প্রীতম কখনও দুরে কোথাও যায়নি। তার একমাত্র দূরে যাওয়া ঘটেছিল যখন শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় এল সি-এ পড়তে। বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের এক মেসবাড়ির দোতলার ঘরে বসে সে তখন ভাবত, ইস! শিলিগুড়ি কত দূর!
কলকাতায় থাকতে থাকতে আর কলকাতাকে দূরের জায়গা মনে হত না তার। শিলিগুড়ির কথা ভেবে শুয়ে শুয়ে চোখে জল আসত না তার। বিয়ের পর বিলুর সঙ্গে হানিমুন করতে গিয়েছিল পুরী। সেই তার আর-একবার দূরে যাওয়া। দিন সাতেকের মধ্যেই কলকাতায় ফেরার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিল সে। অফিসের কাজে বর্ধমান, টাটানগর, সিৰ্জি বা দু-তিনবার দিল্লিতেও যেতে হয়েছিল তাকে। কোনওদিন সে বাইরে গিয়ে ভাল বোধ করেনি। কোথাও দু-তিন দিনের বেশি থাকতে পারেনি। দুর প্রীতমকে টানে না কখনও।
তার প্রিয় শিলিগুড়ি, তার প্রিয় কলকাতা।
কিন্তু দীর্ঘ চব্বিশ ঘণ্টা পর চোখ চেয়ে প্রীতম টের পেল, জীবনে সে এত দূরে আর কখনও আসেনি। শব্দহীন, ঝিঝি-ডাকা আবছা অন্ধকার চেতনার মধ্যে চেয়ে সে অনুভব করল, দূরত্বটা বড় বেশি। মাঝখানে এক বিশাল নদী বয়ে যাচ্ছে কি? অস্পষ্ট সেরকম একটা শব্দ পায় সে। কোনও নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। কোনও মুখ মনে নেই। স্মৃতির কপাট বন্ধ। জীবাণুরা অনেকটা উঠে এল বুঝি! মগজে? হবেও বা। তার শরীরের মধ্যে আর কোনও লড়াই নেই। সে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
দাদা! দাদা, শুনতে পাচ্ছ?
হুঁ।
কেমন আছ? কেমন লাগছে?
ভাল। খুব ভাল।অতি কষ্টে আড়ষ্ট জিভ নেড়ে বলে প্রীতম। কিন্তু কে প্রশ্ন করল তা বুঝতে পারল না। সে যে জবাবটা দিল তার অর্থও তার ভাল জানা নেই। শুধু অভ্যস্ত একটা শব্দ বেরিয়ে গেল মাত্র।
কিছু খাবে?
না।
গরম দুধ খাও। ভাল লাগবে।
গরম দুধ! না, খাব না।
এই যে, লাবুকে দেখো। লাবু সেই সকাল থেকে তোমার পাশে বসে আছে। দেখো।
লাবু? কই?
এই তো! আয় লাবু, বাবার চোখের সামনে আয়।
লাবুর মুখ শুকনো করুণ। হামাগুড়ি দিয়ে সে বাবার মুখের ওপর ঝুঁকে বসল।
কিন্তু চিনতে পারল না প্রীতম। লোকটা কে? মেয়েটা কে? কিন্তু অভ্যস্ত জিভ বলল, লাবুঃ বাঃ বেশ।
তুমি মরে যাওনি তো বাবা?–লাবু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে।
মরে যাইনি তো।—প্রতিধ্বনি করে বলে প্রীতম।
মাকে ডাকব বাবা?
মা কে?
মা! আমার মা?
তোমার মা! বাঃ খুব ভাল।—বলল প্রীতম।
মা সারারাত জেগে ছিল তো। এইমাত্র একটু ঘুমোচ্ছ।
আচ্ছা।
ডাকব বাবা?
শতম লাবুর পিঠে হাত রেখে বলে, যাও, ডেকে আনো।
লাবু গিয়ে ও ঘরে মাকে ডাকতে থাকে।
শতম বিছানায় বসে প্রীতমের কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। সারা শরীরে কোথাও মাংস নেই। কপালটা করোটির মতো শক্ত। দাঁতে দাঁত পিষে শতম বলে, এরা তোমাকে প্রায় শেষ করে এনেছে দাদা। আর নয়, শিলিগুড়ি চলল। তোমাকে ঠিক সারিয়ে তুলব।
প্রীতম শিলিগুড়ি কথাটা যেন বুঝতে পারে। ঠক করে কিছু মনে পড়ে না, তবে একটা মস্ত সাদা পাহাড়, ঘন জঙ্গলের দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে তার।
শিলিগুড়ি?
