৩. হুগলী
বঙ্কিমী পথপ্রদর্শন অনুসারে সপ্তগ্রাম ছেড়ে এবার হুগলী যেতে হয়।
আদি সপ্তগ্রামের ক্রোশখানেক দক্ষিণে দুটি জনপদ : ব্যাণ্ডেল আর হুগলী। যেন হরিহরাত্মা। সরস্বতী নয়, ভাগীরথী তীরে। ‘ব্যাণ্ডেল’ শব্দটাও বঙ্কিমীপথে এসেছে ‘বন্দর’ শব্দ থেকে : বন্দর →বন্দল → বণ্ডল → ব্যাণ্ডল → ব্যাণ্ডেল।
আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি পর্তুগালরাজ পোপের সনদ পেয়ে নিজেকে পূর্বপৃথিবীর ঈশ্বর বলে ভাবতে শুরু করেছেন। পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রতিনিধিকে উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে।
প্রথম ভাইসরয় ভারতবর্ষে এসে পৌঁছালেন 1505 খ্রীষ্টাব্দে : ফ্রাঁসিস্কো দ্য আলমেইডা।
পরবর্তী ভাইসরয় আফেঁসো দ্য আলবুকার্ক। রাজধানী স্থানান্তরিত করা হল গোয়ায়।
এবার দৃষ্টি পড়ল ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে। দুটি বন্দর তাদের লক্ষ্য—সমুদ্র উপকূলে চট্টগ্রাম আর সরস্বতী তীরে সপ্তগ্রাম। কিন্তু সরস্বতী নদীর জলধারা ক্রমশ বিশুষ্ক হয়ে আসছে, তাই ওরা উপনিবেশ গড়ল কিছু দক্ষিণে—ব্যাণ্ডেল-হুগলীতে।
কেটে গেছে বছর-পঞ্চাশ। বাবর-হুমায়ুন শের শাহকে পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষের ইতিহাসে এসে গেছে আকবর-জমানা। আকবর নিরক্ষর, কিন্তু সর্বধর্মের মর্মকথা জানবার আগ্রহ তাঁর। তিলক কাটেন, নিরামিষ আহার করেন, রাজান্তঃপুরে হোম পর্যন্ত হয়, মন্ত্রপাঠ চলে। একটি বিশেষ দরবারকক্ষই নির্মিত হয়েছে সর্বধর্মের মূল কথা অনুধাবনের জন্য : ইবাদৎ-খানা-ই খাশ্।
1579। সম্রাট আকবরের বিশেষ দূত আবদুল্লা এক দোভাষীকে নিয়ে উপস্থিত হল গোয়ায়। বিচিত্র আমন্ত্রণপত্র! সম্রাট দু-জন জেসুইট পাদ্রীকে বাইবেল ও গসপেলের বিভিন্ন গ্রন্থ সমেত রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে আহ্বান করেছেন। জানিয়েছেন—তাঁর উদ্দেশ্য খ্রীষ্টধর্মের মর্মকথা জানবার; পাদ্রীদের নিরাপত্তার দায়-দায়িত্ব সম্রাটের।
এমন আজব কথা ভাইসরয় কল্পনা করতে পারেন না। তবে ঝুঁকিটা নিলেন। তিনজন পাদ্রীকে প্রেরণ করলেন আগ্রায়—দলনেতা রুডলফ্ অ্যাকোয়ভিভা। সম্রাট মন দিয়ে ওদের কথা শোনেন, মেরী মাতার একটি মূর্তিকেও স্থান দিয়েছেন রাজপ্রাসাদে; কিন্তু যে আশা নিয়ে পাদ্রীরা এসেছিলেন; তা পূরণ হল না–সম্রাট খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করলেন না।
কিন্তু বছরখানেকের ভিতরেই তাঁরা একটি সনদ পেলেন সম্রাটের কাছ থেকে—সুদূর বঙ্গদেশে হুগলীতে একটি কুঠি নির্মাণের অনুমতি। 1580 খ্রীষ্টাব্দে। তার বিশ-ত্রিশ বছর আগে থেকেই হুগলীতে পর্তুগীজদের একটা আস্তানা গড়ে উঠেছিল। কারণ ব্যাণ্ডেল গীর্জার নির্মাণকালটা 1559; তবে এই প্রথম পাকাপাকি সনদলাভ।
