পঞ্চম পাঠ
সম্মোহন–শক্তির আরোপিত অনিষ্টকারিতা
সম্মোহন বিদ্যা সম্বন্ধে যাহাদের ব্যক্তিগত আদৌ কোন অভিজ্ঞতা নাই, তাহাদের অনেকের বিশ্বাস, যাহাকে মোহিত করা যায়, তাহার মানসিক শক্তি হ্রাস পায় এবং পুনঃ পুনঃ মোহিত করিলে তাহার মন অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়ে এবং তখন আর তাহার কিছুমাত্র স্বাধীন ইচ্ছা থাকেন। তাহারা আরও বলিয়া থাকে যে, সোহনবিৎ ইচ্ছামাত্রই মানুষের দ্বারা নরহত্যা, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা ইত্যাদি বহু প্রকার অপকৰ্ম্ম করিতে এবং সাধ্বী রমণীগণকেও ব্যভিচারে লিপ্ত করিতে পারে। এরূপ ধারণা নিতান্ত অমূলক। উপরোক্ত ব্যক্তিগণের অনেকেই সম্ভবতঃ অদ্ভুত কাহিনীপূর্ণ সম্মোহন উপন্যাসাদি (hypnotic novels etc.) পড়িয়া ঐরূপ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া থাকে। উপন্যাসকারগণ তাহাদের পুস্তকে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রচারের জন্য বিশেষ আগ্রহান্বিত না হইয়া, উহাদিগকে সাধারণের চিত্তাকর্ষক করিবার জন্যই নানারূপ মিথ্যা ও অসম্ভব কাহিনীর অবতারণা করিয়া থাকেন। সুতরাং যাহারা কেবল উপন্যাসাদি পড়িয়া এই বিজ্ঞানের প্রতি দোষারোপ করেন, তাহাদের কথা নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়।
মনোবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতগণ বলেন যে, সম্মোহন নিদ্রা সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক নিদ্রার অনুরূপ, সুতরাং যখন স্বাভাবিক নিদ্রা মানুষের শরীর কি মনের কোন প্রকারে হানিকর নয়, তখন সম্মোহন নিদ্রাও মোহিত ব্যক্তির কিছুমাত্র অনিষ্টকর হইতে পারেনা। সম্মোহন নিদ্রা পাত্রের পক্ষে ক্ষতিকর নহে বলিয়া, তাহাকে পুনঃপুনঃ মোহিত করিলেও তাহার কোনরূপ অনিষ্টের সম্ভাবনা নাই। পক্ষান্তরে, মোহিত হইবার সময় পাত্রকে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে মনঃসংযোগ করিতে হয়; সুতরাং তাহাকে পুনঃপুনঃ মোহিত করিলে, তাহার একাগ্রতা শক্তিই বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। কতিপয় প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ও উচ্চ উপাধিধারী কয়েকজন খ্যাতনামা ডাক্তারের (চিকিৎসকের) দ্বারা পরিচালিত নিউইয়র্কের একটি প্রসিদ্ধ বিজ্ঞান সমিতি হইতে প্রকাশ পাইয়াছে যে, উক্ত সমিতি তত্ত্বানুসন্ধানের জন্য যে সকল পাত্রকে নিয়মিতরূপে প্রতাহ দুইবার করিয়া ক্রমাগত দশ বৎসর কাল মোহিত করিয়াছেন, সেই সকল লোকও শারীরিক কিম্বা মানসিক কোন বিষয়েই অপরাপর ব্যক্তি অপেক্ষা দুৰ্বল নহে। সম্মোহনবিৎ ইচ্ছাপূৰ্ব্বক মোহিত ব্যক্তিকে তাহার শরীর বা মনের হানিকর কোন আদেশ না দিলে, তাহার বিন্দুমাত্র অনিষ্টের কোন সম্ভাবনা নাই।
সম্মোহন-শক্তি যথার্থ সৎস্বভাব বিশিষ্ট স্ত্রী-পুরুষগণকে তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কুকার্যে প্রবৃত্ত করিতে পারে না। কারণ বাল্যকাল হইতে যে কাৰ্যগুলি তাহার নৈতিক পাপ কৰ্ম্ম বলিয়া শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাদের অন্তর্মন সেই সকল কাৰ্য্য করিতে কখনও স্বীকৃত হয়না। নরহত্যা, ডাকাতি, চুরি, ব্যভিচার ইত্যাদি নৈতিক পাপ কৰ্ম্ম; সুতরাং কোন চরিত্রবান পুরুষকে ঐ সকল কাৰ্যে প্রবৃত্ত করিতে কিম্বা কোন সাধ্বী রমণীকে ব্যভিচারে লিপ্ত করিতে পারা যায় না। যদি সম্মোহনবিৎ উক্ত প্রকৃতি বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকে এরূপ কোন কাৰ্য্য করিতে আদেশ করে, তবে সে উহা করিতে নিশ্চয় অস্বীকার করিবে এবং তজ্জন্য বেশী জিদ করিলে স্বতঃই জাগিয়া উঠিবে। যাহারা চরিত্রহীন এবং সুবিধা পাইলে, স্বার্থ সিদ্ধির নিমিত্ত নীতি-বিগর্হিত কাৰ্য্য করিতে দ্বিধা বোধ করে না, সম্মোহন-শক্তি কেবল তাহাদিগকেই পাপ কাৰ্যে উত্তেজিত করিতে সমর্থ। প্রাসাদের ভিত্তি সুদৃঢ় হইলে যেমন উহা প্রবল ঝড়েও অটল থাকে, সেইরূপ নৈতিক চরিত্র সুগঠিত হইলে উহা পাপ কর্মোত্তেজক সকল প্রকার আদেশের বিরুদ্ধে অবিচলিত থাকিতে পারে। আর সম্মোহনবিৎ যে, সকল লোককে মোহিত করিতে পারে না, একথা ইতঃপূৰ্ব্বে পুনঃ পুনঃ বলা হইয়াছে; সুতরাং উহার পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। সম্মোহন-শক্তি সাহায্যে যে, কোন দায়িত্বজ্ঞানহীন বা স্বার্থলোলুপ কাৰ্য্যকারক লোকের কোন অপকার করিতে পারে না, আমি এরূপ বলিতেছিনা; কিন্তু তাহার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ বলিয়া সে, কোন গুরুতর পাপ কাৰ্য্য করিতে সমর্থ হয়না।
সময় সময় তথাকথিত অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাও সম্মোহন বিদ্যার প্রতি জন সাধারণের ভয় ও ভক্তি আকর্ষণ করিবার উদ্দেশ্যে, ইহার কার্যকারিতা সম্বন্ধে নানা প্রকার আজগবী গল্প প্রচার করেন, তাহাতে তাহারা ইহাকে ভীতির চক্ষেই দর্শন করিয়া থাকে। যদি তাহারা তাহা না করিয়া ইহার যথার্থ স্বরূপ প্রকাশ করেন, অর্থাৎ ইহা দ্বারা যে লোকের প্রভূত বিষয়ে মঙ্গল সাধিত হইতে পারে, তাহা প্রচার করে, তবে এই বিদ্যাচর্চা জন সাধারণের মধ্যে সহজেই প্রসারিত হইতে পারে।