শিলিগুড়ি। যাবে না দাদা?
যাব।
তা হলে আমি আজই রিজার্ভেশন করতে যাব।
প্রীতম যদিও কিছুই মনে করতে পারে না, তবু তার ভিতর থেকে এক প্রম্পটারই যেন বলে ওঠে, ওদের কে দেখবে?
তুমি কি ওদের দেখো? ওদের ওরাই দেখবে।
এ কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেল বিলু। সে নিঃশব্দে বিছানার ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ এক রাতেই শুকিয়ে গেছে। চোখ কান্নায় ফোলা এবং অনিদ্রায় লাল। চুল এলোমেলো। কাল সারারাত সে প্রীতমকে ছেড়ে প্রায় নড়েইনি। অপেক্ষা করেছে, কখন প্রীতমের জ্ঞান ফিরে আসে। আমাকে শুধু খারাপ ভেবেই চলে যেয়ো না প্রীতম। আমি যে তোমাকে কত ভালবেসেছিলাম তা জেনে যাবে না?
শতমের কথাটা কানে আসতেই একটু শিউরে ওঠে বিলু। প্রীতমকে নিয়ে যাবে? নিয়ে যাবে?
প্রীতমের করোটির মতো শক্ত কপালে বিলুও হাত রাখে, কেমন আছ, প্রীতম?
প্রীতম খুব ভাল করে মহিলাটিকে দেখে নিচ্ছিল। এ যেন কে? খুব চেনা। ঠিক মনে পড়ছে না।
প্রীতম বলল, ভাল। খুব ভাল আছি।
আর কেউ না বুঝলেও বিলু ঠিকই টের পায়, একটা দিনের মধ্যেই প্রীতমের মধ্যে একটা বড় রকমের ওলট-পালট হয়ে গেছে। তার এমনও সন্দেহ হয়, প্রীতম তাকে চিনতে পারেনি।
একটু ঝুঁকে বসে বিলু। খুব আস্তে আস্তে বলে, আমি বিলু। চিনতে পারছ?
শতম পাশ থেকে বলে, চিনতে পারবে না কেন বউদি? কী বলছ?
বিলু করুণ মুখটা তুলে মাথা নেড়ে বলে, ও চিনতে পারছে না। আমি জানি।
এরকম কি মাঝে মাঝে হয়?
না। এই প্রথম।
শতমের মুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে, একটু আগেই তো শিলিগুড়ি যাওয়ার কথায় রাজি হয়ে গেল। বিলু বলল, ওর চোখের দৃষ্টিটা দেখো। তা হলেই বুঝতে পারবে।-বলে বিলু আবার প্রীতমের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করে, আমি কে বলল তো? আমি কে?
তুমি!—বলে প্রীতম ভ্রু কোঁচকায়। অনেক দূর থেকে শব্দগুলো আসছে। ঝিঝি-ডাকা আবছায় ভাসছে কিছু মুখ।
লাবুকে চিনতে পারছ না? এই যে লাবু।
লাবু! হ্যাঁ লাবু।—প্রীতম ভ্রু কুঁচকে রেখেই বলে।
শতম চাপা গলায় বলে, ডাক্তারকে খবর দেবে না বউদি?
বিলু মাথা নেড়ে বলে, খবর দেওয়াই আছে। বেলা দশটা-এগারোটা নাগাদ আসবেন কালই বলে গেছেন। আমি ভাবছি, এটা হয়তো ঘুমের ওষুধের এফেক্ট। এটা কেটে গেলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
দাদাকে এবার কিছু খেতে দাও।
খাওয়াব। অচলাকে দুধ গরম করতে বলে এসেছি।
শতম একটু চুপ করে থেকে বলে, এটা কোনও খারাপ সাইন নয় তো বউদি?