পর্তুগীজদের উদ্দেশ্য ছিল ত্রিমুখী। কিছু এসেছিল বাণিজ্য করতে, কিছু সত্যই খ্রীষ্টের বাণী ও ধর্মপ্রচার মানসে। তারা গীর্জা বানাতে থাকে এখানে-ওখানে। কূপমণ্ডূক সমাজপতি আর ক্ষমতাবান জমিদারদের প্রভাবে যারা হিন্দু-ধর্মচ্যুত হয় তাদের ওরা সাদরে গ্রহণ করে, দীক্ষিত করে, গড়ে তোলে প্রথম ইঙ্গবঙ্গ সমাজ। তৃতীয় দল—তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, নিছক দস্যু—এসেছে দেশটাকে লুট করতে। তারা জলে-ডাঙায় চালিয়ে যায় অকথ্য অত্যাচার—নির্বিরোধী মনুষ্য বসতিতে। তাদের প্রধান ঘাঁটি চট্টগ্রাম, খুলনা, নোয়াখালি, সন্দীপ, বরিশাল। গ্রামের পর গ্রাম তারা শ্মশান করে দিয়েছে। সর্বস্ব লুণ্ঠন করে ধর্ম নষ্ট করেছে পল্লীবধূর—তারপর চালান দিয়েছে ক্রীতদাসীর হাটে। তাদের বলে : হার্মাদ। কথাটা এসেছে ‘আর্মাডা’ থেকে। কুঠিয়াল আর পাদ্রীরা প্রকাশ্যে বলেন—ওরা আমাদেরও শত্রু; কিন্তু গোপনে স্বজাতীয়দের প্রতি অনুকম্পা ও সৌহার্দ্য বজায় থাকে।
ঘটনাচক্রে ঐ সময়ে শুকিয়ে যেতে থাকে সরস্বতী নদীর সাবেক জলধারা। সপ্তগ্রামের পতন আর হুগলীর উত্থান প্রায় সমকালীন ঘটনা। হার্মাদদের এই অত্যাচারে শুধুমাত্র দক্ষিণবঙ্গের শান্তিই ব্যাহত হয়নি—এর পরোক্ষ ফল বিপর্যস্ত করে দিল গোটা বঙ্গসংস্কৃতিকেই। কারণ বহুশতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী বাঙলার বহির্বাণিজ্যের পথ গেল চিররুদ্ধ হয়ে। সপ্তডিঙা, মধুকর ভাসিয়ে বাঙালী সওদাগর আর যেতে পারে না—সিংহল, চম্পা, চীন! ভাষান্তরে পশ্চিমের গবাক্ষপথে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে পর্তুগীজরা বন্ধ করে দিল আমাদের পুবের দরওয়াজা। ফলে ঐ বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল অভ্যন্তর ভাগের বাজার মার খেল। কেটে গেল আরও পঞ্চাশ বছর। আকবরের দেহান্তে জাহাঙ্গীর এখন ভারতসম্রাট। জাহাঙ্গীরের জমানায় সেনাপতি মানসিংহ যখন দ্বিতীয়বার বঙ্গভূমে এলেন দ্বাদশ ভৌমিক বা বারো ভূঁইয়াদের বিদ্রোহ দমন করতে, তখন কিছু হার্মাদ নৌ-সেনাপতি বিদ্রোহীদলে যোগ দিল, সুযোগ বুঝে—ফ্রান্সিস কার্ভালো, গঞ্জালেস্, রডা এসে হাত মেলালো প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে।
সে সময়ে হুগলীর কুঠিয়ালরাও তাক বুঝে বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। ভাগীরথী বেয়ে কোন জাহাজ বা বাণিজ্যতরী যাতায়াত করলে তারা শুল্ক আদায় করতে শুরু করেছে। হিন্দু মন্দিরে দেবদেবীর মূর্তি ভাঙছে। মাঝে-মাঝে কুঠিয়ালরা সম্রাটের হারেমে অপহরণ-করা সুন্দরী মেয়ে পাঠায়। জাঁহাপনার রাগ পড়ে যায়। কিন্তু অত্যাচারের নেশায় পর্তুগীজ দস্যুরা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে বসল একবার। এক জাহাজ হজযাত্রীর সর্বস্ব লুণ্ঠন করে তাদের হত্যা করল। জাহাপনা জাহাঙ্গীর আর স্থির থাকতে পারলেন না। বাঙলার সুবেদারকে হুকুম দিলেন হুগলীর কুঠি ধূলিসাৎ করে দিতে।
অচিরেই মুঘল বাহিনী এসে অধিকার করে নিল হুগলী-ব্যাণ্ডেল জনপদ। কেল্লা এবং গীর্জাটি হল ধ্বংস। বহু পর্তুগীজকে বন্দী করে পাঠিয়ে দেওয়া হল আগ্রায়, তার ভিতর ছিলেন ব্যাণ্ডেল-গীর্জার সাত্ত্বিক প্রকৃতির প্রধান ধর্মযাজক দা’ক্রুজ। সম্রাট আদেশ দিলেন হস্তিপদতলে পিষ্ট করে তাঁকে হত্যা করতে হবে। অলৌকিকভাবে নাকি তিনি রক্ষা পান।
চার্চকে ক্ষমা করলেন, কিন্তু ব্যবসায়ীদের নয়। ওলন্দাজ কুঠির সঙ্গে বাণিজ্যের নয়া চুক্তি করলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। সেটা হুগলীর নয়, চুঁচুড়ার কাহিনী।
এ পর্যন্ত যা বলেছি তা ইতিহাস, ঐ উপাদানটুকু নিয়ে এবার গল্প ফাঁদা যাক :
