনেরো জঙ্গলের ভিতরে রাস্তা ছেড়ে ও হেঁটে গেল, তারপর নইনদীয়ার পাড় ধরে পথের সমান্তরালে যাবে ঠিক করল। কোনও বিশেষ কারণে নয়। মন বলল, তাই। এমন সময় যেখানে বুদ্ধি বা যুক্তি অচল, সেখানে মন যা বলে তাই-ই শুনতে হয়।
রোদটা এখন চড়ছে। সকাল দশটা এগারোটাতে শীতের জঙ্গলের শিশির সব বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ার পর গাছপালা থেকে যে এক ধরনের বিশেষ গন্ধ ছাড়ে, কোনও যুবতী মেয়ের চান করে ওঠার পর মুহূর্তের বাথরুমের গন্ধের মতো, সেইরকম গন্ধে ভরে আছে সমস্ত বন। একদল ছাতারে ডাকছে ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যাঃ করে। টিয়ার ঝাঁক চলেছে মাথার উপর দিয়ে। সবুজ টুঁই পাখি টি-টুঁই টি-টুঁই করে চমকে বেড়াচ্ছে।
নইনদীয়া নদীর নামেই গ্রামটার এবং জায়গাটারও নাম। এই নদী একটা জায়গায় এসে একেবারে হেজেমজে গিয়ে কয়েক ফার্লং মতো গিয়ে যেন ভূস্তরের গভীরে ডুবসাঁতারে এসে আবার জেগে উঠেছে। তাই-ই এর নাম নইনদীয়া। নতুন নদী!
কান খাড়া করে চলেছে পৃথু। মৌলভীর কথা ভাবার সময় নেই এখন। মানুষ মরে গেলেও বারো ঘণ্টার বেশি সময় কেউই ভাবে না তার জন্যে। মৌলভী বারো ঘণ্টার অনেক আগে মরেছে। ফুলে ঢোল। মোটেলাল। ডাকল শের সিং এর দলের মোটেলালকে ডাকু মগনলাল যে শুধু খতমই করেছে তাই-ই নয়, বড় নৃশংসভাবেই খতম করেছে। পৃথুর দৃঢ় বিশ্বাস, শিমুল গাছটার কাছে অথবা গাছের ডালে কোনও চিঠিও রেখে গেছে তারা বাকিদের সাবধান করে দিয়ে। ভয় দেখিয়ে। মোটেলাল মরে গিয়ে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে পৃথুর মধ্যে। এই-ই মৌলভীর মৃত্যুর নীট ফল।
নুরজেহানের ঘটনার পর এই ব্যাপারে সব কিছুই থিতিয়ে গেছিল। সপ্তাহে দুদিন ভোপাল কথা বলেছে একবার করে ভুচুর সঙ্গে। কখনও কখনও পৃথুর সঙ্গেও। রাতেই। পরশুদিনের খবর ছিল এইটাই যে, ওঁরা ঠিক জানেন যে মগনলাল এই এলাকাতেই আছে। মোঁগাওতে পর পর তিনটি ডাকাতি হয়েছে গত সাতদিনে। বালাঘাট থেকে আসা একটি ট্রাককে গভীর রাতে লুঠ করেছে পথে। ড্রাইভার এবং ক্লীনারকে গুলি করে মেরেছে। ভগয়ান শেঠ-এর দোকান এবং ভিনোদ ইদুরকারের বাড়িও লুঠ করার সম্ভাবনার কথা পরশুই এক ইনফরমার মারফৎ জেনেছেন ওঁরা। হাটচান্দ্রার বিলিতি মদের দোকান থেকে মদ কিনে নিয়ে মগনলালের দলের দুজন একটি সাইকেল রিকশাতে করে গিয়ে নির্জন জায়গায় নেমে পড়েছিল। সাইকেল রিকশাওয়ালা পুলিশকে ইনফর্ম করেছে। একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক এবার। শিকারি মাত্রই জানেন যে, বড় বাঘকে জখমি করে ছেড়ে রাখার মানে হয় না। পাপ তো বটেই, নিজেরও শান্তি হয় না। হোক এবার যা হবার।
ভোপালের খবরের ব্যাপারটাকে অত ইম্পরট্যান্সও হয়তো দেয়নি ভুচু। ভেবেছিল, ক্রীসমাস পেরিয়ে গেলে কিছু একটা ঠিক করবে। মোটেলালকে সরিয়ে দেওয়া মানে, এর পর সাঁওয়া, শের সিং নিজে এবং তার দলবলের অন্যদেরও যাওয়ার ওয়াক্ত আসবে।