কী জানি। তবে ঘাবড়ে যেয়ো না।
আমার কীরকম লাগছে।
জবাবে বিলু একটু হাসল মাত্র।
অচলা দুধের ফিডার নিয়ে গম্ভীর মুখে ঘরে আসে। কাল সারা রাত সেও প্রায় জেগেই কাটিয়েছে। তবে তার অভ্যেস আছে বলে মুখে রাত জাগার কোনও ছাপ নেই। সে কাছে এসে বলল, সরুন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
বিলু উঠে সরে বসল। মন দিয়ে দেখতে লাগল, অচলা কী সুন্দর পটু হাতে অল্প অল্প করে দুধ খাইয়ে দিচ্ছে প্রীতমকে। গলায় পরিষ্কার একটা ভোয়ালে দিয়ে নিয়েছে।
বিলু আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, অচলা, আমার মনে হচ্ছে ও লোকজন চিনতে পারছে না। তুমি একটু দেখো তো!
অচলা মুখ না তুলেই বলল, ডাক্তার আসুন, উনিই বুঝবেন।
তুমি কিছু বুঝতে পারছ না?
আমি পেশেন্টের অবস্থা খুব ভাল দেখছি না।
কী হল বলো তো?
কী করে বলব! কালও তো নর্মাল ছিলেন। আজ কেমন অন্যরকম দেখছি।
দুধ খাইয়ে অচলা গরম জলে ভেজানো তোয়ালে এনে প্রীতমের মুখ মুছিয়ে চুলগুলো পাট করে দিল। একটু ট্যালকম পাউডার ছড়িয়ে দিল গায়ে। একটা ওষুধ খাওয়াল। তারপর বলল, পেশেন্ট এবার ঘুমাবে। আপনারা ও ঘরে যান।
প্রীতম বাস্তবিকই ঘুমিয়ে পড়ে।
ডাক্তারের জন্য শতম ঘর-বার করতে করতে বারবার ঘড়ি দেখতে থাকে। আঁচলে শরীর জড়িয়ে বাইরের ঘরের সোফায় কোণ ঘেঁষে বসে থাকে বিলু। একদম স্থবিরের মতো। বাড়ির আবহাওয়ায় বিষণ্ণতা টের পেয়ে লাবু দ্বিতীয় শোওয়ার ঘরে গিয়ে খাটের নীচে ঢুকে পুতুল খেলতে বসে।
এতদিন বলার সুযোগ হয়নি, কিন্তু আজ রাগ বিরক্তি শোক সব মিশে শতম নিজেকে সামলানোর চেষ্টা না করেই হঠাৎ বলে ফেলল, এখানে দাদার যত্ন হচ্ছে না বউদি। এবার আমি দাদাকে শিলিগুড়ি নিয়ে যাব।
এ কথার কোনও জবাব মাথায় এল না বিলুর। অনেকক্ষণ ধরে তার মনের মধ্যে ওই কথাটাই প্যারেড করে বেড়াচ্ছে, প্রীতমকে নিয়ে যাবে! প্রীতমকে নিয়ে যাবে।
বিলু শতমের দিকে চেয়ে থেকে মনের সেই কথাটাই মুখ দিয়ে বলল, নিয়ে যাবে!
শতম সামান্য চড়া গলায় বলে, তুমি অফিসে চলে যাও। সারাদিন দাদা তো একা থাকে। আয়া-টায়ারা কি ঠিকমতো সেবাযত্ন করতে পারে?
বিলু আবার বলে, নিয়ে যাবে!
তুমি বাধা দিয়ো না বউদি। দাদার ভালর জন্যই বলছি।
বিলুর ভিতরে যে ঠান্ডা কঠিন এক মানুষ ছিল সে গলে জল হয়ে গেছে। এখন বিলুর মাথার ঠিক নেই। সে খুবই শুষ্ক সরু অসহায় এক গলায় বলল, প্রীতম যদি আর ফিরতে না পারে।
শতম গম্ভীর হয়ে বলল, কী হবে তা তো জানি না। তবে শিলিগুড়ি তো মোটে এক রাতের পথ। প্লেনে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। যখন তখন ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারবে। ভাবছ কেন?
এত অসহায় বিলু কখনও বোধ করেনি। সে নিজের চারদিকে একবার হরিণের মতো ত্রস্ত চাউনিতে দেখে নিল। কিন্তু আসলে কিছুই দেখল না। কোথাও কিছু নেই দেখবার মতো। নিজের করতলের দিকে চেয়ে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, তুমি কি ওকে নিয়ে যেতেই এসেছিলে শতম?