1604 খ্রীষ্টাব্দ। সম্রাট আকবর অসুস্থ। বস্তুত মৃত্যুশয্যায়। টোডরমল্ল ইতিমধ্যে বঙ্গদেশের রাজস্ব-ব্যবস্থার ছকটা বানিয়ে ফেলেছেন। সেলিম অর্থাৎ যুবরাজ জাহাঙ্গীর ইতিমধ্যে একবার ‘খোকা-বিদ্রোহ’ করেছে—বাপের একমাত্র অপরাধ সে বড় বেশিদিন বেঁচে আছে। তা বুড়ো-হাবড়াকে সিংহাসনচ্যুত করতে পারেনি। যেটুকু তার ক্ষমতায় কুলায় সেটুকুই করেছে বিদ্রোহীপুত্র—পিতার অকৃত্রিম বন্ধু, প্রখ্যাত পণ্ডিত ও ইতিহাসবেত্তা আবুল ফজলকে গুপ্তঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করিয়েছে।
অশ্বারোহণে ফাদার দা’ক্রুজ ফিরে আসছিলেন গীর্জায়। পরিধানে পাদ্রীর ঢিলেঢালা কালো পোশাক, মাজার কাছে ফাঁস দেওয়া। নিরস্ত্র তিনি। হঠাৎ বিরাট গীর্জা-চৌহদ্দীর গেটের বাহিরে অশ্বের গতিরোধ করেন। অবতরণ করে পদব্রজে এগিয়ে আসেন। সিংদরোজার বাহিরে একজন অত্যন্ত সুদর্শন মুসলমান যুবক নির্নিমেষনেত্রে লক্ষ্য করছে গীর্জার স্থাপত্য-শিল্প। পোশাক-পরিচ্ছদ রাজপুরুষের, মাথায় জমকালো টুপি, কোমরে দীর্ঘ তরবারি। তার পাশেই একটি মহিলা। সর্বাঙ্গ কালো বোরখায় ঢাকা। শুধু দুটি চম্পকাঙ্গুলি দিয়ে মুখ-ঢাকাটুকু তুলে সেও গীর্জার চূড়ায় ক্রুশকাষ্ঠটির দিকে তাকিয়ে আছে। চম্পক-গৌর বর্ণ, এণাক্ষীবিনিন্দিত দৃষ্টি।। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন যুবক পাদ্রী! রমণীদেহে এমন সৌন্দর্য তিনি কখনো প্রত্যক্ষ করেননি—না বাস্তবে, না শিল্প—কর্মে। রোম, ফ্লোরেন্স, ভেনিস, মিলানের চিত্রসংগ্রহশালা তিনি দেখেছেন—রাফায়েল, তিজিয়ানো, করেজ্জিও তাঁর অপরিচিত নয়—কিন্তু এ কী!
অস্ফুটে স্বগতোক্তি করেন পাদ্রী : আফ্রোদিতে!
শব্দে পাশ ফিরে তাকায়। অপরিচিত পুরুষকে দেখে তৎক্ষণাৎ মুখাবরণটি স্বস্থানে নামিয়ে দেয়। এতক্ষণে লক্ষ্য হল মহিলার পাঁজর ঘেঁষে একটি ফুটফুটে ফুলের মতো মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে। দাক্রুজ রাজপুরুষটিকে বললেন, বে-নস্ দীয়াস্।[১]
[১. Buenos dias = হ্যালো!]
সম্বোধনটি পর্তুগীজ নয়, স্প্যানিশ। দা’ক্রুজ বোধকরি ভেবেছিলেন, এ ভাষা অন্তত ওরা বুঝবে। যুবাপুরুষ কাঁধ ঝাঁকিয়ে খানদানি উর্দুতে বললেন, আপনার ভাষাটা আমার অজানা, মহাশয়। সম্ভবত আপনি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ফলে, আমার জবাব, সেলাম আলাইকুম্।
—আলাইকুম সালাম!—দা ক্রুজ দীর্ঘদিন আছেন ভারতবর্ষে। ভাঙা ভাঙা উর্দু বলতে পারেন। বলেন, বাইরে কেন? আসুন, ভিতরে আসুন।
যুবাপুরুষ বলেন, আমরা বিধর্মী, মুসলমান—
—সেটা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু মা মেরীর গীর্জা সকল ধর্মের জন্যই অবারিতদ্বার। আমি এই উপাসনা-গৃহের প্রধান পুরোহিত—দা’ক্রুজ। আপনাকে সাদরে আমন্ত্রণ করছি।
আগন্তুক বলেন, অত্যন্ত প্রীত হলাম। আমার নাম শের আফকন। আমি বর্ধমানের সুবেদার। সস্ত্রীক হুগলীতে এসেছিলাম। এটি আমার কন্যা : লাডলি।
—লাডলি নয়, লাভলি! আর বেগম সাহেবার নাম আমি জানি না; তাঁর নাম হওয়া উচিত : আফ্রোদিতে!
শের আফকন আরবী-ফার্সিতে আলিম, কিন্তু বুঝে উঠতে পারেন না এ শব্দটির অর্থ। সঙ্গিনীকে বলেন, এস মেহের, পাদ্রী-সাহেব আমাদের ভিতরে যেতে ডাকছেন।
মেহেরুন্নিসা ফিফিস্ করে স্বামীকে কী-যেন বলে। শের বলেন, বেগমসাহেবা জানতে চাইছেন ভিতরে কি আপনার সহধর্মিণী আছেন?