হঠাৎই একটা শব্দে থমকে দাঁড়াল পৃথু। শব্দটা ঠিক কিসের ঠাহর করতে পারল না। ওইখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দু পা মাটিতে গেঁথে গেল। আবারও হল শব্দটা একটু পরই। মনে হল, জলের মধ্যে থেকে এল। জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে নদীর দিকে যাওয়ার সাহস হল না, ধরা পড়ে যাবে বলে। আবারও হল শব্দটা। এবার বোঝা গেল। নদীর মধ্যে পাথরের উপর কেউ কাপড় কাচছে।
খুব সাবধানে, প্রায় লেপার্ড-ক্রলিং করে করে পৃথু এগোতে লাগল ওইদিকে। নদীর পারের দু মিটার মতো দূরে থাকতে একটা পিটিসের ঝোপের আড়ালে সটান শুয়ে পড়ল ও। শুয়ে পড়তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। এবং সঙ্গে সঙ্গে একদল বনমোরগ ভরর ভরর করে সামনের ঝোপ থেকে উড়ল একসঙ্গে। মৌলভীর খাদ্য। অনেকদিন মানা করেছিল পৃথু। পুলিশ যে গুলিগুলো তাকে ডাকাতের মোকাবিলা করতে দিয়েছিল সেই গুলির বেশি দিয়েই মোরগা-নিধক করেছে মৌলভী। এই মোরগ-মারতে এসেই তার প্রাণটা গেল।
পৃথু পিটিসের ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখল, একটা কালো, অল্পবয়সী মেয়ে নদীতে কাপড় কাচছে। লালরঙা একটি তাঁতের শাড়ি। কিন্তু তার পরনে কিছুমাত্র নেই। চান হয়ে গেছে। চুল ভিজে। ভারী সুন্দর তার গড়নটি। মেয়েটিকে এদেশী বলে মনে হল না। সরু কোমর। লম্বা। হাঁটু সমান কুচকুচে কালো চুল। লতানো দুটি বাহু। নিখুঁত সৌন্দর্য!
এমন সময় নদীর ওই পারে দুজন লোককে দেখা গেল। তাদের কোমরে গুলির বেল্ট বাঁধা। হাতে রাইফেল। বড় বড় গোঁফ। অলিভগ্রীন ট্রাউজার, ফুলহাতা শার্ট এবং সোয়েটার গায়ে। লোকগুলোর চেহারা দেখেই বুঝল পৃথু যে ডাকাত। মেয়েটির দিকে চেয়ে তারা একসঙ্গে কী যেন বলে উঠল। হো হো করে হাসল। জানোয়ারের মতো। ওরা সৌন্দর্যর কদর জানে না, মাংস খেতে জানে।
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গেই কাচা কাপড়টি জড়িয়ে নিল গায়ে এবং পরিষ্কার বাংলায় বলল, মরণ! রাতে দিনে একমুহূর্ত নিস্তার দেবেনি গো হারামজাদারা!
পৃথুর গায়ের রোম সব সোজা হয়ে উঠল। এই-ই তাহলে সেই ভৈরবী।
লোকগুলো অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করল মেয়েটির দিকে চেয়ে। তারপর মেয়েটি জল ছেড়ে পাড়ে উঠে গেলে তার সঙ্গে জঙ্গলের গভীরে ঢুকে গেল। পৃথুর মনে হল, খুব সম্ভব মেয়েটির এসকর্ট হিসেবেই এসেছিল লোকগুলো। যাতে পালিয়ে না যেতে পারে সেই জন্যও হয়ত।
ওরা অদৃশ্য হবার পরই পৃথুও নদী পেরুল। খুব সাবধানে, তারপর যেদিকে ওরা গেছিল, সেই দিকেই এগিয়ে চলল যতখানি নিঃশব্দে পারে।
ওদের পথটা ধরে ফেলতে কষ্ট হল না বেশি। লোকগুলো যোধপুরী বুট পরে ছিল। পায়ের দাগ জঙ্গলের মাটিতে পাওয়া যাচ্ছিল সহজেই, সিকি মাইলটাক গিয়েই আস্তানাটার সন্ধান পেল পৃথু। আস্তানা মানে, পাশাপাশি দুটি বড় বয়ের গাছের ডালের সঙ্গে টেনে বাঁধা একটা বড় ত্রিপল। তার নীচে ভোঁর ঘাস এবং কিছু বিচালি পাতা। ঘাস ও বিচালির চেহারা দেখে মনে হল কাল রাতেই পাতা হয়েছে। তারই উপর কম্বল-পাতা বিছানা। সবশুদ্ধ জনা ছয়েক লোক। পাশের একটি মহুয়া গাছের উঁচু ডালে একটি মাচা বাঁধা। তাতে একজন লোক টেলিস্কোপিক লেন্স লাগানো রাইফেল নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। মগনলালের দলের স্নাইপার। একবার দেখতে পেলেই হল। লোকটার গলা থেকে বাইনাকুলারও ঝুলছে।