বলতে পারো তাই। দাদা অমত করলে নিতাম না। কিন্তু দাদা এবার অমত করেনি।
আমারও তো একটা মতামত আছে।
ক্রুদ্ধ শতম বিলুর দিকে ষণ্ডামর্কের মতো তাকিয়ে বলল, তোমার মতটা তা হলে কী? দাদা এইখানে এইভাবে শেষ হোক?
বিলুর আজ মনের জোর নেই। যদি গতকাল অরুণের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাটা না হত, যদি ওভাবে ভেসে না যেত সে, তবে আজ রুখে উঠতে পারত বিলু। অরুণ কোনও সংস্কাব মানে না, বড় বেশি সাহসী। কোনওদিন বিলুর ওপর এই লোভ প্রবল ছিল না অরুণের। কাল সেই লোভ দেখা দিল। বলল, অবশেষে আমার বিয়ের ব্যাপারটা ঠিক হয়ে গেল বিলু। হয়তো জানুয়ারিতে। তার আগে পর্যন্ত এই সময়টুকু আমাদের। অরুণ বিয়ে করছে—এই খবরে একই সঙ্গে বিষাদ ও ক্রোধ চেপে ধরেছিল বিলুকে। আর সব মিলিয়ে হয়ে গেল ওই অদ্ভুত কাণ্ডটা। কেউ জানে না, তবু তারপর থেকেই বিলুর ভিতরে একটা মিয়োনো ভাব, পাপবোধ, চকিত শিহরন খেলে যাচ্ছে। অকারণেই মাঝে মাঝে চমকে উঠছে সে, ভয় ভয় করছে তার, লজ্জা পাচ্ছে।
বিলু মাথা নেড়ে বলল, যেখানে গেলে ওর ভাল হবে সেখানেই নিয়ে যাও। আমি ওর ভালই তো চাই।
তা হলে তোমার মত আছে বলছ?
থাকার কিছু তো নয়। তবে আমাকে তোমরা কেউ একবারও তো জিজ্ঞেস করোনি। আমি কি কেউ নই?
কথাটা বলতে বলতে বিলুর চোখ ভিজে এল। এ ঘটনা তার জীবনে এতই বিরল যে, কখনও নিজের চোখে জল এলে সে নিজেই অবাক হয়। এখন অবশ্য হল না। তবে মুখ ফিরিয়ে শতমের চোখ থেকে মুখ আড়াল করল।
শতম বলল, এটা প্রোটোকলের সময় নয় বউদি। অনুমতি বা তা নিয়ে মন কষাকষি এসব খুব ছেলেমানুষি ব্যাপার। দাদার এখন লাইফ অ্যান্ড ডেথ-এর প্রশ্ন।
বিলুর মনটা তার স্বাভাবিক কাঠিন্য ও শীতলতা কিছুটা ফিরে পেল এ কথায়। সে ঠান্ডা গলায় বলল, নিয়ে যাও, কিন্তু সঙ্গে আমি যেতে পারব না।
সেটা জানি। কিন্তু গেলে তোমার কোনও ক্ষতি হত না। শিলিগুড়ির বাড়িটাও তোমারই বাড়ি।
ভ্রু কুঁচকে বিলু বলে, ওসব কথা থাক শতম।
শতম কথাটা কানে না তুলে বলে, তোমাদের সেখানে একটু কষ্ট হতে পারে, কিন্তু চলেও যাবে। তোমাদের সব খরচ আমরা চালিয়ে নিতে পারব।
আমাদের খরচ সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণাই নেই, তাই বলছ। কিন্তু ও কথা নিয়েও এখন কিছু বলতে চাই না। প্রীতম ইচ্ছে করলে তার যা টাকাপয়সা আছে তা তুলে নিয়ে যেতে পারে।
শতম একটু হকচকিয়ে গেল। বলল, দাদার টাকা নিয়ে আমরা কী করব? টাকার কথা ওঠেই। আমরা শুধু দাদাকেই নিয়ে যেতে চাই।
ওর ওপর তোমাদের অধিকার অনেক বেশি।
শতম মাথা নেড়ে বলে, ওটা তোমার রাগের কথা।
আমার মতো অবস্থায় যদি কাউকে বছরের পর বছর কাটাতে হত তবেই সে বুঝতে পারত আমার রাগ কেন হয়। এতকাল প্রীতমকে আগলে রেখেছি, হঠাৎ এখন তোমরা ভালমানুষ সেজে ওকে নিয়ে যেতে চাইলে রাগ কি হতে পারে না?