—আছেন, আছেন। গৃহস্বামিনীর তরফেই আমি নিমন্ত্রণ করছি।
শের আফকন সপরিবারে ভিতরে এলেন। গীর্জাটি ঘুরে ঘুরে দেখলেন। অল্টারের পিছনে রঙিন কাচের একটি অতি দীর্ঘ গবাক্ষ। তাতে নানান নকশা। মাঝখানে মা মেরীর এক মর্মরমূর্তি। শিশুক্রোড়ে মাতৃমূর্তি। সংলগ্ন বাগিচায় নানান মরশুমী ফুল; একান্তে কবরখানা। একটি বেলা ওঁরা কাটিয়ে গেলেন ব্যাণ্ডেল-চার্চে। মাদাম দা’ক্রুজ মোহিত হয়ে গেলেন মেহেরুন্নিসার সৌন্দর্যে। মেহের সুযোগ মতো জানতে চায়, ‘আফ্রোদিতে’ শব্দটার অর্থ কী? মাদাম দা’ক্রুজ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠেন। বলেন, কে বলেছে? ঐ পাদ্রী তো? ওর দোষ নেই!—বুঝিয়ে দেন, ‘আফ্রোদিতে’ গ্রীকশিল্পীদের ধারণায় সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
পাদ্রীসাহেবের নির্বন্ধাতিশয্যে ‘আলমেয়ারথো’টা[১] সেখানে সারতে হল। দাক্রুজ ওঁদের আশ্বস্ত করলেন কোন ভোজ্যদ্রব্যে শূকরমাংস মিশ্রিত নেই।
[১. Almuerzo = মধ্যাহ্ন ভোজন।]
কথাপ্রসঙ্গে শের বলেন, আপনি তো এদেশের ভাষাটা চমৎকার শিখে নিয়েছেন। মাদামও শিখেছেন দেখছি। কতদিন আছেন হিন্দুস্থানে?
পাদ্রী দা’ক্রুজ রহস্য করে শুনিয়ে দিলেন একটি পর্তুগীজ ছড়া :
‘Vicerei Va, vicerei vam
Padre Paulista sempredtem.’[২]
[২. Vicerous come and Vicerous go, but the Jesuit Fathers are always there : লাটেরা আসে লাটেরা যায়, চিরদিন কেউ থাকে না তারা। পাদ্রী সাহেব বারোমাস ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন একপায়ে খাড়া।।]
পরবর্তী ঘটনাটি প্রায় বিশ বছর পরের
ইতিমধ্যে সম্রাট আকবরের দেহান্ত ঘটেছে। নূরউদ্দীন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর তখন ভারতসম্রাট।
হুগলীর পর্তুগীজ কুঠিয়ালদের অত্যাচারে ক্ষিপ্ত হয়ে জাহাঙ্গীর হুকুম দিলেন হুগলীর দখল নিতে। সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ। অচিরেই মুঘল সেনাপতি দখল করে নিল পর্তুগীজ উপনিবেশ। হুগলী দুর্গ এবং ব্যাণ্ডেল গীর্জাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হল। বহু পর্তুগীজ খ্রীষ্টানকে বন্দী করে বঙ্গাল-মুলুক থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হল আগ্রায়। বন্দীদলে আছেন হুগলী গীর্জার প্রধান ধর্মযাজক দা’ক্রুজ সস্ত্রীক।
জাহাঙ্গীর বাদশাহ্ মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে রকমফের করতেন সেকথা আগেই বলেছি। স্বচক্ষে সেই মৃত্যুদৃশ্য দর্শন করা তাঁর এক বিলাস। এক্ষেত্রে জাহাপনা হুকুম জারী করলেন, ঐ পর্তুগীজ পাদ্রীটাকে হস্তিপদতলে দলিত-মথিত করতে হবে। মাদাম দা’ক্রুজ মহিলা—তাকে লঘুশান্তি দেওয়া হল—শুধুমাত্র স্বামীর মৃত্যুদৃশ্য দর্শন!
একাজের জন্য একটি সুশিক্ষিত হস্তী সম্রাট আকবরের জমানা থেকেই আছে। প্রকাণ্ড রণহস্তী। অদ্ভুত তার শিক্ষা। আগ্রা কিল্লায় বাদশাহ যখন দেওয়ান-ই-আম-এ দরবারে বসেন তখন ঐ গজদানবকে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় উপস্থিত করে মাহুত। বাদশাহ আসেন দক্ষিণপুরের জাহাঙ্গীরী মহল থেকে, উঠে বসেন মসনদে। আকবরের কোন মহিষী প্রকাশ্য দরবারে বসতেন না। জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রে এটি হয়নি। তাঁর পাশে উপবেশন করেন ভারতসম্রাজ্ঞী নূরজাহাঁ। তিনি আসেন পিছনের দরওয়াজা দিয়ে, খাশমহল থেকে, শীস্-মহল পথে।
বসেন অনবগুণ্ঠিতা হয়ে। এটাও জাহাঙ্গীরের এক বিলাস—জগতকে দেখানো, তিনি শুধু ভারতেশ্বর নন, সুন্দরী-শ্রেষ্ঠার মরদ!