পৃথু একেবারে গুলি-খাওয়া চিতার মতো মাটির সঙ্গে লেপ্টে দিল নিজেকে। শরীরের সমস্ত পেশী আর স্নায়ুকে সচেতনতার চরমে পৌঁছে দিয়ে স্থির করে দিল। একটাই জিনিস করার আছে এখন ওর। এখানে সবশুদ্ধ কতজন লোক আছে? আর ওরা আজ রাতটাও এখানে কাটাবে কি না? সেটা জানা দরকার। দলের মধ্যে মগনলাল নিজে আছে কি নেই তাও। মগনলালের চেহারাটা ফোটো দেখে চিনে রেখেছে ও। দূর থেকে দেখতে পেলেও ঠিক চিনে নেবে। অনেক সময় স্বপ্নেও দেখেছে। মাচায় বসা স্নাইপার, বাইনাকুলারটা তুলে ধরল দু’হাত দিয়ে, রাইফেলটা পাশে নামিয়ে রেখে। এই সময় ওকে এক নিমেশে শেষ করে দিতে পারত পৃথু। কিন্তু এখনও নয়। সব কিছুই সময় মতো। গর্ভাধানের সময় থেকে জন্ম সময়ের মধ্যে যেমন এক নির্দিষ্ট ব্যবধান থাকে, তেমনই মৃত্যুর শমন জারি হওয়া আর মৃত্যুর সময়ের মধ্যেও থাকে।
এমন সময় সাইকেল করে একটি লোক এল ওই ক্যাম্পের উল্টোদিকের সুঁড়ি পথ বেয়ে। কে জানে? সাইকেলটা বোধহয় মৌলভী গিয়াসুদ্দিনেরই হবে। হ্যান্ডেলের যেখানে ধরবার সেখান থেকে লাল-নীল প্লাসটিকের ফালি ঝুলিয়ে রাখত মৌলভী। এতেও আছে। লোকটা সাইকেল থেকে নামতেই চিনে ফেলল পৃথু।
এই-ই ডাকু মগনলাল।
ডাকু মগনলাল ত্রিপলের তলায় এক আছাড়ে শুয়ে পড়ে ভৈরবীকে ডাকল। ভৈরবী এসে তার মাথার চুল বিলি কাটতে লাগল। মগনলাল নিচু স্বরে একজন লোককে কী যেন বলল। রান্না করছিল আরেকজন লোক পাথরের উনুনে, কাঠ গুঁজে দিয়ে। তার পাশে আরেকজন বসে রুটি গড়ছিল দু’হাতে চাঁটি মেরে মেরে আর অন্য একজন একটা উনুনের উপর তাওয়াতে তা সেঁকছিল। নাস্তা তৈরি হচ্ছিল। আরও একটি লোক একটি পাঁঠার গলায় দড়ি বেঁধে হাঁটাতেহ হাঁটাতে নিয়ে এল। কোথা থেকে, কে জানে? স্নাইপারটা বাইনাকুলারটা স্থির করে চেয়েছিল পৃথুর পেছন দিকে। এতক্ষণে বুঝল পৃথু। লোকটা মৌলভীর ঝুলন্ত মৃতদেহের উপরই নজর রাখছে। কখন তাকে নামানো হয়, কে বা কারা নামায়, পুলিশ এল কি এল না এই সবই দেখছে বোধহয়। মৌলভীকে মেরে তারই মৃতদেহের আধ মাইলের মধ্যে থাকা যথেষ্ট বিপজ্জনক ছিল ওদের পক্ষে। কিন্তু এই জন্যেই ডাকু মগনলাল ধরা পড়ে না। যা কেউ করে না, যা কারও ভাবনারও বাইরে, মগনলাল চিরদিন তাই-ই করে এসেছে। ও নিশ্চয়ই ভেবেছিল পুলিশ ডেডবডি পেয়ে অন্যান্য সম্ভাব্য জায়গাতেই খোঁজ করবে ওর। ও যে এখানেই একেবারে নাকের ডগায় বসে আছে প্রদীপের নীচের অন্ধকারের মতো, তা কারও মাথাতেই আসার কথা নয়।
সময় বেশি নেই। আজকেই এই পুরো ফোঁড়ার মতো ঘিনঘিনে ব্যথাটিকে অপারেট করতে হবে। হয় ইসপার নয় উসপার। আস্তে আস্তে, খুব আস্তে আস্তে; পৃথু পিছু হটতে লাগল। পনেরো মিনিট ধরে এভাবে পিছনে গিয়ে যাতে স্নাইপারের বাইনাকুলারের নজরে না পড়ে তার জন্য সবরকম সাবধানতা নিয়েই সে যত তাড়াতাড়ি হেঁটে পারে, মোড়ের অশ্বত্থতলার দিকে তত তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে লাগল। তার পায়ের আওয়াজ পেয়ে অথবা তাকে দেখতে পেয়ে কতগুলো হনুমান হুপ হুপ হুপ করে ডেকে উঠল।