শতম যেন এরকম কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না। বলল, স্বামীকে আগলে রাখাই স্ত্রীর কাজ। বউদি, সে কাজটাও তুমি ভাল করে করছ? একে কি আগলে রাখা বলে?
অত কথায় কাজ নেই শতম। নিতে এসেছ নিয়েই যাও। তোমাদের কাছেই হয়তো ও ভাল থাকবে।
আমাদের সঙ্গে তুমি কোনও সম্পর্ক রাখো না বলে হয়তো জানোই না, আমরা কেমন লোক। যদি জানতে তা হলে দাদাকে নিয়ে যেতে চাইছি বলে রাগ করতে না। কিন্তু তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, দাদাকে আমরা প্রাণপণে আগলে রাখব। মাইনে করা লোকের হাতে ছেড়ে দিয়ে চাকরি করতে যাব না।
বিলু নিঃশব্দে উঠে ভিতরের ঘরে চলে এল। রাতে ঘুম হয়নি, শরীর জুড়ে ব্যথা আর ক্লান্তি। সঙ্গে উদ্বেগ, অশান্তি, লজ্জা, পাপবোধ। সে এসে প্রীতমের বিছানায় বসল। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না বিলু। প্রীতমের প্রতি তেমন উথালপাথাল ভালবাসা কোনওদিনই ছিল না তার। কিন্তু এখন মনে হয়, প্রীতম চলে গেলে তার পায়ের তলা থেকে একটা পাটাতন সরে যাবে বুঝি!
কিন্তু এই বোধ তো সত্য নয়। প্রীতমের ওপর কোনওদিক দিয়েই সে নির্ভরশীল নয়। কাজেই যুক্তি দিয়ে নিজের ভাবাবেগকে দমিয়ে দিতে পারল সে। অরুণের কাছে সে শিখেছে, দুনিয়ার কালো দিকগুলি, হতাশার কথাগুলি, দুঃখের বোধগুলিকে পাত্তা দিতে নেই। অরুণ উপদেশ দিয়ে এসব তো শেখায়নি, তাকে দেখেই শিখেছে বিলু। অরুণ ঠিক ওইরকম। কোনওদিন কোনও ঘটনাই তাকে বিমর্ষ করে না।
বিলু শতমের জ্বালা-ধরানো কথাগুলো নিয়ে ভাবল না আর। ভাববে কেন! ওর দাদাকে ও নিয়ে যাক। বিলুর পৃথিবী যেমন ছিল তেমনই থাকবে। হয়তো আর-একটু স্বাধীনতার স্বাদ পাবে সে। একটু মন কেমন করবে প্রীতমের জন্য। তা করুক। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গিয়ে কত লোক কত শোক তাপ সহ্য করে।
আস্তে আস্তে প্রীতমের পাশে ছোট পরিসরে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে কখন অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল বিলু।
ছোট, গোল রোদেভরা সবুজ পৃথিবীটা হেলিকপ্টারের তলায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল প্রীতম। পৃথিবীটা যে এত ছোট তা সে জানত না। কোনও শহর গা চোখে পড়ে না। শুধু কিছু সবুজ ছোট ছোট পাহাড়, একটা ঘন বনাকীর্ণ উপত্যকা, ফুলের বন্যা বয়ে যাচ্ছে সেখানে। একটা ছলছলে পাহাড়ি নদী গেছে এঁকেবেঁকে। আর একটা ন্যারোগেজের রেল লাইন। অনেক প্রজাপতি উড়ছে, পাখি উড়ছে। দেখতে দেখতেই পৃথিবীটা একটা পাক খেল। ও পিঠেও জনবসতি