নূরজাহাঁ : জগতের আলো। অন্তত এককালে ছিল বর্ধমানের সুবেদার শের আফকনের ঘরের ঘৃত প্রদীপ। আকবরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই গদিয়াল হয়ে জাহাঙ্গীরের প্রথম কাজ ঐ শের আফকনকে হত্যা করে মেহেরুন্নিসাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা। মেহের প্রথম কয়েক বছর স্বামীহন্তাকে স্বীকার করে নেয়নি। ক্রমে পোষ মেনেছে। শুধু তাই নয়, পোষ মানিয়েছে। বস্তুত জাহাঙ্গীর-জমানায় ভারত শাসন করেছে নূরজাহাঁ—জাহাঙ্গীর নয়। রাজকীয় দলিল, ফর্মান, যেখানেই জাহাঙ্গীরের স্বাক্ষর সেখানেই নূরজাহাঁ। এমনকি স্বর্ণমুদ্রায় পর্যন্ত ছাপ দেওয়া হত ‘বহুভ শাহ্ জহাঙ্গীর যাফৎ সদ জেবর/বনামে নূরজাহাঁ বদসহে বেগম অর।’ অথচ এমনই তার কূটকৌশল যে, সম্রাট স্বয়ং অনুধাবন করতে পারতেন না—তিনি বেগমের হাতের পুত্তলীমাত্ৰ!
জাহাঙ্গীর শাস্তি বিধান করলেন। হস্তিপদতলে বন্দীর মৃত্যু। সচরাচর এই মৃত্যুদণ্ডটি অনুষ্ঠিত হয় প্রকাশ্যে, সভাভঙ্গে। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত হতভাগ্যকে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় ভূতলে ফেলে রাখা হয়। জাহাঙ্গীর জানেন—মৃত্যুদণ্ড দীর্ঘায়ত করার মধ্যে একটা মজা আছে। সাধারণত আমীর, ওমরাহ—যাঁরা এই নৃশংস দৃশ্য দেখতে চান না, তাঁরা উঠে চলে যান। নূরজাহাঁ স্থানত্যাগ করেন। তখন হত্যাউৎসবে মেতে ওঠেন বাদশাহ্। করতালি দিতেই মাহুত সুসজ্জিত গজদানবকে পরিচালিত করে অগ্রসর হয়ে আসে। অদ্ভুত শিক্ষা গজরাজের। সে বন্দীর নিকটস্থ হয়ে শুণ্ড উৎক্ষিপ্ত করে একটি বৃংহিত ধ্বনি করে। তারপর একটি পা তুলে ঐ ভূতল-শায়িত হতভাগ্যের মস্তকের উপর উৎক্ষিপ্ত করে অপেক্ষা করে। বাদশাহ্ যতক্ষণ না দ্বিতীয়বার করতালিধ্বনি করেন ততক্ষণ গজদানবকে তিন-পায়ে দেহভার রক্ষা করে প্রতীক্ষা করতে হয়। জাহাঙ্গীর এইসময় তাড়াহুড়া করেন না। শায়িত বন্দীর মুখচ্ছবি রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করেন, কখনো বা তার মরণান্তিক আর্তনাদ। তারপর তালি বাজান। গজরাজ তার উৎক্ষিপ্ত চরণটি ধীরে ধীরে নামিয়ে আনে—দেহের অন্য কোনও অংশে নয়, ঠিক মাথার উপর। পাকা কয়েৎবেলের মতো ফট্ করে সেটা ফেটে যায়! ভারী মজার সে দৃশ্য।
পাদ্রী দা’ক্রুজকে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় ভূতলশায়ী করা হয়েছে। তার মস্তকটি একটি পাষাণখণ্ডের উপর ন্যস্ত। সুসজ্জিত হস্তীর উপর মাহুত প্রতীক্ষা করছে। আমীর-ওমরাহরা অনেকে উঠে গেলেন। জাহাঙ্গীরের লক্ষ্য হল নূরজাহাঁ স্থানত্যাগ করেননি। বলেন, এবার তুমি ভিতরে যাও। এখন মৃত্যুদণ্ড হবে।
নূরজাহাঁর লক্ষ্য হল, অদূরে মাদাম দা’ক্রুজ শায়িতা। দুর্ভাগ্যবশত তাঁকে স্বামীর মৃত্যুদৃশ্যটি দেখানো যাচ্ছে না। তিনি মূর্ছিতা। নূরজাহাঁ বললেন, না, আমি থাকব। আমি দেখব
সম্রাট কিছু বিচলিত। এমন তো কখনো হয় না! পেয়ারী বেগম তো এমন কথা ইতিপূর্বে কখনো বলেনি। জানতে চান তার হেতু।
নূরজাহাঁ বলেন, দীন-দুনিয়ার মালিক! আমি গতকাল রাত্রে একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। স্বয়ং পয়গম্বর যেন আমাকে এসে বলছেন—ঐ পাদ্রীটা আমার প্রিয় ভক্ত। ও আল্লাতালাকেই ‘গড’ নামে উপাসনা করে। তুই তোর স্বামীকে বল, ওকে মুক্ত করে দিতে!
জাহাঙ্গীর বিস্মিত হয়ে বলেন, তারপর? তারপর?
—তখন আমি পয়গম্বরকেই সালাম জানিয়ে বললাম, আপনি তো অসীম ক্ষমতাবান। আপনি নিজেই তো ওকে রক্ষা করতে পারেন। আমাকে কেন বলছেন? আমি জানি, আমার স্বামী কখনো অন্যায় করেন না, তাঁর রাজকার্যে আমি কখনো হস্তক্ষেপ করি না। তারপর আমার নিদ্রাভঙ্গ হল। তাই আমি দেখতে চাই তিনি ওঁকে রক্ষা করেন কিনা
জাহাঙ্গীর কিছুটা বিচলিত। তারপর সজোরে করতালি ধ্বনি করে ওঠেন।
গজগমনে অগ্রসর হয়ে এল মহামাতঙ্গ। যথারীতি শুণ্ড উৎক্ষিপ্ত করে গজর্ভায়ে অভিনন্দন জানালো বাদশাহকে। তারপর একটি পদ উৎক্ষিপ্ত করে প্রতীক্ষা করল। জাহাঙ্গীরের আজ ধৈর্য মানছে না। সজোরে করতালি দিয়ে ওঠেন তিনি।
কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! গজরাজ প্রত্যাশিত কর্ম করল না। উৎক্ষিপ্ত পদটি নামিয়ে আনল ভূতলে। নিপুণ-শুঁড়ে একটানে বন্ধনমুক্ত করে দিল বন্দীকে! যেন শুঁড় দিয়ে আদর করল তাঁকে! ধীর পদে ফিরে গেল তার স্বস্থানে।
বাদশাহ বিহ্বলের মতো বেগমের দিকে ফিরে বলেন, কী করতে বল এখন? নূরজাহাঁ একটি সেলাম করে বলেন, জাহাপনা। আপনার রাজকার্যে আমি কখনো হস্তক্ষেপ করি না। কী করবেন তা আপনার বিবেচ্য। তবে পয়গম্বরের স্বপ্নাদেশ যদি মানেন…
বাকিটা অনুক্ত রইল।
জাহাঙ্গীরের আদেশে দা’ক্রুজকে মুক্তি দেওয়া হল। তাঁকে সসম্মানে হুগলীতে প্রত্যাবর্তনের আদেশও দেওয়া হল। এমনকি রাজকোষ থেকে গীর্জাটি পুননির্মাণের ব্যবস্থাও করা হল। কাহিনীর যে অংশটুকু নেপথ্যে আছে তা এবার বলি :
হুগলীতে ফিরে যাবার আগে মাদাম দা’ক্রুজ নূরজাহাঁর খাশমহলে এসে দেখা করেছিলেন। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলেন, আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার সীমা পরিসীমা নেই। কিন্তু একটা কথা, ভারতেশ্বরী! এ কাজের জন্য মাহুতকে যে পরিমাণ অর্থ উৎকোচ দিয়েছেন সেটুকু আমাদের পরিশোধ করতে দিন।
নূরজাহাঁ স্মিত হেসে প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, আপনার গীর্জায় যে নুন খেয়েছি তার দাম দিতে হবে না? সেটা যে নিমকহারামি হয়ে যাবে।
মাদাম দা’ক্রুজ বলেন, গ্রাথীয়াস![১] তাহলে কণ্ঠহারটি রাখুন। লাডলিকে দেবেন। প্রতিদান নয়, উপহার।
হাত বাড়িয়ে মালাটা নিতে হল।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ভারতেশ্বরীর। মন খুলে মাদামকে বলতে পারলেন না— উপহারটা লাড়লি-বেগমকে দেওয়া যাবে না। মায়ের সঙ্গে সে কথা বলে না। পিতৃহন্তার অঙ্কশায়িনী জননীর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।[২]
[১. Gracias = লাখ-লাখ সুক্রিয়া,
২. বিস্তারিত বিবরণ লেখকের ‘লাডলি-বেগম’ উপন্যাসে।]
.
হুগলী থেকে আমরা অনেকটা দূরে সরে এসেছি। চল, সেখানে ফেরা যাক।
শাহজাহাঁ সিংহাসনে আরোহণ করে পর্তুগীজদের অধিকার থেকে হুগলী-ব্যাণ্ডেল পুনরায় অধিকার করে নেন। তার একটি বিশেষ হেতু আছে। জাহাঙ্গীরের শেষাবস্থায় যুবরাজ খুররম্ একবার ‘খোকা-বিদ্রোহ করেন। মুঘল বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হয়ে পালিয়ে আসেন বঙ্গদেশে। সে-সময় তিনি হুগলীর পর্তুগীজ গভর্নরের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন; কিন্তু অভিজ্ঞ গভর্নর বুঝতে পারেন এ ব্যাপারে যুবরাজকে সাহায্য করা উচিত হবে না। খুররম প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। মসনদে বসে তারই প্রতিশোধ নিলেন এতদিনে শাহজাহাঁ।