নেই, একটা ছোট নীল সমুদ্র, একটা বরফে ঢাকা পাহাড়, আর একটা মাঠের ভিতরে সরু মেঠো পথ দেখতে পায় সে। এত সুন্দর জায়গাটা যে, প্রীতম হেলিকপ্টারে কাচের মতো স্বচ্ছ তলাটায় উপুড় হয়ে পড়ে একদৃষ্টে লোভীর মতো চেয়ে থাকে। কিন্তু হেলিকপ্টারটা বারবার চেষ্টা করেও ছোট্ট সুন্দর পৃথিবীটাকে স্পর্শ করতে পারছে না। কোথাও এক অদৃশ্য বলয় বাধা দিচ্ছে। দূরত্বটাকে অতিক্রম করা যাচ্ছে না। চোখে গগলস্ আর হাতে দস্তানা-পরা পাইলট খুব চেষ্টা করছে অবশ্য। কিন্তু হচ্ছে না।
মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার ঝম করে নেমে যাচ্ছে, ছুঁইছুঁই দুরত্বে এসে যাচ্ছে। কিন্তু সুন্দর ছোট্ট গোল রূপকথার রাজ্যের মতো পৃথিবীটা অমনি একটা পাক খেয়ে সরে যাচ্ছে দুরে। অনেকটা দূরে।
তখন ভয়ে হতাশায় ককিয়ে উঠছে প্রীতম। হাত তুলে বলছে, পাইলট! পাইলট! নামাও।
বিরক্ত পাইলট বলে, কী করব? চেষ্টা তো করছি।
আরও চেষ্টা চাই। আরও চেষ্টা।
আমার হেলিকপ্টারে যতটা ক্ষমতা ততটা চেষ্টা করছি। পৃথিবীটা যদি অমন বদমাইশি করে তবে কী করব বলুন!
প্রীতম ভয়ে ঘেমে ওঠে। বলে, বিলু রয়েছে ওখানে, লাবু রয়েছে, আমাকে যে নামতেই হবে।
বিলু কি আপনার একার? আমারও কি নয়?
প্রীতম কেতড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাইলটের দিকে তাকাল। হেলমেটের নীচে ফর্সা ঘাড়, মসৃণ করে ছাঁটা কালো চুল, সুদৃঢ় ঠোঁটের একটু আভাস। ঠিকই তো। বিলু তো তার একার নয়, অরুণেরও।
প্রীতম বলল, আমার বড় কষ্ট হচ্ছে অরুণবাবু।
কেন বলুন তো! কষ্ট কিসের?
বেশি দুরে আমি কখনও যাইনি। আমার এক্ষুনি বিলুর কাছে ফিরে যাওয়া দরকার। আপনি হেলিকপ্টারটা নামিয়ে দিন।
অরুণ খুব বিষণ্ণ গলায় বলে, বিলু? এই পৃথিবীতে তো বিলু থাকে না। এখানে কেউ থাকে না। শুধু আপনি থাকবেন বলে এটা তৈরি করা হয়েছে।
একটু অবাক হয়ে প্রীতম বলে, সে কী? আমি একা এখানে থাকব কেমন করে?
তা তো জানি না। আমার ওপর হুকুম আছে, আপনাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যেতে হবে। তবে এ জায়গাটা খুব সুন্দর। আপনার বোধহয় ভালই লাগবে।
কিন্তু বিলুর কী হবে? লাবুর?
ওরা অন্য পৃথিবীতে ভালই থাকবে। ওদের মতো করে ভাল থাকবে।
সে পৃথিবীটা কত দূর?
কয়েকটা লাইট-ইয়ার।
লাইট-ইয়ার! এত দূর!
হ্যাঁ। দূরত্বটা কিছু বেশি।
হেলিকপ্টারটা হঠাৎ কাত হয়ে সাঁ সাঁ করে নামতে থাকে। ঘরঘর করে চপারের শব্দ হয়। নীচে সবুজ সাদা নীল ঘূর্ণির মতো ছোট্ট পৃথিবীটা পাক খায়।
নামছি।–বলে অরুণ চেঁচিয়ে ওঠে।
না, না! আমি ফিরে যাব তরুণ!