সেটা সম্রাট শাহজাহার শাসনকালের দ্বাদশ বৎসর! রাজধানী তখনো আগ্রা। দিল্লীর লালকেল্লায় পুরা-কদমে কাজ চলছে। এ-যুদ্ধে পর্তুগীজরা প্রায় তিনমাস কাল মুঘল বাহিনীকে প্রতিহত করে রেখেছিল। মুসলমান ঐতিহাসিকেরা লিখে গেছেন—মুঘল সেনাপতি সেই সময় ভাগীরথীর উপর একটি সাঁকো’ নির্মাণ করেন। স্থানটা শ্রীরামপুরের কাছাকাছি। সম্ভবত সেটি একটি ‘পন্টুন-সাঁকো’—অর্থাৎ পাশাপাশি নৌকা সাজিয়ে বানানো সাঁকো—যা বানিয়ে ছিলেন জারেকশাস দার্দানালেস প্রণালীতে, বহু বহু পূর্বযুগে; আর যা বানিয়েছিলেন ইংরেজ স্থপতি বহু-বহু পরবর্তীযুগে—প্রথম হাওড়া ব্রীজ; যা তোমরা দেখনি, আমরা হামেহাল পার হয়েছি, জোয়ার-ভাঁটা খেয়াল করে। কারণ তদানীন্তন ভাগীরথীর বিস্তার ও প্রযুক্তিবিদ্যার জ্ঞানের কথা মনে করে এটাই একমাত্র সমাধান। তবে মুঘল সেনাপতি সুবেদার কাশেম খাঁ দুর্গবেষ্টনকারী পরিখার বাঁধ দিয়ে জল নিষ্কাশন করতে পেরেছিল। পরে বারুদ দিয়ে দুর্গপ্রকারের খানিকটা অংশ উড়িয়ে দেয়। সেই পথে মুঘল সৈন্য দুর্গের ভিতর প্রবেশ করে। হুগলী দুর্গের পতন হয়। বহু পর্তুগীজ নরনারী হতাহত হয়। ওদের অনেকগুলি জাহাজ ও গ্রাব ডুবিয়ে দেওয়া হয়। বস্তুত এই যুদ্ধেই ভারতে পর্তুগীজ প্রাধান্য চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। মহামান্য পোপের সনদ যাই বলুক না কেন এই ঘটনার দুই দশক পরে, অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে পর্তুগীজদের পরিত্যক্ত ভূখণ্ডে ইংরেজরা একটি কুঠি বানায়। প্রথম দিকে ব্যবসায়ে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। পরে, অর্থাৎ পলাশী যুদ্ধের ঠিক একশ বছর আগে ঐ কুঠি লাভবান হতে শুরু করে। সোরা, লবণ ও রেশমের ব্যবসায়ে। তবু মুঘল সুবেদারের সঙ্গে ইংরেজ কুঠিয়ালদের বিবাদ-বিসম্বাদ লেগেই ছিল। আরও দুই দশক পরে এই কুঠি থেকেই একদিন জোব চার্নক নেমে আসেন ভাগীরথীর মোহনার দিকে।
একদিন নোঙর গাড়েন : গোবিন্দপুরে। সেটাই কলকাতা পত্তনের সূচনা। জোব চার্নকের হুগলী ত্যাগের পর নবাবী ফৌজ হুগলী কুঠি দখল করে। সেটি পুনরুদ্ধার করেন রবার্ট ক্লাইভ পলাশীযুদ্ধের প্রাক্কালে।
ইংরেজ সৈন্য হুগলীর দুর্গ ও ফৌজদারের সমস্ত সম্পত্তি অধিকার করে নেয়। এক সপ্তাহকাল হুগলী-ব্যাণ্ডেলের সংলগ্ন গ্রামগুলি নির্বিচারে লুট করে। বর্তমানে যেখানে হুগলীর কালেক্টার-সাহেবের বাসভবন দুর্গটি ছিল সেখানে।
বঙ্গসংস্কৃতিতে হুগলীর আর একটি দানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মর্তব্য—বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয় এখানেই। রাজা-রাজড়ার কুকীর্তির কথা শোনাচ্ছিলাম এতক্ষণ; এবার দুটি মেহনতী মানুষের কথা বলি : পঞ্চানন কর্মকার আর মনোহর দাশ! তাঁদের যৌথ সহযোগিতা ভিন্ন উইলকিন্স-সাহেব ঐ ছাপাখানাটি বানাতে পারতেন না। হ্যালহেড-সাহেব এই ছাপাখানা থেকে যখন প্রথম বাংলা ব্যাকরণ মুদ্রণ করেন তখনও রাজা রামমোহনের জন্ম হতে দু-বছর বাকি।
হুগলী ত্যাগ করে যাবার আগে পর্তুগীজদের প্রসঙ্গটা শেষ করে নিই।
দা-গামা আর তার উত্তরসূরীরা এসেছিল এ দেশে লুট করতে। কিন্তু ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ঐ দলের সঙ্গেই এসেছেন অনেক মহান পর্তুগীজ—যাঁরা মানুষের ভালো করতে চান। সবার আগে বলতে হয় সেন্ট ফ্রান্সিস্ জেভিয়ারের কথা (1506-52)। গোয়াতে এসে পদার্পণ করেন 1542-খ্রীষ্টাব্দে। “He laboured with equal zeal and success among the Corrupt Europeans and the native population.” বহু নির্যাতিত অচ্ছুৎকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেন। পরে শ্রীলঙ্কা ও জাপানেও যান। তাঁর মরদেহ গোয়াতেই রক্ষিত।
এই পর্তুগীজরাই বাংলাভাষার প্রথম বই ছেপে প্রকাশ করে। ভারতে নয়, খোদ রাজধানী লিসবনে। হরফও বাংলা নয়, রোমান হরফ। সময়টা আমাদের কাহিনীর প্রায় সমকালে—1743 খ্রীষ্টাব্দে। মুদ্রিত হয়েছিল তিনখানি পুস্তক। প্রথমটির লেখক আন্তোনিও দো রোজারিও; পরের দুখানির লেখক : মানোয়েল দ্য আসস্যুস্সা। বইটির নাম—মলাটে যা লেখা ছিল: Crepar Xaxtroer Orths. Bhed— Xixio Guror Bichar!
অর্থভেদ’ হল? বঙ্গানুবাদে : “কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ—শিষ্যগুরুর বিচার।”
এ-ছাড়া বাংলাভাষায় মিশে আছে অসংখ্য পর্তুগীজ শব্দ : সাবান, আলমারি, জানলা, তোয়ালে, বালতি, বোতাম, ‘আলপিন’ থেকে ‘কামান’। আরও কত শব্দ : আলকাতরা, আচার, কাকাতুয়া, চা, গির্জা, নিলাম, তামাক, চাবি, ফিতা, গুদাম, লণ্ঠন, বারান্দা, ইস্পাত, কম্পাস, কামরা। অনেক ফুলফল তারা আমদানি করেছিল : আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, কামরাঙা, আলু, জারুল, সফেদা, চীনাবাদাম, কমলালেবু এমনকি সেই ফুলটি—‘কালো যাকে বলে গাঁয়ের লোক’ : কৃষ্ণকলি!
সবার আগে এসেছিল পর্তুগীজ—তাদের আস্তানা হুগলী-ব্যাণ্ডেল। তার পরে আসে দিনেমাররা। সব শেষে ইংরাজ আর ফরাসী। দিনেমারদের আস্তানা ছিল ওলন্দাজ-নগর বা চুঁচুড়া। পর্তুগীজ নাবিকেরা আফ্রিকা বেষ্টন করে যে জলপথটি খুঁজে পেয়েছিল তার চার্ট, ম্যাপ ইত্যাদি সযত্নে লুকিয়ে রাখত—যেন ‘চিচিংফাক’মন্ত্র। কিন্তু কিছু ওলন্দাজ নাবিক চাকরি সূত্রে ওদের জাহাজে বার কয়েক যাতায়াত করার ফলে গুপ্তধনের চাবিকাঠিখানি পেয়ে গেল।
ওলন্দাজ অধিকারের পূর্বযুগে চুঁচুড়ার ইতিহাস অজ্ঞাত। তখন সেটি ছিল এই গৌড়দেশের অযুত-নিযুত গ্রামের মতো গঙ্গাতীরবর্তী একটি শান্ত জনপদ। হুগলীতে যখন পর্তুগীজ প্রভাব বিনষ্ট হল, শাজাহানী-জমানায়, তখনই মাথা চাড়া দিয়ে উঠল চুঁচুড়া’। সপ্তদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে। তারপর দেড়শ বছর ধরে ওরা ওখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। তাদের চরম উন্নতি অষ্টাদশ শতকের অষ্টম দশকে।
হুগলীর কথায় ফিরে আসি :
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পারস্যের রাজধানী তেহরান থেকে আসেন—খাঁ জাহান খাঁ। হুগলীতেই থাকতেন। প্রথমে মুঘল, পরে ইংরেজ বেনিয়া কোম্পানির কাছে সুবেদারী পেয়ে। বিলাসিতার চূড়ান্ত বাহ্যাড়ম্বরে তিনি ভাষায় স্থান পেয়েছেন। মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতা দেখলে আমরা বলি : লোকটা যেন নবাব খাঞ্জা খাঁ। তিনি নবাব ছিলেন না আদৌ।
দানবীর হাজী মহম্মদ মহসীনের বিখ্যাত ইমামবাড়া হুগলীর এক দিকচিহ্ন।
আরও একজন হুগলীবাসী প্রবাদ কথায় অমর হয়ে আছেন।
‘—লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন!’
গৌরী সেনও দানবীর। প্রচুর ধনসম্পত্তিও করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা গৌরীশঙ্কর দেউলটি আজও টিকে আছে। তা ধনী ব্যক্তি তো ডজন-ডজন, তার ভিতর কেউ কেউ মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন। দানধ্যানও অনেকে করেন এ-কথা অস্বীকার করব না। তার ভিতর সেন-মশাই কী করে প্রবাদবাক্যে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছেন? বলি শোন :
সেন-মহাশয় অনেক বিচার-বিবেচনা করে দেখলেন—যে লোকটা দান চাইতে আসে তার বড় সঙ্কোচ। হাত পেতে কিছু চাইতে হবে—সে বড় লজ্জা! কী করা যায়? উনি দারুণ এক বুদ্ধি খাটালেন। প্রার্থীদলকে সেই লজ্জা-সঙ্কোচের হাত থেকে রেহাই দিতে একটি অভিনব ব্যবস্থা করলেন। হুগলী বাজারে গিয়ে কয়েকটি বড় বড় দোকানে—মুদী-দোকান, জামা-কাপড়ের দোকান, দশকর্ম ভাণ্ডারে বলে এলেন, ‘দেখ বাপু, আমার নাম করে কেউ যদি কিছু খরিদ করে তাহলে তোমরা তার দাম চেও না, ক্রেতার নামও জানতে চেও না। খরচটা শুধু খাতায় লিখে রেখ। মাসান্তে আমার কর্মচারী এসে দামটা মিটিয়ে যাবে।’
তাঁর সেই অপরিসীম বদান্যতার সুযোগ যে শুধু সমকালই নিয়েছে তা বলতে পারি না। আজও সরকারী চাকরি পেয়ে অথবা ভোটে জিতে তাঁর নামটি আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি :
‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন!’