ফেরার উপায় নেই প্রীতমবাবু।
ফিরতেই হবে। বিলু, লাবু একা। বড় অসহায়।
একা কেন? আমি তো রয়েছি।
তা বটে।-বলে আবার হতাশায় ভেঙে পড়ে প্রীতম।
খুব কাছাকাছি এসেও তাদের হেলিকপ্টারের নাগাল এড়িয়ে পৃথিবীটা সরে যায় এপাশে, ওপাশে।
দুষ্টুমিটা দেখছেন?—অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে।
প্রীতম জবাব দেয় না। কাচের ওপর উপুড় হয়ে থাকে। চোখে জল আসে। তবু মনে কোনও ভার নেই। একা এই পৃথিবীতে তাকে কতকাল বেঁচে থাকতে হবে? অনন্তকাল! অসীম সময় কী করে একা কাটাবে প্রীতম?
অরুণ ডাকছে, প্রীতম! প্রীতমবাবু!
উঃ।
কেমন লাগছে?
ভাল নয়। একদম ভাল নয়। এখানে কী করে থাকব?
কপালে একটা ঠান্ডা হাত স্পর্শ করে। প্রীতম চোখ মেলে চায়।
অস্বচ্ছতা অনেকটাই কেটে গেছে প্রীতমের। দীর্ঘ ঘুমের পর শরীরের নিস্তব্ধতা আছে, কিন্তু ক্লান্তি নেই।
নিজের ঘরখানাকে চিনতে পারে প্রীতম। চিনতে পারে সামনে দাঁড়ানো অরুণকেও। ফটফটে সাদা একটা টি-শার্ট তার গায়ে। সুন্দর মুখে কিছু উদ্বেগ, একটা খুব সুন্দর গন্ধ ভাসছে বাতাসে।
অরুণ তার কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছেন?
আধো জাগরণে যে জবাব দিয়েছিল প্রীতম এখন জাগ্রত অবস্থায় ঠিক তার উলটো বলল, ভাল আছি। খুব ভাল আছি।
আমাকে চিনতে পারছেন তো?
আপনি! আপনি তো অরুণ!
বাঃ! চমৎকার!
প্রীতম হাসবার চেষ্টা করল। এখনও কানে মৃদু হেলিকপ্টারের শব্দ লেগে আছে। বলল, কিন্তু অত দূরে আমি যেতে পারব না।
কোথায় যাওয়ার কথা বলছেন?
ওই যেখানে আপনি নামিয়ে দিয়ে আসতে চেয়েছিলেন আমাকে।
আমি!—বলে অবাক হতে গিয়েও অরুণ মৃদু হেসে ফেলে, আপনি বোধহয় হ্যালুসিনেশন দেখছিলেন।
অনেক দূর! কিন্তু সে জায়গাটাও সুন্দর।
অনেক দূরে আপনাকে যেতে হবে না প্রীতমবাবু। ইউ আর উইথ আস।
বিলু আর লাবুর কী হবে?
অরুণ চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসে। কপালে হাত রাখে। তারপর মৃদু স্বরে বলে, বিলু আপনার জন্য কান্নাকাটি করছে প্রীতমবাবু। এখন আপনার একটু স্টেডি হওয়া উচিত।
প্রীতমের ঘোর-ঘোর ভাবটা অল্প কেটে যাচ্ছে। সে বড় একটা শ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকে। শরীরে জীবাণুদের কোলাহল। সে একটু একটু করে পা নাড়ল, হাত নাড়ল। না, এখনও সাড় আছে। চোখ চেয়ে সে ভাল করে চারদিকটাকে দেখে নিল।
অরুণের দিকে চেয়ে বলল, আমি শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছি।
শুনেছি। কিন্তু কাজটা কি ভাল হচ্ছে?
কেন? কাজটা কি খারাপ?
বিলু একা হয়ে যাবে।
কেন, আপনি তো আছেন।
ডোন্ট বি এ ফুল। আমি কে? বিলুর জন্য আমি কী করতে পারি?
আমিই বা বিলুর কে? আমরা কেউ কারও নই।
আপনাদের কি ঝগড়া হয়েছে প্রীতম?
না, ঝগড়া কেন হবে?
স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া দেখলে আজকাল আমি খুব ভয় পাই। আমিও শিগগির বিয়ে করতে যাচ্ছি কিনা।
প্রীতম বড় বড় চোখে চেয়ে থাকে অরুণের দিকে।
অরুণ মৃদু হেসে বলে, ইটস টু।